আমাদের দেশে জাতীয় উদ্যোগে চলচ্চিত্র শিক্ষার কোন প্রাতিষ্ঠানিক কেন্দ্র নেই। কিন্তু চলচ্চিত্র শিক্ষা একেবারেই নেই বলা যাবে না। কিছু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে সরাসরি সাবজেক্ট হিসেবে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গনযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের কোর্স হিসেবে চলচ্চিত্র পড়ানো হয়। আবার চলচ্চিত্র ও চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের সাথে যুক্ত সংগঠনগুলোও নিয়মিত/অনিয়মিতভাবে চলচ্চিত্র নির্মানের কোর্স,ওয়ার্কশপ এবং সেমিনার-এর আয়োজন করে থাকে। তা সত্ত্বেও চলচ্চিত্রের শিক্ষার বিষয়টি আমাদের দেশে বরাবরই অনানুষ্ঠানিক এবং আবহেলিত। কোর্স বা অধ্যয়নের বিষয় হিসেবে চলচ্চিত্র কোন না কোনোভাবে অন্যান্য মাধ্যমগুলোর উপর নির্ভরশীল। যেমন টেলিভিশন মিডিয়া, গনমাধ্যাম ও সাংবাদিকতা কিংবা ভিস্যূয়াল আর্ট। চলচ্চিত্র শিক্ষা এদের উপর ভর করে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এগুতে থাকে। অথচ, চলচ্চিত্র বিষয়টি নিজেই অনেক বিশাল এবং বিস্তৃত। পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র শিক্ষার কেন্দ্রের সিলেবাসগুলো দেখলেই তা বোঝা যায়। ফলে, ভর করে বা নির্ভরশীল হয়ে ফিল্ম শেখা ছাত্রছাত্রীরা শেষপর্যন্ত আর ফিল্ম নিয়ে পড়ে থাকতে পারেন না। প্রচুর লোকজন টিভি-মিডিয়াতে চাকরী করছে , কাজ করছে। কেউ বা নিজের চেষ্টায় আর নিয়ন্ত্রিত সুযোগগুলোকে কাজে লাগিয়ে কিছু সার্থকতার সাথে এগিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু খুব কম মানুষই চলচ্চিত্র পরিমণ্ডলে নিজেকে সন্নিবিষ্ট রাখতে পারেন জীবিকা নির্বাহ করার নিমিত্তে । ফলে, সত্যিকার একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা তৈরী হতে পারা খুব কঠিন। আমাদের দেশে বলার মতো যে কয়েকজন চলচ্চিত্রকার আছেন এবং যারা নতুন ডিজিটাল চলচ্চিত্রের হাতে খড়ি নিয়ে পূর্নাঙ্গ চলচ্চিত্র নির্মান করে দেশে-বিদেশে প্রদর্শন করছে, তাদের আসলেই ধন্যাবাদ। কারন, এই দেশের মতো চলচ্চিত্রের অবক্ষয় সম্ভবত আর কোথাও হয়নি, যেখানে গত বিশবছর (২০০৭ সালের ১/১১ প্রেক্ষাপট বাদ দিয়ে) ধরে গনতান্ত্রিক দলগুলোই সরকার পরিচালনা করে আসছেন । কোন সামরিক জুন্তা বা দুর্ভিক্ষপীড়িত প্রেক্ষাপট ছিল না, অথচ স্বাভাবিক চলচ্চিত্রের পরিবেশের সাথে সাথে চলচ্চিত্র শিক্ষার প্রতি মানুষের উৎসাহ নষ্ট হয়ে গেল । ফলে, চলচ্চিত্র একাডেমিক লোকজন ও শিক্ষকও তৈরী হলো না। বিকল্প ধারা বা মুক্ত পর্যায়ের ওয়ার্কশপগুলিতে চলচ্চিত্রের যে তত্ত্বগত ও কারিগরী শিক্ষা দেয়া হয় তাও অনেকাংশে অপরিকল্পিত। বিভিন্ন চলচ্চিত্র সংসদ, ফিল্ম সেন্টার, বা ফিল্ম স্কুলগুলোতে বিভিন্ন কোর্সের মাধ্যমে যে চলচ্চিত্র শেখানো ও পড়ানো হয় তা পর্যাপ্ত নয়। এ ক্ষেত্রে তাদের সীমাবদ্ধতা অপরিসীম। যেসব নির্মাতা, কলা – কুশলী ক্লাস যেন তাতে নিজেদের অভিজ্ঞতার আলোকপাত থাকে বেশি , মূল শিক্ষার দিকটি থাকে উপেক্ষিত। কোন কোন ক্ষেত্রে তারাই ফিল্মের ক্লাস নিচ্ছেন যাদের সর্বোচ্চ দৌড় টেলিভিশনের নাটক পর্যন্তই। হয়তো তিনি একজন বড় বিজ্ঞাপন নির্মাতা, সেলিব্রিটি তো বটেই। আবার কেউবা নিজেদের তত্ত্ব ও স্টাইলে আক্রান্ত, ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে ভাবার সময় কোথায়? তবে, কোনো কোনো নির্মাতা বা কুশলী আসলেই দারুন অনুপ্রানিত করেন শিক্ষার্থীদের। চিন্তার বিষয় হল, তাদের এই অনুপ্রেরনা কখনো কখনো অন্য পথে চলে যেতে পারে। হয়তো কোন ছবি না বানিয়েও তিনি ঋত্ত্বিক ঘটকের মতো এলকোহলিক হয়ে পড়েন; নেশা জাতীয় ঘোরে চলমান চলচ্চিত্র সংকটকে দোষারোপ করেন। আবার কোন ক্ষেত্রে শিক্ষার পুরোটাই দেখা যায় ইউরোপীয় শিল্পসম্মত চলচ্চিত্রের আবহে পরিবেষ্টিত। শিক্ষার্থীরাও বেরিয়ে একজন একজন আইজেন্সটাইনের ‘ব্যাটলশীপ পটেমকিন’, কিংবা তারকোভস্কির ‘নস্টালজিয়া’ কিংবা গদার এর ‘ব্রেথলেস’ বানানোর মোহে আবিষ্ট থাকেন। অনেক তরুণ নির্মাতারা আর্ট-কমেডি-ব্যক্তিগত স্টাইল কিংবা ফোক-লোকাল-ইন্টারন্যাশনাল সবকিছু একেবারে জগা-খিচুরী করে মিশিয়ে টেলিভিশনের পর্দায় ফিল্ম নয়তো, ফিল্মের পর্দায় টেলিভিশন নাটক বানাচ্ছেন । তাদের অনেকে নিজেদের সান্তনা দিতে পারেন এই ভেবে- ফিল্মে না পারলে অন্তত টিভিতে আমরা ফিল্মকে নিয়ে আসতে পেরেছি।
স্পষ্ট হওয়া উচিত — চলচ্চিত্রের সত্যিকারের শিক্ষা বলতে আসলে কি বোঝায়? চলচ্চিত্র আসলে কি?
সিনেমার নিজেরই একটি স্বতন্ত্র জগত আছে। হয়তো কাল্পনিক নয়তো বাস্তবিক, কিন্তু জগতটি অন্যরকম। এটা পুরোপুরি আমাদের চারপাশের ঘটমান বাস্তবতা নয়। এই বিষয়ে অনেক পণ্ডিত অনেক কথা বলেছেন। এখনো বলছেন। তাদের সবার মতামত ও সঠিক। যে কোন চিন্তাশীল মতামত বা বিশ্লেষণ ফেলে দেয়া যাবে না। তবে, চলচ্চিত্র যে তাঁর একটা নিজের যোগ্যতা আছে, তা সবাই স্বীকার করেন। এই যোগ্যতা কিন্তু খালি চোখে বা বই পড়ে কিংবা শুধুমাত্র ধ্রুপদি সিনেমা দেখে অনুধাবন সম্ভব না। এই যোগ্যতা বা শক্তিমত্তাকে বুঝতে হলে প্রচুর সিনেমা দেখার, গবেষণার এমনকি পরীক্ষা -নিরীক্ষা করার অভিজ্ঞতা প্রয়োজন। এর জন্য সবাইকে যে চলচ্চিত্রকারর হতে হবে, তা নয়। অনেক চলচ্চিত্রকার তা পারেনও না। কিন্তু একজন রাজনিতিবিদ বা বিপ্লবী পারেন। যেমন লেনিন পেরেছিলেন। সুইজারল্যান্ড এ নির্বাসন থাকাকালীন সময়ে তিনি প্রচুর সিনেমা দেখতেন এবং সিনেমার সামাজিক, রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক শক্তিকে উপলব্ধি করে বিপ্লব পরবর্তী রাশিয়ায় তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণে জোর দেন। একই ভাবে কিউবায় ফিদেল কাস্ত্রো সরকার সিনেমাকে বিপ্লবের হাতিয়ার করেছিলেন। সিনেমা শুধু আর্টফর্ম বা শিল্প নয়, এমনকি বিনোদনও নয় — সরাসরি জনগনের যোগাযোগ মাধ্যমে পরিণত হল। একই ভাবে বিশ শতকের শুরুতে চিত্রকলার শিল্পীরা চলচ্চিত্র মাধ্যম এ উৎসাহিত হন এবং তাদের বিভিন্ন পরিক্ষা-নিরিক্ষায় শিল্প মাধ্যম হিসাবে চলচ্চিত্র বলিষ্ঠতা লাভ করে। এমনকি অনেক দার্শনিক ও সমাজবিদ সমকালীন সময় এবং মানুষের জীবনকে ব্যাখ্যা করতে চলচ্চিত্রকে প্রয়োজনীয় রেফারেন্স হিসেবে বেছে নিয়েছেন। সারা পৃথিবীতে যদি তাকাই, চলচ্চিত্র সম্পর্কে আমাদের ধারনা একটু বদলাবে আশা করি। উন্নত প্রযুক্তির প্রতিদিনের আবিষ্কার হচ্ছে কেবল সিনেমায় বিনোদন দেয়ার জন্য। আমাদের দেশে যারা ঘরে বসে ৫.১ সারাউনড সাউন্ড সিস্টেমে এলসিডি টিভিতে সিনেমা দেখে গর্ব অনুভব করেন, তা কিন্তু সত্তর-আশি দশকে উন্নত বিশ্ব এর সাধারণ মানুষ সিনেমা হলে উপভোগ করে ফেলেছেন। আপনি এখন তার ঘরোয়া সংস্করণ দেখছেন। এখন তারা থ্রি-ডি বা ফোর-ডি ব্যবস্থায় সিনেমা দেখছেন। আপনি ঘরে এবং ঘোরে বসে আছেন। এ কারনে, তাদের সিনেমা হল শিল্প ভেঙ্গে পড়ে না। হয়ত উন্নয়ন ঘটাতে না পেরে অনেকে ব্যবসা গুটিয়ে ফেলছেন। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তির একটি থিয়েটার হলে ফিল্মকে যে উপায়ে উপভোগ করা যায়, তা আমাদের ড্রইংরুমে বা বেডরুমে সম্ভব নয়। আর এই উন্নত প্রযুক্তির পিছনে যে বিজ্ঞানী বা ইঞ্জিনিয়াররা কাজ করে চলেন, তারা কিন্তু ছবি নির্মাতা নন। কিন্তু তারা ফিল্মের যাবতীয় অনুষঙ্গকে চিনতে পারেন। রাষ্ট্রনায়ক, মনস্তাত্তিক, বিজ্ঞানী থেকে সাধারণ দর্শক — চলচ্চিত্র হতে হবে সবার কাছে অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ।
তাই এই দ্বিতীয় বাস্তবতার এই জগতকে পরিপূর্ন ভাবে সার্থক করতে হলে প্রচুর দক্ষ মানুষ দরকার। ধার করা মানুষ নয়। সত্যিকার এর চলচ্চিত্র জগতের মানুষ – যারা বোঝে চলচ্চিত্র আসলে কি ? কেমন তার চাহিদা, কি তার গঠনপ্রনালী ? আর এই জগত কে আমরা সাধারনভাবে চিনি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে। আমি শিল্পনির্ভর চলচ্চিত্রের দিকে আলোকপাত করতে চাই না। পৃথিবীতের কোনো দেশে ইন্ডাস্ট্রি না থাকলেও শিল্পসম্মত চলচ্চিত্র নির্মান হতে পারে। একথা অবশ্যই মানতে হবে, শিল্প সম্মত চলচ্চিত্র আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশের ভাবমূর্তি তৈরী করে এবং দেশের চলচ্চিত্রের ধারাকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। যে দেশের ধ্রুপদী শিল্প যতবেশী উন্নত, সে দেশের বানিজ্যিক শিল্পও সে অনুপাতে উন্নত হতে বাধ্য। কিন্তু শুধু ধ্রুপদী শিল্প দিয়ে ইন্ডাস্ট্রি চালানো সম্ভব নয়। আমি তাই বলছি, চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিকে পুনরুত্থান করতে হলে, আমাদের সেই দক্ষ নির্মাতা, চিত্র নাট্যকার, সঙ্গীত শিল্পী কিংবা অভিনয় শিল্পী, চলচ্চিত্র সমালোচক, চলচ্চিত্র শিক্ষক, গবেষক, সাধারন কলা-কুশলী প্রয়োজন; যা আমাদের বিকল্প বা স্বাধীন চলচ্চিত্র জগতে এখনো তৈরী হতে পারে নি।(আমি এফডিসি’র আবহাওয়ায় এখন যেতে চাই না) বিকল্প ধারার প্রথম যুগের চলচ্চিত্র কর্মীদের মধ্যে এমন উদ্যোগ ছিল না, তেমনি দ্বিতীয় প্রজন্মের কাছে তা কখনো পরিলক্ষিত হয়নি।
আমরা যত বেশি উৎসাহী একজন ‘আকিরা কুরোসোয়া’ নিয়ে, তার চেয়ে কম আগ্রহী একজন ‘উত্তমকুমার’ নিয়ে। অথচ, এই মানুষটা একাই দীর্ঘদিন কলকাতা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রীকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। আমাদের দেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসেও দেখা যাবে পরিচালক বা নির্মাতারা যা অবদান রেখেছেন, তার চেয়ে হয়তো একটু বেশি অবদান রেখেছেন আমাদের সুরকাররা, অভিনয় শিল্পীরা কিংবা বিনিয়োগকারিরা। রওশন জমিল, মায়া হাজারিকা কিংবা রানী বিশ্বাসের মতো অভিনয় শিল্পীদের আমরা পাঠ করি না। খান আতাউর রহমান, রাজ্জাক, রহমান, শাবানা, ববিতা কিংবা ( দোস- দুশমন খ্যাত ) সেই নায়ক জসিম – এর জীবনী আমাদের কাছে একেবারেই বাতিলযোগ্য। কিন্তু আমাদের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রী একসময় উনাদের কারনে জীবিত ছিল। যদিও এর পেছনে অনেক কারণ আছে। সামাজিক, অর্থনৈতিক আর রাজনৈতিক প্রেক্ষপট ও হাজারো ব্যাখ্যা আছে। আমি সে কারণগুলো বের করারও যথার্থ গবেষণা প্রয়োজন মনে করি।
চলচ্চিত্র শিক্ষা কেবল চলচ্চিত্র ভাষা ও তার কারিগরী দিক, ধ্রুপদী চলচ্চিত্রকারদের নন্দনতাত্ত্বিক বা দার্শনিক চিন্তাভাবনার পাঠ-কে বোঝায় না। এর সাথে যুক্ত হতে হবে নানাবিধ বিষয়, যা চলচ্চিত্রে সামগ্রিকক্ষেত্রকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে তোলে। যেমন, হলিউডের সিলেবাস এ দেখি Stardom পড়ানো হয়। সেখানে ‘গ্রেটা গারবো’ বা ‘মারলোন ব্রানডো’ সহ আরো অনেকে পাঠ্য। পাঠ্য আসলে কি, তাদের জীবন তাদের চলচ্চিত্রে সম্পৃক্ততা, তাদের ভূমিকা এবং তাদের সেই স্বর্নোজ্জ্বল অবদান যা ইন্ডাস্ট্রিকে এত বিশালত্ব দিয়েছে। ভারতীয় চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে মুম্বাই, কলকাতা কেউই তার ব্যতিক্রম নেই। এই যে এতোগুলো ছবি আমদানী হচ্ছে, কেউ কি পরিচালক দেখে আমদানী করছে ? সবই সুপার স্টারদের কথা ভেবে আনছে। Three Idiots কিংবা Sholay ছবির পরিচালকরা কতটুকু শিল্প সম্মত তা নিয়ে কে মাথা ঘামায়? বড় কথা, আমির খান আছে — আছেন অমিতাভ বচ্চন। কিন্তু আমরা নিজেদের ক্ষেত্রে আসলেই সেই সত্যসাহা বা এম এ সামাদ — কে ভুলে যাই। এমন অনেকে এখনো জীবিত আছেন, যারা খুব বেশি দিন আগের নন। একের পর এক সার্থক চলচ্চিত্র উপহার দিয়েছেন — তাদের অভিনয়ের মাধ্যমে, সুর সৃষ্টির মাধ্যমে, কাহিনীর মাধ্যমে। কিন্তু আমাদের তরুণ প্রজন্ম সেই পাঠ নেয়নি। তারা জানে না, কি করে একটি গল্প মানুষের মনে বছরের পর বছর দাগ কেটে যায়। একটি ‘জীবন থেকে নেয়া’র মতো ছবি শতবার দেখার পরও আমাদের সাধারন দর্শকদের আকৃষ্ট করে বছরের পর বছর । হিন্দি ছবি Sholay – র কাহিনীও কিন্তু অনেক বিদেশী চলচ্চিত্র হতে ধার নেয়া । কিন্তু নির্মাতা, অভিনেতা, কলা কুশলী, সুরকার – সবাই মিলে Sholay কে জনপ্রিয়তার শীর্ষ স্তরে পৌঁছে দিয়েছে। ভারতীয় চলচ্চিত্রের বিরোধিতা করতে গিয়ে আমরা কেন তাদের সিনেমার সার্থকতাকে অস্বীকার করবো ? সিনেমা হলে বাণিজ্যিকভাবে ভারতীয় ছবি চলবে অপরিকল্পিতভাবে — তা হয়ত আমি না চাইতে পারি, কিন্তু ভারতীয় তথা পৃথিবীর যাবতীয় দেশের চলচ্চিত্র থেকে আমাদের সর্বাত্মক পাঠ নিতে হবে, তা জনপ্রিয় হোক আর ধ্রুপদীই হোক। আর তা সম্ভব নানা উপায়ে – যদি তার উদ্দেশ্য হয় আমাদের দেশের চলচ্চিত্রের সার্বিক উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধি।
আমাদের দেশের তরুণ প্রজন্ম কেবল চলচ্চিত্রের নির্মান, অভিনয় এবং সামান্য কিছু কারিগরী বিষয় নিয়ে আগ্রহী, কিন্তু কারোরই চলচ্চিত্রকে ধারন করার সামগ্রিকতা আছে বলে মনে হয় না। এর মধ্যে তৈরী হলো আবার একদল চৌকষ বুদ্ধিদীপ্ত, স্বার্থ এবং জ্ঞানী সমালোচক। বিভিন্ন দেশের চলচ্চিত্র নিয়ে যাদের দারুন পড়াশুনা এবং জ্ঞান। বইপত্র বা পত্র পত্রিকার লেখালেখি হচ্ছে । আবার দেশের এফ.ডি.সি নির্মিত ছবি গুলোকে নিয়ে বেশ চটকদার মতামতও দিচ্ছেন তারা । শিল্পী, বুদ্ধিজীবি, শিক্ষিত, সংস্কৃতিবান সম্প্রদায়ের কাছে এফ.ডি.সির ছবি মানেই তো অশ্লীলতা, ভায়োলেন্স আর বর্বতায় ভরা — এর আর ভবিষ্যত কি? একে নিয়ে আবার ভাবনাই বা কেন ? আমাদের পোশাকী কর্পোরেট স্মার্টনেস দিয়ে আমরা কি করে এই নর্দমাসিক্ত পরিবেশের সাথে নিজেদের সম্পৃক্ত করবো ? কিন্তু কেউ কি ভেবে দেখেছে এর পিছনের সত্যিকার বাস্তবতাটা আসলে কেমন ? কেন নায়িকারা পোশাকের তোয়াক্কা না করে অশ্লীলতার নাচ গান করেন ? একজন এক্সট্রা শিল্পীর আর্থিক দৈন্যতা ঠিক কোন পর্যায়ে ? কলাকুশলীদের আর্থিক স্বচ্ছলতা কতটুকু ? যে প্রাচীন বেহালা বাদকটি আজ ইলেকট্রনিক কীবোর্ডের কারণে কাজ পায় না, তার সংসারটা কিভাবে চলছে ? আমরা কি দেখেছি, একজন সিনেমা হলের টিকেট ব্ল্যাকার আজ বিশাল ধনপতি ? (হলেও রাজনৈতিক ছত্রছায়ায়, টিকেট ব্ল্যাক করে নয়) আমরা বাস্তবের সমাজ থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি। সেই স্বপ্ন জগতের বাসিন্দারা, যাদের আমরা নিয়ত তিরস্কার করি; তাদের দৈনন্দিন জীবন যেন দুঃস্বপ্নে ভরা। তাই নতুন নির্মাতা বা চলচ্চিত্রকর্মী বা রুচিশীল দর্শকদের বলি — যখন কোন বাংলাদেশী ছবিতে চরম অশ্লীলতা দেখতে পাই তখনই লজ্জায় মাথা নুয়ে ভাবি — এই তো আমাদের সত্যিকার বাংলাদেশ, আমরা সবাই মিলে আজকে তাকে এখানে নামিয়ে এনেছি। আমি সেই কলাকুশলীদের তাদের শরীরের পেছনের সেই দুঃস্বপ্নে ভরা দারিদ্রতাকে চলচ্চিত্রের পাঠক্রমে পড়তে চাই। হলিউডের বিখ্যাত যৌন আবেদময়ী অভিনেত্রী মেরিলিন মনরো তার উপলব্ধি জানিয়েছিলেন, “Hollywood is a place where they’ll pay you a thousand dollars for a kiss and fifty cents for your soul. I know, because I turned down the first offer often enough and held out for the fifty cents.” আমরা তার বাইরে কোথায় যাবো ?
বিংশ শতাব্দীর তরুণ মাধ্যম চলচ্চিত্র একটি শক্তিশালী সংস্কৃতি। সিনেমা মানে ম্যাজিক, সিনেমা মানেই একটা স্বপ্নের মায়াজাল। কল্পনাকে দৃশ্যগত করার কৌশল এই ছায়াছবির জগত। তার কাহিনীও হবে তেমন যাদুকরী টাইপ। চলচ্চিত্র শিক্ষার ক্লাসে আমি প্রায় দুষ্টমী করে বলতাম, “নায়িকাকে ঘিরে ফেলা বখাটে ভিলেন দের শায়েস্তা করতে নায়ক যদি দরজা খুলে ঢোকে, তা হলো বাস্তব। আর যদি এক লাথিতে দরজা ভেঙ্গে ঢোকে তা হবে সিনেমাটিক।” এটাই কল্পনা, আর এটা হলো ম্যাজিক — আর দর্শক এটাই ভালোবাসে। একই সাথে নায়কের শক্তিমত্তার পরিচয়টা পাওয়া গেল। নইলে এই নায়ক যে চার পাচঁটা গুন্ডাকে কাবু করে নায়িকাকে রক্ষা করতে পারবে, তার গ্যারান্টি কি?” এটা হয়তো নিছকই একটা মজা করা। কিন্তু পাঠক, সিনেমার এরকম হাজারো বিষয় আছে এবং তাকেই আমরা বলি ‘সিনেমাটিক রিয়েলিটি’। নইলে, ব্যাটলশিপ পটেমকিন ছবিতে আইজেন্সটেইন হয়তো বাস্তবের পটেমকিন বিদ্রোহের ব্যর্থতা দেখাতে পারতেন। ‘সিনেমেটিক বাস্তবতা’কে অনুধাবন করতে পারা সমস্ত চলচ্চিত্র নির্মাতা – শিল্পী – কর্মীদের দায়িত্ব; যদি তারা চলচ্চিত্র শিল্পকে সত্যিকার দৃশ্যশিল্পে রুপান্তরিত করতে চান।
বাংলাদেশ ফিল্ম কর্পোরেশন — এর ভেতরে বাইরে যত চলচ্চিত্র নির্মাতা, কলা কুশলীরা আছেন – তারা এতদিন আরামে বা ব্যারামে যেভাবে থাকুন না কেন এখন সময় এসেছে ঘুরে দাঁড়ানোর । অনেক সময় নষ্ট হয়েছে এবং চলে গেছে – এটা ভাবার কারন নেই। এখনই উঠে দাড়াঁতে হবে নইলে আর হয়তো সম্ভব হবে না। ইতিমধ্যে প্রচুর আলস্যের অলি-গলি-রাজপথ তৈরী হয়ে গেছে। প্রতিবন্ধকতার ইমারতও হয়ে গেছে সুউচ্চ ও বিলাসবহুল। ফলে একে ঝেড়ে ফেলতে বিশাল প্রস্তুতির প্রয়োজন। এক বা ক’য়েক মাথায় এত বিস্তৃত আয়োজন নিয়ে এগিয়ে চলা যাবে না । প্রয়োজন অনেকগুলো মাথার সমন্বয়। ইন্ডাস্ট্রিতে সবাইকে প্রয়োজন। একদিকে তানভির মোকাম্মেল,মোরশেদুল ইসলাম, সরওয়ার ফারুকী বা নুরুল আলাম আতিক-কে যেমন দরকার তেমনি এফডিসি-তে কর্মরত চিত্রপরিচালকদেরও গুরুত্বের সাথে প্রয়োজন। প্রয়োজন টিভি, মঞ্চ ও চলচ্চিত্র সহ অন্যান্য পারফরমিং আর্টের ভেতরের বাইরের শিল্পী-কলা-কুশলিদের। তরুণ নির্মাতাদের সুযোগ তৈরি করতে হবে। মনে রাখতে হবে, কাউকে বাদ দেয়া যাবে না বা উপেক্ষা করা যাবে না। আমাদের দেশের চলচ্চিত্র কর্মীদের একটি ভ্রান্তি আছে, খুব শক্তিশালী শিল্প মাধ্যমটির অংশ হওয়ার কারণে তাঁরা অন্য শিল্প জগতের মানুষগুলোকে একটু এড়িয়ে যান । প্রতিটি শিল্প এবং শিল্পীর আলাদা গুরুত্ব আছে। আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। ফলে, কেউ যাতে পিছিয়ে না পড়েন । আমরা যে চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির স্বপ্নকে সফল করতে চাই, তার জন্য এখনো দক্ষ জনবল অপর্যাপ্ত। আমাদের যেটুকু জানা-নাজানা তাই নিয়ে একে অপরকে শিক্ষিত করতে হবে। সকল ক্ষেত্র থেকে সবাইকে কাছে টেনে নিতে হবে। তাদের যথাযথ কর্ম সংস্থান ও কাজের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। আর এজন্যে চাই, সকলের সহযোগিতা এবং একাত্মতা। বর্তমানে আমরা যে সংকটকাল পার হচ্ছি, তা কেবল ভারতীয় চলচ্চিত্র আমদানীর বিরোধিতা, বিদেশী ছবি বন্ধ করে এবং নিজেদের দিকে মনোযোগ না দিয়ে আমরা সফল হয়ে যাবো – এটা ভাবার কোন কারন নেই। ভারতীয় কেন, পৃথিবীর কোন দেশের চলচ্চিত্রের প্রতি বিরাগ বা নেতিবাচক ধারনা থাকা কোনভাবেই কাম্য নয়। বরংচ মূল সংগ্রামটি সার্থক হবে আমরা যখন আমাদের চলচ্চিত্র নির্মাণ ক্ষেত্রটিকে আন্তর্জাতিক ও উন্নত মানের সিনেমা তৈরির আঁতুড় ঘরে পরিনত করতে পারবো। শুধুমাত্র বিরোধিতা করে, আন্দোলন করে, বিদেশী ছবির নিন্দা করে নিজেদের ছোট করার মানে হয় না। তার চেয়ে নিজেদের আত্ম পরিচয় তুলে ধরতে, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে আবার বাংলাদেশের সর্বস্তরের জনগনের কাছে তথা বিশ্ববাসীর কাছে পৌছে দিতে, চলচ্চিত্রের বিশাল যাদুময় স্বর্নখচিত জাহাজটির হাল ধরার এখনই সময়।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৭ comments
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর - ২৭ ডিসেম্বর ২০১১ (৪:০৩ অপরাহ্ণ)
বেশ যুক্তিপূর্ণ লেখা। ধন্যবাদ রাসেল।
Ariful Hoque - ২৯ ডিসেম্বর ২০১১ (১২:৫১ অপরাহ্ণ)
Very Good call for our film activists. Need to focus on the film education, no doubt. As well as one should risk the bang bang and ring the bell on cat’s collar.Thanks people who still dedicating their thoughts and actions in this greater cause.
মুনতাসির মামুন সজীব - ৩১ ডিসেম্বর ২০১১ (৬:৪৪ অপরাহ্ণ)
অনেক তথ্যবহুল লেখা নিঃসন্দেহে।কিন্তু আপনার অবস্থান ধোয়াশাছন্ন মনে হল।আপনি কি মূলধারার এফডিসির বাণিজ্যিক ছবির উন্নতির জন্য চলচ্চিত্র শিক্ষার ইনস্টিটিউট নির্মাণের কথা বলছেন?এফডিসির যে ফর্মূলা তাতে ফিল্ম ইনস্টিটিউট বা চলচ্চিত্র শিক্ষার দরকার নেই,থাকলে এফডিসির লোকেরাই এই দাবী তুলত।আর বিকল্প চলচ্চিত্র তো মৃত হয়ে গেছে অনেক আগেই।এফডিসিরও দিন ফুরিয়ে এসেছে।সামনে এক ভয়ংকর সময় আসছে।
রফিকুল আনোয়ার রাসেল - ১ জানুয়ারি ২০১২ (১১:০২ পূর্বাহ্ণ)
Dear Mr. Shajib,
Thanks for your note. And I am sorry, I failed to express position of mine in my writing. Well, I am neither for commercial films nor for the alternatice movies. Or may be for both. My position is only for total of film and film education. I donot believe in any particular formula of an industry, which cannot be changed. As you said, alternative movies are dead. Its not true, It is here and developing. But my point was not for alternative movies. It is for film industry. The process of learning and and the implementations of new ideas, will change any existing or dominating formula. My views, of course for a space of Film as a big entertainment event, a revenue earning sector, where it can be benefitted for the nation. You said well- The FDC will die soon and the future is vulnarable. But, what should we do ? Waiting for something to die ? So, I took the pen with all my experiences with film and trying to debate with air. May be the wind will carry the messege.Thanks again.
eshita - ৪ জানুয়ারি ২০১২ (১১:৫৯ পূর্বাহ্ণ)
” The process of learning and and the implementations of new ideas, will change any existing or dominating formula.” like your spirit.carry on.
মাসুদ করিম - ৪ জানুয়ারি ২০১২ (১:১২ অপরাহ্ণ)
@ আরিফুল হক, রফিকুল আনোয়ার রাসেল, ইশিতা
পাঠকদের কাছে অনুরোধ ইংরেজিতে মন্তব্য করবেন না। আমরা মুক্তাঙ্গনের পাঠকরা ইংরেজি মন্তব্যে এবং ইংরেজি অক্ষরে বাংলা মন্তব্যে অভ্যস্ত নই। আর লেখকের কাছে অনুরোধ তিনিই যদি ইংরেজিতে মন্তব্য করেন তাহলে পাঠক কী করবে? সবাইকে আবারো অনুরোধ করব, শুধু বাংলায় মন্তব্য করুন।
রফিকুল আনোয়ার রাসেল - ৫ জানুয়ারি ২০১২ (১২:৫০ পূর্বাহ্ণ)
ধন্যবাদ মাসুদ ভাই। অনিচ্ছাকৃত ভুলটির জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত। অফিসের কমপিউটার-এ অভ্র সেটিং না থাকায়, পাঠককে তাৎক্ষনিক অবস্থান ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইংরেজির আশ্রয় নিতে হয়েছিল। আর পাঠকের স্বাধীনতাটা থাকুক। নয়ত কেউ প্রয়োজনীয় কিছু লিখতে গিয়ে অনুৎসাহিত হতে পারেন শুধু ভাষা সেটিং না বোঝার কারনে। লেখকের অবস্থান থেকে আবারো দুঃখিত ।