ট্রেনে যেতে যেতে
শেষবার হংকং গিয়েছিলাম ১৯৯৩ সালে। আজ থেকে ষোল বছর আগে। তখন ব্রিটিশ হংকং, বেইজিং থেকে গিয়েছিলাম ট্রেনে চেপে। আমরা যখন আশির দশকের শেষের দিকে চীনের রাজধানী বেইজিং গিয়ে পৌছাই — পড়াশোনার লক্ষ্য নিয়ে, তখন বেশ মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। এ কোথায় এলাম! স্বপ্নের সাথে যেন কোনোভাবে মেলাতে পারছি না। উচ্চ শিক্ষার্থে বিদেশ যাত্রা, কিন্তু এ কেমন বিদেশ! শুধু সাইকেল আর সাইকেল। বৃ্দ্ধ কমরেডদের দেখতাম নীল রঙের মাও-কোর্টের ইউনিফর্ম পরে আছে, তরুণদের মধ্যে ফ্যাশনের কোনো বালাই ছিল না, জরাজীর্ণ রুশি কায়দার দালানগুলো তখনো দাঁড়িয়ে আছে স্তালিনের বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসাবে। সময় যেন একটা জায়গায় থেমে আছে। সেই সময় চীনকে বড্ড ধূসর মনে হয়েছিল। কারণ চীন নামের ঘুমন্ত ড্রাগনের ঘুম যে তখনো ভাঙেনি। সদ্য সংস্কারের পথে চীন; সদ্য তেং শিয়াও ফিং-এর বিখ্যাত বিড়ালের ইঁদুর খাওয়া তত্ত্ব বাজারে এসেছে। এবং খোলা দুয়ার নীতি (open policy) অনুমোদিত হয়েছে। তথাকথিত লৌহ-যবনিকাও ধীরে ধীরে উঠে যাচ্ছে, সৌভাগ্যের ফিনিক্স পাখি যেন পাখা মেলছে আর বেইজিং যেন সদ্য তার আড়মোড়া ভাঙছে। এ হেন অবস্থায় আজ থেকে দুই দশকেরও বেশি সময় আগে বেইজিং-এ পড়তে এসে সত্যি মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। সেই সময়ে এক অগ্রজ ছাত্র সান্ত্বনা দিয়েছিলেন এই বলে, ‘চিন্তা কইরো না, মাঝে মাঝে হংকং যাইতে পারবা, শহর কারে কয় দেখবা।’ সত্যি তারপর থেকেই যেন আমরা হংকং-এর স্বপ্নে বিভো্র। কবে যাব সেই স্বপ্নের শহরে, সেই আলো ঝলমলে শহরে। অতঃপর আমাদের যাওয়া হয়েছিল সেই শহরে। সেই সময় বেইজিং-এ থাকতে বেশ কয়েকবারই হংকং-এ যাওয়া হয়েছিল। তবে প্রথমবার যাওয়ার অভিজ্ঞতা ছিল অন্যরকম। সেই বেইজিং থেকে ক্যান্টন (কোয়াংট্রোও) ৩৬ ঘণ্টার জার্নি, তারপর ক্যান্টন থেকে ট্রেনে করে সীমান্ত শহর শেনট্রেন দু-আড়াই ঘণ্টার পথ; শেনট্রেন স্থলবন্দর পেরোলেই হংকং। ইমিগ্রেশন আর কাস্টম্স্-এর বেড়াজাল পেরিয়ে ওপারেই যেতেই দেখি মেট্রো ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে। একেবারে পুঁজিবাদী ঝকঝকে ট্রেন। আর ট্রেনে উঠতেই যেন মনে হলো আমরা পৌঁছে গেছি সব পেয়েছির দেশে। আমরা ছিলাম তিনজন — আমি, হেলাল আর হামিদ। তিনজনই তখন বেইজিং-প্রবাসী ছাত্র। দেখছিলাম আইস-বক্সে করে এক তরুণ আইসক্রিম বিক্রি করছে। খুবই সুদৃশ্য মোড়ক দেখে হামিদ লোভ সামলাতে পারল না (বেইজিং-এর আইসক্রিম তখন বড়ই বিস্বাদ), কিনে ফেললো একটা। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত মোড়কটা ছিঁড়তেই আইসক্রিমটা হাত ফসকে নীচে পড়ে গেল! অনেকগুলো চোখ হামিদের দিকে, আর অনেকগুলো চোখ আইসক্রিমের দিকে। হামিদের মন খারাপ হয়ে গেল, বেশ কিছু মূল্যবান হংকং-ডলার জলে গেল। যাই হোক, ট্রেন চলছে বেশ দ্রুত গতিতেই, কিছুক্ষণের মধ্যে কাউলুন শহরের প্রাণকেন্দ্রে পৌঁছে গেল ট্রেন। আর শহরের জৌলুস দেখে সত্যি আমাদের চোখে ধাঁধা লেগে গেল। বিশালকায় বিপণিবিতান, গগনচুম্বী দালান; উপরের দিকে তাকালে আকাশ দেখা যায় না। আকাশ না দেখা গেলে কী হবে, সর্বত্র যেন আলোর বন্যা। বেইজিং থেকে এরকম একটি শহরে এসে আমাদের ধাতস্থ হতে বেশ সময় লেগে গেল। ইতিমধ্যে হামিদ শহর দেখে আইসক্রিম হারানোর দুঃখ ভুলে গেছে; আবেগে জড়িয়ে ধরে বলে ফেলল, ‘মামা, একেই বলে শহর।’ এই ছিল প্রথম হংকং যাত্রার অভিজ্ঞতা। তারপর থেকে আমরা প্রায়ই যেতাম, সমাজতান্ত্রিক সীমানা পেরিয়ে পুঁজিবাদী শহরের জৌলুস দেখতে।
তবে এই সময়ের প্রেক্ষাপট যেন সম্পূর্ণ আলাদা। হংকং চীনের অধীনে চলে এসেছে। চীন এখন পৃথিবীর একটা বড় অর্থনৈতিক শক্তি। রাজধানী বেইজিং-এর জৌলুশ যেন অনেক গুণ বেড়ে গেছে। বেইজিং হংকং এখন এক কাতারে। প্রায় পনেরো বছর পরে বেইজিং এসেছি পিএইচ.ডি. করার লক্ষ্যে, এবং কয়েক বছরের জন্য আবার আমি বেইজিংবাসী। এবার যখন হংকং-এ প্রদর্শনীর জন্য আমন্ত্রণ পেলাম তখন বেশ আনন্দ হয়েছিল এই ভেবে যে অনেকদিন পর আবার হংকং যেতে পারব, স্মৃতিময় হংকং-এ। সিদ্ধান্ত নিলাম ট্রেনেই যাব; এই ধরনের ভ্রমণে ট্রেনই আমার প্রথম পছন্দ। ট্রেনে ভ্রমণের আনন্দই আলাদা — কত লো্কের সাথে দেখা হয়, আর জানালা দিয়ে নানা ধরনের দৃশ্যাবলি দেখতে দেখতে যাওয়া যায়। আর বেইজিং থেকে হংকং ভ্রমণটা আরো চমকপ্রদ। চীনের উত্তর থেকে দক্ষিণে যাওয়া। শীতপ্রধান এলাকা থেকে উষ্ণ মণ্ডলীয় অঞ্চলে। প্রকৃ্তিও যেন আলাদা। বেইজিং-এ যখন বরফ পড়ে তখন হংকং-এ দিব্যি একটা শার্ট গায়ে দিয়ে ঘোরা যায়। যত দক্ষিণের দিকে যাওয়া যায় ততই যেন আমাদের দেশের আবহ অনুভূত হতে থাকে। দক্ষিণের দিকে অনেক বেশি সবুজ, গাছপালার সাথেও আমাদের প্রচুর মিল। প্রচুর বাঁশগাছ চোখে পড়ে। ট্রেনে যেতে চোখে পড়ে প্রচুর জলাভূমি আর তাতে হাঁস চাষ হচ্ছে। হাঁসগুলি জলে সাঁতার কাটছে দেখে আমাদের গ্রামের কথা মনে পড়ে যায়। আমরা যেন দক্ষিণ চীনের সাথে আবহাওয়াগত কারণে বেশি একাত্মতা অনুভব করি। চীনের উন্নতির সাথে তাদের যোগাযোগ ব্যবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আগে যেখানে ক্যান্টনে যেতেই ছত্রিশ ঘণ্টা লেগে যেত, এখন সেখানে চব্বিশ ঘণ্টায় সরাসরি হংকং-এ পৌঁছে যাওয়া যায়। একরাতের জার্নি। কাস্টম্স্ আর ইমিগ্রেশনের ঝামেলা বেইজিং-এই সারতে হয়।

ট্রেনের জানালা থেকে
অক্টোবর মাসের ২৪ তারিখে (২০০৯) ট্রেনে চাপলাম। পিঠে ব্যাক-প্যাক, হাতে ছবির পোর্টফোলিও ব্যাগ, কাঁধে ল্যাপটপ নিয়ে কাস্টম্স্ ইমিগ্রেশন সেরে যখন ট্রেনের কম্পার্টমেন্টে উঠলাম তখন রীতিমত ক্লান্তিতে অবসন্ন হয়ে পড়েছি। মালপত্র যথাস্থানে রেখে জানালার পাশে বিল্ট-ইন আসনে বসলাম; বিশালাকৃতির জানালা পেরিয়ে দৃষ্টি রুদ্ধ হয়ে গেল। কারণ ট্রেন তখনো স্টেশনের ঘেরাটোপে। অপেক্ষায় রইলাম কখন ট্রেন ছাড়বে। এই কম্পার্টমেন্টটা মধ্যম শ্রেণীর স্লিপার ক্যাটাগরির, একেকটি কামরায় ছয়টি স্লিপার (ঘুমানোর ব্যবস্থা সমেত) – একেকদিকে তিনটি করে, একতলা দোতলা তিনতলা। আমার ভাগ্যে পড়েছে দোতলা। উল্টোদিকে দুটি স্লিপারে একটি অল্পবয়সী যুগল, আমার নীচে একটি কমবয়সী তরুণ। একেবারে উপরের দুটি স্লিপার খালি; তাতে ভালোই হয়েছে, আমার মালপত্র রাখা গেল। অল্পবয়সী যুগলটি সারাক্ষণ পরস্পরের গা ঘেঁষে রইল আর নিজেদের মধ্যে খুনসুটি করতে থাকল। তরুণটি একেবারে চুপচাপ। আমিও জানালার দিকে তাকিয়ে অপেক্ষায় রইলাম কখন ট্রেন ছাড়বে। আমি বসে আছি, আমার দিকে সব চীনারা তাকিয়ে আছে। এই কম্পার্টমেন্টে বোধ হয় আমি একজনই বিদেশি। চীনারা আমার প্রতি কৌতূহলী হলেও এগিয়ে এল না আলাপ জমাতে। চীনারা এখন অনেক বেশি আত্মগত, আগের জমানার মতো অত খোলামেলা আন্তরিক নয়। মনে আছে আগে যখন প্রায়শ রেল ভ্রমণ করতাম তখন চীনারা আমাকে ঘিরে ধরত, নানা প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে জানতে চাইত আমাদের দেশ সম্পর্কে। সিগারেট খাওয়াত, ফলমূল, এটাসেটা এগিয়ে দিত। ট্রেনে যেতে যেতেই অনেকে বন্ধু হয়ে যেত। পরে তাদের বাড়িতেও গিয়েছি। আমার মনে আছে একানব্বই সালের সামার ভ্যাকেশনে আমি প্রায় দুই মাস চীনদেশের বিস্তীর্ণ এলাকা ভ্রমণ করেছিলাম – সেই ক্যান্টন থেকে ইউনান, ইউনান থেকে সিচুয়ান, অনেকটা পথই ট্রেনে ট্রেনে কাটিয়েছিলাম। তখন চীনাদের কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল। এখন অবশ্য সেই চরিত্রের চীনা খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তাদের অর্থনৈতিক উন্নতির সাথে সাথে চীনাদের আচরণেও অনেক পরিবতন এসেছে। অবশেষে যথাসময়ে ট্রেন ছাড়ল। ট্রেন ছাড়তেই আনন্দে মনটা নেচে উঠল। কতদিন পরে আবার বেরোলাম; জানালার ধারে দু-চোখ ভরে দেখতে পারব দৃশ্যাবলি, পাহাড়, নদী, বাড়িঘর, মানুষ, রেলক্রসিংয়ে দাঁড়িয়ে-থাকা লোকজন। ট্রেন দ্রুত চলে যায়, যেন চিরুনির মতো আঁচড়ে নিয়ে যায় প্রকৃতি। মাঝে মাঝে ঝাপসা হয়ে যায়, লাঙলের ফলার মতো প্রকৃতিকে ভেদ করে ট্রেন এগিয়ে চলে, আর আমি বসে থাকি জানালার পাশে। হঠাৎ পকেটে মোবাইল বেজে উঠল। আমার স্ত্রীর ফোন, সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা জানার জন্যই ফোন করা। ওর সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে মোবাইল বন্ধ করে আবার আসনে বসে আছি, ঠিক সেই সময়ে ঘটল অবাক-করা কাণ্ডটি। চীনাদের মধ্য থেকে এক ভদ্রমহিলা পরিষ্কার বাংলায় বলে উঠলেন, ‘আপনি কি বাংলাদেশ থেকে এসেছেন?’ আমি তো তাজ্জব, চীনাদের মুখে বাংলা! প্রায় দেড়শো কোটি চীনার মধ্যে খুব বেশি হলে তিরিশ চল্লিশ জন হয়তো বাংলা বলতে পারে। যতটুকু জানি চীনা বেতারের বাংলা বিভাগে বাংলা-জানা কিছু চীনা আছে আর আন্তর্জাতিক প্রকাশনালয়ে কিছু লোক কাজ করে। তাই বলে হংকংগামী ট্রেনে বসে একজন বাংলা-জানা চীনা পেয়ে যাবো! পৃথিবীতে কত কাকতালীয় ঘটনাই না ঘটে। যাই হোক ঘটনার আকস্মিকতা কাটিয়ে উঠে অতঃপর ভদ্রমহিলার সাথে আলাপ পরিচয় করা গেল। তাঁর নাম ছুই ইয়েন লি – একসময়ে কাজ করতেন চীনের বিখ্যাত একাডেমি অব সোশ্যাল সায়েন্স নামের প্রতিষ্ঠানটিতে, বর্তমানে অবসর জীবনযাপন করছেন। স্বামী হংকং-এ চাকুরি করেন, তিনিও এখন হংকং-এ থাকেন; মা-বাবা বেইজিং-এ, তাই মাঝে মাঝে বেইজিং-হংকং করতে হয়। কর্মসূত্রেই বাংলা শিখতে হয়েছিল। একাডেমি অব সোশ্যাল সায়েন্সের দক্ষিণ এশীয় ডেস্কের দায়িত্বে ছিলেন। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় ও শান্তিনিকেতনে বাংলা শিখেছেন। দুই প্রতিষ্ঠানে দুই বছর কাটিয়েছেন। ট্রেনেই রাত্রীকালীন খাওয়া সেরে ভদ্রমহিলার সাথে কিছুক্ষণ আড্ডা দিলাম। তিনি তাঁর ভারতবাসের অভিজ্ঞতা বলছিলেন। আশির দশকের শুরুতে শান্তিনিকেতনে ছিলেন, সেই স্মৃতিগুলিই বারবার ঘুরেফিরে আসছিল। রাজীব গান্ধী এসেছিলেন শান্তিনিকেতনের সমাবর্তনে, সেখানে ছুই ইয়েন লির দায়িত্ব পড়েছিল বিদেশী শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে মানপত্র উপহার দেয়ার। শান্তিনিকেতনে থাকতে থাকতে তিনি যে বাঙালি খাবারের ভক্ত হয়ে গেছেন সে কথাটি বলতেও ভুললেন না।এখনও মাঝে মাঝে মাছভাত রান্না করেন। শান্তিনিকেতনের উত্সবগুলো খুব উপভোগ করেছেন, সাঁওতাল পল্লীতে ঘুরে বেড়ানো্র স্মৃতিগুলো যেন এখনো জ্বলজ্বল করছে। শান্তিনিকেতনে থাকতে তিনি অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তির সাথে দেখা করেছেন। কথাপ্রসঙ্গে বললেন, কলকাতায় গিয়ে সত্যজিৎ রায়ের সাথে দেখা করেছিলেন, তাঁর একটা ইন্টারভিউও করেছিলেন এবং চীনদেশের একটা পত্রিকায় তা ছাপাও হয়েছিল। বললাম কপিটি আছে কিনা। তা একটা বড় ঐতিহাসিক দলিল হতে পারে। কপিটি এখন আর তার কাছে নেই, হয়তো অতটা গুরুত্ব উপলব্ধি করেননি সেই সময়ে।
ধীরে ধীরে রাত ঘনিয়ে এলো। যাত্রীরা সবাই শোয়ার আয়োজন করছে। আমিও ছুই ইয়েন লির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম নিজের স্লিপারে। শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম পৃথিবীটা কত ছোট, হংকংগামী ট্রেনে বসে এই চৈনিক রাতে আমার সামনে চলে এলো শান্তিনিকেতন, সাঁওতাল পল্লী আর সত্যজিৎ রায়। নানান কিছু ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম।
সকালে যখন ঘুম ভাঙলো ততক্ষণে ট্রেন দক্ষিণ চীনে এলে এসেছে। বিস্তর বাঁশ গাছ এবং পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বিস্তর ঝিলের দেখা মিললো — তাতে হাঁসের দল সাঁতার কাটছে। এই দৃশ্য দেখেই অনুধাবন করতে পারি আমরা ক্যান্টনের খুব কাছাকাছি চলে এসেছি। দুপুর নাগাদ পৌছে যাব হংকং। সকালের নাস্তা সেরে আবার জানালার ধারে এসে বসলাম। নাস্তা মানে কাপ নুডল্স্ — ভ্রমণে সবার প্রিয়। কাপে ইন্সট্যান্ট নুডল্স্ রেডি করাই থাকে, শুধু গরম পানি ঢেলে দিলেই স্যুপ নুডলস তৈরি হয়ে যায়। চীনদেশে আর যা-কিছুরই অভাব হোক না কেন, অন্তত গরম পানির অভাব নেই। পাবলিক প্লেসগুলোতে সর্বত্র গরম পানির কল বসানো থাকে। চীনাদের সবুজ চা পানের অভ্যাসের কারণে এই ব্যবস্থা। ট্রেনেও প্রতি কম্পার্টমেন্টে একটি করে গরম পানির কল বসানো থাকে। যাই হোক, ইন্সট্যান্ট নুডল্সের সাথে ইন্সট্যান্ট কফি দিয়ে সকালের নাস্তা সারা হলো। জানালার ধারে বসে দৃশ্যাবলি দেখছিলাম আর নানান ধরনের চিন্তা মাথায় ভিড় করছিল, আর মাঝে মাঝেই ট্রেন অন্ধকার হয়ে যাচ্ছিল। পাহাড় কেটে সুড়ঙ্গ বানিয়ে ট্রেন লাইন বসানো হয়েছে। সুড়ঙ্গের ভিতর দিয়ে যখন ট্রেন যায় তখন স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা আঁধার নেমে আসে। বেইজিং থেকে ক্যান্টন পর্যন্ত যেতে এইরকম বেশ কিছু সুড়ঙ্গ পথ পাড়ি দিতে হয়। চীনদেশ মানে পাহাড়ের দেশ। সমস্ত দেশব্যাপী এই দুর্গম পাহাড়ি রাজ্যে হাজার হাজার মাইল রেলপথ বসাতে গিয়ে কি ঝক্কিটাই না পোহাতে হয়েছে! কত শ্রমিকের রক্ত-ঘাম মিশেছে এই বিশাল কর্মযজ্ঞে, কে জানে! পরিশ্রমী চীনা জাতির মাহাত্ম্য বোধহয় এইখানেই।
ক্যান্টনের দিকে ট্রেন যাচ্ছে আর যেন উষ্ণতা অনুভব করছি। ট্রপিকাল গাছপালার জগতে প্রবেশ করছি। কিছুদূর যেতেই দেখলাম ট্রেন লাইনের দুধারে প্রচুর জবাফুলের গাছ — যাকে বলে চাইনিজ রোজ। গাছগুলোয় থোকা থোকা জবাফুল ফুটে আছে। মনটা একেবারে প্রফুল্ল হয়ে উঠলো। আসলে দক্ষিণ চীনের সাথেই যেন আমরা অনেক বেশি একাত্মতা অনুভব করি।
ক্যান্টন পেরিয়ে ট্রেন ধীরে ধীরে হংকং-এর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যত যাচ্ছে ততই যেন শিহরন অনুভব করছি। কতদিন পরে যাচ্ছি আমাদের প্রিয় হংকং শহরে। ফেলে-আসা দিনগুলোর নানা স্মৃতি মনে ভিড় করছে। বার বার যেন ফিরে যাচ্ছি সেই পুরোনো সময়ে।
সেই সময়ে আমরা চলে যেতাম চুংকিং ম্যানশন-এ। হংকং-এর কাউলুন প্রান্তে নাথান রোডে অবস্থিত এই ম্যানশনটি দক্ষিণ এশীয় মানুষদের প্রাণকেন্দ্র। এখানে দেখা মিলে ভারতীয়, পাকিস্তানি, বাংলাদেশের মানুষজনের। এখানে সস্তায় থাকা খাওয়ার বন্দোবস্তও হয়ে যায়। বেইজিং থেকে এসে আমরা সচরাচর এখানেই উঠতাম। থাকার জায়গা ঠিকঠাক করেই ব্যাগ-ট্যাগ রেখে সোজা চলে যেতাম মংকক-এর নাইট মার্কেটে সস্তায় হালফ্যাশনের জামাকাপড় কেনার জন্যে। প্রতি ট্রিপে তিন চারদিনের বেশি থাকা হতো না। বিস্তর সাবান-শ্যাম্পু পেস্ট-ব্রাশ এবং জামাকাপড় কিনে ফিরে যেতাম বেইজিং। আমরা যারা শিল্পকলার ছাত্র তাদের বাড়তি জিনিসের মধ্যে ছিল রংতুলি কাগজ। বেইজিং-এর পণ্য তখন বড্ড নিম্নমানের। আর জিনিসপত্র কেনার উদ্যেশ্যে আমরা প্রায় পুরো শহরই যেন পায়ে হেঁটে চষে বেড়াতাম। অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকতাম। কথিত আছে, হংকং কখনো ঘুমায় না। প্রাচ্যের এই প্রধানতম পর্যটন নগরী সারারাত জেগে থাকে আর ভ্রমণকারীরা মত্ত হয়ে যায় নানা আমোদ-প্রমোদে।
রাতে আমরা চলে যেতাম হারবার-এর শোভা দেখতে, ওপারে হংকং আর এপারে কাউলুন, দুই যমজ শহর নিয়েই হংকং ফ্রি-পোর্ট। এপার থেকে পুরো হংকং আইল্যান্ডটি দেখা যায়। পাহাড়ের ঢালে ঢালে বিশালাকার হাইরাইজ দালানগুলো — তাতে বর্ণালী আলোকসজ্জার সমাহার। তার প্রতিবিম্ব হারবারের পানিতে। আমরা মুগ্ধ হয়ে দেখতাম। অনেক রাত পর্যন্ত চুংকিং ম্যানশন-এর সিঁড়িতে বসে নানারকম মানুষ দেখতাম। কখনো দেখা যেত মাতাল বিদেশীর সাথে বারবণিতার বচসা। তখন হংকং-এর সময়টা খুব বর্ণময় মনে হতো। আমরা দু’তিন দিনের মধ্যে ঘোরাঘুরি এবং শপিং-এর মিশন শেষ করে আবার বেইজিং-এ ফিরে যেতাম। হংক-এর জ়ীবনযাত্রা এত বেশি ব্যয়বহুল যে বেশিদিন থাকা সম্ভব হতো না। সেই স্মৃতির শহরে যাচ্ছি প্রায় সতেরো বছর পরে।
