ইদানীংকালে বিভিন্ন মহলে ভারতীয় বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের আমদানি নিয়ে বেশ তর্কবিতর্ক শোনা যায়। পুরো প্রক্রিয়াটা সম্পর্কে অনেকদিন ধরেই তেমন ধারণা ছিল না; যেমন, কী ধরনের ছবি আসছে, কারা আনছে, এক্ষেত্রে সরকারের সুস্পষ্ট নীতি মালা কী, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু বর্তমানে বিষয়টি অনেক স্পষ্ট এবং সর্বসাধারণ পর্যায়ে সাড়া জাগিয়েছে। বিষয়টি অনুধাবন মাত্রই আমার ঈশপ-এর একটি গল্প মনে পড়ে গেল। স্যামোসের লোকসভায় এক অত্যাচরী শোষকের বিচারে শাস্তি প্রসঙ্গে ঈশপ ((ঈশপ — প্রাচীন গ্রীসের কথাশিল্পী ও মেষপালক )) এই গল্পটি বলেছিলেন:
এক শেয়াল নদী পার হতে গিয়ে স্রোতের টানে এক খাদে গিয়ে পড়ল। তা থেকে উঠতে অনেক চেষ্টা করেও সে পেরে উঠল না। সুযোগ পেয়ে এক ঝাঁক রক্তচোষা পোকা এসে তার গায়ে লেগে রইল এবং তার রক্ত পান করতে লাগল। এই সময় এক শজারুকে সে পথ দিয়ে যেতে দেখে শেয়াল তার সাহায্য প্রার্থনা করল। শজারু করুণার স্বরে বললে, ‘আমি তোমায় এই খাদ থেকে তুলতে পারবো না সত্যি, কিন্তু তোমার গা থেকে ঐ পোকাগুলি তুলে নিতে পারি আমি, কেমন?’ শেয়াল বললে, ‘না, না, ভাই, তা করতে যেয়ো না।’ ‘কেন, না বলছ কেন?’ ‘না বলছি এই জন্যে যে এগুলি আমার রক্ত এতক্ষণ অনেক খেয়েছে, আর বেশি এরা টানতে পারবে না। এদের সরিয়ে দিলে আর এক নতুন ঝাঁক এসে আমার গায়ে লাগবে, তখন যে রক্তটুকু আমার শরীরে অবশিষ্ট আছে, তাও আর থাকবে না।
চলচ্চিত্র আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত থাকার কারণে এই বিষয়ে পক্ষে-বিপক্ষে অনেক আলোচনায় অংশ নেয়ার সুযোগ ঘটেছে এর মধ্যে। বিভিন্ন আলাপচারিতায় এই বিষয়ে যেটুকু জানা গেল তা হলো: মধ্যবিত্ত তথা আপামর জনসাধারণকে সিনেমাহলমুখী করার জন্য বাংলাদেশের মৃতপ্রায় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকে প্রতিযোগিতায় এনে সুস্থ বিনোদনমূলক চলচ্চিত্র নির্মাণে উদ্বুদ্ধ করাই হলো ভারতীয় চলচ্চিত্র আমদানির উদ্দেশ্য। ব্যাপারটা উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। কারণ, চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থার এবং বিভিন্ন চলচ্চিত্র সংসদ কর্মী, রাজনৈতিক কর্মী ও আরো অনেকের এই বিষয়ে বিরোধিতা। প্রথম প্রথম আলোচনায় গিয়ে বক্তাদের বিভিন্ন মতামত শুনতে শুনতে ভাবছিলাম আমি এই বিষয়ক আলোচনায় অংশগ্রহণে যোগ্য ব্যক্তি কিনা। বা আরো যারা বুদ্ধিজীবী, বিদগ্ধ শুদ্ধ চলচ্চিত্র ও সংস্কৃতি-কর্মী কিংবা নতুন প্রজন্মের টেলিভিশন ডিজিটাল চলচ্চিত্রের নির্মাতা বা কুশলী — আমাদের কারোরই কি এই বিষয়ে সুস্পষ্ট অবস্থান নেয়ার সুযোগ আছে? ভারতীয় সংস্কৃতি, ভারতীয় টিভি চ্যানেল, ভারতীয় নাটক, নায়ক নায়িকা, তাদের স্টাইল-ফ্যাশন সবই তো আমাদের মধ্যবিত্ত মানসিকতায় অনেককাল ধরে লেগে আছে। আবার উন্নত মুক্তচিন্তার মানুষেরাও ভারতীয় পশ্চিম বাংলার সাংস্কৃতিক বলয়ে আবর্তিত হন। একজন তো বলেই বসলেন, ভারতীয় বই আসতে পারলে ভারতীয় সিনেমা কী দোষ করলো? বাংলাদেশ হলেও ভারতীয় অনেক কিছুর উপরই তো আমরা নির্ভর করি। ভারতীয় গরু, শাড়ি, কলম, বই, টেলিভিশন, পোশাক, পেঁয়াজ, চিনি — আরো কত কী? কোথায় ভারতীয় বিষয়টি নেই? আমরা নিজেরাও তো এই ষাট বছর আগে ভারতীয় ছিলাম। তাহলে সিনেমায় অসুবিধাটা কোথায়? এ নিয়ে হইচই বিষয়টি রাজনৈতিক। সাংস্কৃতিক দিক থেকে আমাদের সাথে ভারতীয়দের পার্থক্য কী? আসলে কি তাই? গত ষাট বছরে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ — এই দেশগুলোর মধ্যে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিশাল ব্যবধান তৈরি হয়ে যায়নি? ১৯৪৭, ১৯৬৫, ১৯৭১ — এই সালগুলোর গুরুত্ব কী?
শুনতে-শুনতে ভাবতে-ভাবতে আসলে মাথা নষ্ট। ভারতীয় সিনেমাকে কীভাবে দোষারোপ করা যায়, ভেবে কূল পাই না। আসলে ভারতীয় সিনেমার কোনো দোষ নেই। দোষটা আমাদের নিজেদের। আমরা পরজীবী হয়ে পড়ছি। চাল-ডাল বলেন আর সাহিত্য-সংস্কৃতি বলেন, সর্বক্ষেত্রে পরাশ্রায়ী হয়ে বেঁচে থাকাটাই আমাদের ইচ্ছা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে সংগ্রামে তথা বীজ বপনের কালে ভারতের কোনো ভূমিকা ছিল না। কিন্তু যুদ্ধের শেষদিকে এসে আমাদের সাহসী সংগ্রামী যোদ্ধাদের উপর পুরোপুরি ভরসা না করে (ঠিক ফসল তোলার সময়) আমরা ভারতীয় বাহিনীর উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লাম। এর পেছনের উদ্দেশ্যটি নিয়ে অনেক বিতর্ক থাকতে পারে, কিন্তু এটা ঠিক ১৬ই ডিসেম্বর ভারতীয় বাহিনীর কমান্ডারদের হাতে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে সূক্ষ্ম ও সুচতুরভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের ভারত-নির্ভরতার যাত্রা শুরু। এরপর আর বিস্তারিত ইতিহাসে যেতে চাই না। জাতি হিসেবে বাঙালি যতই সাহসী ও বন্ধুভাবাপন্ন হোক না কেন, অতীত ও বর্তমানে ভারতকে এড়িয়ে পথ চলা তার পক্ষে সম্ভব হলো না। ভবিষ্যৎ বিষয়ে মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
শোনা যায়, ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় ভারতীয় চলচ্চিত্র পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়। বিষয়টি অযাচিতভাবেই রাজনৈতিক। কিন্তু সেই রাজনৈতিক আইনটি পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধুর সরকার বিলুপ্ত করলেন না। ফলে ভারতীয় চলচ্চিত্র বাংলাদেশের বাজারে প্রবেশ করলো না। বঙ্গবন্ধু-পরবর্তী সরকারগুলোকে তেমন ভারতপ্রেমী মনে করার কারণ নেই। এমনকি ১৯৯৬-২০০১ সালের তৎকালীন আওয়ামী সরকারকেও এই বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। তবে, এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। ১৯৭৫ সাল কিংবা ১৯৯৬ সালের আওয়ামী লীগ সরকারগুলোর সাথে বর্তমান সরকারের নৈতিক এবং আদর্শগতভাবে বেশ পার্থক্য রয়েছে। এ বিষয়ে রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা আরো ভালো বলতে পারবেন। আমরা ফিরে আসি ভারতীয় সিনেমা আমদানি প্রসঙ্গে। সকলের কাছে এটা দৃশ্যমান — বর্তমান সরকার ভারতকে তার চলচ্চিত্র নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে দিয়েছে। অবশ্য এটাও বলা যায়, আমরা বেশ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আমাদের নিজেদেরই লাভের জন্য যেন ভারতের চলচ্চিত্র নিয়ে এসেছি। এমনিতেই যাবতীয় দেশী বিদেশী ধার-দেনায় আমরা অভ্যস্ত। এরপর নাহয় সিনেমার ক্ষেত্রেও ধার করে চলবো। মহান (!) ভারতীয় চলচ্চিত্রগুলো আমাদের জীর্ণ, অলস সিনেমাহলগুলোকে আবার চাঙ্গা করে তুলবে। হল-মালিকরা লক্ষ-কোটি টাকা মুনাফা করবে, সরকার পাবে রাজস্ব আর সেই রাজস্ব দিযে সর্বস্তরে উন্নয়নের জোয়ার বইবে। আর কী চাই?
কিন্তু, বাধ সাধছেন কিছু তরুণ নির্মাতা, চলচ্চিত্র ও সংস্কৃতি-কর্মী সহ আরো অনেকে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়, ইন্টারনেটে, ব্লগে লিখে তাঁরা এর প্রতিবাদ করছেন। তাঁদের দাবি — ভারতীয় চলচ্চিত্র আমদানি নিষিদ্ধ ছিল, থাকুক। তাঁদের লেখা বক্তব্য পড়ে বোঝা যায়, তাঁদের যুক্তি কিংবা প্রতিবাদ ধোপে টেকার কথা না। কারণ, যে-চলচ্চিত্রশিল্পকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে তাঁরা ভারতীয় চলচ্চিত্রকে রুখতে চাইছেন, তাঁরা নিজেরাই সেই বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র সংস্কৃতির কাছ থেকে অনেক দূরে। যে দেশীয় চলচ্চিত্রকে (এফডিসি-কেন্দ্রিক) তাঁরা বাঁচাতে চাইছেন, তার অবস্থা ঠিক কোন্ পর্যায়ে? আর যে-সমস্ত শিল্পমানসম্পন্ন চলচ্চিত্র আমাদের দেশে নির্মিত হয়, সেগুলো এমনিতেও সিনেমাহলে প্রদর্শিত হয় না। দেশীয় পরিবেশকদের ঐসব ছবির ব্যাপারে কোনো উৎসাহ থাকে না। ক্ষমতাসীন সরকারগুলো তা নিয়ে ভাবিতও হয় না। বর্তমানে এদের একাংশ আবার ভারতীয়, ইউরোপীয়, এবং হলিউডি শিল্পসম্মত চলচ্চিত্র উপভোগ করেন এবং এফডিসি নির্মিত সিনেমাগুলো দেখে হতাশ হতে হতে এক পর্যায়ে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। আবার আমাদের মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠী অনেক আগে থেকে ভিসিআর-ডিভিডির কল্যাণে হিন্দি ছবির দারুণ ভক্ত। তাঁদের কাছে মধুবালা থেকে কারিনা-ক্যাটরিনা হলো হিন্দি ছবির আদর্শ নায়িকা। সালমান খানের ‘দাবাং’ ছবি দেখে অনেকে মনে স্ফূর্তি অনুভব করেন। ‘শিলা কি জওয়ানি’ বা ‘মুন্নী বদনাম হুই’, ‘ডার্লিং তেরে লিয়ে’ শুনে গা ঝাড়া দিয়ে নেচে ওঠেন। কিন্তু যখনি এফডিসি-তে নির্মিত ‘ধরছি মারে’ বা ‘খাইছি তোরে’ মার্কা কোনো ছবিতে নায়িকাকে অর্ধনগ্ন হয়ে কোমর ঝাঁকাতে দেখেন তখনই ‘অশ্লীল’, ‘বীভৎস’, ‘কুরুচিপূর্ণ’ ইত্যাদি শব্দ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। আমাদের এই সংস্কৃতিটা একটু বোঝা দরকার। ভারতীয় নগরায়ণ ও ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থপনা তার আর্থ-সামাজিক এবং তদুপরি রাজনৈতিক প্রভাবে যে-স্তরে উন্নীত হয়েছে ভারতের চলচ্চিত্র সেই মানটাকে প্রদর্শন করতে চায়। এমনকি ভারতীয় বলিউড-ভিত্তিক চলচ্চিত্রগুলো খোদ ভারতীয়দের আপামর সামগ্রিকতাকে ধারণ করে না। সমুদ্রসম অর্থের স্রোতে একটি কাল্পনিক-স্বাপ্নিক জগৎ আর সর্বসাধারণ সেই স্বপ্নে সর্বক্ষণ বিভোর। এর মধ্যে সমাজের যাবতীয় অনাচার,অনিয়ম, নোংরামি চলছে না তা নয়। যেমন আমাদের দেশে হচ্ছে। এটা কেবল মানের আপেক্ষিকতা। আমাদের দেশের চলচ্চিত্রের সাথে তা তুলনায় গেলে বলতে হয়, আমাদের চলচ্চিত্র আমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিভঙ্গি এবং সাংস্কৃতিক পতনের মানকে প্রদর্শন করছে। অবশ্যই তা কাম্য নয়। কিন্তু পতন ঠেকাবে কে বা কারা ?
তবে এক্ষেত্রে আমরা একটু বিচিত্র স্বভাবের। রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় কিংবা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আমরা অনেক (কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভয়ানক সব) অনাচার মেনে নিলেও এফডিসির চলচ্চিত্রগুলোকে মেনে নিতে পারছি না কেন? আমরা এটা ভাবছি না কেন, আমাদের ঢাকাই ছবিতে মুনমুন (অবশ্যই একজন শিল্পী হিসেবে) যদি শরীর দোলায় রিকশাওয়ালাদের উদ্দেশ্যে, তাহলে ক্যাটরিনা কাইফ (ভারতীয় অভিনেত্রী) দোলাচ্ছে শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত, সামর্থ্যবান জনগোষ্ঠীর উদ্দেশ্যে। বাজার এবং বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যের বিষয়টা একই। পার্থক্য কেবল দর্শকের মান এবং সামাজিক অবস্থানের ক্ষেত্রে। আমাদের টিভি-বিজ্ঞাপন মিডিয়াতে অনেক হার্ট-থ্রব স্টার আছেন। তাঁরা যদি (উচ্চতর) সম্মানীর বিনিময়ে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে শরীর প্রদর্শন করে কিছু করেন বা কোনো চলচ্চিত্রে আইটেম গার্ল হিসেবে নাচেন, তাও কি আমরা ‘ওয়াক ত্থুঃ’ বলে ফেল দেবো? নাকি সেটা আমাদের তখন ‘নান্দনিক’ বলে ভাবতে বাধ্য করবে? সমস্যা হলো, আমাদের অভিনেত্রীরা এখনো চলচ্চিত্রে তেমনভাবে উপস্থাপিত হবার সাহস দেখাননি। যদিও শিল্পী হিসেবে তাঁদের যে কোনো কিছু করার স্বাধীনতা আছে — তাঁদের খ্যাতির প্রয়োজনে, জীবিকার প্রয়োজনে।
কিন্তু এর মধ্যে শিল্প তৈরি হচ্ছে না তা নয়। ভারত যে-কোনো শিল্পচর্চায় অগ্রগামী একটি দেশ এবং সে শিল্পের সাংস্কৃতিক যাতায়াতে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা কোনভাবেই কাম্য নয়। আমি ভারতীয় চলচ্চিত্র আমদানির সর্বাত্মক বিরোধী নই। এমনকি আমি চাই নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে এবং রাষ্ট্রীয় নীতিমালায় পৃথিবীর সমস্ত দেশের চলচ্চিত্র আমাদের দেখার এবং উপভোগের সুযোগ তৈরি হোক। এ বিষয়ে গত ২৮ অক্টোবর, ২০১১ তারিখে দৈনিক প্রথম আলোয় প্রকাশিত ক্যাথেরীন মাসুদের প্রবন্ধ ‘চলচ্চিত্রের চালচিত্র: বাংলাদেশ’-এর শেষে লেখকের প্রস্তাবনারগুলোর সাথে সহমত প্রকাশ করছি।
ভারতীয় বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের অশ্লীলতা, যৌনতা, ফ্যান্টাসি, ভায়োলেন্স ইত্যাদি বিষয়গুলো আমি বাদ দিয়ে দিচ্ছি। ঐসব ছবির আলোচনা সামলোচনা আমার উদ্দেশ্য নয়। দেখা গেল, সিনেমা হলে চলার জন্য যে ছবিগুলো এসেছে তার মধ্যে শাহরুখ খান, আমির খান এর সিনেমা বেশি। মনে পড়লো, গত বছর শাহরুখ খান সাহেব নিজেকে বাংলাদেশের মানুষের কাছে এসে ভালোভাবে পরিচিত করে গেলেন। এমনিতেই তিনি তুমুল জনপ্রিয়। ফলে তাঁর সিনেমাগুলোয় দর্শকে হল উপচে পড়বে এটা স্বাভাবিক। দেখা যাচ্ছে পাইপ লাইনে ‘থ্রি ইডিয়টস’ ছবিটাও আছে। অনেকের ভালো লাগা, তরুণ প্রজন্মকে উজ্জীবিত করা, সুস্থ ধারার এই ছবিটি র্দুজনদের মুখ একটু থামিয়ে দিয়েছে। কিন্তু পাঠক, আমাদের বিভ্রান্ত হবার সুযোগ যাতে না থাকে। আপাতত ‘থ্রি ইডিয়টস’, ‘রাং দে বাসান্তি’ কিংবা ‘তারে জামিন পার’ ধরনের ছবিগুলো এলেও পরে কিন্তু সব বদলে যাবে। তখন ঢাকার সিনেমা হলে তরুণরা ‘টম ডিক হ্যারি’ কিংবা ‘মার্ডার’-এর মতো ভাঁড়ামি বা নগ্নতা-নির্ভর ছবি দেখবে; আবার মধ্যবিত্তরা সপরিবারে তখন ‘দিওয়ানা মস্তানা’ বা ‘ঝুট বলে, কাওয়া কাটে’ মার্কা সস্তা বিনোদনমূলক সিনেমা উপভোগ করবে। আর এর ফলে দর্শকদের রুচির অবস্থা উন্নত হয়ে ক্লাসিক পর্যায়ে পৌঁছুবে, এমন মনে করার কারণ নেই।
আমাদের মধ্যে একজন বামপন্থী অবশ্য নিশ্চিত থাকতে চাইলেন এই ভেবে, বিগত অনেক বছর ধরে টেলিভিশন ও সামগ্রিকভাবে ভারতীয় সবকিছুর নিয়ন্ত্রণে থাকার পরও দেশে ৭৫ শতাংশ কৃষক শ্রমিক শ্রেণীর কোনো সাংস্কৃতিক অবক্ষয় হয়নি। এক্ষেত্রে ভারতীয় ছবি এসে নতুন করে তাদের সংস্কৃতিতে আঘাত হানতে পারবে না। এটা নিশ্চিত হওয়া দরকার, ভারতীয় চলচ্চিত্র দেশের শত শত সিনেমাহলে চলবে এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। কারণ, ভারতীয় সিনেমাগুলো আমাদের পরিবেশকরা যে অর্থ লগ্নী করে আনবেন, তা শ্রমিক বা কৃষক শ্রেণীর পক্ষে উপভোগ করা মোটেও সম্ভব হবে না। এই ছবিগুলো চলবে মূলত ঢাকার প্রধান কয়েকটি সিনেমাহলে (স্টার সিনেপ্লেক্স, মধুমিতা অথবা বলাকায়)। প্রথম প্রথম কয়েকটি বিভাগীয় শহরে হয়তো আসতে পারে, যদিও এই বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই। টিকেটের দামও যে একেবারে রিকশাওয়ালা বা রাস্তার শ্রমিকের ক্রয়সীমার মধ্যে থাকবে, তা নয়। ফলে, এই ছবিগুলোর মূল টার্গেট মধ্যবিত্ত ও উঠতি তরুণ সমাজ যারা দেশের ১৫ বা ২০ শতাংশ (যাই হোক)। আর এই অংশটিকে যদি আক্রান্ত করা যায়, তাহলে এরাই বাকি শতাংশ জনগণকে নির্দ্বিধায় প্রভাবিত করবে বছরের পর বছর।
ভারতের বিভিন্ন আদর্শ এতই আকর্ষনীয় যে আমাদের দেশের যে-কোনো প্রবীণ বা কিশোর তাৎক্ষনিকভাবেই তা গিলে নেবে। যেমন, ভারতের গণমাধ্যমের এবং কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর একটি উল্লেখযোগ্য, আকর্ষণীয় ও বেশ প্রচারিত আদর্শ — ‘ভারতীয় দেশপ্রেম’। সকলে বলে, আমরাও বলি — ভারতে আর কিছু থাক না থাক তাদের কিন্তু দেশপ্রেম আছে। যদিও এটা পরিষ্কার, ‘দেশপ্রেম’ বিষয়টি পণ্য হিসেবে যতদিন বাজারে সমাদৃত থাকবে, ভারতীয় মিডিয়াগুলো ততদিন দেশপ্রেমের গীত গাইতে গাইতে টেলিভিশনের স্পীকারগুলোই নষ্ট করে ফেলবে। এই যেমন বর্তমানে আন্না হাজারি — আদর্শ ও দুর্নীতি বিরুদ্ধে অনশনরত গান্ধীবাদী এই ব্যক্তি ভারতীয় মিডিয়ার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এমন আরো অনেকে রয়েছেন যাঁরা এর চেয়েও বলিষ্ঠভাবে ক্ষমতা, দুর্বৃত্তায়ন, দুর্নীতির ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে (ইরম শরমিলা দ্রষ্টব্য) সোচ্চার ও আন্দোলনরত — তাদের ব্যাপারে মিডিয়ার কোনো উৎসাহ নেই। কেন তা রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা জানেন। এই ক্ষেত্রে প্রথম আলোর বিগত ১৫ নভেম্বর, ২০১১-এর একটি প্রতিবেদন আমাকে আকৃষ্ট করেছে : ‘ঋণের চক্রে আত্মহননের মিছিল’। দেশেপ্রেমে ভরপুর কোন দেশে কৃষকের এই অবস্থা হতে পারে না বলে আমি মনে করি। যাই হোক, আমি কথাগুলো বললাম এই কারণে যে ভারতের চলচ্চিত্র, ভারতীয় গণমাধ্যম বা রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। অনেক বছর আগে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের এক কর্মী একবার দুষ্টুমি করে বলেছিল, ‘পাকিস্তান আর্মির সাথে একটু যোগাযোগ করতে পারলে ভালো হতো।’ আমরা সবাই অবাক হলে সে বললো, ‘তাদের জানাতে চাই, অচিরেই যাতে তারা সানি দেউলকে (ভারতীয় চলচ্চিত্রাভিনেতা) মেরে ফেলে বা ধরে নিয়ে যায়।’ সকলের প্রশ্ন — ‘কেন?’ সে জানালো, ‘পাকিস্তান-বিরোধী বিভিন্ন ফিল্মে, সে একাই যেভাবে হাজার হাজার পাক সৈন্য মেরে ফেলছে, এটা তো ভয়ানক ইন্সপায়ারিং। পাকিস্তান তো ইন্ডিযয়ান আর্মির সাথে কখনও পেরে উঠবে না।’ সবাই হেসে উঠলাম, ‘এ কারণে স্পিরিটকেই শেষ করে ফেললে বিষয়টির নিস্পত্তি হয়ে যাবে।’ চলচ্চিত্রের আড্ডাগুলোতো নিছকই মজা করতে গিয়ে এটা শুনলেও, যে-কোনো চলচ্চিত্রে অনুপ্রেরণা বা নির্মল কাহিনিবিন্যাসের পেছনে নানা উদ্দেশ্য কাজ করে থাকে। হলিউডি চলচ্চিত্র এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রভাব-বিস্তারকারী। ইদানীং কালে ভারতীয় ছবিগুলোতে বিভিন্ন রাজনৈতিক বিষয়কে উপস্থাপন করা হয়। আপাত অর্থে এদের নিছক ফিল্মের কাহিনি মনে হলেও, এর মাধ্যমে মতাদর্শিক দ্বন্দ্ব, জটিলতা নানাভাবে দর্শকের মানসপটে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। ভারতীয় জাতীয়তাবাদ বা কর্পোরেট পুঁজির বাইরের কিছু হলে প্রায় ক্ষেত্রে তা নেতিবাচক দিকে ধাবিত হয়। যেমন, মাওবাদী আন্দোলন নিয়ে নির্মিত বলিউডি সিনেমাগুলো।
ভারতীয় সিনেমার আমদানি প্রসঙ্গে আমাদের এফডিসির কর্তাব্যক্তিদের মতামত গুরুত্ব সহকারে নেয়া উচিত। বিশেষ করে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে যাঁদের অবদান অনস্বীকার্য তাঁদের ভাবনা তো অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের মধ্যে অনেকেই যে এই উদ্যোগে খুবই খুশি তা অবশ্য বোঝা যায়। অনেকে আবার তার ব্যতিক্রম। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় দু-একজনের মতামত অবশ্য পাওয়া গেল। যেমন এফ. আই. মানিক, ইলিয়াস কাঞ্চন এবং মাসুদ পারভেজ (পর্দায় সোহেল রানা হিসেবে পরিচিত) নিউ এজ পত্রিকার (Devided Intersts, NEWAGE EXTRA – ৯ সেপ্টেম্বর ২০১১) ফিচারে বর্ণিত তাদের ভাবনায় মোটামুটি এটা প্রতিফলিত, ভারতীয় বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের আগমন আমাদের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে না। এক্ষেত্রে মাসুদ পারভেজ অবশ্য বেশ রাজনৈতিকভাবে মন্তব্য করলেন, ‘ভারতের প্রদেশ হতে বাংলাদেশের খুব বেশি দেরি নেই’ (On the Line, NEWAGE EXTRA – ৯ সেপ্টেম্বর ২০১১)। কিন্তু কেউই বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের উন্নয়নে কার্যকর কী কী পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে এবং কীভাবে চলচ্চিত্রর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নির্মাণ সম্ভব — তা নিয়ে স্পষ্ট কোনো দিক নিদের্শনা দিলেন না। ক্ষোভের মধ্যে শুধু বেরিয়ে এসেছে, কারিগরি ও সরকারি সহায়তার ঐতিহাসিক অসহযোগিতা। তবে এক্ষেত্রে আমি তাদের অনেক বেশি জনগণ-সম্পৃক্ত হওয়ার আহ্বান জানাই। তাঁদের ভুলে যাওয়া চলবে না, মধ্যবিত্ত দর্শক শিল্পসম্মত চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য আমাদের বিকল্প বা স্বাধীন চলচ্চিত্রকারদের দিকে তাকিয়ে থাকলেও সর্বস্তরের জনগণের প্রত্যাশা কিন্তু বাংলাদেশ ফিল্ম কর্পোরেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের দিকে। যতদিন এফডিসি তার সামর্থ্য ও সামগ্রিকতা নিয়ে এগিয়ে আসবে না, ততদিনে (স্বাধীন বা পরাধীন) কোনো নির্মাতাই বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে জাতীয় অঙ্গনে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারবে না। বিদেশী পুরস্কার নির্মাতাদের চলচ্চিত্র নির্মাণে উৎসাহিত করে, কিন্তু তা দেশের সর্বাত্মক সাংস্কৃতিক আবহ তৈরি করে না। তরুণ নির্মাতাদের উৎসাহিত করা, এফডিসির কারিগরি ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাকে সম্পৃক্ত করা মূলত এফডিসির কাজ। সেই সাথে দেশের অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় চলচ্চিত্রের সাহসী ভূমিকার প্রতি তাদের গুরুত্ব দিতে হবে। বিনিয়োগকারীদের বোঝাতে হবে, চলচ্চিত্র অবশ্যই সচ্ছল হতে পারে। সরকারকে আরো দায়িত্বশীল করে দেখাতে হবে, এটা অবশ্যই লাভজনক একটি ইন্ডাস্ট্রি এবং মানুষকে সুস্থ বিনোদন প্রদানের মধ্য দিয়ে বিপুল রাজস্ব আয় সম্ভব। এতে বিস্মিত হবার কিছু নেই, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই তার নজির আছে। এর জন্য প্রয়োজন সঠিক প্রাতিষ্ঠানিক ও কারিগরি শিক্ষা এবং সামাজিক ক্ষেত্রে চলচ্চিত্রের নিজস্ব সংস্কৃতি।
পাঠক ভুল বুঝতে পারেন, আমি ভারতীয় চলচ্চিত্রের বিরোধিতা করতে বসেছি মনে করে। ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজেও ভারতীয় সিনেমার অনেক পুরোনো দর্শক, ভিসিআর আগমনের যুগ থেকে। তার ব্যাপ্তি এবং প্রভাব সম্পর্কে অল্প-বিস্তর ওয়াকিবহালও আছি। তাই বলতে চাইছি, ভিডিওতে-ডিভিডিতে আমরা যতই বিদেশী ছবি দেখি না কেন, আমাদের সিনেমাহলে কী ছবি চলছে তা নিয়ে একটু ভাববার অবকাশ আছে বলে মনে করি। এই যেমন, একজন আত্মীয় আপনার বাসায় মেহমান হিসেবে দীর্ঘদিন থাকতে পারে, কিন্তু তাকে যদি আপনার ঘরের একটা রুম সাবলেট দিয়ে অধিকার দিয়ে বসেন, তাহলে কি সে আপনার পরিবারের জন্য অল্প সময়ের মধ্যেই অস্বস্তির (ক্ষতির) কারণ হয়ে উঠবে না?
উত্তর দেয়ার দায়িত্ব আপনার উপরই থাকলো।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
১৪ comments
হাঁটুপানির জলদস্যু - ১ ডিসেম্বর ২০১১ (৫:১৩ পূর্বাহ্ণ)
এ প্রসঙ্গে একটি লেখার লিঙ্ক দিয়ে গেলাম।
রফিকুল আনোয়ার রাসেল - ১ ডিসেম্বর ২০১১ (১২:১৯ অপরাহ্ণ)
লিঙ্কটির জন্য ধন্যবাদ। লেখাটি পড়ে ভাল লাগলো খুব।
মোহাম্মদ মুনিম - ১ ডিসেম্বর ২০১১ (৯:২০ পূর্বাহ্ণ)
ভারতীয় ছবি বাংলাদেশে সিনেমা হলগুলোতে দেখানো হবে কি হবে না তা নিয়ে ভারতীয়দের খুব একটা মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। বলিউডের বাজার এখন ভারত ছাড়িয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে গিয়েছে, বাংলাদেশের ছোট্ট বাজার নিয়ে তাঁরা নিশ্চয় খুব চিন্তিত নন। মানে ভারতীয় ছবি আসার ব্যাপারে ভারতীয়দের পক্ষ থেকে কোন চাপ নেই। বাংলাদেশে ভারতীয় ছবি দেখানো হবে কি হবে না সেটা পুরোপুরি আমাদেরই ব্যাপার।
ভারতীয় ছবি দেখানো হলে বাজার রক্ষার তাগিদেই এফডিসিতে মানসম্মত ছবি তৈরি শুরু হবে, এটা হচ্ছে ভারতীয় ছবি দেখানোর পক্ষে যুক্তি। আমার কাছে এই যুক্তিটা খুব শক্ত বলে মনে হয় না। ধরা যাক শাহরুখ খানের ‘দেবদাসে’র পাশাপাশি বুলবুল আহমেদের ‘দেবদাস’ মুক্তি পেলো। স্বয়ং শরৎচন্দ্র বুলবুল আহমেদের দেবদাস কেই সাহিত্যিক বিচারে এগিয়ে রাখবেন। কিন্তু ভারতীয় (এবং অবাঙ্গালী) পার্বতীর শ তিনেক সখি সখাসহ মহা শান শওকতের নাচ গানের কাছে বাংলাদেশের দেবদাস ব্যবসায়িক ভাবে কোন পাত্তাই পাবে না। একটা ছবির জন্য গোটা বাংলাদেশের বাজারই যেখানে দশ কোটি টাকাও নয়, সেখানে কোন নির্মাতাই নিশ্চয় বিশ কোটি টাকা ঢেলে বাংলা দেবদাস বানাবেন না। ফলাফল হচ্ছে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের নিশ্চিত মৃত্যু।
প্রতিযোগিতার অভাবে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প কোনদিন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারেনি, এই কথাটা কি আসলে ঠিক? এফডিসি সরকারি প্রতিষ্ঠান হলেও এখানে বেসরকারি প্রযোজকেরা স্টুডিও ভাড়া নিয়ে শুটিং করেছেন, যারা বেশি টাকা ঢেলেছেন তাঁরা বিদেশে গিয়ে শুটিং করেছেন, অনেকে ভারতে গিয়ে সম্পাদনার কাজ করিয়েছেন। একজন প্রযোজকের সাথে আরেকজন প্রযোজকের প্রতিযোগিতা তো ছিলই। সেই প্রতিযোগিতা মুক্তবাজারের সমস্ত নিয়ম মেনেই হয়েছে। কিন্তু তার পরেও বাংলাদেশে চলচ্চিত্র শিল্প ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়েছে। সিনেমা হলের সংখ্যা ক্রমশ কমেছে, এর একটা কারণ হচ্ছে ভিসিআর আর ডিভিডির শাহরুখ খান, বড় শহর তো বটেই, মফস্বলেও শাহরুখের দাপটে দর্শক সিনেমাহল বিমুখ হয়েছে। আর একটা কারণ হচ্ছে রিয়েল এস্টেট মার্কেট। সিনেমা হল ভেঙ্গে মার্কেট বানালে যদি পয়সা বেশি আসে, তবে হলের মালিক নিশ্চয় তাই করবেন, তাঁর মুল উদ্দেশ্য তো ব্যবসা করা, চলচ্চিত্রের সেবা করা নয়।
ভারতীয় সিনেমার বাজার খুলে দিলে তাতে বলিউডের শান শওকতের ছবিই আসবে, ভারতীয় শিল্পসম্মত ছবি নয়। মধ্যবিত্ত তরুণ তরুণীরা শাহরুখকে বড় পর্দায় দেখার লোভ সামলাতে পারবে না, টিকেটের দাম বেশি হলেও যে টাকায় বই বা জামা কিনত সেই টাকা জমিয়ে ছবি দেখবে। তাতে দেশের চলচ্চিত্র শিল্পের পাশাপাশি মুদ্রণশিল্প, পোশাক শিল্প সব শিল্পেরই ক্ষতি।
হলিউডের প্রবল প্রতাপে ইংরেজি ভাষাভাষী দেশগুলোর একটিতেও নিজস্ব চলচ্চিত্র শিল্প দাঁড়াতে পারেনি। সেকালের হিচকক থেকে শুরু করে একালের মেল গিবসন, সকলেই হলিউডে গিয়েই প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। যুক্তরাজ্য বা অস্ট্রেলিয়ার প্রতিটি তরুণ অভিনেতা বা পরিচালক নিজেদের হলিউডেই দেখতে চান, হয় হলিউডে গিয়ে কাজ করা, না হলে নিজেদের ছবিতে হলিউডের অর্থায়ন। বলিউড বাংলা ভাষা কেন্দ্রিক হলেও বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের বলিউডের সাথে মিলেমিশে কাজ করার একটা সুযোগ থাকতো, হিন্দি ভাষাভাষী বলিউড তো আমাদের পকেট হাতড়ানো ছাড়া কিছুই করবে না।
বাংলাদেশে সিনেমা হলের সংখ্যা ১৬০০ থেকে ৬০০ তে নেমে এসেছে, সেটা আরও নামতে পারে, উঠতেও পারে, সেই উঠানামা বাজারের কঠিন নিয়মেই হবে, তবে সেই বাজারে থাকবেন আমাদের মুল ধারার শাকিব খান আর বিকল্প ধারার ফারুকী, বড় পর্দার শাহরুখ নন।
মাসুদ করিম - ১ ডিসেম্বর ২০১১ (১:২৭ অপরাহ্ণ)
ভারতীয় ছবি আমরা আমদানি করব না, আমরা অবশ্যই আমদানি করব বলিউডি ছবি। তাহলে আমাদের হলগুলোতে তখন চলবে দেশে বানানো ঢালিউডি ও বম্বেতে বানানো বলিউডি ছবি — টালিউডি (কলকাতা) বা মলিউডি(দক্ষিণ ভারতীয়) ছবি তেমন একটা পাত্তা এখানে পাবে না। আর যদি আমরা আরো এগিয়ে গিয়ে ললিউডি(পাকিস্তানি, সালিউডি(চৈনিক) ও হলিউডি ছবি আমাদের দর্শকদের পাতে দিতে চাই, সেখানেও হলিউডি ছাড়া অন্যরা তেমন একটা জায়গা করতে পারবে না। তাহলে আমাদের বাজারে প্রতাপ থাকবে ঢালিউডি, বলিউডি ও হলিউডি ছবির। এখন কথা হচ্ছে এই অসম প্রতিযোগিতায় আমাদের ঢালিউডি ছবি চলবে কি না? যদি চলে তাহলে তার মার্কেট শেয়ার কত হবে?
কিন্তু কোনো আলোচনাই এই পর্যন্ত এদিকে আলোড়িত হতে দেখা যাচ্ছে না। প্রতিটি আলোচনাই হচ্ছে হয় এতে প্রতিযোগিতায় আমাদের ছবির মান ভাল হবে বা বলিউডি ছবির তালে পড়ে আমরা সবাই নষ্ট হয়ে যাব। আমাদের ঢালিউডি ছবি এখন যেভাবে হচ্ছে সেভাবে হলে আমাদের পরিবেশকরা সেছবি নিয়ে তখনও প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শন করবেন যদি সেখান থেকে তিনি ভাল লাভ পান। বলিউডি বা হলিউডি ছবি নিয়মতান্ত্রিকভাবে আমদানি হলে অবশ্যই পরিবেশকদের বেশি বিনিয়োগ করে সেছবি আনতে হবে এবং লাভের হিসাবও ঠিকঠাক তুলে আনতে হবে। ফলে ঢালিউডি ছবি বিলুপ্ত হয়ে যাবে বলে আমার মনে হয় না।
আর বিনোদন বর্হিভূত যেসব ছবি তারা কোথাও কোনোদিন ‘বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মী’ এই মন্ত্রে উদবোধিত হতে পারেনি। তাদের কাছে সর্বদেশে সর্বকালে ‘বাণিজ্যে বসতি অস্বস্তি’ই সত্যবাক্য হয়ে আছে। তাই এই ছবি আমদানি/না-আমদানি প্রসঙ্গে সেসব ছবির আলোচনা একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক।
আবু নঈম মাহতাব মোর্শেদ - ১ ডিসেম্বর ২০১১ (২:২০ অপরাহ্ণ)
আমাদের দেশে যা ছবি তৈরি হচ্ছে এফডিসি তে, ঐসব ছবির একটা নিশ্চিত মার্কেট আছে দেশের ভেতরেই। এখন হিন্দি ফিল্ম আমদানী করলে ঐ মার্কেট নষ্ট হয়ে যাবে এটা মনে হয় পুরোপুরি ঠিক না। যেটা হতে পারে মার্কেট টা ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। কিন্তু আমরা যদি কোলকাতার এক্সপেরিয়েন্স টা দেখি তাহলে দেখবো হিন্দি ফিল্মের ছায়ার তলে সাহসিকতার সাথে মৃতপ্রায় অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে ওরা। এখন যেটা হতে পারে সরকার একটা নিয়ম করতে পারে যে একটা ছবিঘরে প্রতিমাসে কয়টা হিন্দি ফিল্ম চলবে কয়টা শো ঢাকাই ছবি চলবে, এবং প্রদর্শনীর সময় টা ঠিক করে দিতে হবে। তাহলে পরে আমাদের দেশী সিনেমাও বাঁচবে, হল মালিকরাও বাঁচবে।
মোহাম্মদ মুনিম - ৪ ডিসেম্বর ২০১১ (২:৫৯ পূর্বাহ্ণ)
কদিন আগে অপর্ণা সেনের ‘ইতি মৃণালিনী’ দেখলাম, ইন্টারনেটে। ডালাসে দু-দুটো ভারতীয় ছবির থিয়েটার (মাল্টিপ্লেক্স) আছে, বলিউডের ছবি ভারতে মুক্তির সাথে সাথে এখানেও একই সাথে মুক্তি পায়, লোকে দল বেঁধে ছবি দেখতে যায়। গত দশ বছরে ডালাসের থিয়েটারে একটিও ভারতীয় বাংলা ছবি মুক্তি পায়নি। কিন্তু এই সময়কালে কোলকাতায় মনে রাখার মতো গোটা বিশেক ছবি তৈরি হয়েছে। বছরে গোটা দুয়েক ভারতীয় বাংলা ছবি বড় পর্দায় দেখার সুযোগ পেলে আমার নাগরিক জীবন অনেক সুরভিত হতে পারতো, কিন্তু সেটা হবার কোনই আশা নেই।
কলকাতায় ভাল মানের বাংলা ছবি অনেক দিন ধরেই তৈরি হচ্ছে, আগামীতেও হবে, যারা এসব ছবি তৈরি করেছেন এবং করছেন, তাঁরা নিজের তাগিদেই করেছেন, বলিউডের সাথে পাল্লা দিতে করেননি। বাংলাদেশে বলিউডের ছবি এলে মোরশেদুল ইসলামরা ছবি করেই যাবেন এবং কিছু দর্শক সেসব ছবি দেখবেনও। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে শাহরুখ খান এলে শাকিব খান থাকবেন না। বছরে শাকিব খান কয়টা চল্লিশ লাখের দুর্গন্ধময় আবর্জনা আর শাহরুখ খান কয়টা চল্লিশ কোটির সুরভিত আবর্জনা তৈরি করছেন তাতে আমার কোনই আগ্রহ নেই। কিন্তু এই সুরভিত আবর্জনা বছরে বিশ ত্রিশ কোটি টাকা ভারতে নিয়ে যাবে। কয়েক কোটি টাকা হয়তো সরকারের আর হল মালিকদের হাতে থাকবে, কিন্তু এর ফলে লাখ লাখ স্থানীয় চলচ্চিত্র কর্মী কাজ হারাবেন, ছেলে মেয়েরা হুমায়ুন আহমেদের বই না কিনে সেই টাকা শাহরুখকে দেখতে খরচ করবে, তাতে প্রকাশনা শিল্পেরও ক্ষতি। শাকিব খান কাজ হারিয়ে হয়তো ফুটপাতে ছিট কাপড়ের ব্যবসা করবে, নাহলে মালয়েশিয়া যাবে। সেটা কি আমাদের জন্য ভালো হবে?
নুর নবী দুলাল - ২ ডিসেম্বর ২০১১ (৬:১১ পূর্বাহ্ণ)
আপনার লেখাটি পড়ে ভালই লাগল। এ বিষয়ে আমার নিজের লেখা একটি লিঙ্ক শেয়ার করলাম। পড়ে দেখতে পারেন।
nizam uddin - ৫ ডিসেম্বর ২০১১ (১:১২ পূর্বাহ্ণ)
বছরে শাকিব খান কয়টা চল্লিশ লাখের দুর্গন্ধময় আবর্জনা আর শাহরুখ খান কয়টা চল্লিশ কোটির সুরভিত আবর্জনা তৈরি করছেন তাতে আমার কোনই আগ্রহ নেই।nice talk…
nizam uddin - ৫ ডিসেম্বর ২০১১ (১:১৬ পূর্বাহ্ণ)
namashtey mahtab dada,shujog thakle agami saat tarik roj budbaar amar bashay ashunna,ektu khashir rejala jogey SRK’r new release dekhi.apner taka khoroch korte hobena.apni ki kokhono bolliyudi film’er dvd kinechen dada?
রফিকুল আনোয়ার রাসেল - ৯ ডিসেম্বর ২০১১ (২:৪৪ পূর্বাহ্ণ)
আমাদের জাতীয় দৈনিকগুলোও এ বিষয়টি নিয়ে ভাবছে :
‘ভারতীয় চলচ্চিত্র মুক্তি নিয়ে বিতর্ক’।
রফিকুল আনোয়ার রাসেল - ৯ ডিসেম্বর ২০১১ (১:২২ অপরাহ্ণ)
মেঘদূত - ১৭ ডিসেম্বর ২০১১ (১২:৪৭ অপরাহ্ণ)
আমি ভারতীয় ছবি আমদানির পক্ষেই কথা বলব। শুধু ভারতীয় না, অন্যান্য ভাষার সিনেমাও নিয়মিত আমদানি কড়া উচিত।
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর - ১৮ ডিসেম্বর ২০১১ (৮:০৬ পূর্বাহ্ণ)
বেশ যুক্তিপূর্ণ লেখা।
আমরা কিন্তু এখন নানাভাবে ভারতীয় ফিল্ম বা টিভি-সিরিয়াল, নাটক ইত্যাদি দেখছি। এখন আর হলে গিয়ে ছবি দেখারও প্রয়োজন নেই। নানাভাবে তা আমাদের কাছে আসতে পারে।
আমার কাছে যেটা মনে হয়, এখানে ব্যক্তির নৈতিকতা বা অটোসেন্সরশিপ অনেক দরকারি বিষয়। আমরা কলকাতার বাংলা বা অন্য ভাষাভাষির আর্টফিল্ম তো দেখতে চাইই। এখানে শত্রুতার কিছু নেই। এ-ব্যাপারে সরকারের সুস্পষ্ট কার্যকর নীতিমালঅ থাকতে হবে।
সাব্বির হোসাইন - ৪ জুলাই ২০১৪ (১২:০৮ অপরাহ্ণ)
চমৎকার লেখা।
আপনার সাথে আড্ডা দেয়াটা যেমন উপভোগ্য, লেখাটাও তেমন সুপাঠ্য।