যাহারা সংবাদপত্রকে রাষ্ট্রযন্ত্রের চতুর্থখাম্বা বলিয়া প্রচার করিয়া থাকেন, তাঁহারা নিশ্চিতভাবেই ধর্মকে বিশেষ করিয়া ইসলাম ধর্মকে রাষ্ট্রের আসমান বলিয়া মানেন । পাশাপাশি নির্মাণ করিয়া চলেন ধর্মভিত্তিক নানা মধ্যযুগীয় মতাদর্শের আধুনিক সংস্করণ। লুঙ্গির কাপড় হাঁটু পর্যন্ত উঠাইয়া নামেন ধর্মের বহুবিধ ফজিলত, আমল-আখলাকের গল্প প্রচারে। তাঁহাদের এই যুদ্ধে, ধর্মকে রাষ্ট্রের আসমান হিসাবে নির্মাণ ও নিশ্চিতকরণের রেসে সহযোদ্ধা হিসেবে চতুর্থখাম্বাটি প্রয়োজনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসাবে প্রাধান্যশীল হইয়া উঠিয়াছে; উঠিতেছে প্রতিনিয়ত।
পরাধীন দেশের গণমাধ্যম নিয়া সে দেশের মানুষের কোনো স্বপ্ন থাকে না। থাকিতে পারে না। আমাদেরও ছিলো না। ধলা ভদ্দরলোক এবং তাহাদের দেশি দোস্তরা আমাদের দেশ নিয়া, দেশের ধর্ম নিয়া, নারী নিয়া, নোংরা রাজনীতি নিয়া যে নোংরা সাংবাদিকতার জন্ম দিয়াছিলেন, তাহা নিয়া আমার-আমাদের কোনো বিলাপ নাই। বিলাপ থাকিবার মতো কোনো কারণও হয়তো নাই। কিন্তু একটা স্বাধীন দেশের গণমাধ্যম নিয়া সেই দেশের মানুষ স্বপ্ন দেখিতেই পারে। বাংলাদেশও স্বপ্ন দেখিয়া ছিলো। কিন্তু যে প্রজাতিটি আদতেই ধর্ষণপ্রবণ, তাহাদের দ্বারা কোনো স্বপ্নেরই যে বাস্তবতা নির্মাণ সহজতর হয় না।
বাঙালী বড়ই ধর্ষণপটু প্রজাতি। তাহারা একটি দেশকে স্বাধীন করিবার পর যেভাবে তাহাকে পরাধীন করিয়া তুলিয়া ছিল, ঠিক সেভাবেই একটি জ্যোর্তিময় সংবিধানের জন্ম দিয়া তাহাকে বলাৎকারে বলাৎকারে রক্তাক্ত করাতেও বাধে নাই বাঙালীর। ধর্মের সহিত রাষ্ট্রের কোনো যোগ থাকিবে না, একটা স্বাধীন দেশে সে রকমটাই আশা করা গিয়াছিল। কিন্তু হায়, গরিবের আবার লাল পিরান! আমাদের স্বর্গীয় ব্যবসায়ী-রাজনীতিকেরা সবচেয়ে যে ভালো ব্যবসাটি শিখিয়াছিলেন; তাহা ধর্মের ব্যবসা। স্বর্গীয় মহাপিতারা, যাহারা এখন বেহেশতে বসিয়া হুর সঙ্গম করিতেছেন, আমরা তাঁহাদের – সেসব ধর্ম ব্যবসায়ীদের উত্তরপুরুষ । আমাদের সবচেয়ে মেধাবী এবং সৎ ধার্মিকটি এখন পত্রিকার ধর্ম পাতার কলাম লেখক।
প্রথম প্রথম বিভিন্ন ইসলামী দিবস উপলক্ষে দুই-একটা কলাম ছাপা হইত পত্রিকার পাতায়। সেখানে জায়গা করিয়া নিত অন্য ধর্মাবলম্বীরাও। তাদের বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রযন্ত্রের চতুর্থখাম্বাটি সাজিতো নানা উৎসবে। পূর্বে পরোক্ষভাবে হইলেও পত্রিকাগুলো ছিলো ধর্মনিরপেক্ষ। ছিলো সব ধর্মের মানুষের।
২.
যাহা কিছু ভালো তাহার সঙ্গে আমাদের প্রথম আলো। প্রচারসংখ্যায় সর্বাধিক। প্রচারপটুতায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম।
ইহার সম্পাদক জনাব মতিউর রহমান সম্ভবত বাংলাদেশের ধার্মিক সম্পাদকসমূহের মধ্যে প্রধানতম। তিনি এই দুনিয়ায় বসিয়া পরজনমের সুখ-সম্ভোগ নিশ্চিত করিবার জন্যে উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়াছেন। চোখ বুজিলেই দেখিতে পান হুর-সরাব-অবাধ যৌনাচার। তাহার প্রথম শ্রেণীতে প্রথম ক্লাস পাওয়া চতুর্থখাম্বাটিতে প্রতি শুক্রবার ঘটা করিয়া প্রকাশ করা হয় বিশিষ্ট মৌলভির অনবদ্য সুন্দর ধার্মিক ‘কলাম’। সেইখানে ধর্মের নানা নন্দনতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ যেমন উপস্থিত থাকে; তেমনই থাকে ধর্মের সাথে মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের কথা। থাকে বেহেশতে প্রবেশের সবচেয়ে সহজতম পথটির কথা। থাকে জীবন আর ইসলামের নানা সমাজতাত্ত্বিক যোগের কথা। সপ্তাহের আর সব দিন ছাড়িয়া কেন শুক্রবার-ই প্রকাশ করিতে হয় এই ধর্মভিত্তিক সাহিত্য-শিল্পকলাটিকে! শুক্রবারটা মুসলমানদের বিশেষদিন বলিয়া? ঢাকা শহরটা, আমাদের প্রিয় বাংলাদেশটা শুক্রবার টুপি আর পাঞ্জাবিতে সাদা শুভ্র হইয়া ওঠে বলিয়া?
মধ্যবিত্ত মুসলমানদের প্রথম প্রধান এবং শ্রেষ্ঠ খাবার হইতেছে ধর্ম। রাষ্ট্রপ্রধানেরা এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীটাকে ধর্ম ছাড়া আর কিছু দিতে জানেন না ; সম্ভবত চানও না। আর মধ্যবিত্তরা তাহাতেই খুশিতে গদগদ হইয়া থাকে সবসময়। একবেলা না খাইয়া থাকিলে তাহাদের চলে, অপরের দাস হইয়া জীবনযাপনে তাহাদের কোন অসুবিধা হয় না; কিন্তু একবেলা ধর্মপালন না করিতে পারিলে তাহারা অস্থির হইয়া উঠে। রাষ্ট্রপ্রধানেরা তাহাদের শোষণের শেকলে বাঁধেন; আর আমরা মধ্যবিত্তরা বাঁধা পড়ি। মতিউর সাহেব রাষ্ট্রপ্রধানদের এই পলিসি ভালোই আয়ত্ব করিয়াছেন। যেহেতু আমাদের ধার্মিক সম্পাদকটির সাথে রাষ্ট্রপ্রধানের যোগ সবচেয়ে বেশি, সেহেতু এই কাজটি তাঁহার জন্য করা খুব কঠিন তো নয়, নয় নাজায়েজও।
যেহেতু ধর্মের শেকলে বাধা পড়া মধ্যবিত্ত মুসলমানদের কল্যাণেই আমাদের আলোচ্য এই চতুর্থখাম্বাটি সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক হিসাবে প্রতিষ্ঠা পাইয়াছে; তাই এই শ্রেণীটির কথা মতিউর সাহেবের তো ভাবিতেই হয়। বণিকেরা ধর্ম নিয়া বাণিজ্য করিবে ; তাহাতে আর বলিবার কি নতুন! কিন্তু সপ্তাহের আর সব দিন ছাড়িয়া কেন শুক্রবার-ই প্রকাশ করিতে হয় এই ধর্মভিত্তিক সাহিত্য-শিল্পকলাটিকে! শুক্রবারটা মুসলমানেদের বিশেষ দিন বলিয়া ?
ঢাকা শহরটা, আমাদের প্রিয় বাংলাদেশটা শুক্রবার টুপি আর পাঞ্জাবিতে সাদা শুভ্র হইয়া ওঠে বলিয়া? তাহা হইলে প্রথম আলো কর্তৃপক্ষ কি অস্বীকার করে অমুসলিম বাঙালী পরিচয়ের তথ্যমতাদর্শভোক্তা শ্রেণীটিকে? অস্বীকার করে বাঙালী হিন্দুকে, বাঙালী খ্রিষ্টানকে, বাঙালী বৌদ্ধকে? বাঙালী অমুসলিম প্রজাতিটিকে?
প্রাচীন রাষ্ট্রপ্রধানেরা বাংলাদেশের মোসলমানি দিয়া গ্যাছেন অনেক আগেই। এখন আমাদের ধার্মিক সম্পাদকগণ রাষ্ট্রযন্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাম্বাটির মোসলমানি দেবার ব্যবস্থা পাকাপাকি করিয়া ফেলিয়াছেন। আমাদের দেশটা মোসলমানদের। আমাদের প্রিয় সংবিধানটা মোসলমানদের। আমাদের বুদ্ধিজীবিরা, সম্পাদকেরা মোসলমানদের। আমাদের গণমাধ্যমগুলো কেবলই মোসলমানদের। চতুর্থখাম্বাগুলো মোসলমানদের। এখানে অন্য ধর্মালম্বীদের প্রবেশ নিষেধ। নিষেধ।
এখন আমাদের দেশের প্রধান ধারার পত্রিকাগুলি প্রতি সপ্তাহে খুব আওয়াজের সহিত ছাপে ধর্মবিষয়ক পাতা। ইসলামকে প্রতিটি পাঠকের জীবন করে তুলবার প্রয়াসে কতো উৎসব। একজন হিন্দু, একজন বৌদ্ধ, একজন অমুসলিম পাঠক যখন তাহার রক্তঘাম করা পয়সা দিয়া কিনিবেন একটা যুগান্তর, একটা আমার দেশ, সাথে সাথে তিনি কিনিতে বাধ্য হইবেন ইসলামবিষয়ক নানা মসালাসম্বলিত একটি ধর্ম পাতা।
আমাদের সম্পাদকগণ বড়ই ধার্মিক । পৃথিবীর সব ধার্মিকই যতোটা ধার্মিক তাহার চাইতে বেশি বণিক। আর তাই আমাদের ধার্মিক সম্পাদকদের থাবায় এখন ধর্ম সবচেয়ে বড় পণ্য। তাহারা বিনোদন পাতার উর্বশী পতিতাদের পাশে জায়গা করিয়া দেন ধর্মকে।
আমি মাংসের টুকরো থেকে দূরে ছিলাম। আমি নতজানু হবার বদলে নিগ্রহকে বরণ করেছিলাম। আমি পিঠে কুঁজের বদলে বুকে ছুড়িকাকে সাদরে গ্রহন করেছিলাম। আমি গলার বদলে হাতেপায়ে শেকল পরেছিলাম। আমি আমার মতো দাঁড়াতে চেয়েছিলাম। আমি আমার মতো স্বপ্ন দেখতে চেয়েছিলাম। আমি আমার মতো কথা বলতে চেয়েছিলাম। আমি আমার নিজস্ব ভঙ্গিতে দাঁড়াতে চেয়েছিলাম। আমি নিতে চেয়েছিলাম নিজের নিশ্বাস। কিন্তু…আমার চারপাশ জুড়ে দেয়াল, অজস্র থাবা। আমি অন্ধকার ছাড়াতে ছাড়াতে জোছনা খুঁজতে খুঁজতে আবার অন্ধকারে মিলিয়ে যাই।….
তারপর পথে নেমে মানুষের মুখ খুঁজতে থাকি। মুখের ভাঁজ গুলোতে প্রতিরোধের , লড়াইয়ের চিহ্নগুলা মুখস্থ করে করে আত্মহননের রাস্তায় নামি…
