স্মৃতি হাতড়ে বেড়ানোর মতো কষ্টকর বিষয় আর নেই, আর তা যদি হয় বেইজিং-এর মতো শহরে। কারণ এই শহর এতটাই বদলে গেছে যে এক যুগ আগে যিনি এই শহরে এসেছেন তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে এক কঠিন ধাঁধা। নিজের চোখকে বিশ্বাস করা কঠিন। যাকে বলে খোলনলচে পালটে যাওয়া। অবশ্য এর একটি প্রধান কারণ হতে পারে দু’ হাজার আটের অলিম্পিক আয়োজন। পৃথিবীর কাছে একটি ঝকঝকে শহর উপহার দেয়ার বাসনা। সে চেষ্টায় চীনারা যেন অনেকটাই সফল, অলিম্পিকে আগত বিদেশী অতিথিরা সত্যিই মুগ্ধ হয়ে দেখলো বেইজিং-এর এই নব রূপ। অলিম্পিক একটি উপলক্ষ মাত্র, এমনিতে চীনাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বিস্ময়কর, তারই প্রতিফলন রাজধানী বেইজিং-এ। চীনাদের আয় উন্নতি যে যথেষ্ট হয়েছে তার ছাপ সর্বত্র। আজ থেকে বিশ বছরের বেশি সময় আগে বেইজিং শহরে এসেছিলাম। তখন বেইজিং-এর সাইকেলের যুগ, শহর জুড়ে শুধু সাইকেল আর সাইকেল। বড় বড় রাস্তাগুলো যেন খাঁ খাঁ করতো। কিছু ট্যাক্সি, পাবলিক বাস আর সরকারি গাড়ি — এই ছিল পথের সাথী। বরং সাইড লেন-ই ছিল জমজমাট, সারি সারি সাইকেলের মিছিল। তখন এটিই ছিল একমাত্র সমাজতান্ত্রিক বাহন। উঁচু-নিচু ভেদাভেদ নেই, সবারই এক বাহন — সাইকেল। আর এই সাইকেলের কত গুণগান। আমার মনে আছে, আমাদের চীনা ভাষা শিক্ষা ক্লাসে সাইকেল চালানোর সুফল নিয়ে একটি প্রবন্ধ ছিল। তাতে শরীরচর্চা থেকে শুরু করে পরিবেশ-বান্ধব হিসাবে সাইকেলের নানান গুণপনার বিবরণ ছিল। এখনো অবশ্য কিছু লোককে সাইকেল চালাতে দেখা যায় কায়ক্লেশে, যারা প্রথম সুযোগটি কাজে লাগাতে পারেনি, ধরতে পারেনি সম্ভাবনার প্রথম ট্রেনটি। প্রায় পনেরো বছর পর বেইজিং-এ এসে যখন এক চীনা বন্ধুর সাথে দেখা করতে গেলাম তখন তার আচার-আচরণে দেখি বিশাল পরিবর্তন, চালচলনে বন্ধুটি এখন পুরো বুর্জোয়া, গাড়ি ছাড়া এক পা-ও চলতে পারে না, অথচ আগে দেখেছি তার সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিল একটি ভাঙাচোরা সাইকেল। যে-বিশ্ববিদ্যালয়ে একসময় অধ্যয়ন করেছি তার সামনে মোটরগাড়ির সারি, আগে যেখানে শোভা পেত শুধু সাইকেল আর সাইকেল। চীনারা যে-দিকে ঝোঁকে একেবারে বিপ্লব করেই ছাড়ে, এখানেও ঘটে গেছে এক মোটরগাড়ি বিপ্লব ।
চীনারা তাদের উন্নতির যে-তরিকা, তার নামকরণ করেছে সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি। অর্থাৎ পুঁজিবাদি ঘুড়ি যত উপরেই উঠুক তা নিয়ন্ত্রিত হবে সমাজতান্ত্রিক লাটাইয়ে। এক দেশ দুই নীতি – সমাজতন্ত্র আর পুঁজিতন্ত্রের সহাবস্থান। তবে এই নীতিতে চীনারা বেশ সফলই, পুঁজিবাদের এই মিশেলে অন্তত রক্ষা করতে পেরেছে লাল পতাকাটি। চীনদেশে লাল পতাকা এখনও উড়ছে। পুঁজিবাদ আর সমাজতন্ত্রের এই ফিউশন এক বিস্ময়্কর অর্থনৈতিক উন্নয়নের সূচনা করেছে চীনদেশে, যার প্রশংসা নিন্দুকেরাও করে। সমাজতন্ত্র সম্পর্কে আগে মজা করে বলা হতো — সবাই একসঙ্গে গরীব হওয়া; চীন বোধ হয় সেই দুর্নাম ঘোচাতে চেয়েছে। আবার চীনের এই পদ্ধতির সমাজতন্ত্রে সবাই একসঙ্গে ধনী হতে পারবে কি না তা অবশ্য প্রশ্নসাপেক্ষ। তবে এই দেশে যে ধনী্দের সংখ্যা বেড়ে গেছে তা বড় বড় শহরগুলোর পালটে যাওয়া রূপই বলে দেয়, যেমন সাংহাই, ক্যান্টন, বেইজিং।
বেইজিং সত্যিই পালটে গেছে অনেক। শহরের প্রাণকেন্দ্র ওয়াং ফু চিং সড়কে এলেই বড় ধরনের হোঁচট খেতে হয়। এ কোথায় এলাম! সারি সারি চকচকে দালান আর বড় বড় সব ডিপার্টমেন্টাল স্টোর — কোনোভাবেই একে মোলাতে পারছি না আগের জমানার সাথে। কিছু কিছু বেসমেন্ট শপ এত বড় যে সেখানে মার্সিডিজ গাড়ি থেকে শুরু করে আলপিন পর্যন্ত পাওয়া যায় আর সর্বত্র ব্র্যান্ড জিনিসের পসরা। ব্র্যান্ড জিনিসের প্রতি চীনাদের ঝোঁক বেশি। আর বেশির ভাগই আমেরিকান ব্র্যান্ড। চীনা তরুণ তরণীদের হৃদয়ে আমেরিকান ড্রিম ভালোভাবেই গেঁথে গেছে। আমার মনে আছে পনেরো বছর আগে ভালো কিছু কেনার জন্য আমরা হংকং যেতাম, প্রথম যখন আমরা হংকং-এ পা ফেলি বিস্ময়ে অভিভূত হয়েছিলাম গগনচুম্বী দালান আর ঝাঁ-চকচকে বিলাসী বিপণি বিতানগুলো দেখে। আজ বেইজিং আর হংকং যেন এক কাতারে উঠে এসেছে। বেইজিংও ক্রমশ বিলাসী হয়ে উঠেছে। বিলাসী সব পণ্যই আজ চীনাদের হাতের মুঠোয়, সমাজতান্রিক দেশগুলোতে উন্নত ধরনের পণ্যের দুষ্প্রাপ্যতা নিয়ে দুর্নাম ছিলো, আমরা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গ বইয়ে পড়েছি – উন্নত মানের পণ্যের জন্য পূর্ব ইউরোপীয় সমাজতান্রিক দেশগুলোতে কীরকম হাহাকার ছিল। চীনদেশে অন্তত এই ভালো পণ্যের আকাল দূর হয়েছে। আজ থেকে পনেরো-ষোল বছর আগে যখন এই ওয়াং ফু চিং সড়্ক ধরে হেঁটে বেড়াতাম তখন ছিল না এত জৌলুস, সরু রাস্তার দু’পাশে অনেক গাছগাছালি ছিল, গ্রীষ্মকালে গাছের ছায়ায় চমৎকার প্রশান্তি পেতাম, রাস্তার ধারে ছোট ছোট দোকান ছিল, নানান ধরনের খাবারের দোকানও ছিল মূল সড়ক ধরে। সেই দোকানগুলো যেন কোথায় হারিয়ে গেছে। বড় বড় কিছু ডিপার্টমেন্টাল স্টোরও ছিল সমাজতান্ত্রিক কায়দায়, তখন তো পুরো সমাজতান্ত্রিক চীন (সবেমাত্র ‘ওপেন পলিসি’-র সূচনা হয়েছে), মনে আছে এই ডিপার্টমেন্টাল স্টোরগুলোতে খুবই নিম্ন মানের পণ্য সাজিয়ে রাখা হতো, আর সেল্স্গার্লরা নিজেরা আড্ডা দিত, জিনিস বেচার ব্যাপারে তাদের কোনো আগ্রহ ছিল না। তখন ‘মেইয়’ অর্থাৎ ‘নাই’ শব্দটি খুব জনপ্রিয় ছিল, তাদের আড্ডার ব্যাঘাত ঘটলে জিনিস থাকলেও ক্রেতাদের ‘মেইয়’ বলে বিদায় করে দিত। এখন অবশ্য উলটো চিত্র, সেই নাছোড়বান্দা সেল্স্ম্যানশিপ আবার ফিরে এসেছে, যা বিপ্লবোত্তর চীনদেশে ছিল – ‘টেক অর নট টেক, একবার তো সি’। কোনো দোকানে ঢুকলে আর রক্ষা নাই, সুন্দরী সব বিপণি-বালিকারা টানা হ্যাঁচড়া শুরু করে দেয়, এবং জিনিস কিনিয়েই ছাড়ে।
এই ওয়াং ফু চিং সড়কই বেইজিং-এর প্রাচীনতম প্রাণকেন্দ্র, যুগে যুগে শুধু তার চেহারাটা পালটেছে। এটি যে শুধু বিপণিপল্লি তা নয়, সাংস্কৃতিক কেন্দ্রও বটে। এই সড়কের উপরই বেইজিং-এর বিখ্যাত ক্যাপিটাল থিয়েটারের প্রাচীন ভবনটি দাঁড়িয়ে আছে, বিখ্যাত সব নাটকের অভিনয় এখানেই হয়। আমার স্পষ্ট মনে আছে দুটি নাটকের কথা – একটি লাউৎসের টি হাউস, অন্যটি থাং ডাইনেস্টির কবি ‘লি পাই’-এর উপর একটি নাটক। অদূরেই বিখ্যাত চায়না আর্ট গ্যালারি, যেখানে সপ্তাহান্তে ঢুঁ দিতাম নতুন প্রদর্শনীর খোঁজে। এই সড়কের উপরই জমজমাট বইয়ের দোকান ওয়াংফু জিং বুক স্টোর, যা বেইজিংবাসীর সবচেয়ে প্রিয় বইয়ের দোকান। একসময় দেখেছি ওয়াং ফু জিং-এর বিশাল প্রাচীন গির্জাটি উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা ছিল, এখন তা উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। গির্জার সামনের বাগান এখন রূপ পেয়েছে এক অপুর্ব দর্শনীয় স্থানে, প্রতিনিয়ত চোখে পড়ে দর্শনার্থীদের ভিড়, প্রাচীরঘেরা সেই সময়টার সাথে যেন কোনোভাবেই মেলাতে পারছি না। মনে পড়ে সেই সময় পাঁচিলের ওপার থেকে ভেসে আসতো গির্জা সংগীত, কোনো এক বড়দিনে আমরা পাঁচিলের বাইরে দাঁড়িয়ে সংগীতসুধা পান করেছিলাম। ওয়াং ফু চিং-এর অনেক উন্নতি হয়েছে, প্রশস্ত রাস্তা, আধুনিক দোকানপাট, আর এর জন্য মূল্য দিতে হয়েছে প্রাচীন বৃক্ষগুলোকে। নতুন গাছ লাগানো হয়েছে ঠিকই, তবে এগুলি ছায়া সুনিবিড় হতে হয়তো আরো সময় লেগে যাবে। ওয়াং ফু চিং সড়কের একটু দূরেই ঐতিহাসিক ‘থিয়েন আন মেন চত্বর’, তা যেন আগের মতোই আছে; বিশালকায় প্রান্তর, যা পৃথিবীর বৃহত্তম স্কোয়ারগুলোর একটি। এখানে যথারীতি প্রতিদিন সূর্যোদয়ের সাথে সাথে লাল পতাকা উত্তোলিত হয়, আবার সূর্যাস্তের ক্ষণে অবনমন, পিপল্স্ আর্মির জোয়ানেরা সামরিক কুচকাওয়াজের মাধ্যমে কর্মটি সমাধা করে। এই আদি ও অকৃত্রিম সমাজতান্ত্রিক কৃত্যটি দেখার জন্য অনেক লোক ভিড় করে, বেইজিং-এ ভ্রমণকারীদের জন্য এটি একটি বিশেষ দ্রষ্টব্য। স্কোয়ারের একপাশে ফরবিডেন সিটির প্রবেশদ্বারে বিশালকায় মাও সে তুং-এর প্রতিকৃতিটি ঠিক আগের মতোই আছে। স্মিত হাস্যময়।
বেইজিং এখন প্রাচ্যের একটি আধুনিক নগরী, এর সর্বত্র আধুনিকতার ছোঁয়া। বাস, পাতাল রেল সর্বত্র ইউরোপীয় মান অর্জনের প্রচেষ্টা। কোথাও কোথাও পাশ্চাত্য নগরী বলে ভুল হয়। আগের জমানার সাথে তুলনা করলে দেখা যায়, চীনাদের জীবন যাপন ও অভ্যাসেরও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। পাশ্চাত্যের অনেক খাবারদাবারেই তারা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। মনে আছে আগে বেইজিং-এ একটি মাত্র ম্যাকডোনাল্ড বার্গারের দোকান ছিল; এখন তো অলিগলিতে সর্বত্র ম্যাকডোনাল্ড, কেন্টাকি ফ্রাইড চিকেন আর পিজা হাটের ছড়াছড়ি। চীনারা এই সব খাবার আগে ভালো চোখে দেখতো না। আর এখন আমেরিকান এই ফাস্ট ফুডের দোকানগুলোতে ভিড় লেগেই থাকে। অবশ্য ভোজনপ্রিয় চীনারা সব খাবারই চেখে দেখতে অভ্যস্ত; সুতরাং এক দেশ দুই নীতির মতো এক দেশ দুই খাবারের পাশাপাশি অবস্থান। চীনাদের সবুজ চা পানের অভ্যাস সুপ্রাচীন। তবে তরুণ প্রজন্মের মাঝে এর প্রভাব বোধ হয় কমে যাচ্ছে। এখন ওদের হাতে দেখা যায় কোকাকোলার বোতল অথবা নানান ধরনের রঙবেরঙের কোমল পানীয়। তরুণ তরুণীদের পোশাকআশাকও অনেক পালটে গেছে। আগে সেই ঘোরতর সমাজতন্ত্রের যুগে দেখতাম চীনাদের পোশাকআশাক ফ্যাশনের কোনো বালাই ছিল না। এখন অবশ্য চীনারা অনেক ফ্যাশন সচেতন । রাস্তার ধারে পত্রিকার স্টলগুলোতে শুধু ফ্যাশন ম্যাগাজিনগুলোরই দাপট।
আর এটা তো বলাই বাহুল্য যে অর্থনৈতিক উন্নতির সাথে সাথে সবকিছুরই পরিবর্তন হয়। এখানে প্রযুক্তিগত উন্নতিও হয়েছে যথেষ্ট — এ যেন সত্যিকারের এক ডিজিটাল চীন, সর্বক্ষেত্রে কম্পিউটার প্রযুক্তির ব্যবহার চোখে পড়ার মতো। ইন্টারনেটের ব্যবহার ব্যপক এবং বিস্তৃত, দেখে অবাক লাগে বিশ্ববিদ্যালের বুড়ো অধ্যাপকরাও ক্লাসের নোটপত্র ওয়েবসাইটে দিয়ে দেয়। বাসে, পাতাল রেলে সর্বত্র আই.সি. কার্ডের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয় টিকেটিং ব্যবস্থা; এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাইনিং-এও আই.সি. কার্ডের ব্যবহার। খাবার বিতরণের কাউন্টারে ছোট্ট একটি যন্ত্র রাখা আছে, খাবারের দাম হিসাব করে বাটন টিপে যন্ত্রে ছোঁয়ালেই তা কেটে রাখে। চীনের এই প্রবৃদ্ধির পেছনে প্রযুক্তিগত উন্নয়নও নাকি একটি বড় কারণ। কেনই-বা হবে না এই উন্নতি, স্বয়ং প্রেসিডেন্ট হু জিন তাও যে একজন উঁচুমানের প্রকৌশলী; সবাই বলে তাঁর দক্ষ পরিচালনাতেই নাকি আজ দেশের এই উন্নতি। এই যে অগ্রগতি এটাই বোধ হয় একটা দেশের জন্য স্বাভাবিক; কোনো দেশ তো আর থেমে থাকে না। তবে চীনদেশের সেই সময় আর এই সময়ের পার্থক্য এত বেশি যে মাঝে মাঝে মিরাকল বলে মনে হয়।
বেইজিং নামের এই প্রাচীন শহরটি আয়তনের দিক দিয়েও বিশাল, একশ পঞ্চাশ কোটির রাজধানী হিসেবে এই বিশালত্বও যৌক্তিক। এই রাজধানী নিয়ে চীনাদের গর্বের সীমা নেই। অবশ্য গর্ব করার মতো আছেও অনেক কিছু এই শহরে। শহরের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে নানান প্রাচীন স্থাপনা। আবার আধুনিক যুগেও গড়ে উঠেছে নয়নাভিরাম স্থাপত্যকর্ম। সুপ্রাচীন রাজপ্রাসাদ ‘ফরবিডেন সিটি’, ‘সামার প্যালেস’, ‘টেম্পল অব হ্যাভেন’-এর পাশাপাশি এই আধুনিক যুগে যুক্ত হয়েছে পাখির নীড় স্টেডিয়াম (বার্ড নেস্ট), ন্যাশনাল গ্র্যান্ড থিয়েটার, সিসিটিভি টাওয়ার; এছাড়া পুরনো আমলের কলোনিগুলো ভেঙে সব অত্যাধুনিক অ্যাপার্টমেন্ট গড়ে উঠেছে নগর জুড়ে। তবে প্রাচীন দর্শনীয় স্থাপনাগুলো রক্ষা করা হয়েছে অনেক যত্নের সাথে। বেইজিং এখন প্রাচীনের সাথে নতুনের আর প্রাচ্যের সাথে পাশ্চাত্যের মেলবন্ধনের নগরী, সত্যিকারের এক মেল্টিং পট।
অর্থনৈতিক উন্নতির সাথে সাথে চীনদেশের শিল্পকলার ক্ষেত্রেও ঘটে গেছে এক বিপ্লব। বেইজিং এখন বিশ্বব্যাপী শিল্পকলার এক বিশেষ কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। বেইজিং শহরে অনেক পরিত্যক্ত ফ্যাক্টরি জোন আর্ট জোনে রূপান্তরিত হয়েছে, এই আর্ট জোনগুলোই বেইজিং-এর শিল্পকলার প্রাণকেন্দ্র। এখানে ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে উঠেছে প্রচুর গ্যালারি, আর এই গ্যালারিগুলোতে প্রতিনিয়ত প্রদর্শিত হচ্ছে নানা ধরনের শিল্প আয়োজন। শিল্পকলার নানাবিধ কর্মকাণ্ডে সর্বদা উৎসবমুখর এই শিল্প চত্বরগুলো। ভাবতে অবাক লাগে, আগে এই শহরে গ্যালারির সংখ্যা ছিল হাতে গোনা, আর এখন তা হাজার ছাড়িয়ে গেছে! চীনাদের এই শিল্প বিপ্লব (আর্ট অর্থে) বোধ হয় অর্থনৈতিক প্রবৃ্দ্ধিরই পরিপূরক। চীনা শিল্পীদের শিল্প বিষয়ক ধ্যানধারণাও পালটে গেছে বিস্তর, এদের শিল্পচর্চা যেন পাশ্চাত্যের এই সময়ের শিল্পধারাগুলোর সাথে একই সূ্ত্রে গাঁথা। তাই এখন নিউ ইয়র্ক, প্যারিস, টোকিওর পাশাপাশি বেইজিং-এর নাম চলে আসে। সুতরাং আমরা বলতে পারি বেইজিং নগরীর কাঠামোগত উন্নতির পাশাপাশি এর শিল্প-সংস্কৃতির ভুবনেও ঘটে গেছে ব্যাপক পরিবর্তন। আর এইসব কারণে বেইজিং ক্রমশ রূপ পাচ্ছে প্রাচ্যের এক মোহনীয় নগরীতে। তবে এই পরিবর্তিত চাকচিক্যের শহরে অনেক কিছু পালটে গেছে, মানুষগুলোকে বড় অচেনা মনে হয়, সহজ সরল সাধারণ জীবনযাপনকারী চীনারা সবাই যেন এক ইঁদুর-দৌড়ে মত্ত। তাই সেই সময়টির কথা খুব মনে পড়ে, যখন চীনারা বিশ্বাস করতো উন্নত চিন্তায় আর সাধারণ জীবনযাপনে, বাস করতো নৈতিক ও আদর্শিক এক ভুবনে। পরোপকারী, বন্ধুবৎসল, সরলমনা চীনারা কোন্ পথে যাত্রা শুরু করেছে তা হয়তো ভবিষ্যৎই বলে দেবে। অবশ্য কিছু পেতে হলে তো কিছু হারাতেই হয়। সময়ের স্রোত রুখে দেয়া কার সাধ্য, আর তাতে তো উন্নয়নের তরীটি ভাসবেই।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৪ comments
ইমতিয়ার - ২৬ এপ্রিল ২০০৯ (১২:০৪ পূর্বাহ্ণ)
চীনের বিশ বছরের তফাৎটা বুঝতে পারছি আপনার লেখা থেকে : কুড়ি বছরের পরে, তখন তোমারে নাই মনে। নস্টালজিয়া, সে তো থাকবেই; কিন্তু এই পার্থক্যগুলো আপনাকে উদ্বেলিত করছে, না কি ব্যথিত করছে, তা ঠিক ধরতে পারছি না।
দ্রষ্টব্যে বলি, চীনাদের ইন্টারনেট বিপ্লব, সত্যিই অভিভূত হওয়ার মতো। আমরাও তাদের মতো প্রাচ্যবাসী, ভাষার জন্যে রক্ত ঝরিয়েছি বলে গর্বও করি, নানাভাবে ভাষার গুরুত্বও বয়ান করে থাকি; কিন্তু আমাদের ভাষাকে কতটুকু ব্যবহারিক করে তুলতে পেরেছি, বলুন? আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের উৎস-দেশটির ওয়েবসাইটগুলিতে বাংলা-ব্যবহারের ধরণ দেখলে দুঃখ কেবলই বাড়ে, তাও তো বাংলা ব্যবহার করেছে এই ভেবে সান্ত্বনা পেতে হয়।
আপনাকে স্বাগতম, এখানে, সেই ক্ষতি সামান্য পূরণের জন্যে।
রশীদ আমিন - ২৬ এপ্রিল ২০০৯ (৯:১৯ পূর্বাহ্ণ)
যাক, আপনার মূল্যবান মন্তব্য পাওয়া গেল। আপনি ব্যস্ত মানুষ, তারপরও এই আমার লেখা মনোযোগ দিয়ে পড়েছেন, তার জন্য অশেষ ধন্যবাদ। আমার উৎসাহের মাত্রা আরো বেড়ে গেল।
স্মৃতি সততই সুখের, তাই আমার সেই সময়টাই ভাল লাগে …।
আমার লেখাটিতে শুধু খোলা চোখে দেখা পরিবর্তনটিই তুলে ধরার চেষ্টা করেছি … গভীর বিচার বিশ্লেষণে যাই নাই … ভবিষ্যতে এ নিয়ে আরেকটু কাজ করার ইচ্ছা আছে।
শেষের দুটি লাইনে আমি আমার অভিমত ব্যক্ত করার চেষ্টা করেছি : “তবে এই পরিবর্তিত চাকচিক্যের শহরে অনেক কিছু পালটে গেছে, মানুষগুলোকে বড় অচেনা মনে হয়, সহজ সরল সাধারণ জীবনযাপনকারী চীনারা সবাই যেন এক ইঁদুর-দৌড়ে মত্ত। তাই সেই সময়টির কথা খুব মনে পড়ে, যখন চীনারা বিশ্বাস করতো উন্নত চিন্তায় আর সাধারণ জীবনযাপনে, বাস করতো নৈতিক ও আদর্শিক এক ভুবনে। পরোপকারী, বন্ধুবৎসল, সরলমনা চীনারা কোন্ পথে যাত্রা শুরু করেছে তা হয়তো ভবিষ্যৎই বলে দেবে। অবশ্য কিছু পেতে হলে তো কিছু হারাতেই হয়। সময়ের স্রোত রুখে দেয়া কার সাধ্য, আর তাতে তো উন্নয়নের তরীটি ভাসবেই।”
অবিশ্রুত - ২ মে ২০০৯ (১২:১০ পূর্বাহ্ণ)
চীনারা, রশীদ আমিনের ভাষায় সমাজতান্ত্রিক কায়দায়, এক অভাবনীয় পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটিয়েছে।
কার সাধ্যি আছে, এই সত্য অস্বীকার করে? পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ এখন এই দেশটির। তা সাকুল্যে সর্বশেষ হিসেব অনুযায়ী, ২০০০ বিলিয়ন ডলারের মতো হবে। আর এর দু-তৃতীয়াংশই আবার ডলার নামের বৈদেশিক মুদ্রাটি।
কিন্তু ইদানিং নাকি এই ছোট ছোট চোখবিশিষ্ট, ভ্রমণের সময় অনবরত ক্যামেরায় ছবি তুলতে পারদর্শী মানবগণ ডলারের প্রতি মোহ কমাচ্ছেন। বিবিসির এক খবর অনুযায়ী, প্রায় বছর তিনেক হলো চীনারা ডলার, এমনকি তাদের রেনমিনবির ওপরও ভরসা করতে পারছেন না। কে জানে, তারা বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দাকে আগে থেকেই মালুম করতে পেরেছিল হয়তো! অথবা সমাজতান্ত্রিক কায়দায় পুঁজিবাদ করছে বলেই হয়তো চীনারা জানে, মুদ্রাবাজারের ওপর ভরসা করা ঠিক নয়। সবশেষ খবর অনুযায়ী, লন্ডনে জি-২০ হওয়ার ঠিক আগ দিয়ে চীনা ভাইরা ইউরোপ ও আমেরিকার ভাইয়াদের আমাদের গ্রামের ভাষায় বলতে গেলে, ঘাড়দোনা (মানে ঘাড়ধাক্কা) দিয়েছে। ওই সময় চীনা নীতিনির্ধারকরা সবার জন্যে এক সুপরামর্শ ঘোষণা করেছেন,- বিভিন্ন দেশের এখন সময় এসেছে রিজার্ভ কারেন্সী হিসেবে ডলার নামের বৈদেশিক মুদ্রাটির ওপর থেকে নির্ভরশীলতা কমাবার। অবশ্য তারপরও চীনের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের দু-তৃতীয়াংশই ডলার রয়ে গেছে। কিন্তু ঘোষণা হিসেবে এটি খুব গুরুত্বপূর্ণই বটে। কেননা এর ফলে সোনার দামের বাজার একটু বেড়ে গেছে এবং লন্ডনে এখন সোনার দাম, বিবিসির ভাষ্য অনুসারে, প্রতি আউন্সে খানিকটা (৫.৫০ ডলার) বেড়ে গেছে। অভাবনীয়রকম আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেছে সেই সব প্রথাগত বিনিয়োগকারীদের, যারা মনে করেন সোনা কেনাবেচাই হলো সবচেয়ে নিরাপদ বিনিয়োগক্ষেত্র। বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলছেন, চীনের সোনার মজুদ এখনও আহামরি কিছু নয়; যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলির তুলনায় তা নগণ্যই বলতে হবে। আর নীতিনির্ধারকরা যে ঘোষণাই দিক না কেন, ডলারের প্রতি মোহ চীনাদের আগের মতোই আছে।
যতদূর মনে পড়ছে, যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক দখলের আগে, ইরাকের কাছ থেকে তেল কেনার জন্যে ইউরো ছিল বিনিময় মুদ্রা। সাদ্দাম ওই নিয়ম করে দিয়েছিলেন হয়তো বা সুপ্ত প্রতিশোধস্পৃহাও ছিল সে নিয়মে। চীন ছিল এ তেলের অন্যতম ক্রেতা। স্বভাবতই ইউরোর বাজার চাঙ্গা হচ্ছিল। ডলার আভিজাত্য হারাচ্ছিল। এই বিশ্ব অর্থনৈতিক ডামাডোলের সময়, চীনের এই নতুন ঘোষণা তাই খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে হয়।
রশীদ আমিনের কাছে একটি অনুরোধ,- আমরা জানি, একসময় সোভিয়েত রাশিয়া ও চীন সমাজতান্ত্রিক ও জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের স্বার্থে অনুবাদ-পুস্তক প্রকাশনা কেন্দ্র গড়ে তুলেছিল। প্রগতি প্রকাশনের এবং পরবর্তী সময়ে গড়ে ওঠা রাদুগার হালসংবাদ সম্পর্কে আমরা খানিকটা হলেও জানি। কিন্তু চীনের সেই প্রকাশনীর অবস্থা কী (নামটিও মনে আসছে না এখন)? আপনি তাদের অফিসে একদিন ঘুরে আসুন না। ওইখানে কি এখনও বাংলা অনুবাদ ও গ্রন্থ প্রকাশ হয়? বাঙালি কারা তার সঙ্গে জড়িত আছেন? না কি পুঁজিবাদ প্রেস-অফিস-প্রকাশনা সব ভাসিয়ে নিয়ে গেছে? পারলে এসব নিয়ে একটু জানান দেবেন, এই অনুরোধ।
রশীদ আমিন - ২ মে ২০০৯ (৫:৪৮ পূর্বাহ্ণ)
প্রিয় অবিশ্রুত, আপনার সুচিন্তিত ও বিশ্লেষণধর্মী মতামতের জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।
আপনি যে অর্থনীতি সম্পর্কে অনেক খোঁজ-খবর রাখেন এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত; সত্যি বলতে কি আপনার এই লেখা থেকে আমিও বেশ কিছু বিষয় জানতে পারলাম …
এক সময় বিভিন্ন দেশে বিপ্লবের বাণী ছড়িয়ে দেয়ার জন্যে বিভিন্ন ভাষায় বই প্রকাশিত হতো, চীনারা এখন এই লাইন থেকে অনেক আগেই সরে এসেছে, এখন এরা বিপ্লব রপ্তানির চেয়ে পণ্য রপ্তানিতে বেশী আগ্রহী। যতদূর জেনেছি বিদেশী ভাষায় প্রকাশনী সংস্থাটি এখন পুরোপুরি ব্যবসায়িক ভিত্তিতে পরিচালিত হচ্ছে, সেই আদর্শিক বিষয়টি আর নেই। বাংলাদেশের কোনো বাঙালি যে ওখানে কাজ করছেন না সেটা আমি নিশ্চিত, তবে পশ্চিমবঙ্গের কেউ আছেন কিনা সেটা আমি জানি না। রেডিও পিকিং-এ দুইজন বাংলাদেশী সাংবাদিক কাজ করেন ।
বইয়ের দোকানগুলোতে দেখা যায় সফল ব্যাবসায়ীদের জীবনী, সেখানে শোভা পায় না বিপ্লবের পুস্তিকা, মাও সে তুং-এর লাল বই এখন দুষ্প্রাপ্য, বিদেশী পর্যটকরা বেশ উচ্চমূল্যে স্যুভেনির হিসাবে কিনে নিয়ে যায়।