…”এর কারণ কী? মানুষ এখন বাংলাদেশের ছবি দেখতে সিনেমা হলে আসে না। আর নায়ক মাত্র একজন। শাকিবের ছবি বছরে আসে কয়টা? তাহলে আমরা সারা বছর সিনেমা হলগুলো বাঁচাব কী করে? যাঁরা বলছেন যে অনেক লোক বেকার হয়ে যাবে, তাঁদের বলব, আপনারা ভালো ছবি বানান। আপনারা ভালো ছবি না বানালে দর্শক সিনেমা হলে যাবে না। তখন এর দায় আমরা নেব কেন?”
সাইফুল ইসলাম চৌধুরী, প্রদর্শক।
সূত্র: প্রথম আলো
… কেউ কি একবার খোঁজ করে দেখেছেন যে কলকাতার রুগ্ণ চলচ্চিত্রশিল্প কীভাবে আবার ভালো জায়গায় চলে গেল? যখনই মুম্বাইয়ের ছবির মানের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় গেলেন তাঁরা, মুম্বাইয়ের প্রযোজকেরাও কলকাতায় ছবি বানালেন। ওদের সিনেমা হলগুলোর পরিবেশও ভালো হয়ে গেল। এখন বাংলা ছবি সেখানে মুম্বাইয়ের ছবির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে। আমি মনে করি, এ দেশে ভারতীয় ছবি প্রদর্শিত হলে আমাদের ছবির মানও ভালো হবে। এখানে প্রতিযোগিতা হবে এবং তখন অনেক উন্নত মানের বাংলা ছবি উপহার পাব আমরা।…আজকে অনেকেই বলছেন যে আমরা যাঁরা ভারতীয় ছবি প্রদর্শন করব, তাঁদের নাকি বাংলাদেশের ছবি দেওয়া হবে না। ঠিক আছে, মধুমিতা, অভিসার সিনেমা হলকে বাদ দিয়ে যদি তাঁরা ছবি চালাতে চান, চালাবেন। আমি তখন ইংরেজি ছবি চালাব। তারপর একসময় সরকারকে চিঠি দিয়ে সিনেমা হল বন্ধ করে দেব।
ইফতেখার উদ্দীন নওশাদ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, মধুমিতা।
সূত্র: প্রথম আলো
…আমরাই এ দেশের চলচ্চিত্রশিল্পকে এত দূর নিয়ে এসেছি। এ দেশে সিনেমা হল-মালিকেরাই ছবি বানিয়েছেন এবং একটার পর একটা ছবি করে এই শিল্পের সবাইকে পরিচিত করে তুলেছেন। যখন আমরা ছবি প্রযোজনা করলাম, তখনই এ দেশের চলচ্চিত্রশিল্প একটি রুগ্ণ শিল্পে রূপ নিল। আমরা সরে গেলাম। কারণ, দেখলাম যে এখানে ছবি বানানোর মতো অবস্থা নেই। আমরা সিনেমা হল-মালিকেরা, যাঁরা সিনেমাকে ভালোবেসে এই সিনেমা হল রেখেছি, তাদের এ জন্য পুরস্কৃত করা উচিত। কেননা, এখন যদি কোনো ডেভেলপারকে আমরা বলি যে আমাদের জায়গাটি নিন, তাহলে এক কোটি থেকে ১৫০ কোটি টাকা পাব। আর একটি সিনেমা চালিয়ে বছরে কত টাকা পাব আমরা?… আজকে বাংলাদেশের ছবির প্রযোজকেরা লোকসান দিচ্ছেন, আর তাঁরা আমাদেরও লোকসান দিয়ে প্রেক্ষাগৃহ চালাতে বলছেন। কিন্তু এভাবে কত দিন?
কে এম আর মঞ্জুর, সভাপতি, চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতি
সূত্র: প্রথম আলো
সিনেমা হলগুলো বন্ধ করার ক্ষেত্রে হল মালিকদের বক্তব্যগুলোকে উপেক্ষা করা ঠিক হবে না। আমাদের অনেকেই তো নিজেদের পারিবারিক ঐতিহ্যের বসতভিটা দিয়ে দিচ্ছি ডেভেলপার কোম্পানিগুলোকে অর্থনৈতিক সচ্ছলতার উদ্দেশ্যে। সিনেমার হলের মালিকদের দোষ দিই কীভাবে? তাঁদের কী অপরাধ? আমরা কি আদৌ তাঁদের হলগুলোতে যাই? একদিকে চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির দুরাবস্থা, অন্যদিকে ক্রমবর্ধমান অর্থনেতিক চাপ — কী করবেন তাঁরা? তাঁদের অবস্থা না ভেবেই দোষারোপ করে বসলাম — এটা বোধ হয় ঠিক হল না। তাঁরা নিশ্চয় আমাদের বর্তমান চলচ্চিত্র সংস্কৃতির `সিন্দাবাদের ভূত’টিকে সারা জীবন কাঁধে নিয়ে বয়ে বেড়াবেন না? একসময় এই সিনেমা হলের মালিকেরাই তো সেই রুপালি পর্দার জগৎকে আমাদের কাছে নিয়ে এসেছিলেন তাঁদের সেই সময়কার সাংস্কৃতিক মনন বা ভাবনা — তাঁদের গার্মেন্টস বা তামাক-বিড়ি ফ্যাক্টরি না দিয়ে সিনেমা হল বানাতে উৎসাহিত করেছিল। সেই হল মালিকদের তৎকালীন রুচি বা মান যাই হোক না কেন, এখন হয়তো তাঁরা পরিবারের পরবর্তী প্রজন্মের কাছ থেকে তাচ্ছিল্য সইছেন — বিশাল কোন ফ্যাক্টরি না করে কেন খামাখা সিনেমা হল বানাতে গেলেন। হয়তো তখন লাভের মুখ দেখেছিলেন কিন্তু পরে তো গলায় মাছের কাঁটার মতো বিঁধে গেল। তাঁদের এখনকার প্রজন্ম তাই বড় বড় ডেপেলপার আর বিল্ডার্স কোম্পানির কারণে এ যাত্রা রক্ষা পেতে যাচ্ছেন। সিনেমা জগতের বর্তমান হালের তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে, ইচ্ছা থাকলেও হয়তো কলকাতার মতো বিল্ডারদের মাল্টিপ্লেক্স রাখার শর্ত দিতে পারছেন না।
সিনেমা হল বন্ধের বিষয়ে ভালো ছবির অভাবকেই দায়ী করা হয়। কিন্তু ভালো ছবি তো ১৯৮৫ সালের পর থেকেই ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। পরে হয়তো পরিস্থিতি আরও মারাত্মক আকার ধারণ করেছে । কিন্তু সিনেমা হলে চলার মতো ছবি নিশ্চয় তৈরি হয়েছিল। মধ্যবিত্ত জনগণ নব্বই সালের পরে সিনেমা হল বিমুখ হতে শুরু করল। কিন্তু পরবর্তী এতোগুলো বছর তাহলে হলগুলো টিকে থাকলো কীভাবে? সাধারণভাবে আমরা বলছি — রিকশাওয়ালা, শ্রমিক, বস্তিবাসী ইত্যাদি শ্রেণির জন্য ছবি বানানা হয়েছে। তারা তাহলে ছবিগুলো দেখেছে। সাথে কাটপিস, সেক্স ভায়োলেন্স, নাচ গান (হোক না ভালগার) এই সব উপাদান। শহরে দিনমজুর, শ্রমিক, রিকশাওয়ালা শ্রেণিরও অভাব নেই এখনো। তাহলে হলের ব্যবসা তো রমরমা থাকার কথা। হয়তো ছিলও বেশ কিছুদিন। হল মালিকরা ভেবেছেন, এভাবেই হয়তো পুষিয়ে নেয়া যাবে। কিন্তু আর কত? পৃথিবী তো আর আগের মতো নেই। শ্রমজীবী মানুষের আয় দিয়ে পরিবারের জন্য ডাল-ভাতের যোগান দিতেই নাভিশ্বাস, ভালগারিটি উপভোগ করার সুযোগ কোথায়? বিনোদনের নানা মাত্রা যুক্ত হচ্ছে প্রতিদিন। ফলে, বেকায়দায় পড়ে গেল হলগুলো। পয়সাওয়ালারা তো নাই, গরীবরাও হারিযে যাচ্ছে। তরুণ ছাত্র সমাজ ও বিদগ্ধ বোদ্ধারা সিনেমা হলে যায় না। আমাদের মতো ছোটবেলায় স্কুল ফাঁকি দিয়ে ‘একটি টিকিটে দুই ছবি’ দেখার মানসিকতা নাই এখনকার সাইবার কিশোরদের — অতঃপর তালা ঝুলাই।
প্রেক্ষাগৃহই সেই বাজার, যেখানে চলচ্চিত্র বিক্রি হয়ে থাকে। তাই একের পর এক প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ হয়ে প্রদর্শন ও পরিবেশনা-ব্যবস্থা যেমন আজকে ভেঙে পড়েছে, সেভাবে এই শিল্পও একদিন বিলীন হয়ে যাবে। প্রেক্ষাগৃহ এ শিল্পের সেই অংশ, যার সঙ্গে জনগণের পাশাপাশি সরকারও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই চলচ্চিত্রশিল্পকে বাঁচাতে হলে আগে প্রেক্ষাগৃহকে বাঁচাতে হবে।
চলচ্চিত্রের চালচিত্র: বাংলাদেশ
ক্যাথরিন মাসুদ | তারিখ: ২৮-১০-২০১১
বর্তমান অবস্থায় সিনেমাকে পুঁজি করে সিনেমা হলগুলোর টিকে থাকার সম্ভাবনা নেই। ভারতীয় চলচ্চিত্র দিয়ে টিকিয়ে রাখার বিষয়টা স্থায়ী সমাধান নয়। সমস্যাটা যতটা না চলচ্চিত্র জগতের ততটা আসলে সামগ্রিক সংস্কৃতি ও শিল্প জগতের। সাধারনত আমরা ধরে নেই, চলচ্চিত্র সব শিল্পের একটি স্বকীয় সম্মিলন। সাহিত্য, চিত্রকলা, নাটক, সঙ্গীত, নৃত্য – বর্তমানে ঠিক কোন শিল্প মাধ্যমটির উপর পূর্ণভাবে নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করা সম্ভব আমাদের প্রজন্মের, একমাত্র টিভি বা ফটোগ্রাফি ছাড়া ? দেশে প্রতিষ্ঠিত শিল্পচর্চার সকলকেই অন্য কোন পেশার (যথা শিক্ষকতা, চাকরী, ব্যবসা, ডিজাইনার, আর্ট কেউরেটর, লেখক ইত্যাদি) সাথে সম্পৃক্ত থাকতে হয়। তাহলে চলচ্চিত্র নিয়ে বেঁচে থাকার কথা আসে কি করে ? বাণিজ্যিক কিংবা বিকল্প ধারার বলি – সিনেমাজগত এখন খুব ভালো স্থান নয় জীবিকা নির্বাহের।
আমাদের দেশের প্রথম শ্রেণির সুরকার ছিলেন ‘সত্য সাহা’ কিংবা ‘খান আতাউর রহমান’। তারা যে কেবল চলচ্চিত্র জগতের সাথে সম্পৃক্ত থাকার কারবনে খ্যাতনামা হয়েছেন তা নয়, বরংচ চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গিত ক্ষেত্র তাঁদের কারনেও যথেষ্ট লাভবান হয়েছিল। ভারতে চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিকে একজন রবি শঙ্কর, উস্তাদ বিলায়েত খাঁ কিংবা জাকির হুসেইন, শিব শঙ্কর, হরি প্রসাদ চৌরাসিয়া সুরের মাধ্যমে আমাদের কাছে এখনো মধুর করে রেখেছে। সেই ধারাবাহিকতায় এখনকার এ আর রহমান’রা আছেন। আমরা চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিকে প্রানবন্ত করার জন্য নতুন কাউকে তৈরি করতে পারছি না। গীতিকার, শিল্পীদের কথাও একইভাবে বলতে হয়। সাবিনা ইয়াসমিন, রুনা লায়লা, এমনকি নতুন একজন এন্দ্রু কিশোর কি আমরা এখন পাচ্ছি ? বিশ বছর আগেও অনেক সুরকার, গীতিকার, শিল্পী চলচ্চিত্র জগতে ছিলেন, তাঁরা হয়তো শারীরিকভাবে আমাদের মাঝে আছেন এখনো, কিন্তু তাদের অবদানটাকে সামান্য স্বীকৃতি দিয়ে আমরা ঐতিহ্যের অনুধাবন করতে পারিনি। ফলে তারাও পরবর্তী প্রুজন্মকে উৎসাহিত করতে পারেননি দর্শকদের কাছে আসতে। নায়ক রাজ রাজ্জাক একটু চেষ্টা করেছিলেন। ফলে, বাপ্পারাজকে কিছু ছবিতে অভিনয় করতে আমরা দেখেছি। কিন্তু খুব বেশি কেউ আসেননি। অথচ ভারতে রাজ কাপুর পরিবারের তৃতীয় প্রজন্ম এখন চলচ্চিত্র জগতের শিরোনাম।
আমরা সিনেমা নিয়ে ব্যাপক হতাশ। টিভি নিউজে, পত্র-পত্রিকায় বর্তমানে খুব গুরুত্বপূর্ণ শিরোনাম এই ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংকট’। মনে হবে, আমাদের বাকি সব শিল্প ও সংস্কৃতি ঠিকঠাক আছে বেশ, সংকট কেবল সিনেমায় । আমাদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে সংস্কৃতির সংকট কি দারুনভাবে লক্ষনীয় নয় ? আমি একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীর সংস্কৃতি চর্চার কথা বলছিনা। বিশাল একুশে বইমেলা, নাট্য উৎসব, চলচ্চিত্র উৎসব, জেলায় জেলায় বৈশাখী মেলা, বিজয়মেলা আর ক্লোজআপ ওয়ান করে কি আমাদের সংস্কৃতি চর্চা শেষ ? খুব গভীর মনোযোগ দিয়ে চারপাশে যদি তাকাই, তাহলে কি দেখি আমরা ? আমাদের সন্তানরা কি গান শিখছে সুরকার হবে বলে ? নাকি নৃত্য শিখছে নৃত্যশিল্পী হয়ে ক্যারিয়ার করবে ? অথচ অনেক উঁচুমানের করিওগ্রাফার প্রয়োজন একটি ইন্ডাস্ট্রীতে । নতুন শব্দ যোগ হয়েছে পৃথিবীতে, যেমন ইন্ডিপেন্ডেন্ট, অল্টরনাটিভ, ফ্রি-ল্যান্স ইত্যাদি, কিন্তু প্যাশন বা হবি দিয়ে হয়তো এমেচার ভালো শিল্পী হওয়া যায়, তাদের দিয়ে ইন্ডাস্ট্রী চালানো যায় না। ইন্ডাস্ট্রী একটি শক্তিশালী ক্ষেত্র, এখানে প্রতিদিন শিল্পজগতের প্রফেশনাল আর দক্ষতা সম্পন্ন মানুষের সম্মিলন ঘটতে হয়।
সংস্কৃতি, শিল্প, সমাজ একই সুত্রে বাঁধা। কিন্তু আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত মুসলিম সমাজ এখন ক্লাসিকাল শিল্প চর্চা থেকে দূরে চলে গেছে (অন্যান্য ধর্মাবলম্বী যারা, তাদের কেউ কেউ ঐতিহ্যের কারনে এখনো ব্যাক্তিগত বা পারিবারিক পর্যায়ে সেই চর্চাকে ধরে রেখেছেন, কিন্তু পেশা বা জীবিকা’র উপর নির্ভর না করে)। একটা সময় আমাদের সমাজের মেয়েদের একটু গান জানা বা ছবি আঁকা’কে গুণ হিসেবে দেখা দেখা হতো। সনাতন সংস্কৃতির বিবর্তনে আমরা সুর নিয়ে, শিল্প নিয়ে সামাজিক ভাবে উৎসাহী ছিলাম। কিন্তু আজকে গান শোনা মেয়ের কোন দরকার নেই। বিবাহিত হওয়ার পর এই গান বাজনার চর্চা তো রীতিমত নিষিদ্ধ। ছেলেদের সুর নিয়ে উৎসাহ পরিবারে বিরক্তি উৎপাদন কেবল। এ ধরনের ছেলের সাথে প্রেম করতেও সমস্যা। ছবি আঁকা শিল্পী যদি কর্মক্ষেত্রে গ্রাফিক আর্টিস্ট হতে না পারে তাহলে ভাত যোগানো মুশকিল। তাই এখন সবাই কেবলি ভোক্তা হয়ে থাকতে চায়। । তাঁরা সব গ্রহন করবে, কিন্তু সংযোজন করার জন্য নিজেদের বা নিজেদের সন্তানদের বলি দেবে না। তাঁরা বাখ, চাইকভস্কি শুনবে কিন্তু তাদের মতো হতে চায় না। তাঁরা স্তিভ জব-এর মতো ধনী হতে চায় কিন্তু ‘এপ্যল’ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার সংগ্রাম তাদের পছন্দ নয়। তাঁরা একজন কুরোসওয়া কি করে হতে হয় জানে না, এমনকি একজন জেমস ক্যামেরন হওয়ার রাস্তায় খাটতে রাজি নন। এই অদ্ভুত সংস্কৃতির নতুন প্রজন্মকে নিয়ে কি আশাবাদী হবে মানুষ ?
আমাদের চারপাশে খুব শক্তিশালী একটি সংস্কৃতিবিহীন ধনিক শ্রেণি গড়ে উঠে ইতিমধ্যে মহীরুহু হয়ে গেছে। তাদের হাতে ব্যবসা-বাণিজ্য সব। তাঁরা যখন শিল্প সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক বা স্পন্সর হন, তখন মূল উদ্দেশ্য থাকে প্রচার ও বিনোদনমুখি। একটা চলচ্চিত্র উৎসব আর ব্যান্ড কনসার্ট – এর পার্থক্যই তাঁরা আমলে নিতে রাজি নয়। আমরা বার বার খালি পৃষ্ঠপোষকতার জন্য সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকি। ভালো কিছু যা হবে তার দায়িতত্ব সরকারকে নিতে হবে। আর্ট-কালচার করতে লোকসান গুনবে সরকার আর মউজ-মাস্তি’র লাভ গুনবে ব্যাক্তি মালিকানাধিন বা কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো। সরকারি অনুদানকে আমরা শিল্প সৃষ্টির পরীক্ষা নিরীক্ষা’র জন্য রাখি, দর্শক তৈরির জন্য নয়। ফলে সরকারও একবার টাকা দিয়ে পরবর্তীতে টেনশনে পড়ে যায়। তবুও আমাদের বলতে ইচ্ছে হয়, সরকারের টাকা তো জনগনের টাকা, জনগনের টাকায় শিল্প হলে অসুবিধা কি ? কয়েকদিন আগে চলচ্চিত্র নির্মাণে উৎসাহী এক তরুন্ণী আমাকে বললেন,’এতো টাকা দিয়ে এই গরিব দেশে কয়েকজন দর্শকের জন্য আর বিদেশী পুরস্কার-খ্যাতি পাওয়ার জন্য সিনেমা বানানো -এটা এক ধরনের বিলাসিতা মনে হয়।’ আমি একটু থমকে গেলাম শুনে।
কিন্তু এটা সত্যি, আমাদের সাধারন মধ্যবিত্তের দৈনন্দিন সংস্কৃতিতে এখন শিল্প চর্চার স্থান নেই। যাদের আছে তাঁরা পারিবারিক ভাবে, ঐতিহ্যগতভাবে বা নেহাত শখের বশে ধরে রেখেছেন। জাতীয় সংস্কৃতিতে অবদান রাখার মতো সামর্থ্য বা যোগ্যতা বেশির ভাগ মানুষের নেই। পাকিস্তানের কাওয়ালি পরিবারগুলো তাদের সঙ্গীত ধারাকে যেকোনো উপায়ে টিকিয়ে রেখেছেন। আমাদের সংস্কৃতির শিরা উপশিরায় নিয়ত পরিবর্তন চলছে। যেখানে শিল্পচর্চার চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সামাজিকভাবে, অর্থনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া। আর তাই, নতুন কোন আইকন আমরা পাই না শিল্পের বা সন্কংস্কৃতির কোন শাখায়। এখনো যতটুকু টিকে আছে পুরনোরা আছেন বলেই দাঁড়িয়ে আছে। আগের প্রজন্ম শেষ হলেই আসল চিত্রটি আমাদের কাছে ধরা পড়বে। সাংস্কৃতিক সংকট-এর অবস্থাটি অন্য সকল শিল্প মাধ্যমে পরে ধরা পড়বে। কারন, অন্য শিল্প ক্ষেত্রে ব্যক্তি তার একক বা সমষ্টিগত কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ঠেকিয়ে রাখতে পারেন। কিন্তু চলচ্চিত্র বা চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রী-কে এভাবে কারো পক্ষে ধরে রাখা সম্ভব না। স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতাগন কিছুটা সফল হলেও, চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রীর পক্ষে এই পতন রোধ অসম্ভব। আর তাই-ই আমরা দেখছি আজকের বাস্তবতায়।
বড় শহরগুলোতে ক্রমবর্ধমান নগরায়নে সারা দেশ থেকে লোকজন শহরে আসছে জীবিকার উদ্দেশে। এদের মধ্যে অনেকে নগরীতে বিভিন্ন উপায়ে নিজেদের অবস্থান করে নিচ্ছেন। জীবিকার উদ্দেশে আসা এইসব মানুষের নাগরিক অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক সংগ্রামের ভেতর দিয়ে নগরীতে প্রবেশ করছে ধর্মভিত্তিক মানসিকতা। আমি স্পষ্ট করি — আমাদের উঠতি মধ্যবিত্ত সমাজ এখন অনেক বেশি ধর্মসচেতন। এটি কোন দেশের সামাজিক বা সাংস্কৃতিক উন্নয়নের জন্য ভালো কিছু নয়। এর সাথে যুক্ত শিক্ষার কৌলীন্য। সাধারন শিক্ষিত মানুষের নাগরিক আচরনে বোঝা যায়, তাদের শিক্ষার মান কত টুকু। একজন উচ্চপদস্থ সরকারী আমলা বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্পোরেট অফিসার বা মুদির দোকান -কোন একটি পরিস্থিতিতে তাদের অনেকের আচরনে বোঝা মুশকিল কার সংস্কৃতি কোন পর্যায়ে। সবাই আমরা অবলীলায় কর্পোরেট যুগে কেবল ধনতান্ত্রিক বাবস্থাপনাকে দোষারোপ করে, ব্যস্ততার ভান দেখিয়ে নিজেদেরকে গা বাঁচিয়ে দিচ্ছি। এটা ঠিক যে ধনতান্ত্রিক বাবস্থাপনা আমাদের টাকার পেছনে ছুটতে বলল, আমরা তাই ছুটছি। আমরা টাকার পিছনে ছুটতে গিয়ে ধর্মকে হাতে রাখছি, প্রতিদিন সুবিধা অনুযায়ী ধার্মিক হওয়ার মাত্রা বাড়াচ্ছি, কিন্তু সংস্কৃতিকে ধরে রাখতে চাইছিনা। বরঞ্চ ইহকাল-পরকাল জনিত চিন্তাভাবনায় পড়ে সংস্কৃতি নামের বেয়াড়া (!) বিষয়টি যাতে নিজেদের পরবর্তী প্রজন্মকেও ঝামেলায় ফেলতে না পারে, তার ব্যবস্থা করে রাখছি । আবার অন্যদিকে, বাণিজ্যিক বা কর্পোরেট অংশের এই বিনোদনমুখি (নাচে-গানে ভরপুর) সংস্কৃতির চর্চার খুবই প্রয়োজন সাধারন মধ্যবিত্তকে ভোক্তা বানাতে। তাদের উৎসাহে মেলা, উৎসব, পুজা পার্বণ, ঈদ, ভ্যালেন্টাইনস ডে – উদযাপনে কিছুই বাদ যাচ্ছেনা। ফলে আমাদের অবস্থা এখন অদ্ভুত এক ত্রিমাত্রিক জটিল সমীকরণে বন্দী। যারা বিনোদন দিয়ে থাকেন তাদেরও লাক্স সাবানের মতোই একধরনের পন্য মনে করি। দেখা শেষ, বিনোদন শেষ, পায়সা শেষ – এবার পুনরায় জায়-নামাজে দাড়িয়ে নিয়ত বেঁধে ফেল। এ থেকে মুক্তির উপায় আমার জানা নেই। হয়তো থাকতে পারে। তবে যে কঠোর সংগ্রাম তার প্রয়োজন, তা করার মানসিকতা আমাদের আছে বলে মনে হয়না।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তা হল — সংস্কৃতির মূল্যায়নের সাথে সম্পৃক্ত শিল্পীর বা শিল্পচর্চাকারীদের মূল্যায়ন। শিল্পীরা আমাদের সমাজে একটু ব্যতিক্রম। তাদের সবকিছু আমাদের সাধারন জীবনযাপনের বাইরে। এরপরও নাট্যজন, চিত্রকর, আলোকচিত্রশিল্পী, সাহিত্যজন – এঁদের অবস্থান একটু ভাল হলেও, আমাদের সমাজে একজন চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট শিল্পী-নির্মাতা-কলাকুশলীদের অবস্থান ভয়াবহ। বিশেষ করে যাদের অবস্থান মধ্যবিত্ত বা তার নিচের দিকে। আমরা তাদের অভিনয়, নাচগান সবই পর্দায় চোখ কপালে তুলে উপভোগ করি, কিন্তু তাকে নিজের পরিবারের সাথে যুক্ত করতে চাই না। তাদের প্রতি আমাদের কোন শ্রদ্ধা কাজ করে না। বরংচ তাদের জীবনের যেকোনো দুঃখজনক পরিনাম জেনে বাথিত না হয়ে বরং তার সেলেব্রিটি জীবনের ‘উচিত শিক্ষা’ হয়েছে বলে মনে করি। আমি বার বার বলছি, সাধারন মধ্যবিত্ত সংস্কৃতির মানসিকতার কথা। এতে অদ্ভুত কিছু সমস্যা তৈরি হচ্ছে। মধ্যবিত্ত সমাজ থেকে নারীপুরুষ যারাই বিনোদনের জগতে পা রাখেন, বেশিরভাগেরই ফিরে আসার সুযোগ থাকেনা। তাঁরা নিজেদের স্বপ্নের জগতের কাল্পনিক মায়া জালে আটকে পড়েন, কিছুদিন প্রাণবন্তও জীবন কাতালেও অচিরেই ঝরে পড়েন শুকনো পাতার মতোই। আমরা মানতে চাইনা, তাদেরও আমাদের মতো দুঃখ কষ্ট আছে, তারাও আমাদের মতো আটপৌরে ছিমছাম জীবনে থাকতে পারত। কিন্তু তাঁরা আমাদের প্রতিদিন এর সুখদুঃখের মধ্যে বিনোদন দিতে শিল্পী হয়েছেন, অমানুষিক পরিশ্রম করে শিল্প তৈরি করছেন। বিনিময়ে খ্যাতি আর নাম পেয়েছেন হয়তো অনেক, কিন্তু তাদের জীবনে অপ্রাপ্তিও আছে অনেক- যা আমরা দেখতে পাই না। আমাদের সমাজে চলচ্চিত্র তথা শিল্পের সাথে যুক্ত মানুষগুলোর প্রতি এই সম্মানবোধ সামাজিকভাবে তৈরি হতে হবে।
আমার উপলব্ধি হয়তো সবাইকে আশাহত করতে পারে, কিন্তু এর মধ্যে আমিও আশাবাদী হয়ে উঠেছি নতুন করে। এটা ঠিক আজ অনেকের মনোযোগ সিনেমার সংস্কৃতির দিকে। চলচ্চিত্র সংস্কৃতি খুবই শক্তিশালী বিষয়। সিনেমা মানেই একটি নতুন বাস্তবতা – কখনো তা ম্যাজিক, ফ্যান্টাসি, আবার কখনো একেবারে নিখাদ বাস্তবতা। আমাদের চারপাশের জীবনের মতোই সিনেমার ঘটনাকে বিশ্বাস করে চরিত্রগুলোর সুখদুঃখে কাঁদতে থাকি, আনন্দ পাই। খারাপকে পরাজিত দেখতে ভালো লাগে, সুন্দরকে ভালবাসতে, ভালোকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে জয়লাভ করতে দেখতে আমাদের ভালো লাগে। সত্যি বা কাল্পনিক- যে ঘটনাই হোক না কেন, আমাদের মনের গভীরে দাগ কেটে যায়। সিনেমাকে ভালবাসতে চাইলে, সিনেমাকে বিশ্বাস করতে হয়। সিনেমার মানুষগুলোকে আপন করতে হবে। সিনেমাকে ভালবাসার একটি সত্য আমাদের পাশের দেশে আছে। ভাষা সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। ভারতে অনেক জাতির, অনেক ভাষার বিভাজন থাকলেও জাতীয় ভাষা হিসেবে হিন্দি’কে শক্তিশালীভাবে প্রতিনিধিত্ব করছে বোম্বের চলচ্চিত্র শিল্প। ফলে তার মাধ্যমে ভারতীয় সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়ছে সারা ভারতে, সারা পৃথিবীতে । এই জাতীয়তাবাদী চিন্তার বিপক্ষে অনেক মতামত থাকতে পারে। কিন্তু ভারতীও চলচ্চিত্র সফল ভাবে এই জাতীয়তাবাদ ধারন করে রেখেছে।
আমাদের সংস্কৃতিতে সিনেমাকে আপন করে নিতে হবে। কলাকুশলীদের নিয়ে আমাদের যে মানসিকতা তার পরিবর্তন দরকার। শিল্পীদের যথার্থ মর্যাদা ও সম্মানী আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। সমাজের সর্বস্তরে সিনেমা নিয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন। জাতীয় শিক্ষা কার্যক্রম ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চলচ্চিত্র শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করতে হবে। আমরা শিক্ষিত সমাজ সিনেমাকে যে বোদ্ধা ও সংস্কৃতিপ্রেমীদের মিলনায়তনে নিয়ে এসেছি, তা থেকে মুক্ত করে সিনেমাকে আবার সর্বসাধারণের কাছে নিয়ে যেতে হবে। ‘জনপ্রিয়’ বা ‘ধ্রুপদী’ ধারা নিয়ে অনেক গবেষণা করতে হবে। প্রোফেশনাল নির্মাতাদের অবশ্যই তাঁদের মেধা এবং শিল্পীসত্তার সর্বস্ব দিয়ে জনগণের জন্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে হবে। অনেকে ভুল বুঝতে পারেন, তাই বলি — জনগণের জন্য সিনেমা বললে বাণিজ্যিক ছবি বোঝায় না। আবার কেবল কম্যুনিস্ট ধারার চলচ্চিত্রও বোঝায় না। মানুষ যাতে সিনেমাকে আপন করে নিতে পারে, সিনেমার সাথে তার অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎকে খুঁজে পায়। সিনেমা হল মালিকরা যাতে টিকিট বিক্রি করে হল চালানোর সুযোগ পান। পপুলার বা জনপ্রিয় ধারার সিনেমা যাতে তার নিজস্ব শিল্পসত্তা বজায় রেখে সর্বস্তরে মানুষের হৃদয়ে প্রবেশ করে। পুরো প্রক্রিয়াটা শুরু হয়ে রাতারাতি চিত্র বদলে দেবে তা নয়, কিন্তু এখনি সেই শ্রেষ্ঠ সময় শুরু হওয়ার।
কিছুদিন আগে স্টার সিনেপ্লেক্স-এ শত শত শিশুদের মাঝে আনিমেশন ছবি ‘কুংফু পান্ডা’ দেখতে গিয়ে মনে হল — সিনেমার নতুন দর্শক আবার তৈরি হচ্ছে। তারা সবাই চোখ বড় বড় করে বিশাল পর্দায় শুনছে দার্শনিক কচ্ছপ বুড়োটা সেই পাণ্ডা’কে বলছে:
You are too concerned with what was, and what will be. There is a saying. Yesterday is history, tomorrow is a mystery, but today is a gift. That is why it is called the present.
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৪ comments
Nadia Jasmine Rahman - ১১ এপ্রিল ২০১২ (১:৩৩ পূর্বাহ্ণ)
খুব ভাল লাগলো। সত্যি কথা গুলো লেখার জন্য। এই কথাগুলো যারা জানে, তারাও না জানার ভান করে। অন্য কাউকে বলতে ভয় পায়, যদি তার জাত নেমে যায়! আরো লিখেন। এরকম লেখা আমাদের খুব দরকার।
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর - ১১ এপ্রিল ২০১২ (৬:৩৯ পূর্বাহ্ণ)
অতি বিশ্লেষণধর্মী লেখা। প্রয়োজনীয় অনেক প্রসঙ্গই তাতে জায়গা পেয়েছে। সিনেমার বর্তমান অবস্থা, দর্শক, পরিবেশক, সিনেমাকর্মী ইত্যাদি সবার কথাই একেবারে গভীরভাবে উঠে এসেছে । এমনকি সমকালীন শহুরে সামাজিকবিন্যাস নিয়েও ভালো অবজার্ভেশন আছে । আছে সিনেমাকর্মীর আলাদা মনোকষ্টের কথাও।
সব মিলিয়ে একটা কার্যকর লেখা এটি।
রাসেলকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
রফিকুল আনোয়ার রাসেল - ১১ এপ্রিল ২০১২ (৩:১০ অপরাহ্ণ)
আপনাকেও ধন্যাবাদ জাহাঙ্গীর ভাই।
মোহাম্মদ মুনিম - ২৭ জুলাই ২০১২ (১২:৩২ পূর্বাহ্ণ)
আমি এফডিসিতে তৈরি বাংলা ছবি (মানে মূলধারার বাংলা ছবি) সর্বশেষ দেখেছি প্রায় পনের বছর আগে, ছবিটির নাম এবং নায়ক নায়িকা কে ছিলেন এখন কিছুই মনে নেই। শুধু মনে আছে ঘণ্টা তিনেকের ছবিটি শেষ পর্যন্ত দেখতে গিয়ে আমাকে (এবং হলের অন্যান্য দর্শকদের) কি পরিমাণ মানসিক কষ্টের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল। নিজের সাংস্কৃতিক মান অত্যন্ত উচ্চস্তরের, এমন দাবী করছি না, কিন্তু একজন ‘মোটা দাগের’ কর্মজীবী মানুষও এই ছবিতে কি বিনোদন খুঁজে পাবেন সেটাই আমি বুঝতে পারিনি। এই গত পনের বছরে এফডিসির ছবির মান উন্নত হয়েছে এমন কোন খবর পাইনি। এই মানের ছবি চালিয়ে ১২০০ কেন, ১০০ টি সিনেমা হলও খোলা রাখা দুরূহ। একটি সিনেমা হল খোলা থাকবে না বন্ধ হয়ে যাবে সেটা অবশ্য দর্শক সংখ্যা ছাড়াও অন্যান্য ফ্যাক্টর দ্বারাও নিয়ন্ত্রিত হয়। সিনেমা হলের মালিক যদি দেখেন সুপার মার্কেট ডেভেলপারকে হল বিক্রি করে তিনি ১০ বছর আগে যে দাম পেতেন, তার তিন গুন পাবেন, তবে প্রতিটি শো হাউস ফুল হলেও তার কাছে হল বিক্রি করাটাই লাভজনক মনে হতে পারে।
ষাট সত্তরের দশকে বাংলাদেশের অধিকাংশ মধ্যবিত্ত পরিবার প্রতি মাসে এক দুবার ‘বই’ দেখতে যেতেন। সেই ‘বই’ দেখা আশির দশক থেকেই কমতে শুরু করেছে এবং এখন শূন্যের কোঠায়। কমে যাওয়াটা হয়তো টিভির কারণেই হয়েছে। আশির দশকেই বাংলাদেশে টিভিতে জনপ্রিয় ধারাবাহিক নাটকগুলোর প্রচার শুরু হয়, সেই সাথে সাথে টিভির দাম কমতে শুরু করে। বাড়িতে বসে সপ্তাহে একবার ‘সকাল সন্ধ্যা’ বা ‘এইসব দিনরাত্রি’ ক্রমশ শাবানা আলমগীরকে হারিয়ে দিতে শুরু করে। এর পরে মধ্যবিত্ত টিভিতে ভারতীয় চ্যানেল পেলেন, টানাটানির সংসারেও ক্যাবল নেওয়া চাইই চাই, এসব ছেড়ে পানসে বাংলা ছবি কে দেখে। পাড়ার খালাম্মাদের কয়েকজন মিলে অলস দুপুরে রাজ্জাক ববিতার ‘বই’ দেখতে যাওয়ার অভ্যাস চিরতরে বিদায় নিলো।
খালাম্মাদের হারিয়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের টার্গেট অডিয়েন্স হয়ে গেল নিম্নবিত্ত। ছবির থিম একই থাকল, বেড়ে গেল স্থূলতা আর ভাঁড়ামি। মরহুম হুমায়ুন ফরিদী কিছু কাঁচা টাকার বিনিময়ে দীর্ঘ দেড় দশক বাংলা সিনেমা টেনে নিয়ে গেলেন, টেনে নিয়ে গেলেন এমন এক জায়গায়, যখন তিন ঘণ্টা বসে বাংলা ছবি দেখা একটা অত্যাচারের পর্যায়ে চলে গেল, সিনেমা হলের সাথে সস্তা স্ট্রিপ ক্লাবের তেমন কোন পার্থক্য থাকলো না। ‘চম্পা ম্যাডাম’ শুটিংয়ে আসেন, একটু পরে ছবির হিরো। হিরো হিরোয়িন কেউই স্ক্রিপ্ট পড়েননি, পড়েননি কোন (জাঁ লুক) গদারীয় কারণে নয়, পড়েননি কারণ সহকারী পরিচালক তখন সবে সেদিনের স্ক্রিপ্ট লিখছেন। নায়ক নায়িকা দুজনেই মেকআপ গেটাপ নিয়ে এলেন, নায়কের পরনে তুন্দ্রা অঞ্চলের পোশাক, নায়িকাও পরেছেন সেরকম বিদঘুটে কোন পোশাক। দুজনেই স্ক্রিপ্টে চোখ বুলিয়েই সেটে চলে এলেন, সেটের আলোকসজ্জা দেখে বোঝার উপায় নেই সেটা সকাল না রাতের শট। মাঝে মাঝেই ক্যামেরার ফোকাস থাকছে না, তাতেও শট ওকে হয়ে যাচ্ছে। চূড়ান্ত অযত্ন আর অপেশাদারিত্ব নিয়ে এক একটি ছবি পর্দায় উঠে, দেখবে যখন রিকশাওয়ালা আর দিনমজুরেরাই, ছবিতে কয়টা ‘জায়গা মত’ শট আর অশ্লীল সংলাপ আছে, সেটাই বিবেচ্য, অন্য কিছু নয়।
বাংলাদেশে মুল ধারার চলচ্চিত্র, মানে এফডিসি কেন্দ্রিক চলচ্চিত্রশিল্প এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে, সেটাকে সুস্থ করে তোলা একেবারে অসম্ভব বলেই মনে হয়। এখন নিম্নবিত্তকে টানার ক্ষমতাও এফডিসি হারিয়ে ফেলেছে। তবে এফডিসির মৃত্যু মানেই বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের মৃত্যু নাও হতে পারে, ইমপ্রেস টেলিফিল্ম বছরে দু তিনটি করে ছবি বানিয়ে এখন পর্যন্ত প্রায় বিশটির মত ছবি নির্মাণ করেছে। এভাবে অন্যরাও এগিয়ে আসলে বিকল্পধারাটিই মূলধারা হয়ে উঠবে। ক্যাথেরীন মাসুদ যেটা বলেছেন, চলচ্চিত্র প্রদর্শনের জন্য মাল্টিপ্লেক্সের বিকল্প নেই। আমেরিকাতে সব মিলিয়ে ৬০০০ সিনেমা হল আছে (প্রায় সবকটাই মাল্টিপ্লেক্স)। যুক্তরাষ্ট্রের আয়তনের (বাংলাদেশের ৭০ গুন) সাথে তুলনা করলে বাংলাদেশে মোটামুটি ১০০টি মাল্টিপ্লেক্স থাকলেই যথেষ্ট। বাংলাদেশে বড় শহরতো মোটে দুটো, ঢাকা এবং চট্টগ্রাম, ঢাকা শহরে বিশটি, চট্টগ্রামে দশটি, জেলা শহরগুলোতে একটি দুটি করে মাল্টিপ্লেক্স। এখন উপজেলা শহরগুলোতে দুয়েকটা করে ছোট সিনেমা হল আছে। হিট ছবি আসলে মোটামুটি ব্যবসা চলে, না হলে মাসের পর মাস হল দর্শকশুন্য থাকে। উপজেলা শহরের স্বল্প সংখ্যক দর্শক দিয়ে সিনেমা হলের ব্যবসা একেবারেই sustainable নয়। পাঁচ-দশটি উপজেলা শহরের দর্শক যদি বছরে দশ বারও চল্লিশ মাইল দুরের জেলা শহরের মাল্টিপ্লেক্সে গিয়ে ছবি দেখে আসেন তবে মাল্টিপ্লেক্সের ব্যবসাও ভাল চলে, উপজেলার দর্শকদেরও নাগরিক জীবনে একটা নতুন মাত্রা আসে। মধ্যবিত্ত সে অর্থে আবার কখনোই হলে ফিরে আসবে না, সময়ের সাথে সাথে বাংলাদেশে সিনেমা দর্শকদের demographyও পালটে গেছে। বাংলাদেশে এখন লক্ষ লক্ষ কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণ তরুণী আছে, তরুণ পেশাজীবী আছে, রংবেরঙের মোবাইল ফোন কেনা আর রেস্টুরেন্টে খাওয়ার মত যথেষ্ট টাকাও তাদের হাতে আছে। মানসম্মত ছবি মাল্টিপ্লেক্সগুলোতে দেখানো হলে তাদেরও নিয়মিত প্রেক্ষাগৃহে ছবি দেখার অভ্যাস গড়ে উঠবে। প্যাকেজ নাটকের পরিচালক এবং অন্যান্য কর্মীরা কাজ করতে করতে ইতিমধ্যেই ছবি তৈরির মৌলিক দক্ষতা অর্জন করে ফেলেছেন। ফারুকীর (এবং তার কিছু কিছু মুরিদের) intellectuality না থাকুক, ঘণ্টা দুয়েকের ঝরঝরে ছবি তৈরি করার দক্ষতা অবশ্যই আছে। এদের হাত ধরেই ফিরে আসতে পারে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প।