পথে পথে এত ধূলা, এত কথা বাঙ্ময়

আজ রাত সাড়ে আটটার দিকে ধানমণ্ডির সাত মসজিদ রোডের গ্রামীণ রূপায়ণে গিয়ে নতুন আসা পাঞ্জাবি-ফতুয়া দেখছিলাম, আমার মতো আরো বেশ কিছু নারী-পুরুষ পছন্দের কাপড়টি নেড়েচেড়ে দেখছেন। তিনজন বিক্রয়কর্মীর সবাই ব্যস্ত। এসময় বছর পঁচিশেক বয়সের একটা হিজড়া সবাইকে ডিঙিয়ে কাউন্টারের সামনে গিয়ে বলল, ‘দে, টেকা দে, ঈদের বখশিস।’

সবাই ক্রেতা সামলাতে ব্যস্ত থাকায় ওর দিকে মনোযোগ দিতে একটু দেরি হলো। ও আবার বলল, ‘দে, তাড়াতাড়ি দে। অনেক কাজ।’

শপের সুপারভাইজার বলল, কী কাজ?

‘আরো অনেক জায়গায় যেতে হবে।’

কেন?

‘ঈদ বখশিস ওঠাতে।’

আমি কাপড় দেখতে দেখতে ওদের কথা শুনি। কাউন্টারের মেয়েটা ওর গলার মেয়েলি স্বর শুনে মিটমিটিয়ে হেসে খুন। বিক্রেতা ছেলেটা দশ টাকা দিয়ে দিতে বলে। সে সাধে। নেয় না।

‘দশ টাকা দিবি কেন? দশ টাকা তো টং দোকানিও দেয়। এত বড়ো দোকান, মাত্র দশ টাকা দিবি? দে, আরো বেশি দে।’

বেশি টাকা দরকার তো কাজ করিস না কেন?, সুপারভাইজার বলল।

‘আমাদের কাজ দেয় না কেউ। দে, কুড়ি টাকা দে।’

সুপারভাইজার যেদিকে যায়, সে তার সঙ্গে সঙ্গে যায়। ক্রেতারা বিরক্ত হচ্ছে কিনা এই আশঙ্কায় সে কুড়ি টাকা দিতে বলে। কাউন্টারে বসা মেয়েটা ‘লজ্জায় জিভ কাটা যাচ্ছে’-ভাবের রূপায়ণ ঘটিয়ে একটা কুড়ি টাকার নোট ওর দিকে বাড়িয়ে দেয়। টাকাটা নিয়ে সে হনহন করে বেরিয়ে যায়।

ওর চলে যাবার মিনিট বিশেকের মধ্যে আমার কেনাকাটার বিপরীতে দরদাম চুকিয়ে বেরিয়ে গেলাম। কিন্তু মাথায় কাজ করতে থাকল এই বাক্যটা– ‘আমাদের কাজ দেয় না কেউ।’ কী নির্মম একটা সত্য। কাজের সক্ষমতা আছে কিন্তু কাজ করবার সুযোগ নেই, নেই অধিকারও। মানবাধিকার লঙ্ঘনের খুবই চরম উদাহরণ। অথচ আমরা একে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বলে মানতেই শিখি নি আজো।

আমরা ওদের কাজ দেই না। আরো দিই না ম্যালা কিছু। আড্ডায় রাখি না। পরিবারের সাথে থাকতে দিই না। সামাজিক অনুষ্ঠান-পার্বণে অ্যালাউ করি না। স্কুলে গিয়ে পড়াশোনা করতে দিই না। ভোটাধিকার দিই না। (এবার কি ওরা জাতীয় পরিচয়পত্রের মালিক হতে পেরেছে? আমার জানা নেই। ধারণা করি, দেয়া হয় নি।)

তো, বাঁচবার প্রয়োজনে ওদের বৃহদাংশের বাধ্য হয়ে সম্প্রদায়ের পেশাই বেছে নিতে হয়। লোকমনোরঞ্জন, শরীররঞ্জন, অন্যান্য অপরাধমূলক কাজ ও মাধুকরীবৃত্তি। ওদের কী দোষ? দোষ তো আমাদের।

মাসকয়েক আগে পিআরএসপি ও শিক্ষা বিষয়ক এক সেমিনারে হিজড়া কমিউনিটির এক নেতাকে অসাধারণ বক্তৃতা করতে শুনলাম। চমৎকার যুক্তি দিয়েছেন ওনি তার কথায়, বেশ গোছানো ছিল সেসব কথা। ওই নেতা আমাদের শিক্ষা কারিকুলামে নারী-পুরুষ বৈষম্য বিষয়ে তার ধারণা ব্যাখ্যা করবার পর জানান যে শিক্ষা পাওয়ার সুযোগে এবং শিক্ষাসূচি প্রণয়নে হিজড়াদের প্রতি সমাজ-রাষ্ট্র নিদারুণ বৈষম্য করে। ‘হিজড়ারাও মানুষ’ এই ধারণাটি যদি স্কুল থেকেই শিশুরা নিতে পারত, তাহলে সামাজিক বৈষম্য হয়ত কিছুটা কমত। নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্র আমাদের জন্য কোনো নিরাপত্তাই বিধান করে নি। করতে সম্ভবত প্রস্তুতও না।

সমাজ যদি হিজড়াদের সম্মানের চোখে দেখতে শেখে, রাষ্ট্রের সকল সুবিধা যদি এদের জন্যও উন্মুক্ত থাকে, তাহলে এখন আমরা হিজড়াদের একটা অংশকে যেভাবে দেখি, নিঃসন্দেহে তার থেকে অন্যরকম করে দেখব।

সেটাই হবে মানবাধিকারসম্মত। মানবসম্মত।

সাবস্ক্রাইব করুন
অবগত করুন
guest

9 মন্তব্যসমূহ
সবচেয়ে পুরোনো
সাম্প্রতিকতম সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত
Inline Feedbacks
View all comments
9
0
আপনার ভাবনাগুলোও শেয়ার করুনx
  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.