আসল ইতিহাস বনাম মিথ্যে প্রচারণা: বঙ্গবন্ধু এবং তাজউদ্দিন

তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন মহান নেতা, কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে ছাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা ইতিহাসের সত্যের সাথে প্রতারণা। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরে ইতিহাস বিকৃতির এক উদ্বেগজনক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা শারমিন আহমদ বিভিন্ন বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বকে খাটো করার চেষ্টা করছেন। কখনও তিনি সরাসরি দাবি করছেন, কখনও সন্দেহজনক উৎস থেকে উদ্ধৃতি টেনে প্রমাণ করতে চাইছেন—মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা নাকি অতিরঞ্জিত।

Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman and Tajuddin Ahmed

কেন এই সম্পাদকীয় লেখা জরুরি হয়ে উঠলো?

তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন মহান নেতা, কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে ছাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা ইতিহাসের সত্যের সাথে প্রতারণা। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরে ইতিহাস বিকৃতির এক উদ্বেগজনক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা শারমিন আহমদ বিভিন্ন বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বকে খাটো করার চেষ্টা করছেন। কখনও তিনি সরাসরি দাবি করছেন, কখনও সন্দেহজনক উৎস থেকে উদ্ধৃতি টেনে প্রমাণ করতে চাইছেন—মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা নাকি অতিরঞ্জিত।

এই প্রচেষ্টা শুধু বঙ্গবন্ধুকে নয়, তাজউদ্দীন আহমদকেও একটি ভুল প্রেক্ষাপটে দাঁড় করায়, যা ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি অবমাননাকর। এসব দাবি তথ্যবিহীন, বিভ্রান্তিকর ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর স্থান অপরিহার্য ও সুপ্রতিষ্ঠিত, এবং তা অস্বীকার করা মানে স্বাধীনতার দীর্ঘ লড়াইয়ের মূল চেতনাকেই অস্বীকার করা।

তাই এ লেখা একপ্রকার দায়বদ্ধতা—জাতির গৌরবময় ইতিহাস রক্ষা ও সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস। এই সম্পাদকীয় কোনোভাবেই তাজউদ্দীন আহমদের অবদান অস্বীকার করে না; বরং তাঁকেও তাঁর যথাযথ মর্যাদায় স্মরণ করেই ইতিহাসের বিকৃতি রোধ করতে চায়। তাজউদ্দীন আহমদ আজ বেঁচে থাকলে, ইতিহাস বিকৃতির এই প্রবণতার বিরুদ্ধেই তিনিও সোচ্চার হতেন।

মুক্তাঙ্গন

…………

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুধু একটি ভূখণ্ডের স্বাধীনতার লড়াই ছিল না — ছিল নেতৃত্ব, ত্যাগ ও আস্থার এক অভূতপূর্ব সমবায়। সেই ইতিহাসে তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী, কামরুজ্জামান অবিসংবাদিত নাম। কিন্তু তাঁদের নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আজ, দুঃখজনকভাবে, এই সত্যটিই বিকৃত করার চেষ্টা চলছে। 

কোনো সন্দেহই নেই যে তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন একজন মহান নেতা, যেমন ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মোহাম্মদ মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামান। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই চার নেতার মধ্যকার দৃঢ় বন্ধন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তাঁদের প্রতি বাংলাদেশের নাগরিক মাত্রেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার প্রশ্ন রয়েছে।

তবে এই নির্ভেজাল কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সময় বিস্মৃত হলে চলবে না যে এই চার মহান নেতার নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু শুধু এই চার নেতার গুরু ছিলেন না, তিনি ছিলেন বঙ্গোপসাগর বিধৌত বদ্বীপে বসবাসকারী সকল মুক্তিকামী মানুষের কান্ডারী। তাই আমাদের মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে সকলের অবদান ছাপিয়ে বঙ্গবন্ধু ঋজু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়েছেন যা কখনোই ম্রিয়মান হবার নয়।

বর্তমানে বাংলাদেশে বল্গাহীনভাবে ‘অস্বীকৃতির সংস্কৃতি’ চলছে, যা শুধুমাত্র একজন ব্যক্তিকে নয়—সমগ্র মুক্তিযুদ্ধ, আত্মত্যাগ ও জাতিসত্তার ইতিহাসকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। একজন নেতা বা ব্যক্তির মূল্যায়ন করতে হয় তাঁর কৃত অবদানের ভিত্তিতেই। কিন্তু নায়ক নির্মাণের নামে ইতিহাস বিকৃত করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মত মহানায়কের ভূমিকাকে হেয় প্রতিপন্ন করা যায় না। কিন্তু চলমান সময়ে আমরা দেখছি অত্যন্ত উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তা-ই করার চেষ্টা হচ্ছে ।

অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, বিগত অনেক বছর ধরে মহান নেতা তাজউদ্দীন আহমদ-এর কন্যা শারমিন আহমদ স্বয়ং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান হ্রাস করার ও সম্মান হানি করার চেষ্টা করে আসছেন। সম্প্রতি প্রথম আলো পত্রিকার সম্পাদক মতিউর রহমানের নেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এক পর্যায়ে বলেছেন যে “রাও ফরমান, খাদিম হোসেন রাজা, এমনকি ভুট্টো—তাদের লেখনীতে আছে, ‘আমাদের মূল শত্রু কিন্তু আসলে তাজউদ্দীন আহমদ।’”

এই কথা বলার মাধ্যমে শারমিন ইঙ্গিত করতে চেয়েছেন যে পাকিস্তানীদের মূল মাথাব্যথার কারণ শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন না, বরং তাঁদের চক্ষুশূল ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ।

লেখক হিসেবে শারমিন আহমদ তিনজনের নামোল্লেখ করেছেন। ১৯৭১ সালকে ঘিরে এই তিনজনের লেখা বই যথাক্রমে ‘হাউ পাকিস্তান গট ডিভাইডেড’, ‘এ স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ওউন কান্ট্রি’, এবং ‘দি গ্রেট ট্র্যাজেডি’। বই তিনটি আমার পাঠের সুযোগ হয়েছে। এই তিন বইয়ে শারমিন আহমদ, উনার পিতা তাজউদ্দীন আহমদ প্রসঙ্গে যা ব্যক্ত করেছেন সে ধরণের কোন কথা আছে বলে আমার জানা নেই।

এ প্রসঙ্গে বই তিনটি থেকে কিছু তথ্য দিচ্ছি যা পাকিস্তানীদের চোখে নেতা হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের আপেক্ষিক গুরুত্ব বুঝতে সহায়তা করবে:

১) How Pakistan Got Divided (২০১ পৃষ্ঠা, রাও ফরমান আলী):

  • তাজউদ্দীন আহমদ উল্লেখ: ৫ বার
  • বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উল্লেখ: ১৭৫ বার

২) A Stranger in My Own Country (১২৬ পৃষ্ঠা, খাদিম হোসেন রাজা):

  • তাজউদ্দীন আহমদ উল্লেখ: ০ বার (শুধুমাত্র পরিশিষ্টে নাম)
  • বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উল্লেখ: ৪৬ বার

৩) The Great Tragedy (৭৯ পৃষ্ঠা, জুলফিকার আলী ভুট্টো):

  • তাজউদ্দীন আহমদ উল্লেখ: ৩ বার
  • বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উল্লেখ: ১৭৫ বার

৪) Witness to Surrender (২৩৫ পৃষ্ঠা, সিদ্দিক সালিক):

  • তাজউদ্দীন আহমদ উল্লেখ: ৫ বার
  • বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উল্লেখ: ২২৭ বার

এই বইগুলো পড়ে পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ এবং তাদের বুদ্ধিজীবীরা কাকে ভয় পেতো বা কাকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখেছে সে বিষয়টি স্পষ্ট হয় । বইগুলোতে বঙ্গবন্ধুর নাম এবং ভূমিকা এত বেশিবার উল্লেখ করা হয়েছে, যাতে বোঝা যায় তাঁর উপস্থিতি ও নেতৃত্বই ছিল পাকিস্তানী আধিপত্যবাদীদের প্রধান চ্যালেঞ্জ।

সর্বশেষে, বিনয়ের সাথে তাজউদ্দীন কন্যা শারমিন আহমদকে বলবো এ ধরনের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করা থেকে বিরত থাকতে।

ইতিহাস বানানো যায় না।

ইতিহাস বিকৃত করার কাজে প্রথম আলো গ্রুপের এহেন নানা প্রকল্পের প্রতি ধিক্কার জানাই!

সদা প্রবহমান সময়ধারায় ইতিহাস নির্মিত হয়, যা ফরমায়েশী প্রচেষ্টায় পরিবর্তন-পরিবর্ধন করা যায় না। 

ইতিহাস সবসময়ই নিজের ভাষায় কথা বলবে।

সমাপ্ত


সিনপসিস:

এই সম্পাদকীয় নিবন্ধটি সাম্প্রতিক সময়ের ইতিহাস বিকৃতির প্রবণতার বিরুদ্ধে একটি যুক্তিপূর্ণ প্রতিবাদ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বের অবদান খাটো করার যে চেষ্টা কিছু মহল করছে—বিশেষ করে তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা শারমিন আহমদের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে—এই লেখা তার বিপরীতে তথ্যনির্ভর প্রতিক্রিয়া। লেখাটির উদ্দেশ্য হচ্ছে জাতির ইতিহাসকে সম্মান ও সুরক্ষা দেওয়া এবং সকল সত্যনিষ্ঠ নেতার মর্যাদা রক্ষা করা, বিকৃত বয়ানের বিপরীতে ঐতিহাসিক বাস্তবতা তুলে ধরা।



সাবস্ক্রাইব করুন
অবগত করুন
guest

1 মন্তব্য
সবচেয়ে পুরোনো
সাম্প্রতিকতম সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত
Inline Feedbacks
View all comments
1
0
আপনার ভাবনাগুলোও শেয়ার করুনx
  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.