“মুনিম ভাই, আপনেরে ২৮০০ ‘টাকার’ কার্ড দিসে সিটি ব্যাঙ্ক, কই খাওয়াইবেন কন” আমার রুমমেট চেঁচিয়ে ঊঠল। আমেরিকায় আমার প্রথম ক্রেডিট কার্ড, ২৮০০ ডলার, এই ২৮০০ ডলারে আমি একশো ফানুস কিনে কিছু ফানুস উড়ানোর আজন্ম সলজ্জ সাধ পূরণ করতে পারি, নতুন জুতো কিনতে পারি, বেড়াতে যেতে পারি, শুধু মাসের শেষে মিনিমাম পেমেন্ট করলেই হবে। আমি শ তিনেক ডলার প্রথম মাসেই লোণ করলাম, মিনিমাম পেমেন্ট মোটে বিশ ডলার। কয়েক মাস বাদে আমার লোণ হাজার দুয়েক, মিনিমাম পেমেন্ট এমন কিছু নয়, ৫০ ডলার। আরও কয়েকটা কার্ড বাগিয়ে আমার ক্রেডিট লিমিট দাঁড়ালো ১৫ হাজারে, দুবছর বাদে দেশে গিয়ে বিয়েও করে এলাম, মূলত ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমেই। এর বছর খানেক পরে আমার স্ত্রী যখন এদেশে এলেন, তখন মিনিমাম পেমেন্ট আর ‘মিনিমাম’ নেই, সেটা মাসে ৭০০ ডলারের কাছাকাছি। আমার মোট ঋণ তখন বিশ হাজার ডলারের উপরে। এই ঋণের চাপে নব বিবাহিত স্ত্রীকে নিয়ে জোছনা এবং বৃষ্টি বিষয়ক নানা হূমায়নীয় ঢং করার যে স্বপ্ন ছিল, তাও বাস্তবায়িত হয়নি। আমার স্ত্রীকে মঁপাসার ‘দ্য ডায়মন্ড নেকলেসের’ কেরানীর স্ত্রীর মত কাজে নামতে হয় এবং কয়েকবছর কাজ করার পর আমাদের ঋণ শোধ হয়। আমি ক্রেডিট কার্ড কোম্পানিগুলো থেকে থেকে যা লোণ নিয়েছি তার পরিমাণ সব মিলিয়ে ১২-১৪ হাজারের বেশী নয়। তবে সব মিলিয়ে শোধ করেছি ৩০ হাজার ডলারেরও বেশী।
ব্যক্তিগত গল্প বলে বিরক্তি উৎপাদনের জন্য দুঃখিত। তবে এই গল্প ঠিক ব্যক্তিগত নয়, আমেরিকাতে বসবাসকারী প্রায় সবারই একই গল্প। আমেরিকান বড় বড় ক্রেডিট কার্ড কোম্পানিগুলো অতি লাভজনক ব্যবসা করে চলেছে দশকের পর দশক। সিটি গ্রুপের কার্ড নিয়ে আমি যে শুধ ফানুস উড়িয়েছি তাই নয়, টিউশন ফি দিয়েছি, পাঠ্যবই কিনেছি, মানে সেই কার্ড আমাকে পড়াশুনা শেষ করে আমেরিকায় নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্যও করেছে, শুধু আমাকেই নয়, লক্ষ লক্ষ মার্কিন ছাত্রকে করেছে। কিন্তু তাই আমরা কেউই বলছি না যে সিটি গ্রুপের CEO বিক্রম পণ্ডিতের নোবেল পাওয়া উচিত। বিক্রম বাবু নোবেল তো দুরের কথা, অতিরিক্ত বোনাস নেবার কারণে ওবামার বিরক্তির কারণ হয়েছিলেন।
বাংলাদেশেও গ্রামীণ ব্যাঙ্ক নামে একটি ব্যাঙ্ক আছে, গত কয়েক দশক ধরে মার্কিন ক্রেডিট কার্ড কোম্পানিগুলোর মত লাভজনক ব্যবসা করছে। ঋণ দেওয়া হয়েছে দরিদ্রদের, তাদের বেশীরভাগই সময়মত সুদসহ ঋণ শোধ করেছে এবং করে চলেছে। ব্যাঙ্কটি বলছে যেহেতু গরীবরা সময় মত ঋণ শোধ করেছে, সেহেতু ধরে নিতে হবে তারা ঋণ নিয়ে নিজেরা ব্যবসা করেছে, ব্যবসায় লাভ হয়েছে এবং এর মাধ্যমেই তারা ঋণ শোধ করার সামর্থ্য অর্জন করেছে। ঋণ না পেলে তারা দারিদ্রের যে গভীর গাড্ডায় ছিল, সে গাড্ডাতেই থাকতো। জাপান কোরিয়ার মত দেশগুলোও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে দারিদ্র ব্যাপক হারে কমিয়েছে, তবে সেটা old fashioned wayতে, ব্যাপক রপ্তানীমুখি শিল্পায়ন করে আর সেই শিল্পে লোকজনকে কাজ দিয়ে। এখন যেমন করছে চীন। বিশ্বে কেবল মাত্র বাংলাদেশেই দেখা গেলো গরীবদের লোণ দিয়ে ব্যবসা করিয়ে দারিদ্রমুক্ত করা যায়।
তবে সেই দারিদ্রমুক্তির ব্যাপারটিও অবশ্য এতই সন্তর্পণে হয়েছে যে আমরা বাংলাদেশীরা দেশে থেকেও সেটা টের পাইনি। আমরা পত্রিকা খুললেই দেখতাম পনের হাজার বাংলাদেশী অবৈধ পথে মালয়েশিয়াতে গিয়ে কাজ না পেয়ে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছে, বেপরোয়া তরুণ বিমানের চাকায় উঠে বিদেশে পালাতে গিয়ে দম আটকে মারা গেছে, সাহারা মরুভূমি পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টায় মারা গেছে ডজন খানেক বেকুব যুবক। দারিদ্রমুক্তির ব্যাপারটা আমরা প্রথমে জানলাম তৎকালীন মার্কিন ফার্স্ট লেডী হিলারি ক্লিনটনের কাছ থেকে। তিনি সশরীরে বাংলাদেশে গিয়ে দেখলেন দারিদ্রমুক্ত মহিলাদের। কয়েকঘন্টা দেখেই তিনি বললেন গ্রামীণ ব্যাঙ্ক দারিদ্রমুক্তিতে বিশাল ভূমিকা রাখছে। এর কয়েক বছর বাদে বিল ক্লিনটন স্বয়ং এলেন। তিনি অবশ্য নিরাপত্তা জনিত কারণে দারিদ্রমুক্ত অঞ্চলে যেতে পারলেন না, তবে দারিদ্রমুক্ত মহিলা এবং শিশুরা এলেন মার্কিন দূতাবাসে, দারিদ্রমুক্ত আনন্দিত শিশুরা ক্লিনটনকে ঘিরে নাচ গানে মেতে উঠলো। তিনিও বললেন দারিদ্রমুক্তি ঘটেছে। ক্লিনটন যে বছর এলেন সে বছরই এই পোস্টের লেখকও বুয়েট থেকে পাস করলো, পাস করে বেকার ঘুরতে লাগলো, এক স্নেহশীল শিক্ষকের কল্যাণে সে জাপানী দলের সাথে দোভাষীর কাজ নিয়ে চাঁদপুরের এক গ্রামীণ গ্রামে গেল। দারিদ্রমুক্তির কিছুই সে দেখল না, তবে জাপানী সাহেবেরা দেখা গেলো এই গ্রামের দারিদ্রমুক্তদের কি করে আর্সেনিক মুক্ত করা যায় সেই নিয়ে নিরীক্ষা করছেন। দারিদ্রমুক্তদের অবশ্য আর্সেনিক মুক্তি নিয়ে তেমন কোন আগ্রহ দেখা গেল না। দারিদ্রমুক্তদের জিজ্ঞাসা করা হল গ্রামে আর্সেনিক বিশুদ্ধকরনের প্লান্ট বসালে তাঁরা অর্ধেক খরচ দিতে রাজী কিনা, দারিদ্রমুক্তরা বলল “সরকার পুরা খরচ দিলে দিবো, নাইলে নাই, গত বছরও সায়েবরা আইয়া একই কতা কইছিল, আমরা না কইরা দিসি”।
গ্রামীণ ব্যাঙ্কের দারিদ্রমুক্তি এতটাই চুপিসারে ঘটেছে যে গ্রামাঞ্চলের অনেক মহিলাই সম্ভবত এর খোঁজ পান নি, নইলে গার্মেন্টসে দিনে বার ঘণ্টা কাজ করার জন্য তিরিশ লক্ষ মহিলা গ্রাম ছাড়বেন কেন? নিজেদের মা বোনেরা গ্রামীণ ঋণ নিয়ে দারিদ্রমুক্ত হচ্ছেন, বাড়ির গর্দভ যুবকটি তা বোধহয় বুঝতেই পারেনি, নইলে জমি বিক্রি করে মধ্যপ্রাচ্যের নির্মাণ শিল্পে কাজ করতে যাওয়া কেন। কেনইবা শুধু শুধু ক্রেনের ধাক্কায় ধুম করে মরে যাওয়া।
তিরিশ লক্ষ গার্মেন্টস কর্মীর আর চল্লিশ লক্ষ প্রবাসীর অর্থনীতিতে অবদান বছরে চল্লিশ বিলিয়ন ডলার। আর গ্রামীণের বিতরণ করা ক্ষুদ্র ঋণের পরিমাণ? ১ বিলিয়ন ডলার। চল্লিশ বিলিয়নের পুরোটা না হোক, খানিকটা তো trickle-down হয়ে গ্রামেই যায়, সেটা কি পারে না ১ বিলিয়নের বার্ষিক কিস্তি মেটাতে? ক্ষুদ্রঋণের ফিল্ড অফিসার তো ছাগল কেনার জন্য রোকেয়া বেগমের হাতে গুজে দিয়ে যান ‘ক্ষুদ্রঋণ’, সেই সাথে হিসাবের খাতা, সাপ্তাহিক কিস্তির পরিমাণ তাতে লেখা আছে। সেই কিস্তি শোধ হয়েই যায়, হয় ছাগলের দুধ বেঁচে না হলে রোকেয়া বেগমের আঠার বছরের কন্যার ঢাকার গার্মেন্টসে রক্ত বেঁচে। বছর ঘুরলেই গ্রামীণের ঝকঝকে ব্যালেন্স শিট, ২০০ মিলিয়ন গ্রোস প্রফিট, ১০ মিলিয়ন নেট প্রফিট। সেই ব্যালেন্স শিট নিয়ে ডঃ ইউনুস ঘুরে বেড়ান সারা পৃথিবীতে, সাথে আছে গোটা দশেক ‘সাকসেস স্টোরি’, হতদরিদ্র সুফিয়া বেগমের পাকা বাড়ি, স্বামী হারা রাবেয়া খাতুনের গ্রামীণ ফোনের জমজমাট ব্যবসা, সেই সাকসেস স্টোরি দেখে ইউরোপের অডিটোরিয়াম ফেটে পড়ে স্ট্যান্ডিং ওভেশনে। অডিটোরিয়াম দেখেছে ৭২এর তলা বিহীন ঝুড়ি, এখন দেখছে ১ বিলিয়ন ডলারের গ্রামীণ ব্যাঙ্ক সেই ঝুড়ির তলা লাগিয়ে ফেলেছে। ১৫০ মিলিয়ন লোকের ঝুড়ি, এই ঝুড়ির তলা ১ বিলিয়নে লাগে না, ৪০ বিলিয়ন লাগে, তিরিশ লক্ষ গার্মেন্টস কর্মীর আর চল্লিশ লক্ষ প্রবাসীর উদয়াস্ত পরিশ্রম লাগে, কিন্তু এত হিসাবের সময় কোথায়? সুফিয়া বেগমের পাকা বাড়ির ভিস্যুয়াল, এর কাছে হেরে যায় নিরামিষ অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান।
কিছু কিছু বেরসিক অর্থনীতিবিদ অবশ্য বলেই যান, ক্ষুদ্র ঋণ একটা হাইপ, ক্ষুদ্র ঋণের প্রবক্তারা দাবী করেন সবার মাঝেই একজন entrepreneur লুকিয়ে আছে, কথাটা ঠিক নয়, সকলেই entrepreneur নয়, কেউ কেউ entrepreneur। তবে নাকের সামনে টাকা ঝোলালে সকলেই নেবে, সেটা ১৬ দফা নাকে খত দিয়ে হলেও নেবে। নিয়ে চেষ্টা করবে নিজস্ব ব্যবসার, অল্প জনই সফল হয়, বেশীরভাগই ব্যর্থ। তবে সেযুগের কাবুলিওয়ালার মত পাওনাদার এসে প্রতি সপ্তাহে দরজা ধাক্কালে পাওনা ঠিকই আদায় হয়। ব্যাঙ্কের হিসাব ঠিকই মিলে যায়, তবে ব্যাঙ্কের হিসাব মিলে যাওয়া মানে এই নয় যে দেনাদারেরা সবাই ব্যবসা করে দারিদ্রমুক্ত হয়েছেন। দারিদ্রমুক্তি কোন ব্যাঙ্কের কাজ নয়, এটা সরকারের কাজ, দারিদ্রমুক্তির জন্য শিক্ষা, অবকাঠামো, কর্মসংস্থান এসবই প্রয়োজন। বাংলাদেশ সরকার (মানে বেকুব এবং দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদেরা) গত কয়েক দশক ধরে রাস্তা এবং সেতু বানিয়েছেন, স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্র বানিয়েছেন, সরকারী মাঠ কর্মীরা অনেক বছর ধরেই গ্রামে গ্রামে গিয়ে জনগণ কে স্বাস্থ্যসেবা দিয়েছেন, পরিবার পরিকল্পনা করতে বলেছেন, সবই দারিদ্র বিমোচনের পূর্বশর্ত। ইউরোপের সাহেবেরা অবশ্য এত কিছুর খবর রাখেন না, তারা ‘আবুলে’ ভর্তি বাংলাদেশ দেখেন, আর দেখেন দরিদ্র নারীদের হাতে মোবাইল ফোন তুলে দেয়া ডঃ ইউনুসকে, দারিদ্রমুক্তি যা ঘটছে, এনার হাত ধরেই হয়েছে।
সাহেবরা ইউনুস আর গ্রামীণ ব্যাঙ্ককে দিয়ে দিলেন বিশাল এক মেডাল, মেডালের নাম নোবেল পুরষ্কার। এই মেডালের ধাক্কায় বাংলাদেশীরা উঠে গেল বিশাল এক উচ্চতায়, উচ্চতা এতটাই বেশি যে তাদের “নীচের দিকে তাকাতে ভয় লাগছে”। ফ্রাঙ্কফুর্টের রাস্তার ফুল বিক্রেতা, প্যারিসের কফির দোকানের ওয়েট্রেস, হিথরো এয়ারপোর্টের কাস্টমস কর্মকর্তা, নিউইয়র্কের ডাউন টাউনের বেশ্যা, সকলেই প্রবাসী বাংলাদেশীদের দেখলেই সম্মান জানাচ্ছে (এই পোস্টের লেখক অবশ্য সম্মান পাওয়া দুরে থাক, নিজের মুসলিম পরিচয় লুকাতেই ব্যস্ত, ফর্মাল রিপোর্টেও বাপের দেওয়া নাম Mohammed Munim লিখে না, লিখে ‘Moe’ Munim)। এই নোবেলের কল্যাণে ক্ষুদ্র ঋণের মাহাত্ম্য অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়লো। সবচেয়ে বেশী পড়লো দক্ষিণ আমেরিকান দেশ মেক্সিকোতে। ওয়াল স্ট্রিটের সফল মেক্সিকান ব্যাংকাররা ঝাঁপিয়ে পড়ছে ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবসায়। ওয়াল স্ট্রিট কানেকশন যেহেতু আছে, শতকরা ৪/৫ সুদে বৃহৎ ঋণ পাওয়া কঠিন কিছু নয়। সেই বৃহৎ ঋণ খাটবে শতকরা ২০ ভাগ সুদে, ক্ষুদ্র ঋণ হিসাবে, মুনাফার করার এর চেয়ে সহজ উপায় এই দুনিয়াতে নেই। গ্রামীণ ব্যাঙ্কের ১ বিলিয়নের যাদুতে মুগ্ধ ব্যাংকাররা এখন ৮০ বিলিয়ন খাটাচ্ছেন ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবসায়, ৭ বিলিয়নের পৃথিবীতে ৬ বিলিয়নই মোটামুটি দরিদ্র, এদের বিরাট অংশ নিবে ক্ষুদ্র ঋণ, এই দরিদ্রদেরই একটা অংশ হবে ক্ষুদ্র ঋণের ফিল্ড অফিসার, গরীবকে দেওয়া ঋণের টাকা আদায় গরীবকে দিয়েই হবে, ৮০ বিলিয়ন ৮০০ বিলিয়ন হতে আর বিশেষ দেরী নেই।
নোবেল পেয়ে আকাশে উঠে ডঃ ইউনুস দেখলেন দেশের কলহপ্রিয় দু নেত্রীর বড়ই দুর্দিন যাচ্ছে, সকলেই ভাবছে এই দু নেত্রী মাইনাস হলেই বেহেশতের দরজা খুলে যাবে। সিভিল এলিট আর সেনাবাহিনী শাসিত বেহেশতি বাংলাদেশে আর রাজনৈতিক জঞ্জাল থাকবে না, পাঁচ বছর পর পর লগী বৈঠার শোডাউন থাকবে না, দুর্নীতি থাকবে না। ডঃ ইউনুস নেমে পড়লেন দরিদ্র মহিলা কেন্দ্রিক তাঁর রাজনৈতিক স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে, কিন্তু দেখলেন চালের দাম মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে সামলানো খুব কঠিন, ছাত্রের গালে সিপাহীর সামান্য চড়ের ঘটনা সামলাতেই কারফিউ ডাকতে হয়। তিনি মানে মানে কেটে পড়লেন।
রাজনীতির স্বপ্ন ছেড়ে ডঃ ইউনুস নিয়ে এলেন এক নতুন তত্ত্ব, তত্ত্বের নাম ‘সামাজিক ব্যবসা’। বিশ্বের সকল অর্থনৈতিক বালা মুসিবতের কারণ নাকি মুনাফা কেন্দ্রিক ব্যবসা (বিল গেটস, স্টিভ জবসের মত লোকেরা মাইক্রোসফট আর এপল খুলেছেন নিজেদের ব্যক্তিগত লাভের কারণে, তাঁরা নিজেদের ব্যবসা বাড়িয়ে ১০০ বিলিয়নে নিয়ে গেলেন, লক্ষ লক্ষ লোককে কাজ দিলেন, সবই করলেন ব্যক্তিগত লাভের জন্য!)। সামাজিক ব্যবসা হবে জনসেবা কেন্দ্রিক, মুনাফা করা যাবে না, ব্যবসায় যা লাভ হবে সবই ফিরে যাবে সে ব্যবসাতে, চমৎকার ব্যবস্থা। কেমন চমৎকার, তা দেখাতে তিনি দেশে নিয়ে এলেন ফরাসী দই প্রস্ততকারক ড্যানোনকে। ড্যানোন দইয়ের প্ল্যান্ট বসিয়ে ফেললো, দইয়ের প্ল্যান্ট তারা পৃথিবীর যেকোনো জায়গাতেই বসাতে পারে, মূল চ্যালেঞ্জটাই তো দইয়ের বাজার তৈরি করা। ডঃ ইউনুস করলেন দই বিক্রির দারুণ ব্যবস্থা, দরিদ্র মহিলাদের দেওয়া হল ক্ষুদ্র ঋণ, সেই ঋণ দিয়ে তাঁরা কিনে নিবেন পাইকারি দই, পাইকারি দই তাঁরা বাড়ী বাড়ী গিয়ে বিক্রি করবেন, লাভের টাকায় তাঁরা ক্ষুদ্র ঋণ শোধ করবেন। ব্যাপার হল মার্কেটিংয়ের ঝুঁকি পুরোটাই দরিদ্র মহিলাদের। এই মহিলাদের কেউ কেউ দই ভালো বিক্রি করবেন, দ্রুত ঋণ শোধ করে তাঁরা নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে যাবেন। কিন্তু অনেকেই দইয়ের ব্যবসা সামলাতে পারবেন না, তবে তাঁরা কিস্তির টাকা ঠিকই শুধবেন, সেটা হালের বলদ বিক্রি করে, না হলে সৌদি প্রবাসী সন্তানের টাকায়। দরিদ্র মহিলার তো আর অভাব নেই, যারা ঝরে পড়বেন তাদের জায়গা নিতে আসবেন নতুনরা। এভাবে কিছু সফল, আর অনেক অসফল দরিদ্র মহিলার কাঁধে ভর রেখে মোটামুটি সহজেই ড্যানোন বাংলাদেশের দইয়ের বাজার নিয়ে নেবে। দু টাকার শক্তি দইয়ের ব্যবসা দাঁড়িয়ে গেলে শুরু হবে বিশ টাকার ‘মজার দইয়ের’ ব্যবসা, বাজার যখন দাঁড়িয়েই গেছে, ট্র্যাডিশনাল রিটেল মার্কেটই সেই ‘মজার দই’ বিক্রির দায়িত্ব নেবে।
বাংলাদেশে দইয়ের ব্যবসা অবৈধ নয়, বিদেশী বিনিয়োগও আমরা চাই। কিন্তু গ্রামের সহজ সরল মহিলাদের এই স্বাধীন ব্যবসার মুলো দেখানো কেন? তাঁরা কি আসলেই স্বাধীন ব্যবসায়ী, নাকি শক্তি দইয়ের সেলস পারসন মাত্র? সেলস পারসনরা মাস গেলে বেতন পান, না হলে বিক্রির কমিশন। বিক্রিতে সুবিধা করতে না পারলে শুধু তাঁদের চাকরিটাই যায়, ব্যবসার মূলধন নয়। ইউরোপ আমেরিকা দেখবে জনা বিশেক সফল দই ব্যবসায়ী মহিলার (আর তাঁদের মাঝে ডঃ ইউনুসের) হাসিমুখ, দেখবে না হাজার হাজার ব্যর্থ দই ব্যবসায়ী সর্বস্বান্ত মহিলার কান্না। সামাজিক ব্যবসার সফল বাস্তবায়নের জন্য আরেকটি নোবেল পুরষ্কারের সুপারিশ হতেই পারে।
ডঃ ইউনুস নিজেকে কিভাবে দেখেন জানি না, তবে নিশ্চিতভাবেই তাঁর মাঝে এক রাজনৈতিক মহানায়ক দেখে বাংলাদেশের মধ্যবিত্তের একটা বিরাট অংশ। রাজনৈতিক স্বপ্ন তাঁদের দেখিয়েছেন ডঃ ইউনুস নিজেই, সেই স্বপ্ন ‘দাবায়ে রাখতে পারবা না’ আর ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ এর গোলমেলে সেকেলে রাজনীতি নয়। তাঁর স্বপ্নের বাংলাদেশে দরিদ্র মহিলারা চালাবেন চট্টগ্রাম বন্দর, ভিডিওতে মার্কিন ওয়াল মার্ট পাহারা দেবে বাংলাদেশের গ্রামের মানুষ, ছাত্ররা মারামারি ছেড়ে মন দিয়ে লেখাপড়া করবে। সেটা ঠিকই আছে, স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীন নাগরিক তিনি, রাজনৈতিক স্বপ্ন দেখার অধিকার তো তাঁর আছেই। কিন্তু এই স্বপ্ন বাজ কে ঘিরে কি এত আগ্রহ কেন মার্কিনীদের? লাদেনকে ৫ বছর লুকিয়ে রেখেও পাকিস্তান নির্বিঘ্নে আমেরিকায় বছরে ৪ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি করে, মার্কিন ক্রেতারা কেনেন বলেই তো রপ্তানি হয়। কিন্তু এই স্বপ্নবাজের গায়ে টোকা পড়লেই অতি নিরীহ বাংলাদেশের পণ্য নিয়ে মার্কিন ক্রেতারা উদ্বেগ প্রকাশ করেন। কেন করেন? দেশে তো ‘আবুল’ আগেও ছিল, বিশ্বব্যাংক এই ‘আবুল’দের নিয়েই এত বছর বাংলাদেশে কাজ করেছে, ‘আবুল’রা কি নাইজেরিয়াতে নেই? পাকিস্তানে নেই? সেখানে তো ঠিকই লোণের টাকা যাচ্ছে। বাংলাদেশেরটা কেন আটকে গেল? কেনইবা মার্কিন রাষ্ট্রদূত আগ বাড়িয়ে বলেন, লোণ আটকে যাওয়াতে স্বপ্ন বাজের কোন হাত নেই?

পেশায় প্রকৌশলী, মাঝে মাঝে নির্মাণ ব্লগে বা ফেসবুকে লেখার অভ্যাস আছে, কেউ পড়েটড়ে না, তারপরও লিখতে ভাল লাগে।
