গত ১৮ জুলাই ২০০৮, শুক্রবার দৈনিক সমকালের উপসম্পাদকীয় পাতায় জনাব হুমায়ুন আহমেদের একটি সাক্ষাৎকার ছাপানো হয়, এটি গ্রহণ করা হয় সুইডেনে, সাক্ষাৎকারটি নেন সাবিবর রহমান খান।
শুরুতে তিনি সাক্ষাৎকার দেয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন যে, দেশের সাংবাদিকরা খুব ভাল করেই জানেন তিনি সাক্ষাৎকার দেন না, এখন বিদেশে সাক্ষাৎকার দিলে দেশীয় সাংবাদিকদের জন্য তা অস্বস্তিকর হয় কিনা…
ঐ সাক্ষাৎকারের কিছু অংশ এরকম :
প্রশ্ন :আপনি তো মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন। আপনার দৃষ্টিতে একাত্তরের মৌলবাদ ও মৌলবাদী এবং বর্তমানের মৌলবাদ ও মৌলবাদীর মধ্যে তফাত কোথায় ?
উত্তর : একাত্তরের মৌলবাদ ও মৌলবাদীরা ছিল একটি বিদেশী শক্তি অর্থাৎ পাকিস্তানের অংশ। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের মৌলবাদ ও মৌলবাদীরা কোন বিদেশী শক্তির অংশ নয়। এটাই পার্থক্য। তবে আমাদের এত মৌলবাদী- মৌলবাদী চিৎকার করে কোন লাভ নেই, কারণ বিশ্বের সব দেশেই এখন এসব আছে। ইন্ডিয়ায় আছে বিজেপি, আমেরিকায় আছে ক্লু ক্লাক্স ক্লান – সারা পৃথিবীতেই আছে মৌলবাদী।
প্রশ্ন : বাংলাদেশে মৌলবাদের সমস্যা কি সমস্যা নয় ? বিএন পি-জামায়াত সরকারের সময়ে বাংলা ভাই,শায়খুল হাদিস, ৬৩টি জেলায় একসঙ্গে বোমাবাজি – এসব কি সমস্যার আওতায় পড়ে না ?
উত্তর : আমি মনে করি না। বাংলাদেশে মৌলবাদের সমস্যা বড় কোন সমস্যা এখনো হয়নি। জনগণ যদি ভোট দিয়ে মৌলবাদীদের নির্বাচন করে, তাহলে গণতান্ত্রিকভাবে তাদের কি বাদ দেয়া যায় ? হোক না তারা মৌলবাদী।
…
প্রশ্ন : এ দুর্মূল্যের বাজারে বাংলাদেশের মানুষ এখন কেমন আছে ?
উত্তর: সবাই খুব ভাল আছে। বিশ্বের সব জায়গাতেই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। এখনো বাংলাদেশে চালের দাম বিশ্বের যে কোন জায়গার চেয়ে কম।
প্রশ্ন : বাংলাদেশের বর্তমান সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে আপনি কোন্ দৃষ্টিতে দেখেন ?
উত্তর :আমি তাদের খুব ভাল দৃষ্টিতে দেখি। তারা খুব ভাল কাজ করছে।
…
প্রশ্ন : বাংলাদেশে জামায়াতের মৌলবাদী রাজনীতি বন্ধ করা উচিত। আপনি কী বলেন ?
উত্তর : আমি কোন রাজনীতি বন্ধ করার পক্ষপাতী নই। সারভাইভ্যাল ফর দ্য ফিটেস্ট। যে ফিটেস্ট সে সারভাইভ করবে। যে আনফিট সে সারভাইভ করবে না।
…
প্রশ্ন :বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার কি সাংবিধানিকভাবে বৈধ ?
উত্তর : তারা যথাসম্ভব সংবিধান মেনে চলেছেন বলে আমার বিশ্বাস।
…
প্রশ্ন : কিছুদিন আগে আমেরিকায় একটি অনুষ্ঠানে পশ্চিমবঙ্গের কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তসলিমাকে একজন বিতর্কিত লেখিকা বলেছেন। আপনি কি এ ব্যাপারে একমত ?
উত্তর : হ্যাঁ। আমার মনে হয়, উনি একজন বিতর্কিত লেখিকা। কারণ উনার লেখা দিয়ে উনি নিজেই নিজেকে বিতর্কিত করেছেন। তবে তসলিমা নাসরিন যে দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে আছেন, সেজন্য আমি খারাপ বোধ করি। কারণ একজন লেখক তার মাতৃভুমিতে বসবাসের অধিকার রাখে। তসলিমাকে দেশে ফিরতে দেয়া উচিত।
…
প্রশ্ন : বাংলাদেশের লেখকরা কি স্বাধীন ?
উত্তর : হ্যাঁ, বাংলাদেশের লেখকরা স্বাধীন।
প্রশ্ন : তাহলে ড.হুমায়ুন আজাদকে মরতে হলো কেন ?
উত্তর : কারণ, যে বইটা তিনি লিখেছিলেন, তা এতই কুৎসিত যে, যে কেউ বইটা পড়লে আহত হবে। তার জন্য মৌলবাদী হতে হয় না।
প্রশ্ন : ঠিক এই কারণেই কি তসলিমা নাসরিন দেশ থেকে বিতাড়িত ?
উত্তর : হয়তোবা।
প্রশ্ন : শহীদ জননী জাহানারা ইমাম দেশদ্রোহীর মামলা মাথায় নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। ওনার অপরাধ কী ছিল ? আপনি কী মনে করেন ?
উত্তর :উনাকে তো কেউ খুন করেনি। উনি তো ক্যান্সারে মারা গিয়েছেন। উনাকে দেশদ্রোহী কখনোই বলা হয়নি। দেশদ্রোহী কথাটা ভুল ইনফরমেশন। তাঁর বিরুদ্ধে কখনোই দেশদ্রোহীর মামলা করা হয় নি। তাছাড়া পুরো ব্যাপারটাই ছিল এত তুচ্ছ, আমরা জানি যে, পুরো ব্যাপারটাই ছিল একটা সাজানো খেলা। এটা নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। মৌলবাদীরা তো আমাকে কতবার মুরতাদ বলেছে, তাতে কি আমি মাথা ঘামিয়েছি কখনো ? কখনো না।
…
লক্ষণীয়, এ সাক্ষাৎকারে সাহিত্য নিয়ে কোন কথা নেই। সাহিত্য নিয়ে তার কোন কথা বা দৃষ্টিভঙ্গি বা লেখাও কখনো চোখে পড়ে না।
যাই হোক, বাংলাদেশের সাহিত্যমোদী, সাহিত্য সমালোচক বা তরুণ লেখকদের কাছে জনাব হুমায়ুন আহমেদের কোন গুরুত্ব নেই। তিনি বাংলাসাহিত্যের কোন গুরুত্বপূর্ণ লেখকও নন।
মুশকিল হচ্ছে, তাঁর অনেক পরিচয় থাকার পরও তিনি নাকি নিজেকে লেখক পরিচয় দিয়েই আনন্দ পান।
তিনি এই সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে, তিনি নাকি আনন্দ লাভের জন্যই লিখে থাকেন, এখন এই আনন্দের ভাগ যদি পাঠককে দেয়া যায় ইত্যাদি। তাঁর এই আনন্দ আবার বেড়ে যায় ঈদ সংখ্যাগুলি প্রকাশের সময় হলে এবং একুশের বইমেলা শুরু হবার ঠিক আগে আগে।
তিনি শিক্ষকও, বই লিখে, নাটক বানিয়ে তাঁর পরিচিতি ব্যাপক, তিনি মিডিয়ার কাছে খুবই দামী মানুষ। তিনি উচ্চশিক্ষিত, বুঝদার মানুষ, তিনি বললেন, বাংলাদেশের মানুষ এখন খুব ভাল আছে। (প্রসঙ্গ : দ্রব্যমূল্য)
বাংলাদেশের মানুষ কি এখন সত্যিই ভাল আছে ?
এখন চালের কেজি ৪০ টাকা। ডালের কেজি ১১০ টাকা, তেল ১২২ টাকা/ লিটার (হুমায়ূন আহমেদের সমস্যা নেই, তিনি এক কোটি টাকা দিয়ে এক একটি সিনেমা বানান, সাক্ষাৎকারে উল্লেখ আছে)।
একজন রিকশাচালক বা দিনমজুর বা অন্যান্য শ্রমজীবী, যার আয় দিনে আনুমানিক ২০০ টাকা, তার বাড়িতে যদি পাঁচজন খাওয়ার লোক থাকলে তার ন্যূনতম দৈনিক চাল লাগবে সাড়ে তিন/চার কেজি। শুধু চালই প্রায় ১৫০ টাকার । তারপর তাদের বাসা ভাড়া, চিকিৎসার খরচ, ছেলেমেয়েদের স্কুল।
ঢাকা শহরের সর্বমোট সোয়া কোটি নাগরিকের মধ্যে ৮০ শতাংশ মানুষের আয়ই ঐ ধরনের। কেউ দিনেরটা দিনে আয় করছে, কেউ-বা মাসে।
বাংলাদেশের মানুষ এখন খেয়ে না-খেয়ে তিলে তিলে মরছে, চিকিৎসার অভাবে মরছে, দিন দিন বাড়ছে চালসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম, আর তার বিরুদ্ধে কথা বলার রাস্তাও বন্ধ, সরকার জনগণের কণ্ঠরোধ করে রেখেছে।
গত সরকারের আমলে দ্রব্যমূল্যের কারণে জনগণ ব্যয় সংকোচন করেছিল, অর্থাৎ প্রয়োজনীয় দুইটা জিনিসের জায়গায় একটা জিনিস কিনে খেয়ে কম খাওয়ার চর্চা শুরু করেছিল। এখন তাও বন্ধ হবার জোগাড়, সরকার বলছে, চালের দাম বেশি হলে আলু খাও।
প্রাণটা কোনমতে টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম করছে বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ।
আর হুমায়ূন আহমেদ বলছেন, বাংলাদেশে মৌলবাদ কোন সমস্যা নয় । আমেরিকা, ভারতে আছে, বাংলাদেশেও আছে।
বাংলাদেশের আগামী দিনের প্রধান সমস্যা মৌলবাদ। হরকাতুল জিহাদ, জেএমবি সহ চারটি জঙ্গি গোষ্ঠীকে সরকার নিষিদ্ধ করতে বাধ্য হলেও সেগুলিসহ আরো কয়েকটি জঙ্গি গোষ্ঠীর তৎপরতার খবর পত্রিকার মাধ্যমে পাওয়া যাচ্ছে। এদের বিষয়ে সরকার সবসময়ই সন্দেহজনকভাবে উদাসীন । আফগানিস্তান, কাশ্মির সহ বিশ্বের কয়েকটি জায়গায় সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত উগ্র ইসলামি কয়েকটি জঙ্গি গোষ্ঠী জিহাদ সংগঠনের জন্য বাংলাদেশে ট্রেনিং ক্যাম্প করে কাজ করে যাচ্ছে। শুধু কাগজে কলমে নিষিদ্ধ করা ছাড়া তাদের বিরুদ্ধে কোন সরকারই কার্যকর কোন পদক্ষেপ আজো নেয় নি। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা, রমনার বটমূলে বোমা হামলা, সিনেমা হলগুলোতে বোমা বিস্ফোরণ, ব্রিটিশ কূটনীতিক আনোয়ার চৌধুরীর উপর বোমা হামলা, বিচার ব্যবস্থাকে অনৈসলামিক অ্যাখ্যা দিয়ে বিচারক ও আইনজীবীদের প্রাণনাশ সহ বিভিন্ন ধ্বংসাত্মক তৎপরতা তারা চালিয়ে যাচ্ছে নিয়মিতই। বাংলাদেশ সৃষ্টির মৌল চেতনা, বাঙালি সংস্কৃতি ও এ অঞ্চলের ঐতিহ্য, প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সদ্ভাব, বিজ্ঞান চেতনা, আধুনিক বিজ্ঞান শিক্ষা ও নারী শিক্ষার প্রতি তীব্র বিদ্বেষ ও ঘৃণা লালন করা হিংস্র গ্রুপ গুলি যে বাংলাদেশকে আফগানিস্তানের মতো ধ্বংসস্তুপ বানানোর কাজ করে যাচ্ছে এ-খবর পাঠকদের অজানা নয়।
(বাংলাদেশে শত শত আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী , ভাবা যায়! জেএমবির ধরা পড়া কিছু কিছু আত্মঘাতী সদস্যের জবানীতে পত্র-পত্রিকায় রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল যে, আরো শত শত আত্মঘাতী সদস্য নির্দেশের অপেক্ষায় প্রস্তুত। তারা কোথায়? তাদের কি অন্য কেউ ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত করে তুলছে ? )
জাহানারা ইমাম নামটিরই একটি প্রতীকী তাৎপর্য আছে বাংলাদেশে। যুদ্ধাপরাধী, জামাত শিবির ও ফ্রিডম পার্টির কর্মী ও বিএনপির কিছু উগ্র ধরনের লোক ছাড়া এই বীরমাতাকে শ্রদ্ধা করে না এমন লোক আমাদের সমাজে বিরল।
মুক্তিযুদ্ধে সন্তান ও স্বামী হারানো এই বীরনারী ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠন করে সমাজে জাঁকিয়ে বসা স্বাধীনতার বিরুদ্ধ শক্তিকে আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলেছিলেন; যদিও বিভিন্ন কারণে ‘৭১-এর ঘাতক-দালালদের বিচার আজো করে ওঠা যায় নি। তরুণ প্রগতিশীল সমাজ জাহানারা ইমামকে আজো শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে, যার লেশমাত্র হুমায়ূন আহমেদের কথায় নেই (“উনাকে তো কেউ খুন করেনি..”)।
অথচ তিনি সুযোগ পেলেই বলে থাকেন যে, মুক্তিযুদ্ধে তাঁর পিতাকে হত্যা করা হয়েছিল।
অনেকেই (বিশেষত কতিপয় বইয়ের দোকানদার ও প্রকাশক) বাজারে একটি কথা চালু করার চেষ্টা করে থাকেন যে, হুমায়ুন আহমেদ বাংলাদেশে প্রচুর পাঠক সৃষ্টি করেছেন।
বাঙালি পড়ুয়া জাতি এমন “বদনাম” বাঙালির কোন ঘোরতর শত্রুও দেবে না।
একজন সমাজ-সচেতন লেখক হিসাবে হুমায়ূন আহমেদেরও কোন “দুর্নাম” নেই। তিনি “আজ চিত্রার বিয়ে”. “কাল নীতার গায়ে হলুদ”, “পরশু জলিলের আকিকা” এই ধরনের পুতুপুতু দ্রব্যাদি দুই মলাটের ভিতর সরবরাহ করে রুপালি মুদ্রার ঝনঝনানি গুনে দুধে-ঘিয়ে সুখী জীবন কাটাচ্ছেন। বাংলাদেশের কোটি কোটি নিরন্ন মানুষের কান্না শোনার কান তাঁর কি আছে?
তাঁর বই বিক্রি হয় হাজার হাজার কপি। কেনে কারা? তারা কি বাংলা সাহিত্যের পাঠক ?
তারা বাংলা সাহিত্যের পাঠক হোক বা না হোক, তাদের সংখ্যা অনেক। তাঁর নাটক দেখে অনেকেই, তাঁর কথাকে অনুসরণ করে অনেকেই, বিশেষত কিশোর কিশোরী তরুণ তরুণীর বড় একটি অংশ। তাঁর পাঠকের উপর হুমায়ুন আহমেদের প্রভাব লক্ষণীয়। (যেমন “হিমু” সেজে কোন কোন পাঠকের ঘুরে বেড়ানো, তাঁর বই বিক্রি বাড়ানোর জন্য ওয়ার্ড কমিশনার পদপ্রার্থীর স্টাইলে মিছিল করা ইত্যাদি)।
এখন এই তরুণ নাতিতরুণদের মাঝেও যদি হুমায়ুন আহমেদের দুষ্ট চিন্তাগুলি (১. বাংলাদেশের মানুষ এখন ভাল আছে, ২. মৌলবাদী মৌলবাদী করে লাভ নেই, ৩. তসলিমা বিতর্কিত লেখক, ৪. জাহানারা ইমাম দেশদ্রোহীর অপবাদ নিয়ে মারা যান নি, তিনি ক্যান্সারে মারা গেছেন ইত্যাদি) ছড়িয়ে পড়ে? সমাজে যদি এই চিন্তাগুলির বিস্তার ঘটে?
তাহলে ?
তাহলে অথর্ব, চিন্তাহীন, মূঢ়, মৌলবাদের প্রতি সহানুভূতিশীল, সমাজবিমুখ, এক তরুণ জনগোষ্ঠীর আবির্ভাব কি ঘটবে না সমাজে?
