শেষ পর্যন্ত আমরা কোন রাষ্ট্রের নাগরিক

রাষ্ট্র থেকে গণতন্ত্র উবে গেলে রাষ্ট্র আপনাআপনি একটা ভিন্ন রূপ গ্রহণ করে। এই একবিংশ শতকেও সেই রাষ্ট্রব্যবস্থা রাজতন্ত্র হয়ে যেতে পারে। হয়ে যেতে পারে সামরিক একনায়কতন্ত্র অথবা সামরিক আর সিভিল ব্যুরোক্র্যাসির মিশেলে আমলা নির্ভর রাষ্ট্র, শেষ বিচারে যা পুলিশি রাষ্ট্র। কেননা আমলারাষ্ট্রের প্রধান চালিকাশক্তি পুলিশ। আমলা রাষ্ট্রের সাংঘাতিক সব আইনকানুন প্রয়োগ করতে হয় পুলিশকে। পুলিশই হয়ে ওঠে রাষ্ট্র পরিচালনার একমাত্র নিয়ামক।

১১ জানুয়ারির পর বলা হচ্ছে বিগত সরকার ব্যর্থ। তারও আগের সরকার ব্যর্থ। অর্থাৎ ওই দুই সরকারের পারিচালনাধীন রাষ্ট্র দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, লুটপাট, অনিয়ম আর সীমাহীন ব্যর্থতার কারণে ব্যর্থ রাষ্ট্র হয়ে উঠেছিল। ১১ জানুয়ারির পর সেই ব্যর্থ রাষ্ট্র এখন সুনীতি আর সুসময়ের দিকে ধাবমান। ‘সীমাহীন ব্যর্থতার কারণে’ সেই রাষ্ট্রের বিগত দুই সরকার প্রধানের কালিমালিপ্ত চরিত্র জনসম্মুক্ষে উন্মোচন করে দিয়েছে বর্তমান সরকার। সরকারের হয়ে কাজটি পরিচালনা করছে পুলিশ। পুলিশের সেই ‘স্বাধীন’ কাজকে সরকার নিজেদের হস্তক্ষেপ বলে মানতে চাইছে না। সরকার এ ক্ষেত্রে সার্জজনীন ব্যাখ্যার আশ্রয় নিয়েছে : ‘আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে/চলছে’। এ থেকে মনে হবে পুলিশ যে যে কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে তা কেবলই পুলিশের নিজস্ব স্বাধীন চিন্তা থেকে নেওয়া। তার মানে পুলিশ সরকারের কেউ নয়। অথচ পুলিশ বিগত দুই সরকারের বড়ো বড়ো নেতানেত্রীদের গ্রেপ্তার করছে সরাসরি সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশক্রমে এবং সেই নেতানেত্রীদের গ্রেপ্তারের পরপরই সরকারের একাধিক উপদেষ্টা নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। তখন বলা হচ্ছে না যে ‘আমরা কিছুই জানি না’। কিন্তু যখন গ্রেপ্তারকালীন বা গ্রেপ্তার পরবর্তী সময়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠছে তখনই সরকারের একাধিক উপদেষ্টা সম্পূর্ণ ব্যাপারটা পুলিশের এবং দেশের আইনের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছেন। এবং ‘আইন সবার জন্য সমান’ বলে ইতি টানছেন। ধন্যবাদ দুজন বিচারপতি সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চকে। শেখ হাসিনার জামিনের জন্য দায়েরকৃত রিট শুনানির সময়ে ‘আইন সবার জন্য সমান’ এই মুখস্থ কথাটা ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বলায় বিচারপতি বলেছেন ‘না সবক্ষেত্রে সমান তা মনে হয় না। আপনি চুরি করলে জেলে ডিভিশন পাবেন, কিন্তু একজন সাধারণ নাগরিক তা পাবেন না, তাকে সাধারণ কয়েদিদের সঙ্গে রাখা হবে’ (সমকাল, ৩১ জুলাই, ২০০৭)।

যেহেতু ১১ জানুয়ারির পর জরুরি অবস্থা চলছে, তাই এটা কোনো সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র নয়, রাজতন্ত্র নয়, প্রাচীন ট্রাইবাল সমাজও নয়। এটা অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার কর্তৃক চালিত রাষ্ট্র। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো গণপ্রতিনিধি নেই। তার নির্দেশ-আইন বাস্তবায়িত হয় সরকারি আমলা দ্বারা। আমলারা আইন, নির্দেশ, হুকুম-ধমক, বল প্রয়োগ সবই যেহেতু পুলিশ দিয়ে করেন, সেহেতু এটা এক অর্থে ‘পুলিশী রাষ্ট্র’। আর সে কারণে পুলিশকে খুব বড়ো গলা করে ঢেলে সাজানোর কথা বলা হচ্ছে। এই ঢেলে সাজানোর কাজে যে পরিমাণ টাকা-পয়সা লাগবে তাও প্রায় মুফতে পাওয়া যাচ্ছে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি ইত্যকার সংস্থাগুলো পুলিশ বিভাগ সংস্কারের টাকার জোগান দেবে (এ এক ভারি মজার লেনদেন! ওরা দেশের ছিন্নমূল মানুষগুলোর মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের বাবদ কোনো অনুদান দেয় না, বরং পুলিশ দিয়ে সেই ছিন্নমূলদের ঝুপড়ি ঘর ভাঙার কাজে সাহায্য দেয়! পুলিশকে জনগণের বন্ধু হওয়ার সোনার পাথরবাটি মার্কা কর্মাকণ্ডে টাকা দেয়!)।

১১ জানুয়ারির পর আমরা অনেক ভালো ভালো কথা, মহান সব প্রতিশ্র“তি শুনেছি। অনেক ‘পদক্ষেপ’, অনেক ‘ব্যবস্থা’, অনেক ‘পরিকল্পনা’, অনেক ‘কঠোর সিদ্ধান্তের’ কথা শুনেছি। সত্যিকার অর্থে শেষ পর্যন্ত ফলপ্রসূ হয়েছে দুর্নীতির অভিযোগে কিছু বড়োমাপের নেতানেত্রী আর ব্যবসায়ী কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তার করে জেলে পোরা। সরকারকে অনেক প্রতিশ্র“তি থেকে শেষ পর্যন্ত সরে আসতে হয়েছে। এবং সরে এসে সরকারের উপদেষ্টারা, আমলারা, বড়ো কর্তারা সেই সব শব্দযোগে সেই সব ব্যাখ্যাই দিয়েছেন, যা বিগত ব্যর্থ সরকারের মন্ত্রী-নেতারা দিতেন। দেশের নিু আর মধ্যম আয়ের মানুষ দ্রব্যমূল্যের কষাঘাতে দিশেহারা, জর্জরিত। কোথাও কোথাও পেটের জ্বালা জুড়োতে অসহায় গরিম মানুষ আত্মহত্যা পর্যন্ত করেছে। সেই নির্বিচারে প্রতিদিন বৃদ্ধি পাওয়া দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে অর্থ উপদেষ্টা বলেছেনÑ ‘মানুষের আয় ও ক্রয় ক্ষমতা বাড়ার কারণে পণ্যের মূল্য বেড়েছে’ (ভোরের কাগজ, ২৭ জুলাই, ২০০৭)!

এই কথাটা হাজার বার বলেছেন ‘ব্যর্থ সরকারের’ অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান। দিশেহারা মানুষ যখন ২২ টাকার আটা ৩১ টাকায়, ১৮ টাকার চাল ২৮ টাকায়, ৫২ টাকার সয়াবিন তেল ৮০ টাকায় ৪৮ টাকার ডাল ৮০ টাকায় বাধ্য হয়ে কিনে জীবন বাঁচায়, তা দেখে যদি একজন দায়িত্বশীল মানুষ ক্রয়ক্ষমতা বাড়ার আর আয় বাড়ার দৃষ্টান্ত খুঁজে পান তাহলে সত্য প্রমাণের জন্য এখন মানুষকে ধারদেনা করে, ঘটিবাটি বেঁচে ওই সকল খাদ্য না কিনে অনাহারে মরতে হবে।

যেহেতু এটা এখন কার্যত ‘পুলিশি রাষ্ট্র’ তাই ভূখা মরার আগে ভুখা মিছিল হচ্ছে না।  বিদ্যুতের অভাবে লণ্ঠন মিছিল হচ্ছে না। দ্রব্যমূল্য কমানোর জন্য মানব বন্ধন হচ্ছে না যেহেতু মানুষ সবই সয়ে নিচ্ছে, যেহেতু কোনো প্রতিবাদ করার সুযোগ নেই, সেহেতু রাষ্ট্রের পরিচালকরা ধরে নিচ্ছেন সবই ঠিকঠাক আছে! কোথাও কোনো অভাব নেই! বানভাসি কেউ না খেয়ে নেই! খালিশপুরের শ্রমিকরা সর্বস্বান্ত বেকার হয়ে সুখে ঘুম দিচ্ছে! বস্তি ভাঙা হাজার হাজার মানুষ বৃষ্টিতে ভিজে খিঁচুড়ি-ভাঁপা ইলিশ দিয়ে মজা করছে! বাজারে গেলে যা চাই তা যেকোনো মূল্যে পাওয়া যাচ্ছে এবং ‘সংশোধিত পুলিশ’ থাকায় ন্যায় ও আইনের শাসনে মানুষ সুখে নিদ্রা যাচ্ছে! পুলিশের আইজিপি সাহেব প্রায়শঃই মিডিয়াতে হাত-পা নেড়ে দেখাচ্ছেন যে, আগে তার ডানে-বামে রাজনৈতিক খবরদারি ছিল, পুলিশ তাই ভুলপথে চালিত হতো। এখন ডানে-বামে, সামনে-পিছে কোনো রাজনৈতিক খবরদারি নেই, তাই পুলিশ নিরপেক্ষভাবে দেশসেবা করছে! তিনি তার কথা বরেছেন। রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্র পরিস্তিতি সেইমতো বলবে। পরিস্থিতি হলো জরুরি অবস্থার সুযোগে মাঠ পর্যায়ের পুলিশকে কারো কাছে জবাবদিহি করতে হচ্ছে না। পুলিশকে দিয়ে যখন রাষ্ট্রের নিপীড়নমূলক, নিবর্তনমূলক কর্মকাণ্ড করানো হচ্ছে, তারও কোনো জবাবদিহিতা থাকছে না। কেন পুলিশ খালিশপুরের লঙ্গরখানা ভেঙে দিলো, কেন খাবার বিতরণকারীদের দাবড়ে খেদালো, কেন অসহায় অভুক্ত মানুষদের খাবার জোগান বন্ধ করে দিলো তার ব্যাখ্যা নেই। আসামি ধরতে গিয়ে কেন তার বৃদ্ধ বাবাকে পুলিশ লাথি দিয়ে মেরে ফেললো? যদিও ২৮ জুলাই দৈনিক সমকালে ‘বরিশালে পুলিশের লাথিতে বৃদ্ধের মৃত্যুর অভিযোগ’ খবরের প্রতিবাদ করেছেন বরিশালের পুলিশ সুপার। যথারীতি তিনি অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, ‘হেলালকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে আসার পর অজ্ঞাত কারণে তার বাবা এসকেন্দার সর্দারের মৃত্যু হয়’। আর প্রতিবেদকের ভাষ্য- ওই সংবাদ এসকেন্দার সর্দারের পুত্রবধূ পারভিন আক্তারসহ পরিবারের একাধিক সদস্যের বক্তব্য অনুযায়ী প্রকাশিত হয়। কেন জয়পুরহাটে থানাহাজতে আঃ সামাদকে আত্মহত্যা করতে হল? কেন ওই থানার এসআই আমিনুল ইসলাম ও কনস্টেবল এমদাদ আলীকে ‘ক্লোজ’ করা হলো? ব্যাখ্যা নেই। বদলে যাওয়া পুলিশের এমন সুখ্যাতি শুধু এটুকুই নয়। প্রতিদিনই এমন ঘটনা ঘটছে। সবটুকু খবরে আসে না।

আমরা কার্যত ‘পুলিশি রাষ্ট্রে’ বসবাস করছি, এটা মানতে দেশের সাধারণ মানুষের বাধা নেই, কারণ তারা নমুনাগুলো উপলব্ধি করছে, বিশেষ করে খুলনার খালিশপুরের ১৪ হাজার শ্রমিক, চাঁপাইনবাবগঞ্জের হাজার হাজার কৃষক, বরগুনায় সারের জন্য পুলিশের বাড়ি খাওয়া শত শত চাষা আর প্রতিদিন ফুটপাথের হাজার হাজার লাঠিপেটা হওয়া হকাররা শরীরের ব্যথা নিয়েই বুঝছেন। পুলিশ দিয়ে সরকার তার সমস্ত সিদ্ধান্ত, বিরুদ্ধমত দমনকরণ, আইন প্রয়োগ, জেলখানা ভরে ফেলা, সাধারণ গরিবদের দাবড়ে দুবড়ে ‘সোজা’করণ করতে পারবেন হয়তো। কিন্তু দেশের সর্বত্র খাদ্যের হাহাকার; এবং সেই হাহাকার পরবর্তী পরিস্থিতিও কী পুলিশ দিয়ে নিরাময় সম্ভব?

সাবস্ক্রাইব করুন
অবগত করুন
guest

15 মন্তব্যসমূহ
সবচেয়ে পুরোনো
সাম্প্রতিকতম সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত
Inline Feedbacks
View all comments
15
0
আপনার ভাবনাগুলোও শেয়ার করুনx
  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.