টানা দুই বছরের তত্ত্বাবধায়ক কাম সেনা শাসন, সেই শাসনে মানুষের আহাজারি, দ্রব্যমূল্য নিয়ে মানুষের খাবি খাওয়া, এর থেকে পরিত্রাণের জন্য মানুষের আকুল আগ্রহে বসে থাকার ভেতর খুবই নিরবে এদেশের মানুষের সামনে আর একটি ভয়াবহ বিপদ উপস্থিত হয়েছে। দুই বছরের জাতাকলে পিষ্টোনো মানুষ একটা বহুল কাঙ্খিত নির্বাচনে সদ্য ভোট দিয়ে তাদের পছন্দের সরকার নির্বাচিত করে সবে একটু থিতু হয়েছে। সবে তারা দ্যব্যমূল্যের অসহনীয় দশা থেকে বাঁচার জন্য উন্মূখ হয়ে আছে, ঠিক তখনই এই দুঃসংবাদটি তাদের শুনতে হলো। পাট চাষীরা এই সংবাদ শুনে মাথায় হাত দিয়ে বসেছেন। স্থানীয় বাজারে পাটের ক্রয় মূল্য নেমে ১১শ থেকে ১ হাজার হয়ে গেছে! যা কিছুদিন আগেও ছিল ১৪শ বা ১৫শ এর মত। যে পাট চাষীরা আগেই টাকা নিয়ে খেয়ে ফেলেছেন তাদের এখন হিসেবের বাইরে অতিরিক্ত পাট আড়ৎদার কে বুঝে দিতে হবে। আর যারা সকল প্রকার চাষাবাষের খরচপাতি হিসেব করে সেই মত পাটের স্টক করেছিলেন তাদের তো মাথায় হাত।
কিছুদিন ধরেই আন্তর্জাতিক বাজারে পাটের দাম কমে আসছিল। এবার পাটের প্রধান তিন ক্রেতা,চীন,ভারত আর পাকিস্তানও পাট কেনা অর্ধেকে নামিয়ে এনেছে। এর কারণ তেমন কিছুই না, তাদের চাহিদা কমে গেছে। অর্থাৎ তারা নিশ্চই বিকল্প কিছু একটার সন্ধান পেয়েছে। এর বিপরীতে আমাদের পাট নিয়ে কায়কারবার করা সংস্থার ‘শ্বেতহস্তিদের কথা বার্তা শুনলে মনেই হবে না যে পাট নিয়ে আমরা যতটা না ভাবি তার চে অনেক বেশী ভাবে এর ব্যবহারকারীরা। আমাদের এই কর্তারা যখন চোঙার সামনে কথা বলবেন তখন মনেই হবে না যে পাটের বাজারের কোন তারতম্য হয়েছে বা হচ্ছে! তারা এটা বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলেছেন যে পাটের বহুমুখি ব্যবহার বাড়াতে হবে, পাটের অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদা বাড়াতে হবে, পাটচাষীদের নায্যমূল্য দিতে হবে…..। পাট নিয়ে আমাদের রাজনীতিক আর নীতিনির্ধারকদের যে কি পরিমানে দরদ তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ হলো আমাদের সবচেয়ে বড় পাটকলটি বন্ধ করার পর আমাদের রাজনীতিকরা,তৎকালিন বিএনপি-জামাত সরকারের মন্ত্রিরা, আমলারা খুশিতে মিষ্টিমুখ করেন! কারণ আদমজী নামক সেই পাটকলটি নাকি বছরের পর বিপুল পরিমানে লোকাসান গুনছিল! সেই লোকসান থেকে তারা জাতিকে পরিত্রাণ দিয়েছেন! তারা তো মিষ্টিমুখ করবেনই! পাট এবং বাংলাদেশের অন্যান্য কৃষিপণ্য নিয়ে বিশ্বব্যাংক,এইএমএফ,এডিবি সংস্থাগুলোর যে প্রেসক্রিপশন ছিল তার কোনটিই এদেশের জন্য উপযোগী ছিল না। তার পরও আমাদের সেসব মানতে হয়েছে। গিলতে হয়েছে। এখন যখন আমাদের যেটুকু পাট উৎপন্ন হতো সেটুকুরই বাজার শেষ, তখন বিশ্বব্যাংকঅলারা কোন নতুন প্রেসক্রিপশন দিচ্ছেন না। দেবেন না, কারণ আর কোন প্রেসক্রিপশর নেই। আমাদের দেশে আগেও যে পরিমানে পাট ব্যবহার হতো, এখনো সেই পরিমানেই পাট ব্যবহারের চল গড়ে ওঠেনি। আগে সাত কোটির বাংলাদেশ যে পরিমান পাট ব্যবহার করত এখর তার দ্বিগুণ লোকসংখ্যা হয়েও সেই আগের অনুপাতে পাটের ব্যবহার। তার মানে এখানেও পাটের বিকল্প তৈরি হয়েছে। তাহলে বাকি থাকছে রপ্তানী। আমাদের পাটের মূল আবাদটাই হতো বা হয় রপ্তানীর উদ্দেশ্যে। কিন্তু যারা কিনবেন তারা যদি আর না কেনেন, তাহলে কি করতে হবে, তেমন কোন বিকল্পও আমাদের কর্তাদের মগজে নেই।
পাটের আন্তর্জাতিক বাজার নিয়ে এই দুঃসংবাদটি ছাপা হয়েছে দৈনিক সংবাদ এ, ১০ জানুয়ারী ২০০৯ এ। আর কোন জাতীয় দৈনিকে খবরটি আসেনি। সংবাদ লিখছে, ভারত, চীন, পাকিস্তান থাইল্যান্ড, ইতালি, জার্মানি, ভিয়েতনামে যে পরিমান পাট রপ্তানী হয়েছে বা প্রতিবছর হয়, তার ৮৮ ভাগই রপ্তানী হয় চীন,ভারত আর পাকিস্তানে। চীনের যে আমদানী সেটার ক্রেতা ইউরোপীয় দেশগুলি ক্রমান্বয়ে পাটজাত দ্রব্যের আমদানী কমিয়ে দেওয়ায় চীনও তার চাহিদার তুলনায় আমদানী করেনি। তাছাড়া চীনের এই রপ্তানী বাধাগ্রস্থ হওয়ায় তাদের ৩৬ শতাংশ পাটকল বন্ধ করে দিতে হয়েছে। ভারতে লাগাতার পাটকলে ধর্মঘটও পাট রপ্তানী কমে যাওয়ার কারণ। সব কিছু মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, বিশ্বে যখনই আমদানী-রপ্তানীতে বড় ধরণের কোন দুর্ঘটনা বা বাধা সৃষ্টি হয় তখনই আমাদের উৎপাদিত পণ্য মার খায়, আবার আমরা যা আমদানী করি তা চড়াদামে কিনতে হয়। এটা যেন নিয়মে দাঁড়িয়ে গেছে! যেহেতু এবার সারা বিশ্ব জুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা চলছে, তাই গোটা ইউরোপে আমাদের বা আমাদের কাছ থেকে কিনে যারা রপ্তানী করেন তাদের ভরাডুবি হয়েছে।
আমি একবার শিলিগুড়ি যাওয়ার সময় পথের দুধারে দেখেছিলাম মাইলের পর মাইলে পাট চাষ হয়েছে। জিজ্ঞাসা করে যানা গেল ওরা এখানে কয়েক বছর আগেও পাটের বদলে ধান চাষ করত। তাহলে এখন কেন তারা পাট চাষে ব্রতি হলেন? এই প্রশ্নটাই আমাদের কর্তাব্যক্তিরা মগজে ঠাঁই দিতে নারাজ। তারা বুঝেছে যে, আদমজী বন্ধ হওয়ার পর পরই বাংলাদেশে আরো কিছু গুত্বপূর্ণ পাটকল বন্ধ হয়ে গেছে এবং বন্ধ হওয়ার সারিতে আরো কল দাঁড়িয়ে আছে। তাহলে বাংলাদেশে যে কাঁচা পাট উৎপাদন হবে সেগুলো যদি যথাযথভাবে আন্তর্জাতিক বাজাারে ঢুকতে না পারে তাহলে কোথায় যাবে? খুব সহজ উত্তর, সেই কাঁচা পাট বৈধ বা অবৈধ উপায়ে ভারতের বাজারে আসবে। ভারত সেই পাট ব্যবহারের পাশাপাশি আরো ব্যবহার বাড়ানোর জন্য নিজেরাই নতুন নতুন পাটকল বসিয়েছে! তাহলে কি দাঁড়াচ্ছে ব্যাপারটা? বাংলাদেশ তাদের পাটকল বন্ধ করে দিচ্ছে, আর ভারত নতুন করে পাটকল স্থাপন করছে! আমাদের মোটামাথার আমলা আর এইসকল দপ্তরের অধিকর্তাদের কানে পানি ঢোকানোর আর কোন উপায় খোলা আছে বলে আমার মনে হয় না। কারণ তারা সরকারি পয়সায় বেশুমার মচ্ছব করার জন্য আগেই নিজেদের চুলজ্জা,চোখের মাথা, কানের মাথা খেয়ে বসে আছেন!
এটাতো গেল বিশ্ববাজারের কথা। তাহলে আমাদের যে কৃষকরা চড়াদামে সার বীজ,কীটনাশক কিনে পাট চাষ করে উৎপাদন ব্যয়ও তুলতে পারবেন না তাদের কি হবে? পাট অধিদপ্তর কেবল ব্যাংকসুদ কমানো বা স্টক করে রাখার কথা বলেই খালাস।
সরকারের হাতেও এখন আর সময় নেই। সরকার তাদের কাজটাজ গুছিয়ে সময় করতে করতে পাটের যে কি দশা হবে সেটি বোধকরি সরকারে এখন যারা সদ্য দায়িত্ব নিলেন তারা ঠাওরে আনছেন না। আমরা আশা করতে পারি সরকার অনতিবিলম্বে এই গুরুতর বিষয়টিকে আমলে নেবেন,এবং পাটচাষীদের এই বিপর্যয় থেকে রা করবেন।শুধু ব্যাংক ঋণ মওকুফ করে যে পাটচাষীদের বাঁচানো যাবে না সেটা আমরা যেমন বুঝতে পারছি ঠিক সেভাবেই বুঝতে পারা উচিৎ কর্তাদের। আশা করব তারা কৃষকের কষ্টগুলো বুঝবেন। যদিও এধরণের আশার কোন ভিত্তি এদেশে কোন কালেই ছিল না, এখনো নেই। তবুও আমরা উপায়হীন আশা করা ছাড়া আর কি-ই বা করতে পারি!
আমাদের মাতৃগর্ভগুলি এই নষ্ট দেশে
চারদিকের নিষেধ আর কাঁটাতারের ভিতর
তবু প্রতিদিন রক্তের সমুদ্রে সাঁতার জানা
হাজার শিশুর জন্ম দেয় যারা মানুষ……
