মো ইয়ানের নোবেলপ্রাপ্তি এবং ‘হোং কাউলিয়াং’-এর স্মৃতি

আন্তর্জাতিক শিল্পকলার অঙ্গনে ইতিমধ্যে চীনা শিল্পীরা জোরালো অবস্থান করে নিয়েছেন। এবার বুঝি শুরু হলো সাহিত্যের পালা। [...]

১৯৮৭ সাল, প্রথমবারের মতো চীনে পা রেখেছি; সেই বছরই মুক্তি পেলো ট্রাং ইমোউ-এর ‘হোং কাউলিয়াং’ (Red Sorghum) ছবিটি। আর সাথে সাথে যেন সমস্ত চীনদেশে একটি ঝড় বয়ে গেল, এবং চীনবাসী গভীর এক ‘হোং কাউলিয়াং জ্বরে’ আচ্ছন্ন হয়ে পড়লো। আমি তখন ছাত্র হিসাবে চীনদেশে সদ্য এসেছি; তখনও চীনা ভাষার কোর্স সম্পন্ন করিনি। আমার চীনা ভাষার কথন এবং শ্রুতি কোনোটাই ভালোভাবে আয়ত্তে আসেনি। তবে একটি গানের কলি শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা — ‘হাউ চিউ, হাউ চিউ’ অর্থাৎ ‘ভালো মদ, ভালো মদ’! এই গানটি ছিল ‘হোং কাউলিয়াং’ ছবির গান, সেই সময় ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।

ট্রাং ইমোউ-এর ছবি ‘হোং কাউলিয়াং’

‘হোং কাউলিয়াং’ ছবিটি নানা কারণেই সেই সময় জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এটি ছিল ট্রাং ইমোউ-এর প্রথম ছবি, আর একেবারে প্রথম ছবিতেই বাজিমাত। ট্রাং এবং তাঁর সমসাময়িকরা চীনা চলচ্চিত্রের পঞ্চম প্রজন্ম হিসাবে পরিচিত। এঁরা চীনা চলচ্চিত্রের আধুনিক ধারার পথিকৃৎ; এই প্রজন্মের পরিচালকেরাই চীনা ছবিকে বিশ্বের দরবারে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। ট্রাং-এর প্রথম ছবিটি যখন মুক্তি পায়, সেই সময় চীনের সামাজিক এবং রাজনৈতিক অবস্থার একটা বড় ধরনের পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে — চীন যেন নতুন যুগে প্রবেশ করছে। এই নতুন সময়ের পরিপূরক হিসাবে শিল্প-সংস্কৃতিতেও একটা বড় পরিবর্তন লক্ষ করা গেল।

‘হোং কাউলিয়াং’ ছবির একটি দৃশ্যে কোং লি

ট্রাং ইমোউ-এর এই ছবিটিতে লোকসঙ্গীতের ব্যবহার ও সেই সাথে একেবারে নতুন আঙ্গিকে চীনের লোক-সংস্কৃতির উপস্থাপন ছিল একটা চমক। আরেকটি চমক ছিল নায়িকা কোং লি-কে (Gong Li) যৌন আবেদনময়ী অভিনেত্রী হিসাবে উপস্থাপন। ট্রাং-এর পাশাপাশি কোং লি-ও এই ছবির মাধ্যমে দুনিয়াজোড়া পরিচিতি পান। কোং লি বেশ সাহসী অভিনেত্রী হিসেবে নিজেকে মেলে ধরেন; বেশ ক’টি শয্যাদৃশ্যসহ তাঁর খোলামেলা অভিনয়কে সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে বেশ দুঃসাহসিক প্রচেষ্টাই ছিল। তবে ‘হোং কাউলিয়াং’ মুক্তির প্রায় পঁচিশ বছর পর আবার এই ছবিটি আলোচনায় উঠে এসেছে যে কারণে তা ইতিমধ্যে কমবেশি সকলেই জেনেছেন। যে-লেখকের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত হয়েছিল এই সাড়াজাগানো ছবিটি, সেই মো ইয়ান (Mo Yan)এ বছর সাহিত্যে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সম্মান নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।

মো ইয়ান (জ. ১৯৫৫)

মো ইয়ান সম্পর্কে আমার যে খুব বেশি জানা আছে তা নয়। চীনে থাকা অবস্থায় আমি তাঁর নামও তেমন শুনিনি। চীনের সাহিত্য বোধ হয় বিশ্ব-দরবারে কমই পৌঁছেছে। তার একটা বড় কারণ বোধ হয় ভাষাগত জটিলতা। চীনা ভাষা সম্পর্কে সারা বিশ্বেরই একটা ভীতি আছে। এবং দীর্ঘদিন বহির্বিশ্বের সাথে চীনের শীতল সম্পর্কও একটা কারণ হতে পারে। তবে ল্যু সুন (Lu Xun) চীনা সাহিত্যের এক বড় দিকপাল যাঁর পরিচিতি বিশ্বজোড়া। তবে ল্যু সুন ছাড়াও আরো দু-একজনের নাম জানা অনেকে জানেন — মাও তুন (Mao Dun), কুয়ো মোরুয়ো (Guo Moruo), লাউ শে (Lao She) প্রমুখ।

আমার মতে, চীনা আধুনিক সাহিত্যের চরম বিকাশ না হওয়ার পিছনে দুটি উল্লেখযোগ্য কারণ হলো পার্টির নিয়ন্ত্রণ এবং চীনাদের খুব জোরালো ঐতিহ্যবাদিতা। অতীতের সাহিত্যে চীনারা এমনভাবে আচ্ছন্ন হয়ে থাকে যে, নতুনের দিকে আর মুখ ফিরায় না। যেমন চীনাদের অত্যন্ত প্রিয় উপন্যাস ‘লাল প্রাসাদের স্বপ্ন’ (হোং লোউ মং, Dream of the Red Mansion)। অষ্টাদশ শতাব্দীর লেখক সাউ শুয়েছিন-এর (Cao Xueqin) এই উপন্যাসটি একটি ট্র্যাজিক ঘটনাকে অবলম্বন করে রচিত। বলা যেতে পারে চীনারা এই উপন্যাস দ্বারা এখনও গভীরভাবে আচ্ছন্ন। তবে সময় অনেক পালটে যাচ্ছে। চীনাদের সাথে পাশ্চাত্যের যোগাযোগ বহুগুণ বেড়েছে। আজকাল শিল্প-সাহিত্য সহ সমস্ত ক্ষেত্রে পশ্চিমা হাওয়ার ছোঁয়া লেগেছে; শুরু হয়েছে ব্যাপক আদান-প্রদান। আর সেই আদান-প্রদান যে অন্দরমহল পর্যন্ত ব্যাপ্তি পেয়েছে তার প্রমাণ মো ইয়ান-এর নোবেল প্রাপ্তি। এই প্রথম এমন একজন নোবেল পেলেন যিনি চীনা সরকারের সাথে সম্পৃক্ত, নিখিল চীন সাহিত্যিক সমিতির সভাপতি। এই প্রতিষ্ঠানটি সরাসরি সরকার এবং পার্টি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কাজেই মো ইয়ান-এর নোবেলপ্রাপ্তি রীতিমতো বিস্ময়কর ঘটনা। কারণ এ-যাবৎ কাল চীনাদের মধ্য থেকে যাঁরা নোবেল পেয়েছেন, তাঁরা হয় ভিন্নমতাবলম্বী নয়তো অন্য দেশের নাগরিক। মো ইয়ান-ই একমাত্র ব্যতিক্রম। তবে এ-কথা বলাই বাহুল্য, শত নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়েও চীনে শিল্প-সংস্কৃতির যে চর্চা সংগঠিত হয়েছে তার একটি ভিন্ন তাৎপর্য আছে। বিশেষ করে আন্ডারগ্রাউন্ড সাহিত্য যখন ডালপালা মেলবে তখন নিঃসন্দেহে একটি চমকপ্রদ অধ্যায়ের সূচনা ঘটবে। কারণ এত বিচিত্র ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে আর কোনো জাতি তার পথ পরিক্রমা করেছে কিনা আমার জানা নেই।

আন্তর্জাতিক শিল্পকলার অঙ্গনে ইতিমধ্যে চীনা শিল্পীরা জোরালো অবস্থান করে নিয়েছেন। এবার বুঝি শুরু হলো সাহিত্যের পালা। তবে চীনাদের একটি বিষয়ের প্রশংসা করতেই হয় — ওরা যতোই আধুনিকতার চর্চা করুক না কেন, প্রাচ্য সংস্কৃতির ভাবনা থেকে কখনো বিচ্যুত হয় না এবং শেকড় থেকেও বিচ্ছিন্ন হয় না। মো ইয়ানের লেখার সর্বাঙ্গেও রয়েছে মাটির গন্ধ।

রশীদ আমিন

জ়ীবনের এই রহস্য কে করিতে পারে ভেদ, ভুবনডাঙ্গায় ঘোরা-ফিরা ক্ষণিকের বিচ্ছেদ

২ comments

  1. সবুজ পাহাড়ের রাজা - ২০ অক্টোবর ২০১২ (৩:১২ পূর্বাহ্ণ)

    আন্তর্জাতিক শিল্পকলার অঙ্গনে ইতিমধ্যে চীনা শিল্পীরা জোরালো অবস্থান করে নিয়েছেন।

    একমত।

    মো ইয়ানের লেখার সর্বাঙ্গেও রয়েছে মাটির গন্ধ।

    মো ইয়ানের কয়েকটি লেখা এর মাঝেই পড়া হয়েছে। মাটির গন্ধের, মানে, চীনা সাংস্কৃতিক বলয়ের দিকটি আসলেই ফুটে উঠে মো ইয়ানের লেখায়।

    চমতকার লেখা।

  2. ডাইনোসর - ২০ অক্টোবর ২০১২ (১০:১৯ পূর্বাহ্ণ)

    মো ইয়ানের কোন লেখাই পড়া হয় নি।। বাংলায় কি কোন অনুবাদ পাওয়া যাবে?

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.