কৃষি প্রধান অঞ্চল চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জের কানসাট। ওখানকার অধিকাংশ লোকই কৃষিজীবী এবং খেটে খাওয়া মানুষ। কৃষিকাজকে কেন্দ্র করেই তাদের জীবনের যাবতীয় সুখ, দুঃখ, হাসি কান্না, সফলতা, ব্যর্থতা। তাই নির্দিষ্ট মওসুমে তারা ধান বপন করে তাদের সর্বস্ব দিয়ে, এমনকি যারা নিতান্তই হতদরিদ্র, কিছুই অবশেষ নেই, তারাও ধার দেনা করে, ঘরের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বিক্রি করে ঢেলে দেয় ধানের জমিতে। ধান উঠলে যাবতীয় ধারদেনা শোধ হবে, ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাবে, গৃহিনীর মুখে হাসি ফুটবে, সচল থাকবে সংসারের চাকা।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার এ অঞ্চলটি বাংলাদেশের অন্যান্য জনপদের মতই শান্ত, নির্বিরোধী এবং নিরীহ জনগনের আবাস। নিজস্ব সংস্কৃতি, গান, আম এর বাইরে তাদের আলাদা সংগ্রামী কোন বৈশিষ্ট্যর কথা আলাদা করে কেউ শোনেনি। কিন্তু ২০০৬ সালের একটি ঘটনা কানসাটকে সমগ্র দেশের আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসে, বিদু্যতের অভাবে পানির অভাব ঘটে, পানির অভাবে ধানের চারা মারা যেতে থাকে। ঐ অঞ্চলে বিদ্যুৎ বিতরণ করে থাকে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি, ফলে কানসাটবাসী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি মুখোমুখি বিরোধে জড়িয়ে পড়ে।
পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি কানসাটে কি কি করেছিল?
১.কয়েক বছরের মধ্যে মিটার ভাড়া ৪৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০৫ টাকা নির্ধারণ।
২. বিদ্যুৎ দিতে পারুক বা না পারুক গ্রাহকসংখ্যা বাড়িয়ে ২৪ হাজার থেকে ৫৬ হাজারে উন্নিত করণ (প্রত্যেক গ্রাহকের কাছ থেকে মিটার ভাড়া বাবদ বিপুল অর্থ আদায় করা যাবে)।
৩. গ্রামবাসীকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ না করা।
গ্রামবাসীর অভিযো,গ ২৪ ঘন্টার মধ্যে ৩ ঘন্টাও বিদ্যুৎ থাকে না, ঐ থাকাকালীন সময়েও ৭/৮ বার ভোল্টেজের বাড়া কমার কারণে তাদের মটর পুড়ে যায়। বিদ্যুৎ না থাকলে সেচপাম্প চলে না, সেচপাম্প না চললে জমিতে পানির সরবরাহও বন্ধ হয়ে যায়। ফলে পানির অভাবে কৃষকের চোখের সামনেই তাদের জমিতে ধানের চারা গুলি নষ্ট হয়ে যেতে থাকে। মারা যেতে থাকে।
ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠে কৃষক, প্রতিবাদ করে।
প্রতিবাদী কৃষকদের শায়েস্তা করার জন্য পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কিছু লোক রাতে এসে (রাতের আসার কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে জবাব দিয়েছিল, মিটার চেক করতে এসেছে) তাদেরই ট্রান্সফরমার চুরি করে নিয়ে যায় (বিদ্যুতের কাজ না জানলে ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি না থাকলে সাধারণ কারো পক্ষে ট্রান্সফরমার খোলা সম্ভব নয়), চুরির দায় চাপায় গ্রামবাসীর উপর এবং জরিমানা বাবদ মোট মূল্য ১,১৪,০০০ টাকা এর অর্ধেক (বাকী অর্ধেক সমিতি দেবে) পরিশোধ করার নির্দেশ দেয়। (তিনটি ট্রান্সফরমারের মুল্য সর্বোচ্চ ৪৫,০০০ টাকা, স্থানীয় একজন পাম্পচালকের ভাষ্যমতে)।
এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে অসন্তোষ দানা বেঁধে ওঠে। স্থানীয় কৃষকরা এসব সমস্যা সমাধানের জন্য স্মারকলিপি দেয় স্থানীয় সংসদ সদস্য, পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি, পিডিবি, পুলিশ ইত্যাদি আরো কয়েকটি জায়গায়। দেয়া হয় গোলাম রাব্বানীর নেতৃত্বে, যিনি কিছুদিন আগে পল্লী বিদ্যুৎ গ্রাহক সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিতে কয়েকটি মিটিং হয়, প্রতিটি মিটিংয়েই গ্রামবাসীদের দাবীগুলি উপেক্ষা করা হয় এবং ছয়মাস পর সর্বশেষ মিটিং এ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জি এম এর উপস্থিতিতে গোলাম রাব্বানীকে তিরস্কার করা হয় এসব উদ্ধত দাবী পেশ করার জন্য।
চোখের সামনে জমির পর জমির ধান হারিয়ে, সারাদিন সারারাত অন্ধকারে থেকে, উচ্চমূল্যে বিদূতের দাম পরিশোধে বাধ্য হয়ে জনতা তখন দিশেহারা, মরিয়া। গোলাম রাব্বানী তখন কয়েকজন এলাকাবাসীকে নিয়ে “পল্লী বিদ্যুৎ সংগ্রাম সমিতি” গঠন করেন। যারা কর্মসূচী দেয় পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি কার্যালয় ঘেরাও এর।
ঐ দিনই বিপুল লোকের মিছিল এগিয়ে যায় অন্যায় ও শোষনের প্রতীক হয়ে উঠা পল্লী বিদ্যুৎ ভবনের দিকে, মিছিলে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন রাব্বানী। মাইকে বার বার তার আহ্বান ভেসে আসছিল, আপনারা শান্তিপূর্ণ ভাবে সমাবেশে অংশ নিন, কেউ সংঘর্ষে জড়াবেন না। কিন্তু তার কথা চাপা পড়ে যায় পুলিশের গুলির শব্দে।
স্থানীয় একজন বয়স্ক কৃষক টিসুর মতে, টি এন ও সাহেব বললেন, ফায়ার। সাথে সাথে লুটিয়ে পড়ল নয়ন, মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে, টিসু এবং কয়েকজনের কাছ থেকে গুলিবিদ্ধ নয়নকে ছিনিয়ে নিয়ে পুলিশ তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায় পলী্ল বিদ্যুৎ সমিতির অফিসের খোলা ময়দানে, ফেলে রাখে তাকে, ধীরে ধীরে সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে সে। সেদিন কাজলও মারা যায়। মোট চারটি জীবন এবং অসংখ্য গুলিবিদ্ধ প্রতিবেশী, আত্মীয় পরিজন, বন্ধুবান্ধব দেখে পুরো এলাকাবাসী ফুঁসে উঠে।
শুরু হয় সর্বাত্নক আন্দোলন।
সরকার কোন আলোচনা বা সহনশীলতা বা এলাকাবাসীর আর্জি বিবেচনার তোয়াক্কা না করে শক্তি প্রযোগ করে আন্দোলন দমন করার কৌশল নেয়। পাঠানো হয় ব্যাপক পুলিশ।
পুলিশ গিয়ে কি কি করল সেখানে?
১. গ্রামজুড়ে ভয়াবহ তান্ডব চালানো হল (গ্রামবাসীর মতে ১৯৭১ ও এ বীভৎসতা দেখেনি কানসাটের মানুষ)
২. নির্বিচারে গুলিবর্ষণ। শিশু বৃদ্ধ যাকেই যেভাবে পেয়েছে রাস্তায় ফেলে জোট বদ্ধ হয়ে নির্মম প্রহার। ১২ বছরের কিশোর খুন। পালাতে গিয়ে নিশানা করে গুলি করা হয় আরেক কিশোরকে।
৩. দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে টাকপয়সা লুট, ভাঙচুর। বড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িও ভাঙচুর করেছিল পুলিশ।
৪. ১২ বছরের এক কিশোরীকে তুলে নিয়ে গিয়ে রাতভর ধর্ষণ। গ্রামবাসী তার সম্পূর্ণ নগ্ন অচেতন দেহ কুড়িয়ে আনে পরের দিন।
৫. জোড়হাতে ক্ষমা প্রার্থনারত চলৎশক্তিহীন বৃদ্ধের হাতে গুলি, অশ্লীল গালিগালাজ।
৬. কিশোরী, যুবতী এমনকি বৃদ্ধাদের প্রহার। নির্বিচারে গ্রেফতার। নির্যাতন।
৭. সর্বশেষ কানসাট আন্দোলনের নেতা গোলাম রাব্বানীকে মধ্যরাতে গ্রেফতার, চোখ ও হাত পিছমাড়া করে বেঁধে নির্যাতন। মামলা। আসামী অসংখ্য। গ্রেফতার অসংখ্য।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি কি করল?
স্থানীয় সংসদ সদস্যের নাম শাহজাহান মিয়া। তিনি ফোনে আন্দোলন বন্ধের নির্দেশের পাশপাশি গোলাম রাব্বানীকে কিছু হুমকিও দিলেন। যেমন মিছিল করা যাবে না। করলে “জনগন” মিছিল ঠেকাবে। মিছিল ঠেকানোর জন্য তিনি পাঠালেন তাদের দলের নেতা (জাতীয়তাবাদী কৃষক দলের স্থানীয় সভাপতি) মাহবুবকে। (গ্রামবাসীর মতে তার নাম “বোমা মাহবুব”, বোমা তৈরী ও নিক্ষেপের জন্য এলাকায় যার বিশেষ “খ্যাতি” আছে) সে তার দায়িত্ব পালন করল নিষ্ঠার সাথে, ব্যাপক বোমা নিক্ষেপ করা হল (একজন গ্রামবাসীর মতে) ঐদিন রাস্তায় একটি তিল পরিমানও স্থান ছিলনা যেখানে মাহবুবের বোমা পড়ে নি।
সরকার কি করল?
তৎকালীন এল জি আর ডি মন্ত্র্ত্রী ফোন করলেন গোলাম রাব্বানীকে। জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি চাও?
স্বাভাবিকভাবেই গোলাম রাব্বানী ব্যক্তিগত প্রলোভনের ফাঁদে পা না দিয়ে জনদাবী পুরণের আহ্বানই জানিয়েছিলেন সরকারের উচ্চপর্যায়ে।
গোলাম রাব্বানীকে গ্রেফতার কবার পর, উত্তর বঙ্গের প্রায় সব পুলিশকে (১৫,০০০) পাঠানো হয় কানসাট বাসীদের “দমন” করবার জন্য। তাদের নেতাকে জেলে পুরে রেখে, নির্দেশনাহীন জনতাকে সহজেই “ঠান্ডা” করে দেয়া যাবে, হয়তো এমনই আকাঙ্খা ছিল “নির্বাচিত” গণতান্ত্রিক সরকারের।
পুলিশ, সরকার, জনপ্রতিনিধি এসব কেন করল?
পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তাদের বর্ধিত বেতন ভাতা দিতে, গাড়ি বাড়ি সুবিধা দিতে (তাদের বেতন ও সুবিধা পিডিবি’র কর্মকর্তাদের চেয়ে বেশী)।
পল্লী বিদ্যূৎ সমিতি কি করে?
পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি নিজেরা বিদ্যুৎ উৎপাদন করে না। ২.০০ টাকা হারে পি ডি বি এর কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনে নিয়ে সেটা গ্রামবাসীর কাছে বিক্রি করবে ৪.০০/৪.৫০ টাকা হারে। এই বর্ধিত টাকা ব্যয় হয় গুটিকয়েক কর্মকর্তার বিলাসী জীবন যাপনে।
২০০৬ সালে ঘটে যাওয়া চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাট অঞ্চলে দুর্বার গনআন্দোলন ও রাস্ট্রশক্তিকে পরাস্ত করে জনতার বিজয় অর্জনের ঘটনাকে উপজীব্য করে, উপরোক্ত ঘটনাগুলি তথা আন্দোলনের সমগ্র দিকগুলি, রাস্ট্রীয় নির্মমতা এবং স্থানীয় জনসাধারণের ব্যাপক ত্যাগ, আবেগ, চেতনা, জীবনকে ধারণ করে, নির্মিত হয়েছে এই তথ্যচিত্র “মন্দ্রিত কানসাট”।
ছবিটির বিশিষ্টতা কোন জায়গায়?
তীব্র আন্দোলনের সময়, সংবাদমাধ্যমকমর্ীদের মত প্রাণের ঝুকি নিয়ে চলতে থাকা উত্তাল আন্দোলনের সজীব চিত্রগ্রহণ, আন্দোলনকারীদের টাটকা ক্ষোভ, সদ্য সন্তানহারা মায়ের, অঙ্গহানির শিকার হওয়া মানুষের, ভীত সন্ত্রন্ত কিশোরীর, বিমূঢ বৃদ্ধ, দিশেহারা শিশু ..সর্বস্তরের গণমানুষের অংশগ্রহণ এই ছবির বিশেষ দিক। সচরাচর তথ্যচিত্রের মত, নির্মোহ, দূর থেকে দেখে এসে ঘটনার বর্ণনা বা তথ্য পরিবেশনা নিয়ে এ ছবি নয়, বাংলাদেশের রাজনৈতিক আয়োজনে গড়ে উঠা আন্দোলন সমুহের বিপরীতে ..পুরো বাংলাদেশকে নাড়িয়ে দেয়া সাধারণ জনগনের এ আন্দোলনকে তুলনা করা চলে, ৬৯ বা ৯০ এর আন্দোলনের সাথেই। স্থানীয় কয়েকজন বয়স্ক ব্যক্তিও আখ্যায়িত করলেন, পুলিশি হামলাকে ৭১ এর পাক বাহিনীর নৃশংসতা ও অসভ্যতাকে ছাড়িয়ে যাওয়া বলে।
শুধু মাত্র বিদুতের দাবিতে প্রাণ বিসর্জন দেয়া এ নয়, ঐ সময় পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি হয়ে উঠেছিল শোষন, অন্যায়, অত্যাচার ও জুলুমের প্রতীক। পাশে পেয়েছিল স্থানীয় সাংসদ, পুলিশ, বিডিআর তথা পরিপূর্ণ রাস্ট্রীয় শক্তিকে। তাই কানসাটবাসীর আন্দোলনও ছিল ন্যায্য দাবী আদায়ের জন্য রাস্ট্রশক্তি ও গায়ের জোরে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির গনবিরোধী কার্যক্রমের বিরুদ্ধে সাধারণ জনতার সংগ্রাম, যা করতে গিয়ে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েও আন্দোলন চালিয়ে গেছে তারা, পুলিশি খুন, লুঠপাট, মামলা, ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ, নির্যাতনকে জয় করে, নেতা গোলাম রাব্বানীকে মধ্যরাতে চোখ ও হাত পিছমোড়া করে বেঁধে ধরে নিয়ে যাওয়ার পরও সাধারণ জনতাই আন্দোলনের নেতৃত্ব তুলে নিয়েছিল নিজেদের হাতে। বৃদ্ধ কৃষকের দৃঢ কণ্ঠে শুনি, জেল ভেঙে তাদের নেতাকে মুক্ত করে আনার প্রত্যয়, সরকারী কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত হুমকিকে উপেক্ষা করে গ্রামীণ মহিলাদেরও ব্যাপক মিছিল সংগঠন, লাগাতার হরতাল, অবরোধ, সর্বোতভাবে এই ছবি সাধারণ জনতা ও নিপীড়ক সরকার এই দুই গোষ্ঠীর মুখোমুখি লড়াইয়ের সত্য চিত্র।
তথ্যচিত্র: মন্দ্রিত কানসাট। ফরম্যাট: ডিভিক্যাম। পরিচালক: আমিনুল আকরাম, সাইফুল হক অমি, বরকতউল্লাহ মারুফ। দৈর্ঘ্য: ৫২ মিনিট।
