দেশ ঘুরে দেখার দল খুঁজে পেতে বেশ কিছুটা সময় লেগেছিল। তবে এটাও ঠিক নয় যে তার আগে বেড়ানো হতো না। বেড়াতে যাবার জন্য চাই সমমনের মানুষের সঙ্গ, নয়তো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা আর উপভোগের থাকে না। সেকারণেই দল বেঁধে ঘোরার এক মারাত্মক বাজে অভ্যেস হয়ে গেছে আমার। দেশটার এ-ফোঁড় ও-ফোঁড় করতে বেশি একটা সময় অবশ্য লাগেনি, দক্ষিণ-পশ্চিম, উত্তর-পূর্ব কোন দিকে কী আছে তা জানার জন্য আমাদের বাংলাদেশের ম্যাপটাকে রুমের মেঝেতে ফেলা হলে দশ বাই বারো ফুটি রুমের মেঝেটাকে অনেক বড় মনে হয় আর আমাদের উৎসুক মন শুধু জেলা শহরের মাঝে কখনোই থেমে থাকতো না। তাই ভ্রমণ দল বি.টি.ইএ.ফ.-এর দপ্তর পরিচালক (!) কাম হাউজ কিপার গনি ভাইকে প্রায়ই দেখা যেত ম্যাপটাকে আরও খানিকটা বাড়িয়ে ফেলতে।
বিশেষ জায়গা খোঁজার ইঁদুর দৌড় খেলায় গনি ভাই এগিযে থাকতেন সব সময়। তাই বাংলাদেশের গ্রাম থেকে জেলাশহর উপশহর প্রায় অনেক জায়গাতেই যাওয়া হয়েছে কিছু দেখার এবং কিছুই না দেখার – স্রেফ বেড়ানোর উসিলায়। তা নিছক বেড়ানো ছাড়াও বেশ কিছু ছিল, এক সাথে এতোজন মানুষ, একসাথে থাকা আবার স্হানীয়দের সাথে আঁতাত থাকার কারণে বিশাল দলের পরিব্রাজক টিম হতো প্রায় যে-কোনো জায়গায় গেলেই। তাই একা থাকা কিংবা একা ভ্রমণের বিলাসিতা কিংবা সাহসিকতা কোনোটাই জন্ম নেয়নি আমার মধ্যে।
তবে এটাও মারাত্মক সত্য, দল বেঁধে কোথাও যাওয়াটা সব সময়ই সুখের ছিল যতবার বি.টি.এই.এফ.-এর সাথে গিয়েছি। তবে ব্যতিক্রমী বীরপুরুষ যে আমাদের সাথে একেবারেই ছিল না তা নয়। উজ্জ্বল ভাই, সারা দুনিয়ার ভিসা অফিসের কড়া আইনগুলোকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে যেভাবে একে একে ৫৪টি দেশে ঘুরেছেন তার গল্প শোনাও বেশ রোমাঞ্চকর। তাঁর কথা হলো, একাই ভাল। কিন্তু ভ্রমণ-গুরু যখন দেশে ঘোরেন তখন কেন যেন একা কোথাও যান না। কেন তা এখনো জানা হয়নি। তবে এতটুকু সত্যি তিনিও মনে হয় কোথাও একা যেতে চান না; কেননা তাঁর মতো সপ্রতিভ মানুষ একা বেড়ানোটা নিতান্ত উপায় না পেয়ে করেন, এটা বোঝা যেত মাঝে মাঝে।
আর আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আরও জটিল। আমি টিম ম্যান আর না পারতে ওয়ান ম্যান আর্মি। ২০০৭-এ ভারতের পাহাড় জয় করে আসার পর থেকে কিছু একটা করার চিন্তা করে যখন আটকে গেলাম ওয়ার্ল্ড টুরের চিন্তায় তখনো খুঁজতে থাকলাম কাকে পাব সাথে। পাওয়া গেল রিফাত ভাইকে আর সাথে কিছু দিনের জন্য উজ্জ্বল ভাইকে।
জুন মাসে রওনা হলাম ব্যংককে। তিনজন। কাজকর্ম দেখানোর জন্য উজ্জ্বল ভাই রইলেনও কিছুদিন। কাজকর্মে দারুণভাবে ফিরে এলাম আমি আর রিফাত। তবে রাতের বেলা বসে আড্ডা দেয়ার সময় শুধু বাংলাদেশের কথা। আসলে আমার মনে হয় যাঁরা দেশের বাইরে থাকেন তাঁদের কাছে দেশের গল্পই থাকে বেশি। আর আমরা তো তবু জানি যে চলে যাব কদিন পর, কিন্তু তাঁদের অনেকেই তো শেষ কবে গেছেন বা আবার কবে যাবেন তা জানেন না। সময় পরিক্রমায় রিফাতও চলে গেলেন দেশে। আমি আটকে থাকলাম পরিকল্পনায় – বিশ্ব ভ্রমণের মতো এক ব্যাপক অনুভবে। তবে খুঁজতে থাকলাম বাংলাদেশ, এখানেও। ব্যংককে। খুঁজে পেতে খুব কষ্ট হলো না, বাংলাদেশ অ্যামবাসিতে পেলাম — বাংলাদেশ। প্রধান থেকে সবাই। না বললেই নয়, মুস্তাফা কামাল সাহেব, মশিউর ভাই। সময় দিলেন, ভালবাসা দিলেন, দিলেন বাংলাদেশের স্বাদ। তবে তাঁদের তো কাজ আছে, আমার মতো ভবঘুরের সাথে বসবাস তাঁদের দ্বারা সম্ভব নয়। আমার খোঁজার শেষ নাই। যেদিন কাজ থাকে না বাংলাদেশী ভাতের হোটেল কস্তুরী-তে বসে থাকি। মানুষ দেখি। দেশী মানুষের কথা শুনি। শেষমেশ ইব্রাহিম ভাই তাঁর ডেরায় জায়গা করে দিলেন থাকার জন্য। আমিও রাজি। যা হোক কথা তো বলা যাবে। ছোট্ট একটা ঘর। মেঝেতে গদি বিছানো।
সারাদিন তিনি ব্যস্ত থাকেন হোটেল নিয়ে, আর আমি আমার কাজে। রাতের বেলা, বেশ রাতে আমাদের শহর দেখা, দোকানের জন্য বাজার করা, গান শুনতে যাওয়া — এই ছিল কাজ। তবে এটা সত্যি, আমার কাছে সঙ্গটাই ভালো লাগতো। আর বাড়তিটুকু পেতাম বোনাস। সন্ধ্যা হলে সোহেল মামা আর শামিম ভাইয়ের সাথে নদীর পারে বসে প্রমোদ-তরী গোনাই ছিল কাজ। আর ছিল তাঁদের কোরিয়ার জীবনের গল্প। কতো কিছু যে জানতে পারলাম তাঁদের কথায়। আমি মনে মনে প্রেমে পড়ে গেলাম কোরিয়ার, যেতেই হবে কোনো এক সময়।
শুক্রবার হলে সবাই একসাথে মসজিদে। কত কথা, দেশের কথা, ঢাকার কথা। শুনতে আমার ভালো লাগে, তাই আসি। ধর্মের আড়ালে আটকে থাকে আমার অনুগমন। আমি ধার্মিক না হলেও বক-ধার্মিক নই। নদীর পারের গুজরাটিদের তৈরি করা মসজিদটাকে তাই দারুণ লাগে আমার। ভালো লাগে মানুষের সাথে কথা বলতে।
দুবাই এয়ারর্পোটে যে অনেকক্ষণ আটকে থাকতে হবে তা জানতাম না। রওনা দেয়ার পর বুঝতে পারলাম আমার টিকিটের সাথে হোটেল রিজার্ভ করা নাই। তাই বেশ ধাক্কাই খেলাম। অগত্যা উপায় না দেখে আবার খুঁজতে লাগলাম আমার মতো কাউকে, দেশী হলে ভালো, যে-কোন একজন হলেও চলবে। কোনো লাভ হলো না। এয়ারবাস ৭৭৭-এর পেট-মোটা বডির ভিতরে যে কতো মানুষ বসতে পারে তা না দেখলে বিশ্বাস করতে পারতাম না। তবে আমার সিটের আশেপাশে কচি-কাঁচার মেলা। বিমান ভ্রমণ যে কতটা বিরক্তকর তা মনে হয় ইন ফ্লাইট ম্যাগাজিন আর এন্টার্টেইনমেন্ট ফ্যাসিলিটির বাহার দেখলেই বোঝা যায়। তবে এত যে বিলাসিতা, উপভোগের সৌভাগ্য – যাত্রীরা কি তাতে খুব খুশি? আমার তো মনে হলো না। কেন জানি বিমান যাত্রা নিদারুণ উপভোগের যোগাড় মাত্র।
রাতের আঁধার চিরে দুবাইয়ের আলো এসে লাগল আমার উইন্ডো সিটে, আমি তাকিয়ে থাকি দূরে, রাস্তার চলে যাওয়া গাড়িগুলোকে দূর থেকে তো আমাদের ঢাকার মতোই লাগে। মরুভূমির বুকে গাছলতার আভা, তা টাক মাথায় কেশ গজানোর টেকনিক্যাল হেয়ার ইমপ্ল্যান্ট করার মতোই। চোখে লাগে।
আমার পরের ১৫ ঘণ্টার বাসস্থান হলো দুবাই ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। বাইরে আমার দাবাড়ু ভাই মঞ্জু অপেক্ষায় আছে, তবে তাকে জানাবার জন্য উপায়ন্তর না দেখে ইমেইল করে দিলাম। ঘিঞ্জির মতো চারদিক — মানুষ আর মানুষ। হঠাৎ করে বাংলাদেশকে খুঁজে পেলাম। গেলবার পরিব্রাজক টিম বি.টি.ই.এফ. যখন প্যাডেল স্টিমারে করে মংলা যাওয়ার জন্য ভর রোজায় অফিস-ক্লাস-কাজ ছেড়ে সদরঘাটের সদর দরজায় উঁকি মারছিলাম তখন পিঠের পিছনের ব্যাগ সামলানো আর তার পিছনের কম টাকায় থাকার “বোর্ডিং” প্রায় শতকোটি মানুষ এর দিকে তাকিযে থাকি! দুবাইয়ের খরা মরুর বুকের মাঝের এই এয়ারপোর্টের অবস্থার এর চেয়ে একটু ভালো। এটা শীততাপ নিয়ন্ত্রিত। রেলিং-এ মানুষ, সিঁড়িতে মানুষ, চেয়ারে মানুষ, মেঝেতে মানুষ। বসা মানুষ, শুয়ে থাকা মানুষ। ল্যাপটপের স্ক্রিনে মুখ গোঁজা মানুষ, কফি হাতে মানুষ। সাদা মানুষ, কালো মানুষ, কালা মানুষ, ধলা মানুষ। মানুষ আর মানুষ। আমিও দাঁড়িয়ে আছি তাদের মাঝে। তবে আমি বাংলাদেশ খুঁজতে থাকি দুচোখ দিয়ে, প্রাণপণে। কথা বলা দরকার, আমি একা থাকতে একদমই পারি না!
ট্রানজিট যাত্রীদের খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। খাবার খুঁজতে গিয়ে বাংলার শব্দ পেলাম। কোথায় যেন। আশেপাশে কোথাও। খেই হারিয়ে আবার “সামুচা”য় মন দিলাম। তবে বুঝে গেছি, আছে, আমরা আছি। রাত ২টা হবে, একমাথা থেকে অপর মাথা হাঁটাহাঁটি করে সময় কটানো ছাড়া আর কিছু করার ছিল না। বসবো যে তারও জো নাই। এ কথাটা বিশ্বাস হয়তো আমার মা করবে না, কিন্তু আমার বন্ধুরা যারা গুলশানে অফিস করেন তাঁরা জানেন শত শত বাস আর ট্যাক্সিতে পা রাখা যায় না সময়মতো। আমি বসার জায়গা খুঁজলাম আর দেখতে লাগলাম ল্যাপটপটাকে জিইয়ে রাখার জন্য পাওয়ার পয়েন্ট পাওয়া যায় কিনা। তবে আমার চেয়েও আরো আগে এবং বেশি সময় নিয়ে আছে কিংবা থাকবে এমন মানুষের সংখ্যাও তো কম নয়। তারা আমার আগে থেকে বসে আছে জায়গামতো।
অগত্য হাঁটা ধরলাম। নীচে গেলাম, উপরে উঠে এলাম, নীচতলার মার্কেটে উঁচুতলার জিনিস, আমার জন্য না, তাই পালিয়ে এলাম। পুরো “দ্য টার্মিনাল” ছবির মতো অবস্থা। এর মাঝে ট্রলির আইল ঠেলতে দেখলাম কিছু লোককে। ভালো করে খেয়াল করার পর দেখা গেল, বাংলাদেশী। আমার বয়সী বা তার চেয়ে কমই হবে। কথা বলার জন্য এগিয়ে গেলাম। ৬ মাস আগে এসেছেন। এখানেই কাজ। প্রতিদিন ৮ ঘণ্টা। ভালোই আছেন। কারণ তাঁর কাজ এই বিশাল এয়ারপোর্ট বিল্ডিং-এর মাঝে, নয়তো মরুভূমির লু হাওয়ায় কয়লা হয়ে যেতেন — এই তাঁর ভাষ্য। কথা হলো তাঁর জীবনপ্রণালী নিয়ে। বেশ সুখেই আছেন।
সাও পাওলো, ব্রাজিল
সময় যেমন শুরুর পর থেকে থেমে নেই তেমনি আমি সকাল দেখলাম। এবার আটলান্টিক পাড়ি দিতে হবে। যাব ব্রাজিল। অনেক দূর আমার দেশ থেকে। কাউকে জানি না যারা বাংলাদেশী। তাই বাধ্য হয়ে আমার লোকাল বন্ধুর শরণাপন্ন হতে হয়েছিল। বেশ লম্বা ট্রিপ। প্রায় সব মিলিয়ে ১৩ জন। সময় তাড়িয়ে বয়স কমিয়ে ফেললাম খানিকটা। স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬টার একটু পরেই নেমে এলাম প্লেন থেকে। নিয়ম-মাফিক কার্যক্রম, ব্যতিক্রম হলো এখানে কোনো বাংলাদেশি কিংবা ইন্ডিয়ান দেখতে পেলাম না। তবে ইন্ডিয়ানদের আনাগোনা যে আছে এখানে তা না বললেই নয়। অনেককেই দেখলাম দুবাই থেকে এ পথে আসতে। তবে তাঁরা কী করেন তার কোনো ধারণা পেলাম না।
বন্ধু লু-এর সাথে এবারই প্রথম দেখা। বেশ আগে থেকে কথা হলেও সামনাসামনি এবারই প্রথম। সোজা তার বাসায়। শরীর খুব ক্লান্ত। কখন যে ঘুময়ে পড়েছিলাম জানি না। তবে যখন উঠলাম তখন বেশ রাত। প্রায় নির্ঘুমভাবেই কেটে গেল বাকি সময়টা। আজ আমাদের সাও পাওলোর বাইরে যাবার কথা। তাই করলাম। চলে এলাম ক্যাম্পিনাস-এ। এখানেই আমার সাইকেল চালনা শুরু। তবে মনের মধ্যে একটাই খোঁচা, একটু বাংলাদেশ চাই। এদিক-ওদিক তাকাই, কোথাও কেউ নেই। পরে ভাবলাম, মনে হয়ে মূল শহর থেকে দূরে এসেছি বলে কাউকে দেখা পাচ্ছি না। তবে আছে কোথাও, নিশ্চয়ই আছে।
ফিরে আসার পর মেক্সিকোতে যাওয়ার বন্দোবস্ত করার ফাঁকে ফাঁকে এদিক-ওদিক ঘুরে দেখতে গেলাম, শহরটা কেমন! আর মনের কোণের বাসনাটা হলো অন্তত একজন বাংলাদেশীকে খুঁজে বের করা। কত জায়গা ঘুরলাম, রিপাবলিকা, মিউনিসিপাল থিয়েটারের আসে পাশ, সবচেযে বড় মিউনিসিপালটির মার্কেট। সাথে লু্। কিন্তু কোথাও পেলাম না। অগত্যা মসজিদ খোঁজা শুরু করলাম। পেয়েও গেলাম বাড়ির কাছে, তবে কোনো শুক্রবারে হানা দিতে পারলাম না বলে দেখা করা গেল না কারো সাথে। আমার বিশ্বাস ওখানেই পেয়ে যেতাম কাউকে না কাউকে।
পেরু হয়ে মেক্সিকো যাওয়ার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু সময় সহ আরো কিছু জটিলতার জন্য আর যাওয়া হয়ে উঠলো না। ট্রানজিটের জন্যও ভিসা লাগে আমাদের। তাই ল্যন পেরু-র ফ্লাইট ধরা হলো না। অগত্য অ্যারো মেক্সিকো-র সরাসরি ফ্লাইট ধরে নিলাম। সারারাতের জার্নি শেষে কেবল বোর্ডিং ব্রিজ দিয়ে এগুতে শুরু করতে না করতে ইমিগ্রেশন পুলিশের নেক-নজরে পড়ে গেলাম। প্রথমে “পাসাপোর্টটা” এবং “ভিসতা” দেখতে চাইলেন। দেখালাম। এ-হাত, ও-হাত হতে হতেই শুতে পেলাম — পারফেক্টট। কিছুই বুঝতে পারলাম না। আসলাম পর্তুগিজ রাজ্য থেকে স্প্যানিয়ার্ডদের দেশে। তাই আমার ‘দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে না জুয়ায়’ মাধ্যমিকে পড়া কবিতার সারমর্ম মনে পড়ে গেল। আমার ভাষাগত বিদ্যা খুবই খারাপ আর বাংলা বাদে অন্যান্য ভাষা শেখার চেষ্টা চালালেও ফলাফল শূন্যের কোঠায়। আমি বাংলাকে অনেক ভালোবাসি!
পুলিশ সাহেবের সাথে হাঁটা শুরু করলাম। খানিকটা থেমে তাঁকে আমার ইনভাইটেশনটা দেখানোর পর আবার শুনতে পেলাম – পারফেক্ট। বেশিক্ষণ আর কথা হলো না। সোজা সিল দিয়ে দিলেন আর বলেল বইনস্ দিয়েস্ – ওয়েলকাম। বেরুতেই দেবরূপ-কে পেলাম। খুবই ভালো লাগল। এতদিন পর আবার বন্ধুটির দেখা পেলাম। শেষবার দেখা হয়েছিল সেই ২০০৪-এ। তার আগে পাহাড়ে – গারওয়ালে। এখন শিক্ষকতা করে এখানে। কলকাতার বাঙালি হলেও পূর্বপুরুষের পূর্ববঙ্গীয় ভাব এবং বিলাসিতা এখনো তার মাঝে প্রকট। তাই খানিকটা রিলিফ্ড হলাম তাকে দেখার পর। তার ডেরায় গেলাম। সপ্তাখানেক নিজের কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে আর বন্ধ মিলিয়ে – বন্ধুপত্নীর আতিথেয়তায় বাংলাদেশ খোঁজার তাড়া অনুভব করছিলাম না। আমি এসেছি সাইকেল নিয়ে বিশ্ব ভ্রমণে। আমি এইচ.আই.ভি.দের নিয়ে কাজ করছিলাম দেশে এবং সে কারণেই এখানে আসা। মেক্সিকো সিটি ইউথ ফোর্সের হয়ে ইয়ুথ জার্নালিস্ট হিসেবে কাজ করব। সাথে নিজেরও কাজগুলো শেষ করতে করতে প্রায় ৩ সপ্তাহ চলে গেল। আমার ভ্রমণ-গুরুর কথায় মধ্য আমেরিকার দেশ দর্শনের জন্য প্রথম যখন গুয়েতেমালার ভিসার জন্য গেলাম তখনই বুঝে গেলাম — হবে না।
অগত্যা দেশ খোঁজায় মন দিলাম আবার, তাও বাংলাদেশ। কিন্তু কোথায় পাই। আবার পুরোনো পন্থা ধরে মসজিদের দিকে মন দিলাম। কিন্তু কোথায়? কেউ জানে না। এত বড় শহরের প্রায় বেশির ভাগ রাস্তাই কেউ চেনে না, মসজিদ তো দূরের কথা। ইন্টানেটে দুদিন কাটিয়ে পাঁচটি ঠিকানা পেলাম। এবং তিন ঠিকানায় আর কিছুই নাই, গিয়ে খোঁজ নিলাম। শেষে এক বৃহস্পতিবারে ইউক্লিদিস রাস্তার মাঝামাঝি দ্বিতল বাড়ির ভিতরে মসজিদটাকে আবিষ্কার করলাম। ফ্রান্সিস্কো নামের এক ভদ্রলোক দরজা খুলে দিলেন। দেখলাম মেঝের কার্পেট পরিষ্কার করছিলেন। বসে না থেকে বহু দিন পর নামাজ পড়লাম। মরক্কোর আরেকজন এলেন। কথা হলো, তবে বুঝতে পারলাম না এখানে তিনি কী করেন। দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে, খেতে হবে। ভাবলাম সবাই একসাথে যাব। কিন্তু আমাকে বসিয়ে রেখে তারা বাইরে গেলে, যখন ফিরলেন বুঝতে আমার অসুবিধা হলো না তারা কোথায় গিয়েছিলেন। আমি খানিকটা অবাকই হয়ে গেলাম।
আজ শুক্রবার, সকাল সকাল বেরিয়ে গেলাম। দুপুর ২টা থেকে নামাজ। উপরের তলায় একেবারে শেষ কাতারে জায়গা নিলাম, যাতে সবার দিকে চোখ রাখা যায়। খানিক বাদে সবার মাঝে একজনকে মনে হলো বাংলাদেশী। তাই কথা বলার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকলাম। মনের মধ্যে নামাজের চেয়ে তার আকর্ষণ আমার কাছে অনেক বেশি। কেন তা জানি না। নামাজ শেষে খাওয়ার সময় আমার দৃষ্টি গেল তার দিকে। আমি নিশ্চিত হয়ে গেলাম তিনি আমার দেশের লোক, বাংলায় কথা বলেন। বাইরে এসে পেলাম আরো কয়েকজনকে। সবাই থাকেন এখানে। আজাদ মামার সাথে সখ্য হলো। কথা হলো অনেক। বললেন তার বাসায় উঠতে। আমি তো এককথায় রাজি।
শেষমেশ অনেক দিন বাদে, প্রায় ২৮ দিন পর মনে হলো আবার, পৃথিবীর পথে খুঁজে পেলাম আমার বাংলাদেশ।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৮ comments
ইমতিয়ার শামীম - ১৬ সেপ্টেম্বর ২০০৮ (১:২১ অপরাহ্ণ)
“দুপুর ২টা থেকে নামাজ। উপরের তলায় একেবারে শেষ কাতারে জায়গা নিলাম, যাতে সবার দিকে চোখ রাখা যায়। খানিক বাদে সবার মাঝে একজনকে মনে হলো বাংলাদেশী। তাই কথা বলার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকলাম। মনের মধ্যে নামাজের চেয়ে তার আকর্ষণ আমার কাছে অনেক বেশি। কেন তা জানি না। নামাজ শেষে খাওয়ার সময় আমার দৃষ্টি গেল তার দিকে। আমি নিশ্চিত হয়ে গেলাম তিনি আমার দেশের লোক, বাংলায় কথা বলেন।”
– নামাজ পড়তে যাওয়ার একটি ব্যবহারিক উপকারিতা দেখতে পেয়ে মজা লাগল। ব্যাংককের ওই হোটেল কস্তুরিতে খাওয়ার সৌভাগ্য আমারও হয়েছে, যদিও কারও সঙ্গে পরিচয় হয়নি। হোটেলটি খুঁজে বের করেছিল আমার বন্ধু অপি আর লাকী। ওখানে বসে বসে খাওয়ার চাইতে বাংলা গান শোনাটাই ছিল আমার কাছে বেশি আকর্ষণীয়। আর ব্যাংককের বিখ্যাত কইগুলো দেখেছেন তো… কালো কুচকুচে তাগড়া জোয়ান।
আমি আরও গিয়েছিলাম রিভার কাওয়াই ব্রিজ; রাজার প্যালেস, গণতন্ত্র মিনার, সর্বোচ্চ বুদ্ধমন্দির, পাতাইয়া, এলিফ্যান্ট ভিলেজ কিংবা ব্যাংককের বুকের ওপর দু’ধার বন্ধ করা আদি ব্যাংককের একটি রাস্তা (নামটা এই মুহূর্তে কিছুতেই মনে করতে পারছি না) এসবের চেয়ে ওটাই ছিল আমার কাছে অনেক দ্রষ্টব্য।
ব্যাংককের কথা আমি কিছুতেই ভুলতে পারি না, কেননা বাংলাদেশের বাইরে ওটাই আমার প্রথম কোনও রাষ্ট্র দেখা।
আপনার আরও সব ভ্রমণবৃত্তান্ত পড়ার অপেক্ষায় থাকলাম।
মুনতাসির - ১৯ নভেম্বর ২০০৮ (৫:০৯ পূর্বাহ্ণ)
আমি অত্যন্ত লজ্জিত এত দেরি করে উত্তর দেবার জন্য। আমি একটু আটকা পড়েছিলাম। দুঃখিত।
সৈকত আচার্য - ১৬ সেপ্টেম্বর ২০০৮ (৮:৩৭ অপরাহ্ণ)
@মুনতাসিরঃ আপনার ভ্রমন কাহিনী ভাল লেগেছে। ভাল লেগেছে, আপনার সহজ করে বলার ধরনটি। আর একটি বিষয় প্রশংসা করার মত মনে হয়েছে, তা হ্ল, এত ব্যস্ততার ভিতর দিয়ে যাওয়ার পর ও প্রতিদিনের অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে আপনি কিছু কিছু দিব্যি সঞ্চয় করে তুলে রাখছেন এবং তা অকৃপণতার সাথে আমাদের জন্য বিলিয়ে দিচ্ছেন। তবে পাঠকের দাবী পূরণ করতে হলে, বাকী ভ্রমন কাহিনীগুলো অবিলম্বে বন্দীদশা থেকে মুক্ত করতে হবে। এই আশায় থাকলাম।
বেশ কিছুদিন ধরে ভাবছিলাম, এই ব্লগে যদি কেউ একটি ভ্রমন কাহিনী লিখত, তাহলে, আনন্দের সাথে তা পড়তাম। কারন, আমি ভ্রমন বিষয়ক কোন রচনা পেলে, দ্রুত পড়ে নেয়ার পক্ষে। পড়তে পড়তে, ভাবতে ভাল লাগে, আমিও ঐ ভ্রমনের একজন ভ্রমন সংগী। আমার বিশ্বাস, আপনার ভ্রমন কাহিনী পড়তে গিয়ে অনেকেই ঐ ভ্রমনের সাথে নিজেকে একাত্ম করে নিয়েছে।
অলকেশ - ১৬ সেপ্টেম্বর ২০০৮ (৯:১০ অপরাহ্ণ)
পৃথিবী আপনাকে কি আপন করে ফেলেছে? আপনেরা কি পর হয়ে যাচ্ছে? আর পরেরা আপন? তা হলেই আপনি যাযাবর। আপনার যাযাবর জীবন দীর্ঘজীবী হোক। পরবর্তী কিস্তির অপেক্ষায় বেশীদিন থাকতে চাই না। আপনার কল্যান হোক।
সৈয়দ তাজরুল হোসেন - ১৭ সেপ্টেম্বর ২০০৮ (৩:৫০ অপরাহ্ণ)
মুনতাসির, আপনার ভ্রমন কাহিনী পড়তে পড়তে খুব লোভ লাগছে, এ’রকম বাঁধন হারা হয়ে ঘুরে বেড়ানোর লোভ । আমি ও মনে মনে যাযাবর, ইউরোপের ৬/৭ টি দেশে সামান্য ঘোরার সুযোগ হয়েছে, কিন্তু যে কোন দেশের দু’একটি শহরে ৩/৪ দিন ঘুরে তৃপ্তি হয়নি । আমার তো মনে হয় একটি দেশে অন্তত কয়েক সপ্তাহ থেকে এ মাথা ও মাথা ঘুরার পর বলা যেতে পারে যে, দেশটা এক চিলতে দেখেছি ।
আপনার বিদেশে বাংলাদেশ খোঁজার ব্যাপারটির সংগে অনেকেই একমত হবেন । একটি কথা বলি, অনেকের কাছে হয়তো হাস্যকর মনে হতে পারে । বিদেশে আসলে দেশের ধ্যুৎ ধ্যুৎ করা সিনেমার গান পর্যন্ত আর ততটা অখাদ্য মনে হয় না ।
আপনার এত চমৎকার পোষ্টে মাত্র একটি ছবি দিয়েছেন, এটা রীতিমত অন্যায় । পরের পর্বে প্রচুর ছবি চাই । ধন্যবাদ
রায়হান রশিদ - ২০ অক্টোবর ২০০৮ (৩:৪৩ পূর্বাহ্ণ)
সিরিয়াস পর্যটকের ঘাটতি ছিল এ তল্লাটে, পেয়ে গেলাম। এখন শুধু দরকার (নিদেনপক্ষে) একজন নভোচারী, একজন অভিযাত্রী, একজন ভূলোমন বৈজ্ঞানিক, প্রেমিক, বিপ্লবী, . . .
(আর কেউ পূরণ করুন না তালিকাটি?)
শাহেদ সুমন - ৯ ডিসেম্বর ২০০৮ (৮:০০ অপরাহ্ণ)
মেক্সিকোতে আমি প্রায়ই যাই, আমার শ্বশুর বাড়ী, বাংলাদেশি আছেন বলে জানতাম, কিন্তু বেশির ভাগ বর্ডারের পাশে থাকে বলে জানি। মেক্সিকো সিটিতে যারা থাকে, তাদের সাথে আপনার যোগাযোগ আছে এখনো?
ব্লগ পড়ে অভিভূত, শুভ হোক আপনার বিশ্ব ভ্রমন।
রায়হান রশিদ - ১১ ডিসেম্বর ২০০৮ (২:৪১ অপরাহ্ণ)
মুনতাসির,
এবার একটু অন্য বিষয় নিয়ে কথা বলি। কিছুটা সচেতনভাবেই তুমি হয়তো বিষয়গুলো নিজে উত্থাপন করোনি তোমার লেখায়। সম্ভবত পাঠককে অযথা “বিরক্ত” করতে চাওনি।
ভাবছিলাম, এইডস নিয়ে নিজের সাধ্যমত এই সচেতনতা তৈরীর প্রয়াসে ঠিক কি কি প্রতিবন্ধকতার সম্মূখীন হয়েছো? ঠিক কখন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলে এই কাজটিতে হাত দেয়ার? সব কি পরিকল্পনামাফিক হয়েছিল শুরু থেকে? নাকি এক ঘটনা আরেক ঘটনায় snowball হতে হতে আজ এখানে এসে উপনীত হয়েছো?
বিদ্যমান রক্ষণশীলতা আর সমাজ এবং রাষ্ট্রের নানা prejudice এর মধ্যে বাংলাদেশে এইডস নিয়ে কাজ শুরু করার অভিজ্ঞতা খুব সুখকর হবার কথা না। সে সব আমাদের সাথে share করা যায় মনে হয়। কেমন সাড়া পেয়েছো? বন্ধুদের কাছে কিংবা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে? আমি নিশ্চিত, সে বিষয়ে বলবার মত অনেক কথা তোমার অভিজ্ঞতার ঝুলিতে রয়েছে। ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কারো নাম সরাসরি উল্লেখ করতে অস্বস্তি বোধ করলে না হয় সে সব গোপন করেই বলো।
দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়ানোর কিছু বাস্তব সমস্যাও তো রয়েছে। প্রথমেই যেটা মনে আসছে, সেটা হল অর্থায়ন। কিছু অভিজ্ঞতা থেকে জানি, যত বড় ও গুরুত্বপূর্ণ কাজই হোক, পৃষ্ঠপোষকতা বা sponsorship পাওয়া যে কত পাহাড় প্রমাণ কঠিন কাজ! Sponsor দের থাকে নিজ নিজ এজেন্ডা, দৃষ্টিভঙ্গি। এটা ঠিক – যে পাহাড়ে চড়তে ভয় পায়না সে এসব মানবসৃষ্ট পাহাড়ের প্রতিবন্ধকতায় দমার পাত্র নয়। কিন্তু পথটা যে ঠিক ফুল বিছানোও ছিলনা, তা বেশ অনুমান করতে পারি। এ বিষয়গুলো নিয়ে লিখলে, তাতে আমাদেরও সচেতনতা কিছু বাড়তো।
সেদিন কথায় কথায় বলছিলে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি সংকটের কথা। বলছিলে – যে দেশটি প্রতিনিয়ত আন্তর্জাতিক খবরে স্থান পায় তার প্রাকৃতিক/রাজনৈতিক দুর্যোগের কারণে, সে দেশের একজন হয়ে বিদেশী কোন সংস্থার কাছে সাহায্য/সহযোগিতা চাইতে তোমার আত্মসম্মানে লাগে। তোমার ভাষায় “ভিক্ষা চাইতে ইচ্ছে করেনা”। এই আবেগটা বুঝতে পারি, এবং আমাদের প্রত্যেকেই সম্ভবত তার ভাগীদারও। জানতে ইচ্ছে করে, বহির্বিশ্বের মানুষ যখন তোমার লক্ষ্য এবং mission এর কথা জানতে পারে, তখন কি তাদের চোখে কোন নতুন উপলদ্ধির আলো ঝিলিক দেয়না? সে সব মুহুর্তে কেমন লাগে গরীব সাধারণ এই দেশটির প্রতিনিধিত্ব করতে? কিংবা, বিদেশে বসবাসরত বাঙ্গালীদের কাছ থেকে কেমন সাড়া পেয়েছো?
“চালাক” অভিযাত্রীদের অর্থ, পৃষ্ঠপোষকতা কিংবা মিডিয়া কাভারেজের কখনো অভাব হয়না। নিউজিল্যান্ড সফরের অভিজ্ঞতায় লিখেছো হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিতে হবে সামনে, অথচ তখন এমনকি খাবার পয়সাটুকুও তোমার হাতে ঠিকভাবে ছিলনা। সুতরাং এটা খুব পরিস্কার যে, তুমি এখনো পুরোপুরি “চালাক” হয়ে উঠতে পারোনি। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা মনমুগ্ধকর সফর আর প্রকৃতির বর্ণনা আমরা পেয়েছি তোমার লেখায়, পাশাপাশি দারুন সব ফটোগ্রাফ। কিন্তু পড়তে পড়তে এক ধরণের অপরাধবোধও হয়েছে মনে। মনে হয়েছে, আমরা পাঠকরা বুঝি স্বার্থপরের মত শুধু আনন্দটারই ভাগীদার হচ্ছি, বাস্তবতার টানা পোড়েনে এর যে কুয়াশাচ্ছন্ন দিক আছে, তার ভাগীদার হতে পারছিনা। আমরা বাংলাদেশের ছেলে মুনতাসিরের সেই সব অভিজ্ঞতাও শুনতে চাই, যে এখনো “চালাক” হয়ে উঠতে পারেনি।