সাপ্তাহিক দুটি ছুটির দিন (শুক্র ও শনি)-এর প্রথমটিতে আমি সাধারণত বাইরে কোনোরকম কাজ না রেখে বউ ছেলের সঙ্গে কাটাই। মাঝে মাঝে যে এ নিয়মে ব্যত্যয় ঘটে না তা নয়। যেমন গত সপ্তাহে বউ-ছেলেকে বিশেষ জরুরি কাজের অজুহাত দেখিয়ে বন্ধুদর্শনে উত্তরা চলে যাই এবং বিকেলটা খুবই আনন্দে কাটাই। এই আনন্দের হাত-পা-চোখ-মুখ খুলে দেখানো এ পোস্টের উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য যাত্রাপথের একটি দারুণ অভিজ্ঞতা বিনিময়।
অনেকেই জানেন, বেশ কিছুদিন ধরে বেভকো নামে ৫৩ আসনের একটা এসি গাড়ি চালু হয়েছে আজিমপুর-উত্তরা রুটে। আগে একদিন আমি এ গাড়ি চড়ে মহাখালী গিয়েছি। এটি দ্বিতীয়দিন। ধানমণ্ডিতে আমি যেখানটায় থাকি, সেখান থেকে এই বাসটি ধরতে কলাবাগান আসাই সুবিধাজনক। কিন্তু এবার কলাবাগান পার্কের সামনের নির্ধারিত স্থানে এসে দেখি টিকিট দেবার জন্য যে লোকটা নিয়মিত টেবিল পেতে বসে, সে নেই। অন্য কাউন্টারগুলোতে জিজ্ঞেস করলে ওরা বলল, আজ ও আসে নি। যেহেতু কাউন্টার নেই, সেহেতু আগাম টিকিট ছাড়াই হয়ত যাওয়া যেতে পারে, এটা মনে করে ননএসি কোনো গাড়ির টিকিট না নিয়ে আমি বেভকোর জন্যই অপেক্ষায় থাকলাম। কারণ এত গরমে ননএসিতে ভ্রমণ করলে আনন্দটাই মাটি হয়ে যেতে পারে।
যাই হোক, একটা সিগারেট ধরিয়ে কয়েক টান দি্তেই গাড়ি এল। চালককে হাত ইশারায় বুঝাবার চেষ্টা করলাম যে কাউন্টারে লোক নেই, কিন্তু আমি যাত্রী। গাড়ি দাঁড়াল। উঠে দেখি ৫৩টি আসনই পূর্ণ। এত গরমের মধ্যে এসি গাড়ি করে যেতে পারছি, সেটাই আরামের, আসন থাক বা না থাক। চালকের আসনের বাঁ’পাশের ইলেকট্রোপ্লেটেড রডে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম।
গাড়িটি মানিক মিয়া এভিনিউতে পড়তেই একটা গ্রাসহোপার উড়ে এসে বসল লুকিং গ্লাসে। কন্ডাক্টর ধরতে গেলে ওটি উড়ে এসে বসল চালকের কাঁধে। ওখান থেকে সে ঠিকই ধরে বসল। আমি বললাম, ‘প্লিজ মারবেন না পোকাটাকে, ছেড়ে দিন।’ কন্ডাক্টর বলল, ‘ঠিক আছে মারব না’। চালক কন্ডাক্টরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘জিগাইয়া দেখ তো টিকিট কাটছে কি না!’ আমি বললাম, ‘টিকিট কাটবে কী, ও তো স্টাফ!’ এবার চালক বললেন, ‘তাইলে জিগাইয়া দেখ, কার্ড দেখাইতে পারে কি না।’ এবার আমি বললাম, ‘চেনা বামুনের পৈতা লাগে না।’ ‘তাইলে তো ছেড়েই দিতে হয়’– এই বলে চালক দরজা খুলে দিলেন। কন্ডাক্টর বলল, ‘এইহানে ছাড়ন যাইব না, ঘাসে ছাড়ন লাগব। সামনে গিয়া একটু ব্রেক কইরেন।’ চালক দরজা বন্ধ করে আবার টানলেন গাড়ি। খামারবাড়ির মোড়ে গিয়ে আবার দরজা খুলে দিলে কন্ডাক্টর গাছ লক্ষ্য করে ছুড়ে দিল পোকাটাকে। পোকাটা দিব্যি উড়াল দিয়ে সংসদ ভবনের আওতার মধ্যে একটা আমগাছের ডালে গিয়ে বসে পড়ল। আমার স্বস্তি লাগল খুব। অন্য যাত্রীরা যারা দেখেছে ঘটনাটা তাদেরও মুখ দেখলাম প্রসন্ন।
দরজা বন্ধ করে কিছুদূর এগিয়ে এবার চালক কন্ডাক্টরকে ইংগিত করে বললেন, ‘মামলায় পড়লে কিন্তু আমি কিছু জানি না।’ কন্ডাক্টর বলল, ‘কী রকম?’ ‘বুঝস না ব্যাটা, পোকাটা তো গাড়িতে উঠছে আবদুল্লাহপুর থেইকা, এখন এতদূরে এইখানে নামাইলি, যদি হারাইয়া যায়!’, বললেন চালক। কন্ডাক্টর বলে, ‘হারাইব না।’ আমি বললাম, ‘ও তো আর বাচ্চা না যে হারিয়ে যাবে, রীতিমতো বয়স্ক লোক! এখানে কিছুক্ষণ ঘুরেফিরে বিকেলের ট্রিপে হয়ত বেভকো করেই আবার চলে যাবে।’ কন্ডাক্টর বলল, ‘এখানে অনেক গাছগাছড়া আছে। আবদুল্লাপুরে তো গাড়ির প্যাঁপোঁ ছাড়া কিছু নেই।’ চালক বললেন, ‘তা অবশ্য ঠিকই কইছস।’ আমি বললাম, ‘শুধু কি গাছগাছড়া, চোর-ছ্যাঁচড় মন্ত্রী-এমপিদের আড্ডাখানা দেখবারও সুযোগ পাইব।’ ‘যাক তাইলে তো দেখি ভালাই অইছে!’, চালকের এই মন্তব্যে কন্ডাক্টর হ্যাঁ-সূচক মাথা নেড়ে বলল, ‘হ’।
এ ব্যাপারে কথা আর আগায় নি। কিন্তু ঘটনাটা দুটো কারণে আমার মনে খুব দাগ কেটে গেল। ১. চাইলেই ওরা পোকাটাকে তুচ্ছ জ্ঞান করে মেরে ফেলতে পারত। কিংবা বাঁচাবার ভান করে রাস্তায়ও ছুড়ে দিতে পারত। কিন্তু সেটা ওরা করে নি। ২. ড্রাইভার-কন্ডাক্টরদের আমরা কোনো ব্যতিক্রম ছাড়াই বেরসিক বলে ভেবে থাকি। কিন্তু এদের মধ্যেও যে দারুণ রসবোধ আছে, এ আলাপচারিতা না শুনলে আমি বুঝতেই পারতাম না। বেঁচে থাকুক ওই গ্রাসহোপার, বেঁচে থাকুক চালক-কন্ডাক্টরের রসবোধ।
