আমাদের দেশের বুদ্ধিব্যাপারীরা ইনিয়ে-বিনিয়ে মাখো মাখো করে কৃষকজয়গাঁথা রচনা করেন। নিজের চৌহদ্দীর ভেতর শহুরে জজবা মেখে আলাভোলা কুষকদরদি সাজেন। “কুষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে”-র মত ছেঁদো কথা দিয়ে বানী সাজান। নিজেকে “কৃষকের সন্তান” বলে গর্ব করেন। কৃষকের দরদে গন্ধগোলাপে নাক ডুবিয়ে কাঁদেন। কিন্তু কাল থেকে কালান্তরে এদেশের লেখাপড়াজানা মানুষ কেবলই কুষকপীড়ন করে যাচ্ছেন। কৃষকপীড়নের ইতিহাস এত বেশি ভারি হয়ে গেছে যে একাত্তরের পাক জল্লাদদের নয় মাসের অত্যাচারকেও হার মানিয়েছে।
এটা হলো ক্রমাগত অত্যাচার। নির্বিচারে ঠান্ডা মাথায় চালিয়ে যাওয়া অবিচার। প্রতি মুহূর্তে যা ঘটে চলেছে খন্ড খন্ড ভাবে। কখনো তা মিডিয়ায় আসছে,কখনো আসছে না।
এই পোস্টে পর পর চারটি পর্ব দেওয়া হবে। এই পর্বগুলির সাথে বিজ্ঞ পাঠকের পর্যবেক্ষণ,অর্থাৎ যার কাছে এ ধরণের অত্যাচারের বিবরণ বা মনে থাকা ঘটনা আছে তাঁরা সেগুলি দিলে একটা পূর্ণাঙ্গ লেখা দাঁড় করানো যাবে। একেবারে নিখুঁত সন-তারিখ মিলতেই হবে এমন নয়। সম্ভাব্য মাস এবং বছর উল্লেখ করলেই হবে। আশা করি আপনাদের স্মৃতিতে বা রেকর্ডে ছোট ছোট কুষক নিপীড়ন বা অত্যাচারের যে টুকু বর্ণনা বা ইতিহাস আছে সেটা এই লেখাটা পূর্ণাঙ্গ করতে সাহায্য করবে।
————————————————————————————————-
ইন্ট্রো-১. ‘মানব সভ্যতার ইতিহাস শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস’। কার্ল মার্কসের এই যুগান্তকারী উক্তিটি কমবেশি সারা বিশ্বের মানুষ জানেন। শ্রেণীতে শ্রেণীতে দ্বন্দ্ব এবং সেই দ্বন্দ্ব মীমাংসিত হয় নব্য শ্রেণীর উত্থানে। মানব সভ্যতা ক্রমবিকাশ লাভ করে। যবে থেকে এই গণনা সেই থেকে আজ অব্দি শ্রেণী সংগ্রামের পরাজিত শক্তি কৃষক, তথা কৃষিজীবী, তথা কৃষি শ্রমিক। গত শতকের প্রথম ভাগে সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠনের পর কিছুকাল মূলত কৃষিশ্রমিক থেকে শিল্প শ্রমিক হওয়া মানুষগুলো শ্রেণী সংগ্রামের পুরো ভাগে নেতৃত্ব দিয়ে বিজয় লাভ করেছিল এবং কিছুকাল মতার স্বাদ গ্রহণ করেছিল। ক্রেমলিনের চার দেওয়ালের ভেতর সেই ক্ষমতা কুগিত হতে খুব বেশি সময় লাগেনি। বিশ্বের বৃহত্তম দেশটির সেই ‘বিজয়ী’ কৃষক আজ ফিরে গেছে আঠার শতকের অন্ধকারে।
ইন্ট্রো-২. ‘১৯২৮ সালের আইনের সংশোধন ব্যাপারে স্পষ্ট প্রমাণ হলো বাংলার আইনসভার কংগ্রেসি সভ্যদের কাছে চাষীর স্বার্থের চেয়ে জমিদারের স্বার্থ বড়ো’ (‘জমির মালিক’, অতুল চন্দ্র গুপ্ত, ১ জ্যৈষ্ঠ, ১৩৪১) ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনের সমসাময়িক রায়ত-আন্দোলনে চাষীদের পে যেসব দাবি উপস্থিত করা হয়েছিল ১৯৩৮ সালে তার প্রায় সমস্তই পূরণ হয়েছে। কিন্তু বাংলার চাষীর গোয়াল যদি গরুতে ভর্তি হয়ে থাকে, আর তার গোলা যদি ধানে বোঝাই হয়ে গিয়ে থাকে, তার একমাত্র কারণ, সে গোয়াল ও গোলা নিতান্তই ছোট; পূর্বেও ছিল, এখনো আছে।
ইন্ট্রো-৩. ‘১৯১১ সাল থেকে ১৯২৫ সাল পর্যন্ত, এই সময়ের মধ্যে সর্বত্র মজুরির হার বেড়ে যায়। ১৯১১ সালে চাষীদের মজুরি আট আনা থেকে দশ আনা হয়। ১৯৩০ সালে যখন সমস্ত ফসলের দাম কমে যায় তখন কৃষি মজুরদের মজুরিও সেই সঙ্গে কম হয়ে যায়। ১৯৪৩ সালে জিনিসপত্রের দাম অসম্ভব রকম বেড়ে যায়। চাল প্রতি মণ ৩০ থেকে ৫০ টাকা, কোনো কোনো জায়গায় ৭০-৮০ টাকা (সের ১২ আনা থেকে ২ টাকা)। সে সময় কৃষি মজুরদের দৈনিক মজুরিও বেড়ে যায়। আট আনা থেকে বেড়ে বার আনা এবং দেড় টাকাও হয়ে যায়। মজুরদের রোজগারের সমস্ত টাকাই খাদ্যবস্তু কিনতে খরচ হয়ে যায়। সে সময় সর্বাপো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মজুর শ্রেণী’ (‘বাংলার চাষী’, শান্তিপ্রিয় বসু, ১ জ্যৈষ্ঠ ১৩৪১ বঙ্গাব্দ)।
ইন্ট্রো-৪. ‘২৫ মার্চ ১৯৭১, পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বাঙালির ওপর হত্যাযজ্ঞ শুরু করলে বীর বাঙালি রুখে দাঁড়ায়’। এরকম বাক্য বা ঈষৎ পরিবর্তিত বাক্য গত ৩৫ বছর ধরে লেখা হচ্ছে। এখন সেটা ‘মিথ’ হয়ে গেছে। যে ‘বাঙালি’ রুখে দাঁড়ায়, এবং অস্ত্র হাতে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে (ধারণা করা হয় দেড় লাখ সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধ করেছিল) তাদের আশিভাগ ছিল বাংলার কৃষক, অথবা চাষী, অথবা কৃষি মজুর। অথবা মজুরদের সন্তানসন্ততি। পর্যায়ক্রমে সেই দলে শামিল হয় চাষীর পড়ুয়া ছেলে, শ্রমিক, বাঙালি সশস্ত্র সেনা, পুলিশ ইপিআর এবং অন্যান্য শ্রেণীর কিছুসংখ্যক মানুষ। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেই কৃষক, কৃষকের ছেলে, কৃষি মজুর, কৃষি মজুরের শ্রমিক ছেলে আর তাদের পড়ুয়া ছেলেদের চোখের সামনে তাবৎ কৃতিত্ব ছিনতাই হয়ে যায়। চাষীর ছেলে আবারো লাঙল হাতে শক্ত জমিতে দিনমজুর। সে সময় দিনমজুরের মজুরি ছিল ১ টাকা থেকে ২ টাকা, অথবা আড়াই টাকা। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সেনাসদস্য, ইপিআর বা পুলিশ সদস্যদের মাসিক ভাতা ছিল ৬০ থেকে ১০০ টাকা (ভারতীয়) চাষীর বা চাষীর ছেলের মজুরি ছিল ৩০ থেকে ৪০ টাকা! ’৭১ সালে চাষীর মজুরি ২ টাকা দিয়ে চাল পাওয়া যেতো ১ থেকে দেড় সের। তার পুরো দিনের মজুরি দিয়ে চাল ছাড়া আর কিছুই কেনা যেতো না। চাষার স্বপ্ন সোনার বাংলা শুধু মাত্র জাতীয় সঙ্গীতে থেকে গেলো। এসএলআর জমা দেওয়া চাষী বা চাষীর ছেলে হাতে পেলো ২ টাকা প্রতি দিন! মাসে ৬০ টাকা!!
১৯১১ সাল থেকে ১৯৩০ সালে কৃষিমজুর তার মজুরি দিয়ে কিনতে পারতো ১ থেকে দেড় সের চাল। যারা বাংলার গৌরব, গর্ব গাথা নিয়ে বেশুমার সাফাইস্যা দেন, গল্প-কবিতা- উপন্যাসে বাংলার গোয়াল ভরা গরু গোলা ভরা ধান নিয়ে সীমাহীন আবেগে কল্পিত স্বর্গবাসের তুলনা দেন তারা সেই সময়ে যেমন মতলববাজ অথবা বেকুব ছিলেন। এখনো তেমনি বেকুব, মতলববাজ, ধান্ধাবাজ এবং শ্রেণী শোষণে, শ্রেণীতোষণে মশগুল। ১৯৪৩ সালে বিশ্বজুড়ে যুদ্ধের ডামাডোলে দ্রব্যমূল্য অসম্ভব বেড়ে গেলে তখনকার ‘সুশীলরা’ খুবই দয়াশীল (!) হয়ে কৃষিমজুরের মজুরি বাড়িয়ে বার আনা করেছিলেন। তখন সেই বার আনা দিয়ে কৃষিমজুররা যেটুকু চাল কিনতে পারতো, ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে নিজের ফলানো ফসল কিনতে তাকে সেই ৪৩ সালের মতোই শ্রম দিয়ে সারা দিনের মজুরি শেষ করতে হতো ওই ১ থেকে দেড় সের চাল কেনার জন্য।
১৯৭১-এর মুক্তিযোদ্ধারা শ্রেণী পরিচয় অনুযায়ী যার যার নির্দেশিত মনজিলে মকসুদে পৌঁছে গেছেন। সে সময়ের ক্যাপ্টেন জেনারেল হয়ে কেউ আছেন, কেউবা অবসরে চলে গিয়েও ফিরেছেন বড়ো কোনো দপ্তরের প্রধান হয়ে। সে সময়ের ছাত্র মন্ত্রী হয়েছেন, এমপি হয়েছেন, হয়েছেন কবি, চিত্রকর, স্থপতি, প্রকৌশলী, আমলা, ব্যবসায়ী, সে সময়ের শিল্পী হয়েছেন শিল্পমালিক। জোতদার-জমিদার আর ধনী কৃষকের ছেলেরা দেশের, সরকারের সব গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত। সে সময়ের সৈনিক এখন বড়ো শিল্পপতি। কেরানি এখন বড়ো আমলা, দোকানদার এখন কারখানা মালিক। কিন্তু গোটা মুক্তিযুদ্ধের আশিভাগ মানুষ, যে ৩০ লাখ আত্মাহুতি দিয়েছে তার আশিভাগ মানুষ, যে বীরযোদ্ধারা নিজের জীবন তুচ্ছ করে দেশ স্বাধীন করেছে তার আশিভাগ মানুষ, যে স্বপ্নচারী, কিন্তু শতাব্দীর পর শতাব্দীজুড়ে অত্যাচারিত-নিপীড়িত চাষী প্রতিবাদী হয়ে নিজের ভূখণ্ড মুক্ত করেছে তার আশিভাগ মানুষ, সেই হতভাগা চাষী, চাষীর ছেলে আজো সেই ভোতা লাঙল আর আধমরা গরুতে লেপ্টে আছে, তার ভাগ্য বদলায়নি এক রত্তিও। বরং বিশ শতক এবং একুশ শতকের এই সাত বছরের সবচেয়ে ক্রান্তিকালে পড়েছে কৃষক। বাংলার চাষা। সে এখন এই ৫০ হাজার বর্গমাইল খোঁড়াখুড়ি করে ফসল ফলানো ছাড়া অন্য কোথাও নেই। তার ওপর তুঘলক, চেঙ্গিস, হালাকু, বাবর, শাহজাহানরা, ইংরেজ-পাঞ্জাবিরা যে অত্যাচার করেছে তার চেয়ে বিন্দু পরিমাণ কম অত্যাচার হয়নি স্বাধীন দেশে। আর এখন সেই অত্যাচার-নিপীড়ন ভিন্নমাত্রা পেয়েছে। এখনকার অত্যাচার আরো আধুনিক, আরো ম্যাকানাইজড, আরো সুসংগঠিত, আরো নিখুঁত, আরো সিলেকটিভ, আরো ব্যাপক, আরো ভয়ঙ্কর। (চলবে)

আমাদের মাতৃগর্ভগুলি এই নষ্ট দেশে
চারদিকের নিষেধ আর কাঁটাতারের ভিতর
তবু প্রতিদিন রক্তের সমুদ্রে সাঁতার জানা
হাজার শিশুর জন্ম দেয় যারা মানুষ……
