শান্তির খোঁজে পর্বতে ‌: দ্বিতীয় পর্ব

(পূর্ব প্রকাশিতের পর. . .) আজকের পথ গত দু'দিনের পথের চেয়েও খানিকটা দীর্ঘ এবং সময়ও লাগলো বেশি। মানসিকভাবে নিজেকে তৈরি রেখেছিলাম। সকালের খাবারটাও একটু ভারী হলো। আগের দিনের রাস্তার মতোই পরিবেশ। তবে নদীটা পার হবার পর থেকে বেশ চড়াই শুরু হলো। আর প্রথম চড়াইটা বেশ বড়। ওঠার গতি মন্থর সবার। শেষ মাথার কাছাকাছি এসে দেখতে পেলাম আমাদের ঘোড়ার বহর হেলে-দুলে এগিয়ে আসছে ব্রিজের দিকে। চারদিকে সবুজ রঙের ছড়াছড়ি, ঈষৎ ধূসর রঙের নদী, মেটে ট্রেইলের উপর বহরটা দেখতে সারিবাঁধা পিঁপড়ের দলের মতোই মনে হবে। পিছন থেকে এগিয়ে যাওয়ার গুঁতো খেয়ে সংবিৎ ফিরল। সময় কম [...]

প্রথম পর্ব / দ্বিতীয় পর্ব / তৃতীয় পর্ব
——————–

(পূর্ব প্রকাশিতের পর. . .)

ঠাকুরকুয়া : ৩৫৩৫ মিটার

আজকের পথ গত দু’দিনের পথের চেয়েও খানিকটা দীর্ঘ এবং সময়ও লাগলো বেশি। মানসিকভাবে নিজেকে তৈরি রেখেছিলাম। সকালের খাবারটাও একটু ভারী হলো। আগের দিনের রাস্তার মতোই পরিবেশ। তবে নদীটা পার হবার পর থেকে বেশ চড়াই শুরু হলো। আর প্রথম চড়াইটা বেশ বড়। ওঠার গতি মন্থর সবার। শেষ মাথার কাছাকাছি এসে দেখতে পেলাম আমাদের ঘোড়ার বহর হেলে-দুলে এগিয়ে আসছে ব্রিজের দিকে। চারদিকে সবুজ রঙের ছড়াছড়ি, ঈষৎ ধূসর রঙের নদী, মেটে ট্রেইলের উপর বহরটা দেখতে সারিবাঁধা পিঁপড়ের দলের মতোই মনে হবে। পিছন থেকে এগিয়ে যাওয়ার গুঁতো খেয়ে সংবিৎ ফিরল। সময় কম। রওনা হয়েছিলাম আটটার দিকে। এখানে দুপুর গড়াবার আগেই সন্ধ্যা নামে এবং শুরু হয়ে যায় ঝড়-বৃষ্টি। সে আশঙ্কা মাথায় রেখে প্রত্যেকেই নিজের সর্বোচ্চ গতিতে এগিয়ে চলেছে।

চড়াইটা ধরে উঠে এলে দারুণ একটা সমতল ভূমি। পুরোটাই ঘাসে ঢাকা। গাছের উচ্চতা কমে যেতে শুরু করেছে; কেননা আমরা প্রায় তিন হাজার মিটার বা ১২ হাজার ফুট উচ্চতা অতিক্রম করতে চলেছি। জুনিপারের ঘন ঝোপ আর পাথরের পাতার মতো শক্ত ঘাস। গাছগুলোকে যখন ছাড়িয়ে এলাম তার খানিক বাদেই আবহাওয়ার পরিবর্তনটা প্রকাশ পেল। বুঝতে পারলাম আমরা ট্রি লাইন অতিক্রম করেছি। পায়ের তলায় মাটি শক্ত হতে হতে এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে প্রথমে মোরেইন এলাকায় প্রবেশ করলাম। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পথের মধ্য দিয়ে কখনো একা আবার কখনো দলের সাথে এগিয়ে যেতে থাকলাম। এই জায়গাটা আমাকে নেপালে এভারেস্ট বেস ক্যাম্প যাওয়ার পথে লেবুচের পরের এমনই এক সমতল বিশাল ভূখণ্ডের কথা মনে করিয়ে দেয়। দুপুরের কড়া রোদে অবস্থা ত্রাহি ত্রাহি। এ পথে খুব বেশি চড়াই ছিল না। তবে আজকের রোদের ঝাঁঝটা একটু বেশি। সাড়ে দশটার দিকে আমরা পৌঁছে গেলাম। ক্যাম্প স্পট খানিকটা নীচের দিকে। উপর থেকে পার্বত্য নদীপাড়ের সবুজ ঘাসে মোড়া অদ্ভুত সুন্দর একটা মালভূমি। মাঝে মাঝে ছোপ ছোপ হয়ে ফুটে আছে ফুল। কতকগুলো হলুদ, কতকগুলো বেগুনি। মাদার ইন ম্যানভিল-এ পড়া রডোডেনড্রনের বাহার দেখলাম। কতই-না শোনা এই ফুলের নাম। আবেশে জড়িয়ে রেখেছে সারা পথ। এগিয়ে যেতে যেতে মন-ভোলানো রূপে কাছে টানে গাছের ছায়া, ক্লান্ত শরীর যেন একটু বিশ্রাম চায়। সম্বল বলতে চকোলেট বার। পানি তো পথেই আছে, সময় মতো বোতল ভরে নিলেই হলো। তবে তাতে নিশ্চিতই থাকবে জুনিপারের গন্ধ আর নুড়ির মিশেল।

এই জায়গাটাতে হাইড্রো-ইলেক্ট্রিক পাওয়ার প্রোজেক্ট হওয়ার কথা ছিল, যা কিনা এখন বারসেনিতে হয়েছে। আর তাই এখনও বেশ কিছু স্থাপনা দেখতে পাওয়া যায় এখানে। তার মধ্যে মেটাল আর ফাইবারের লাইট ওয়েট মেটেরিয়ালের ঘরগুলো এখনও অটুট আছে। আগামীকালের ট্র্যাকটা বেশ বড়, তাই আজ তাঁবুটা খাটিয়ে এরকম দুটি ঘর পরিষ্কার করে থাকার ব্যবস্থা করা হলো। ধূসর হয়ে যাওয়া বোর্ডগুলোতে নানা ধরনের লেখালেখি আর আঁকিবুকি। ঘরের দরজা-জানালার অবস্থা বেশ করুণ। দুপুরে খাওয়া হলো ডিম আর ভাত। এর মাঝেই শুরু হয়ে গেল বৃষ্টি। পড়িমরি করে যে যার রুমে। জোর বৃষ্টি খোলা জানালা পেয়ে আমাদের সঙ্গী হতে পারার আনন্দে আত্মহারা। পলিথিন শিট আর ছাতা দিয়ে কোনো মতে আটকে রাখা হলো। পাশের ঘরে দেবাশিসদার গলা শোনা গেল — ”সাধের লাউ বানাইলো মোরে বৈরাগী”। সবাই মিলে হেঁড়ে গলায় গান ধরলাম।

অতো উঁচুতে যেখানে পাখি ওড়ে না

অতো উঁচুতে যেখানে পাখি ওড়ে না

বেস ক্যাম্প কার্ডে সবার সিগনেচার দেয়া বাকি ছিল; তাই গানের সাথে সমান তালে চলল স্বাক্ষর। দেখতে দেখতে খামে ভরা কার্ডগুলোর স্তূপ জমে গেল সবার মাঝে। বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষণই দেখা গেল না। ঝুম ঝুম বৃষ্টির শব্দে এই গহিন হিমালয়ের মাঝে অদ্ভুত এক নৈসর্গিক পরিবেশ তৈরি হয়েছে। রাতের বেলার খাবার নেবার সময়ও বৃষ্টি বন্ধ হলো না। তবে ঘুমটা যে ভালো হবে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহই রইল না।

টিম মিটিংয়ে আগেই ঠিক করা হয়েছে যত সকালে পারা যায় রওনা হতে হবে। সে কারণেই প্রাতরাশে মুড়ি আর চা ছাড়া কিছুই মিলল না। ঠাকুরকুয়া থেকে বেস ক্যাম্প একদিনের পথ। লম্বা এই পথের মাঝখানে আর কোথাও নাকি ক্যাম্প করার জায়গা নেই। এবং এর পরের পথটা আমাদের কারোই চেনা নয়, তাই দুপুরের খাওয়ার পর গাইড চমন সিং, শেরপা ঠেন্ডিব আর পেমা-কে নিয়ে বেরিয়ে গেল পথের সাথে আগের দিনেই কিছুটা পরিচিত হয়ে নিতে।

এবার শুরুতেই হাড়ভাঙা খাটুনির জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল সবাই। চড়াই উঠছে তো উঠছে। গুল্ম-লতার ঝোপ আর লম্বা লম্বা ধূসর ঘাসগুলোর মধ্য দিয়ে হালকা হয়ে যাওয়া পথ ধরে এগোলাম। বেশিক্ষণ লাগল না। ক্রমেই টের পেলাম আমরা বেশ উচ্চতায় চলে এসেছি। হাঁটার গতির কারণেই ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে গেছে পুরো দলটা। মোরেইন আর বোল্ডারের পথে কেউ যদি বেশি দূরে থাকে তো তাকে অনুসরণ করা যথেষ্টই কঠিন। একারণেই একসময় খেয়াল করলাম আমি সম্পূর্ণ একা। কোন পথ ধরে এগোবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। অনুমান করে এগিয়ে যেতে থাকলাম। একটা রীজ পার হয়ে ঘণ্টাখানেক যাওয়ার পরও কোনো হদিস পেলাম না বাকিদের। তবে ভাগ্য ভালো যে কেবল একদিকেই যাওয়া সম্ভব। অগত্যা কী করা! ভাগ্যের উপর ভরসা করে চলতে থাকি। বুদ্ধ আর রাহাদাকে দেখে খানিকটা আশ্বস্ত হলাম। যদিও বেশ দূরে তারা; তাকে কী, আছে তো! একসময় তাদের ধরে ফেললাম। রাস্তা নিয়ে আমার মতো তারাও আস্থা হারিয়ে ফেলার উপক্রম। তিন জনে মিলে এবার এগিয়ে যেতে থাকলাম।

বেস ক্যাম্প হবে রুতিরুনি গ্লেসিয়ারের কাছে। সেটাকে মাথায় রেখে যাচ্ছি, কিন্তু গ্লেসিয়ারের দেখা তো আর পাই না। এদিকে বেলা বেড়ে গেছে। পেটের মধ্যে গুরর গুরর শব্দ আসছে, রোদে মাথায় ক্যাপ রাখা দায়। এর মাঝে বেশ খানিকটা দূর থেকে প্রায়-সমতল কিন্তু বোল্ডারে ভরা জায়গাটাকে আলাদা করা যায় এমনিতেই। বেশ বড় (খুব কম করে হলেও তিন তলার সমান হবে) বোল্ডারের কারণেই মনে হয় এলাকাটার কোনো বিশেষত্ব আছে। বাম পাশ খাড়া পাথরের দেয়ালে আটকানো আর ডান পাশে গর্জন করে এগিয়ে যাচ্ছে নদী। এগিয়ে এলাম এ পথটুকুও; কারণ সামনে বসন্তদাকে অপেক্ষা করতে দেখলাম। বুঝিয়ে দিলেন কীভাবে কোন দিকে বাকি পথটুকু যেতে হবে। ক্লান্ত শরীরকে বিশ্রাম দেয়ার জন্য বসে গেলাম দিবাকরিনালার পাশে।

আবহাওয়া খারাপের দিকে। বৃষ্টি আসার প্রবল সম্ভাবনা। পরিকল্পনা মাফিক আমাদের এর মাঝে বেস ক্যাম্পে পৌঁছে যাবার কথা। তাই কষ্টটা মনে হয় বেশিই হচ্ছে এখন। মিনিট পনেরো হবে, উঁচু রীজ থেকে তন্ময়কে দেখলাম হাত নেড়ে ইশারা করছে ঐদিকে যাওয়ার জন্য। প্রথমটা ঘাবড়ে গেলাম সবাই; খারাপ কিছু হলো নাকি — এই ভেবে। পরে গাইড চমন সিং-এর ইশারার মর্মোদ্ধার করলেন বসন্তদা। ফিরে গেলেন ফেলে আসা পথে। আমরা বেশ এগিয়ে গিয়েছিলাম। সবাইকে আবার পিছনের দিকে যেতে হবে। আমরা যেখানে অপেক্ষা করছিলাম তার থেকে আরো মিনিট কুড়ি দূরের পথে অপেক্ষা করছে সবাই। বিশ্বদা এগিয়ে গেলেন তাদের ডাকতে। আমি এগুতে থাকলাম বসন্তদার দিকে। উপরে অনেক্ষণ বাদে সাগর ভাইকে দেখে ভালো লাগল।

রুতিরুনি গ্লেসিয়ার : বেস ক্যাম্প
তন্ময় আর সাগর ভাইয়ের সাথে সেই বড় বোল্ডারটার কাছে ফিরে এলাম। ঘোড়া থেকে মাল নামানো শুরু করে দিয়েছে। বুঝলাম এটাই আমাদের বেস ক্যাম্প। চলে এলেন সবাই। গত দিনগুলোতে আমাদের সাথে কখনো সামনে কখনো পিছনে থাকা আমাদের দেয়া ”হাচ” নামের কুকুরটা শুয়ে আছে ঘাসের উপর। সারা শরীর প্রশ্বাস আর নিশ্বাসের তালে তালে উঠছে নামছে। শুনশান নীরব হিমালয়ের কোলে নতুন এক বসতির গোড়া পত্তনে আমরা ব্যস্ত। খুঁজলে কিছু মেষপালকের দেখা মিলতে পারে; এছাড়া ৩০ কিলোমিটারের মধ্যে আর কারো দেখা পাওয়া একেবারেই অসম্ভব।

নদীতে পানি আনতে গেল রামলাল। কিচেন টেন্ট বা শেড যা-ই বলা হোক, সেটা বসল সেই বড় বোল্ডারটার গায়ে। এবার খেয়াল করলাম, এর গায়ে কোনো একসময় নীল রঙের কালিতে তিন-চার লাইন কিছু একটা লেখা হয়েছিল। মানে এখানেই আরেক বার কিংবা অনেক বার গড়ে উঠেছিল বসতি। চমন সিং-এর মতে এর পরে গিয়ে একেবারে ক্যাম্প ১-এ না গেলে ভালো জায়গা মেলা ভার। সবুজ ঘাসের জমিন, পাশেই নদী, বেশ সুন্দর একটা কিচেনের ব্যবস্থা, যোগাযোগের সুবিধা — সবকিছু মিলিয়ে এরচেয়ে ভালো জায়গা আমরা পেতাম না সামনের দিকে। তাছাড়া ঘোড়াগুলোও আর এগোতে পারবে না। এত মালপত্র আমাদের পক্ষে নিয়ে যাওয়া একেবারেই সম্ভব না।

এলপি গ্যাস আর বার্নারের কল্যাণে তাঁবু ফেলে ব্যাগগুলো ঢেকাতে ঢোকাতেই খাবারের বাঁশি শুনতে পেলা। দুপুর গড়িয়ে বিকেল, খিদে তো লাগবেই। গতানুগতিক খাওয়া; তবে সমস্য হলো বাঙালির ছেলে বলে হাতের বদলে চামচ দিয়ে খাওয়ায় তেমন একটা জমছে না। হাত দিয়ে খেতে কোনো মানা নেই, তবে এই ঠাণ্ডায়, কনকনে ঠাণ্ডা পানিতে প্রতি বেলা হাত ধোয়ার সাহস শেরপা আর কুকদের থাকলেও আমার মতো অনেকেরই ছিল না। মালগুলোকে যথাসম্ভব একসাথে করে পলিথিনে ঢেকে রাখার আগেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। যে যার তাঁবুতে স্লিপিং ব্যাগের ভিতরে ঢুকে ক্লান্ত শরীরটাকে খানিকটা উষ্ণতা দেয়ায় ব্যস্ত। বৃষ্টির শব্দ পরিবেশটাকে পাল্টে দিল। একনাগাড়ে বৃষ্টি পড়ছে। কখনো খুব বেশি, কখনো-বা কম; তবে থামছে না। রিপনের চোখভরা তন্দ্রা, সাগর ভাইয়ের ব্যাগ গোছানার তাগাদা, তন্ময়ের এমপি-থ্রি প্লেয়ার দিয়ে গান শোনার চেষ্টা — সবকিছুই কেমন যেন একটু আলাদা। প্রকৃতি মানুষকে কেমন পাল্টে দেয়! ঢাকা শহরে কখনোই আমরা এই সময় এমনভাবে শুয়ে-বসে থাকতে পারতাম না। এই শীতে একটু বাড়তি উষ্ণতার জন্য যারপরনাই কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করছিলাম সবাই।

বুদ্-ধ-অ-অ তাঁবু ঝাড়… এই সৌরভ, তোদের তাঁবুর কী অবস্থা… ইমরান… ও ইমরান… বসন্তদার ডাকে ভাবনায় ছেদ পড়ল। সংবিৎ ফিরে পাবার পর বুঝতে পারলাম তাঁবু আগের চেয়ে আরো কিছুটা কাছে চলে এসেছে, ঠাণ্ডার প্রকোপও বেড়েছে। বৃষ্টি এরই মাঝে তুষার হয়ে গেছে, আগে খেয়াল করিনি। সাগর ভাই আর তন্ময় বাইরে গেল আশপাশটা পরিষ্কার করতে। আমি আর রিপন তাঁবু ঝাড়ার কাজে লেগে গেলাম। ঢুপ ঢুপ শব্দ আসতে থাকলো আশপাশ থেকে। প্রায় ফুটখানেক বরফ। রিপন ও তন্ময়ের জীবনে এটা প্রথম তুষারপাত। ওদের বিস্ময়ভরা মুখ দেখতে খুব ভালো লাগলো। তাঁবুর চারপাশ পরিষ্কার করে ছাতা নিয়ে এ ওর তাঁবুতে কুশল বিনিময় হলো। খাবারের কী অবস্থা, বিকেলের চা হবে কিনা — এই সবও জেনে নেয়া গেল। একসময় পুরোপুরি থেমে গেল ঝড়। বেরিয়ে পড়লাম সবাই। রাতের খাবারেরও সময় হয়ে গেছে। যে যার মতো দাঁড়িয়ে পড়েছে। প্রথম দিন, তাই খাবারের বেশ ভালো আয়োজন। খাসির মাংস আর ভাত। গোগ্রাসে খেল সবাই। একে গরম খাবার, তার উপর মাংস। নাকে-মুখে ঝোলের ঝাঁঝ টের পেলাম এবার। পানি ঝরতে শুরু করেছে নাক দিয়ে। তড়িঘড়ি খাওয়া শেষ করে যত দ্রুত সম্ভব ঢুকে গেলাম যে যার মতো।

ঠাণ্ডার চেয়েও বেশি ভয়াবহ হলো হাড়-কাঁপানো বাতাস। দমকা হাওয়াতে কিছুটা সময় যে কাটাবো তারও জো নেই। শেষ গন্তব্য তাঁবু, স্লিপিং ব্যাগের ভিতরকার উষ্ণতা।

বেস ক্যাম্পে দ্বিতীয় দিন
আজ ক্যাম্প ১-এ লোড ফেরি করতে হবে। তবে সকালে কিছুটা আলসেমি সবাই দেখাল, ঘুম থেকে দেরি করে উঠল। রামলালের চায়ের ডাকে কয়জন তাঁবুর দরজাটা একটু ফাঁক করে মগ বের করেছে আমি অনুমান করতে পারি। আটটার দিকে বের হলাম। ভাত আর বাটার, এই হলো আমাদের প্রাতরাশ। তাই খাবার নেয়ায় খুব একটা রাশ (!) দেখা গেল না। খাওয়া শেষে দিনের পরিকল্পনা জানিয়ে দিলেন বসন্তদা। গতকাল শেরপা ঠেন্ডু আর গাইড চমন সিং সামনের দিকের রাস্তা দেখে এসেছে। পরের ক্যাম্প ঘণ্টা চারেকের পথ। তবে পুরোটাই বিশ্রী রকমের বোল্ডারে ভরা।

মালামাল ভাগ করে দেয়া হলো সবার ব্যাগে। দশটার দিকে সবাই একসাথে বের হলাম। সবার আগে লেজ দুলিয়ে দুলিয়ে আমাদের সাথে চলল হাচ। হাঁটা না বলে ছোটা বলাটাই ভাল। সে দৌড়ে আমরা অনেকেই এগিয়ে গেলাম; আর যারা পিছিয়ে পড়ল তারা রইল বেশ পিছনে। দারুণ ভয়ে ছিলাম অনুজপ্রতিম তন্ময়কে নিয়ে। তার শক্তির কোনো কমতি নেই; কুড়ি-ছোঁয়া বিখ্যাত রুশ পর্বতারোহী আনাতোলি বুখারেভ-এর মতো দেখতে প্রায় ছয় ফুটি মানুষটার এই পথে প্রথম পা ফেলা। এ পথে পায়ের পেশীশক্তির চেয়ে অভিজ্ঞতার প্রয়োজন অনেক বেশি। তাই তন্ময়কে চোখের আড়াল হতে দিলাম না কখনোই। শক্তি আর অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে এ এগোতে থাকল কখনো আমার সাথে, কখনো-বা খানিকটা এগিয়ে।

প্রথম ঘণ্টার কিছুটা সময় চলে গেল উপরে উঠতেই। কেবলই উঠছি। তবে হাঁটার কষ্ট এখন কিছুটা কম অনুভূত হচ্ছে; কারণ পা-র চেয়েও অনেক বেশি সক্রিয় রাখতে হচ্ছে মাথাকে। কোথায় পা ফেলবো, কোথায় ফেললে কী হবে — এই চিন্তাতেই সময় শেষ। পথ বলতে বিশেষ কিছু নেই। যে দিকটাকে সুবিধার মনে হচ্ছে সেদিক দিয়ে এগিয়ে যাওয়া। দূরের কোনো একটা বোল্ডারের ফাঁকে হঠাৎ করেই দেখা গেল সবাইকে বসে থাকতে। মনে হলো এটাই ক্যাম্প ১। হাহ্! মরীচিকা। জল পানের জন্য বিশ্রাম, পৌঁছানো মাত্র আবার ছোটা। এর অবশ্য প্রয়োজনীয়তাও আছে। পাহাড়ে বেলা বারোটার পর থেকে আবহাওয়া এমনভাবে বদলে যায় যে এর কোনো লক্ষণ আগে থেকে বোঝা যায় না। আর যেহেতু আজ শুধু মালপত্র রেখেই চলে আসা, তাই তড়িঘড়িটা স্বাভাবিক।

এবার অবশ্য নিশ্চিত হলাম যে এটাই ক্যাম্প। বসন্তদা আর শেরপারা নিজেদের প্যাক থেকে মালগুলো বের করে একত্র করতে শুরু করেছে। তবে জায়গাটা একেবারেই মনে ধরল না আমার মতো তন্ময়েরও। একে তো ফাঁকা, তার উপর রীজের একেবারে শেষে অবস্থান এই উঁচু জায়গাটার। খানিক পাশে নদী বয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ের দেয়ালে ঘেরা চারপাশ। তাই বাতাস যেন আমাদের পেয়ে মহাখুশি। এই গহিন পাথরের জঙ্গলে অন্তত কাউকে পাওয়া গেল, এই তার ভাব। উত্তর-দক্ষিণমুখী বাতাসের তোড়ে কীভাবে রাত কাটাতে হবে, তাঁবু ফেলার আগেই তা ভাবতে বসলাম। বেশি সময় না নিয়ে ফেরার তাড়া সবার মাঝে, কখন আবার আবহাওয়া খারাপ হয়ে যায়! তবে সাগর ভাইয়েরা এখনো পৌঁছয়নি। রওনা হয়ে গেলাম, পথে দেখা হলো তাদের সাথে; মালগুলো বড় পাথরের আড়ালে রেখে সবাই একত্র হলাম।

বেস ক্যাম্পে দুপুরের খাবার ছিল বিখ্যাত পোস্ত আলু আর ভাত। হায়! এই খাবার, এই অমানুষিক কষ্টের পর? তাঁবুতে ফিরে আমাদের আলোচনার বিষয়ই হতো খাবার — ঢাকায় ফিরে কখন কী খাব। বেস ক্যাম্পে পাঠালাম সবাই। তবে আমরা শুধু নিজেদের বাড়ির ঠিকানায় ছাড়লাম। গাইড চমন সিং ফিরে যাবে; আবার সময়মতো ঘোড়া নিয়ে কবে আসবে তাও বলে দেয়া হয়েছে ওকে।

(পরের খণ্ডে সমাপ্য)

প্রথম পর্ব / দ্বিতীয় পর্ব / তৃতীয় পর্ব
——————–

মুনতাসির

আমি পাহাড়ে চড়ি, সাগরে ডুবি, পৃথিবী আমার প্রেম।

১ comment

  1. Pingback: মুনতাসির | মুক্তাঙ্গন

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.