বাংলাদেশের ইতিহাস কৃষক নিপীড়নের ইতিহাস (তিন)

১ম পর্ব / ২য় পর্ব / এর পর থেকে . . .

এই পোস্টে পর পর চারটি পর্ব দেওয়া হবে। আজ দেওয়া হলো তৃতীয় পর্ব। এই পর্বগুলির সাথে বিজ্ঞ পাঠকের পর্যবেক্ষণ, অর্থাৎ যার কাছে এ ধরণের অত্যাচারের বিবরণ বা মনে থাকা ঘটনা আছে তাঁরা সেগুলি দিলে একটা পূর্ণাঙ্গ লেখা দাঁড় করানো যাবে। একেবারে নিখুঁত সন-তারিখ মিলতেই হবে এমন নয়। সম্ভাব্য মাস এবং বছর উল্লেখ করলেই হবে। আশা করি আপনাদের স্মৃতিতে বা রেকর্ডে ছোট ছোট কৃষক নিপীড়ন বা অত্যাচারের যে টুকু বর্ণনা বা ইতিহাস আছে সেটা এই লেখাটা পূর্ণাঙ্গ করতে সাহায্য করবে।

ইন্ট্রো-৬ : তথাপি আইন আজো বর্গাদারকে এই অধিকার দেয় নাই
‘সমাজ সমীক্ষা’ (ইন্ডিয়ান স্কুল অফ সোস্যাল সায়েন্স-এর মুখপাত্র), অষ্টম বর্ষ, পঞ্চম-ষষ্ঠ সংখ্যা ১৯৯৬ থেকে একটি প্রতিবেদনের অংশ উল্লেখ করা প্রয়োজন। ‘১৯৩৯ সালে ভূমিরাজস্ব কমিশনের নিকট কৃষক সভা যে স্মারকলিপি দাখিল করে তাহাতে ভাগচাষীর সমস্ত অধিকার দাবি করা হয়। এই সময় স্বতঃস্ফূর্তভাবে উত্তরবঙ্গের দিনাজপুর-রংপুর, জলপাইগুড়ি জেলায় ‘আধিয়ার আন্দোলন’ ব্যাপকভাবে ছড়াইয়া পড়ে, …এই আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতি ১৯৪৬-৪৭ সালের ঐতিহাসিক ‘তেভাগা আন্দোলন’। ১৯৪০ সালে ভূমিরাজস্ব কমিশন তাহাদের রিপোর্টে সুপারিশ করেন, …১৯২৮ সালের আইনে বর্গাদার সম্পর্কে ঐরূপ বিধান করা ভুল হইয়াছে। বর্গাদারকে প্রজা বলিয়া স্বীকার করিতে হইবে; মালিক আইনত: অর্ধেক ভাগের বদলে তিন ভাগের একভাগ মতে বর্গাদারের নিকট হইতে আদায় করিতে পারিবেন”। তথাপি আইন আজো বর্গাদারকে এই অধিকার দেয় নাই। আজ লীগ মন্ত্রিসভা বাংলার মসনদে : বাংলার ভাগচাষী ও গরিব চাষীর শতকরা ৭০ ভাগ মুসলমান। ইহারা আজ অনাহারে ও দুর্ভিক্ষে মরিতেছে; নৃশংস জোতদার মজুতদারের শোষণে ধ্বংস হইতেছে, তবুও লীগ মন্ত্রিসভা গত সাত মাসের মধ্যে এই সুপারিশ আইনে পরিণত করিবার ফুরসত পান নাই; আর তাই অনশন জর্জরিত ভাগচাষীরা গরিব কৃষকের সহিত মিলিয়া নিজেদের আইন তৈরি করিবার জন্য তেভাগার লড়াই শুরু করিয়াছে। আওয়াজ তুলিয়াছে-দখল রেখে চাষ কর/ ফসল কেটে ঘরে তোল/ আধি নাই তেভাগা চাই/ বিনা রশিদে ভাগ নাই/ বাজে কোন আদায় নাই/ পাঁচসেরের বেশি সুদ নাই/’।

এতো বড়ো একটা কোটেশন টানতে হলো এ কারণে যে, আজকে যারা প্রাচীন বাংলার কৃষকের ভাগচাষীর সুখের পারাবারের জিগির তুলে গণতন্ত্রের মানসপুত্র বলে সোহরাওয়ার্দীকে তুল্য করেন তাদের ভুল ভাঙানো দরকার। ব্রিটিশের নাগপাশ থেকে সদ্যমুক্ত হওয়া বাংলার চাষা ক্ষেতমজুরদের ন্যায্য অধিকার কীভাবে তৎকালীন লীগ মন্ত্রিসভা ভূলুণ্ঠিত করেছিল এটা তার সামান্য দলিল। তেভাগার প্রসঙ্গ এজন্য টানা হলো যে, সে সময় যে ভাগচাষী তেভাগার জন্য জীবন দিয়েছিল ষাট বছর পরও সেই ভাগচাষী তার অধিকার পায়নি। আজো শুধু জমির মালিক হওয়ার সুবাদে অর্ধেক ভাগ জমির মালিকের ঘরে ওঠে। সে সময়কার আরো একটি প্রতিবেদন- “মহাজনে ধান কিনিয়া গুদাম ভর্তি করে/ পেটের দায়ত্ গরিব নোকে গরু বিক্রি করে/ তবুতো না বাঁচে প্রাণ মহা চিন্তাত্ পরে/ উপায় না দেখিয়া শেষত্ জমি বিক্রি করে”। এই যে ক্ষুদে কৃষকের জমি বিক্রি করার কারণ সেটি কি আজো সমানভাবে প্রযোজ্য নয়?

গত সংখ্যায় পঁচাত্তর পূর্ববর্তী সময়কালের কথা বলা হয়েছিল। এই প্রতিবেদনে পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ের কথা :-

পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পরে জিয়াউর রহমান সামরিক ক্যুর মাধ্যমে মতা দখল করে প্রথমেই ধ্বংস করেছিলেন এদেশের গরিব কৃষক, মজুরদের স্বার্থ দেখা বাম রাজনীতিকে। ওই রাজনীতির দোদুল্যমান সুবিধাবাদী অংশকে টাকা আর ক্ষমতার প্রলোভনে কিনে নিলেন। যারা বিক্রি হলেন না তাদের ওপর নেমে আসলো যুদ্ধের বিভীষিকা। রাজনৈতিক মুলো দেখিয়ে রক্ষীবাহিনী কর্তৃক গ্রেপ্তারকৃত বাম নেতাদের ছাড়িয়ে আনলেন এবং বিক্রি না হওয়া বাম নেতাদের সরাসরি খতম করার ঘোষণা দিলেন। দ্বিতীয় যে কাজটি শুরু করলেন সেটা বাংলার কৃষক, ক্ষেতমজুর, গরিব চাষীদের ধ্বংস করার মহাপরিকল্পনা। তার এই মহাপরিকল্পনায় অকাতরে টাকা ঢালতে লাগলো দেশের ভেতরকার মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া, উঠতি পুঁজিপতি, জোতদার এবং বিদেশী অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠান। তিনি ‘খালকাটা কর্মসূচি’ মূলত শুরু করলেন তার উর্দিপরা অজনপ্রিয় দলকে দেশের সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিত করবার জন্য, দেশজুড়ে আওয়ামী লীগের যে জনপ্রিয়তা তা খর্ব করার জন্য এবং সর্বোপরি দাতাসংস্থাগুলোর ফাড অ্যাকশন প্রোগ্রাম বা ফ্যাপ বাস্তবায়ন করার জন্য। যত্রতত্র খাল কেটে ক্ষুদ্র চাষীর দুএক বিঘে জমিও শেষ করে দেওয়া হলো। জোতদাররা দলে দলে জিয়ার দলে নাম লেখাতে লাগলো। জোতদারদের বসানো পাম্পের পানি খাল দিয়ে যে জমিতে ঢুকলো সে জমি জোতদার বা ধনী কৃষকের, কিন্তু যেহেতু পানি ঢুকেছে সেহেতু দুএক বিঘে জমির মালিককেও পানির জন্য টাকা গুনতে হলো। খালে খালে ভরে উঠলো বাংলার সমান জমিগুলো। খণ্ড খণ্ড হতে থাকলো এমনিতেই খণ্ড হয়ে থাকা জমি। বেহাত হতে থাকলো ছোট ছোট জমির টুকরোগুলো।
ইতিহাসের নির্মম বাস্তবতা হলো হালাকু, চেঙ্গিস, মুঘল, পাঠান, জাঠ, ইংরেজ, পাঞ্জাবি সবার দ্বারাই বাংলার কৃষক, ক্ষেতমজুর, চাষী বর্গাদার, আধিয়াররা লুণ্ঠিত হয়েছে, ধর্ষিত হয়েছে, খুন হয়েছে, অত্যাচার-নিপীড়িত হয়েছে, গৃহহীন হয়েছে। কিন্তু অপমানিত হয়নি। জিয়াউর রহমান প্রথম বাংলার চাষীকে অপমান করলেন। স্বেচ্ছাশ্রমে খাল কাটার জন্য তিনি চালু করলেন, ফুড ফর ওয়ার্ক বা কাজের বিনিময়ে খাদ্য এবং খয়রাতি সাহায্য। তিনি কৃষককে কাজের বিনিময়ে (খাল কাটার জন্য) খাবার দিলেন, আর খয়রাত দিলেন। সেই প্রথম বাংলার কৃষক খয়রাত গ্রহণ করে খয়রাতি হয়ে গেলো। সেই কৃষকই পরে জমিজমা বেঁচে মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি দেওয়ার পর মিসকিন হয়ে গেলো। পঞ্চাশের মন্বন্তরে (বাংলা ১৩৫০ সালের মহাদুর্ভিক্ষ) লাখে লাখে অনাহারে মৃত্যুও বাংলার চাষীকে খয়রাতি করতে পারেনি, চাষী কারো কাছে হাত পেতে ‘ফুড ফর ওয়ার্ক’ গ্রহণ করেনি, অথচ জিয়াউর রহমান পুরো বাংলাকে খালের জলে ভাসিয়ে খয়রাতি করে দিলো।

জিয়ার মন্ত্রিসভার সে সময়কার কুলিন বামদের মধ্যে জাদুমিয়া, নুরুল হুদা, এস এ বারী এটি, তোয়াহা, ছটি মির্জা, সামসুল হক, বারিন দত্ত প্রমুখেরা সারা জীবন ক্ষেতমজুরের কল্যাণ স্বপ্ন বুকে ধারণ করার পরও মন্ত্রী হয়ে, সাংসদ হয়ে চাষীর রক্ত ছাড়া নৈবেদ্য গ্রহণ করতেন না। সোহরাওয়ার্দী যেমন বাংলার চাষীর জন্য কিছুই করেননি, তেমনি জিয়া মন্ত্রিসভার তাবড় বামরা ‘মানি ইজ নো প্রবলেম’ তত্ত্বে ডুবে চাষীর কথা ভুলে গেছেন। তাদের নির্দেশে তাদের চোখের সামনে দুতিন বিঘে জমি ব্লকে পড়ে না বলে চাষীরা অনাবাদি রেখেছে। খালের জলের পয়সা জোগাতে না পেরে জমি ফাঁকা থেকেছে। চাষীর কাছে তার জমি কর্ষণহীন থাকার অর্থ বউ বাঁজা থাকা। এর পর জিয়াউর রহমানের হাত ধরেই বহুজাতিক কর্পোরেট বেনিয়ারা বাংলার চাষ জমি দখল করেছে। বন্ধাবীজ দিয়ে, কীটনাশক দিয়ে, কারিগরি সহায়তার নামে বাঁধের মধ্যে ফেলে চাষীর জমি কর্পোরেট থাবায় ফেলেছে। দেদার টাকা চলে গেছে গ্রামের ধনী কৃষকের হাতে। সেই টাকায় গরিব চাষীর খণ্ড খণ্ড জমিগুলো বেহাত হয়ে গেছে। চাষী প্রাণ বাঁচাতে ছুটেছে শহরে, বস্তিতে, রেল লাইনের ধারে। সেই ছোটা আজো অব্যাহত।

(চলবে)

মনজুরাউল

আমাদের মাতৃগর্ভগুলি এই নষ্ট দেশে চারদিকের নিষেধ আর কাঁটাতারের ভিতর তবু প্রতিদিন রক্তের সমুদ্রে সাঁতার জানা হাজার শিশুর জন্ম দেয় যারা মানুষ......

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.