বঙ্গবন্ধু এবং ওরিয়ানা ফালাচী

গত ১৭ মার্চ ছিল বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন। যে যেখানে সুযোগ পেয়েছেন, বঙ্গবন্ধুর গুণকীর্তন করে গলা ফাটিয়ে ফেলেছেন। যাই হোক, এই লেখা বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন নিয়ে নয়, সম্প্রতি পড়া বঙ্গবন্ধুর এক সাক্ষাৎকার নিয়ে। [..]

গত ১৭ই মার্চ ছিল বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় নিশ্চয় দেশে ব্যাপক উৎসাহ নিয়ে এই জন্মদিন পালিত হয়েছে। কিছুদিন আগে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের ফাঁসি হয়ে যাবার পরে যারা মিষ্টি খেয়ে, আধাবেলা অফিস করে ছুটি কাটাতে চলে গিয়েছিলেন, তাঁরাও নিশ্চয় এই সু্যোগে আধাবেলা বা পুরো বেলা ছুটি নিয়েছেন। যেখানে সুযোগ পেয়েছেন, বঙ্গবন্ধুর গুণকীর্তন করে গলা ফাটিয়ে ফেলেছেন। যাই হোক, এই লেখা বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন নিয়ে নয়, সম্প্রতি পড়া বঙ্গবন্ধুর এক সাক্ষাৎকার নিয়ে।

এক বন্ধুর কল্যাণে ইতালিয়ান সাংবাদিক ওরিয়ানা ফালাচীর নেয়া বঙ্গবন্ধুর ‘সাক্ষাৎকারের’ বিবরণ দেখলাম। সাক্ষাৎকারটি নেয়া হয়েছিল ১৯৭২ সালের জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারিতে, ফালাচীর বর্ণনামতে ‘ঘৃণ্য নগরী’ ঢাকা শহরে (যেখানে সশস্ত্র মুক্তিবাহিনী ঘুরে বেড়াচ্ছে আর ইচ্ছামত লুটতরাজ করেছে, দৈনিক রাস্তাঘাটে অবাঙ্গালী হত্যা চলছে)। একটি সদ্য স্বাধীন দেশ সম্পর্কে একটিও ইতিবাচক কথা নেই। ফালাচী বঙ্গবন্ধু বিষয়ে টাইম পত্রিকায় যে সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে তার উল্লেখ করেছেন। টাইম পত্রিকার অনলাইন আর্কাইভে রাখা সেই লেখা পড়ে সংশয়ের তেমন কিছুই দেখা গেল না। বরং দেখা গেল কিশোর বঙ্গবন্ধু ব্রিটিশ আমলের পুলিশের হাতে বন্দি হয়ে ছয়দিনের জেল খেটেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের আন্দোলনে সাহায্য করতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিরতরে বহিষ্কৃত হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু ফালাচীর ‘কঠিন’ প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যান আর তাঁকে অফিস থেকে বের করে দেন। ফালাচী আরও বলেছেন যে মুক্তিবাহিনী তাঁকে হত্যার হুমকি দেয় এবং এক জার্মান পর্যটকের সহায়তায় তিনি বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে আসেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর এক ভাগনের উদ্ধৃতি দিয়ে জানান, বঙ্গবন্ধু একজন মাথামোটা ব্যক্তি যিনি ফাঁকতালে নেতা বনে গেছেন। সাক্ষাৎকারটি পড়ে বঙ্গবন্ধুকে মোটামুটি একজন গ্যাং লীডার ছাড়া আর কিছুই মনে হয়নি। তবে সেন্ট পিটার্সবার্গ টাইমসের অনলাইনে আর্কাইভে দেখা গেল (১৮ জানুয়ারি, ১৯৭২) বঙ্গবন্ধু সকল মুক্তিযোদ্ধাকে ১০ দিনের মধ্যে অস্ত্র জমা দিতে নির্দেশ দিয়েছেন।

একজন পেশাদার সাংবাদিক এই জাতীয় মিথ্যাচার কেন করলেন সেটা বুঝতে পারছি না। মূল সাক্ষাৎকারটি কোথাও খুঁজে পাইনি। তবে এই সাক্ষাৎকারকে কেন্দ্র করে www.sheikhmujiburrahman.org বঙ্গবন্ধুর নামে মিথ্যা প্রচারণা চালানো হচ্ছে। জামায়াত নেতারাও আসন্ন যুদ্ধাপরাধ বিচারে ফালাচীর বইয়ের (Interview With History) উদ্ধৃতি দিবেন বলে শোনা যাচ্ছে। কিন্ত সেই একই সময়ে বিশ্ববিখ্যাত সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য শুনে পোড় খাওয়া সাংবাদিক ফ্রস্ট নিজেও আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন এবং ‘জয় বাংলা’ বলে তাঁর সাক্ষাৎকার শেষ করেন। যুদ্ধাপরাধীদের ব্যাপারে একজন প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদের মতই বঙ্গবন্ধু বলেছেন “Trial, I have to give it to them.”

বঙ্গবন্ধুকে আসমান থেকে নেমে আসা কোন ফেরেশতা বলে প্রতিষ্ঠিত করা আমাদের কারোরই উদ্দেশ্য নয়। তবে ৪০-এর দশকে মুসলিম লীগে যুক্ত হয়ে একটি দীর্ঘ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু তৈরি হয়েছেন। তিনি পাকিস্তান আন্দোলন করেছেন, ৪৬-এর দাঙ্গায় বহু মুসলমানের জীবন রক্ষা করেছেন। পাকিস্তান তৈরি হবার পরে পুর্ব বাংলার নাম পুর্ব পাকিস্তান করার প্রতিবাদ করছেন। ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। বাংলাদেশের আর্দ্র জলবায়ুতে চলচ্চিত্র তৈরি করা যাবে না এইসব ভুয়া থিয়োরী ছূঁড়ে ফেলে দিয়ে তিনি এফডিসি প্রতিষ্ঠায় কাজ করেছেন (এই তথ্য এফডিসি ওয়েবসাইটে নেই)। পাকিস্তানের ২৪ বছরের ইতিহাসে তিনি অসংখ্যবার জেল খেটেছেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার মত জটিল মামলার মোকাবেলা করেছেন। মামলায় প্যারোলে মুক্তির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে সরকারকে মামলা তুলে নিতে বাধ্য করেছেন। স্বাধীনতার পরে ভারতীয় বাহিনীকে অতি দ্রুত বিদায় করেছেন। বিহারীদের রক্ষা করার জন্য তাঁর সরকার দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ নিয়ে জাতিসংঘের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে

“…In this situation a new and untried government was faced with the task of converting a provincial administration into a national government, without benefit of any transitional or preparatory period. Most of the senior civil servants in East Pakistan had come from the West wing, and many of the most experienced Bangalee leaders and administrators had been lost or, like Sheikh Mujibur Rahman himself, were still detained in Pakistan. Government departments capable of administering the world’s eighth largest nation had to be created from the wreckage of a demoralized and discredited provincial administration that had been accustomed to defer decisions to Islamabad. Sheikh Mujibur and his colleagues succeeded in doing this. A workable administration was established. The pessimists were confounded and the disasters they had predicted were averted. The ten million refugees and the millions of displaced Bangalees were reabsorbed quickly and quietly. Law and order was by and large preserved. The threatened mass slaughter of minorities did not take place. Most important of all, the people were fed….”

এত বছর পরে এসে তাঁর সরকারের অনেক পদক্ষেপই ভুল মনে হতে পারে, কলকারখানার জাতীয়করণ, রক্ষীবাহিনী, বাকশাল গঠন সবই বিতর্কিত পদক্ষেপ। ৭৪-এর দুর্ভিক্ষে ফসল ভাল হবার পরেও কালোবাজারী এবং অন্যান্য কারণে ব্যাপক সংখ্যক লোক না খেয়ে মারা যায় (এই অন্যান্য কারণের একটা হল কিউবাতে পাট রপ্তানির অপরাধে মার্কিন সরকারের ২ মিলিয়ন টন খাদ্যশস্যের চালান আটকে দেয়া)। ‘৭২ থেকে ‘৭৫ -এ তাঁর সরকারের নেয়া পদক্ষেপগুলো বাংলাদেশকে ভালোর দিকে না খারাপের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল সেই বিতর্ক আজকের যুগে অনেকটাই একাডেমিক বিষয়। বর্তমান বিশ্বের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ নিজস্ব পথে এগিয়ে যাবে। কিন্তু যেটি শুধু একাডেমিক বিষয় নয় সেটা হচ্ছে আমাদের প্রজন্মের মাঝে বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে গড়ে উঠা কিছু কমন ধারণা। ধারনাগুলো হচ্ছে : ‘তিনি একজন মাঠ গরম করা উগ্র জাতীয়তাবাদী ছিলেন, স্বাধীন বাংলাদেশ কি করে শাসন করবেন বুঝতে পারছিলেন না, গ্রামের মোড়লের মত করে দেশ চালাচ্ছিলেন। “আমার কম্বল কই” “কোথায় আজ সিরাজ সিকদার” “লালঘোড়া দাবরাইয়া দিবো” এ জাতীয় কিছু কথা তিনি বলেছেন আর তাঁর সাগরেদ আর সন্তানেরা আজ মেজর ডালিমের স্ত্রীকে কিডন্যাপ, কাল ব্যাঙ্ক ডাকাতি এই করে বেড়াচ্ছিল। তাঁর মৃত্যুর পরে “স্বাধীনতার ঘোষক” জিয়াঊর রহমান খলিফা উমরের মত সততা নিয়ে, বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু করে, নিজের হাতে খাল কেটে বাংলাদেশকে উদ্ধার করেন।’

আমার নিজের সিরিয়াস রাজনৈতিক পড়াশোনা মোটামুটি শুন্যের কোঠায়, পাড়ার আড্ডা আর দৈনিক পত্রিকা এই হচ্ছে আমার দৌড়। এই নিয়েই আমার রাজনৈতিক বিশ্ববীক্ষা গড়ে ঊঠেছে। এই অতি সিম্পলিফাইড বিশ্ববীক্ষা নিয়ে বঙ্গবন্ধু আর জিয়াউর রহমানকে নিয়ে যে কমন ধারণা আছে সেটার বেশি কিছু ধারণ করা সম্ভব ছিল না। তবে ইদানীং কিছু ‘চ্যাংড়া’ ব্লগার (যেমন অমি পিয়াল, হাসান মোরশেদ) কিছু বইপত্র পড়ে যেসব ব্লগ লিখছেন তাতে বোঝা যাচ্ছে যে আমার বিশ্ববীক্ষা অনেকাংশেই ভুল।

মেজর ডালিমের বইয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে অমি পিয়াল যা লিখেছেন তাতে দেখা যাচ্ছে কিডন্যাপের ব্যাপারটা পুরোটাই অন্য রকম। বঙ্গবন্ধু সিরাজ সিকদারকে হত্যা করে পরের দিন সংসদে “কোথায় আজ সিরাজ সিকদার” সদম্ভে এই ঘোষণা দেবার ব্যাপারটাও মিথ্যা। শেখ কামালের ব্যাঙ্ক ডাকাতির ব্যাপারটা আমি শুনেছিলাম একজন বাম নেতার কাছে। তাঁকে অবিশ্বাস করার কোন কারণই আমি খুঁজে পাইনি। দেখা যাচ্ছে সেই ব্যাপারটাও নেহাতই গুজব।

আমেরিকাতে আসার পরপর এখানকার টিভিতে নীল আর্মস্ট্রং এর চন্দ্রাভিযান বিষয়ে একটি ডকুমেন্টারি দেখি। ডকুমেন্টারির মুল বক্তব্য হল নীল আর্মস্ট্রং এবং তাঁর সঙ্গীরা চাঁদে যাননি। মার্কিন সরকার আমেরিকার কোন এক জায়গাতে চাঁদের সেট সাজিয়ে, ফিল্ম তুলে সেটাই টিভিতে চন্দ্রাভিযান হিসাবে চালিয়েছে। ডকুমেন্টারিটি দেখে আমার মাথা খারাপ হবার যোগাড়। এতদিন শুনলাম নীল আর্মস্ট্রং চাঁদে গেছেন, চাঁদে সূক্ষ্ম নীল দাগ দেখে পৃথিবীতে ফিরে তিনি মুসলিম হয়ে গেছেন। এই সবই মিথ্যা? শেষে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বৃদ্ধ অধ্যাপককে এই ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, এ ব্যাপারটিকে বলে ‘কন্সপিরেসি থিয়োরী’, পৃথিবীর তাবৎ বিষয়ে কন্সপিরেসি থিয়োরী আছে, এবং কোন কোন থিয়োরী ব্যাপক সংখ্যক লোকে বিশ্বাস করে। চন্দ্রাভি্যান প্রকল্পে লাখ দুয়েক লোক জড়িত ছিল, এত বড় বিষয়টি ফাঁকিবাজি হওয়া একেবারেই অসম্ভব। তিনি আরও বললেন যে চন্দ্রাভিযানের প্রাযুক্তিক খুঁটিনাটি বেশি লোকে বুঝবে না, আর সেই নিয়ে ডকুমেন্টারি বানালে লোকে দেখবে না। কিন্তু চন্দ্রাভিযানের পুরো ব্যাপারটিই ফাঁকিবাজি এই চমকপ্রদ থিয়োরীটি লোকে আগ্রহ ভরে দেখবে, আর এই সুযোগে বিজ্ঞাপন দেখিয়ে কিছু পয়সা বানানো যাবে, এই হচ্ছে ডকুমেন্টারির মূল কথা। এর মধ্যে সত্যানুসন্ধানের কিছুই নেই। চাঁদে সূক্ষ্ম নীল দাগ আর আর্মস্ট্রং সাহেবের মুসলিম হওয়া প্রসঙ্গে অধ্যাপক বললেন দুটো তথ্যই মিথ্যা।

চন্দ্রাভিযান বিষয়ে মুখরোচক গালগল্প নির্দোষ ব্যাপার, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নামে কিছু ফালতু গুজব আর তার উপর ভিত্তি করে একটি গোটা প্রজন্মের বিরাট অংশের রাজনৈতিক দর্শন দাঁড়িয়ে যাওয়াটা গুরুতর ব্যাপার। এই রাজনৈতিক দর্শনের কারণে মইন ইউ আহমেদের ক্ষমতা দখল দেখে আমরা হাততালি দিয়ে ফেলি। আমরা দেখি না একই ভাবে ক্ষমতা নিয়েছেন ইস্কান্দার মির্জা, আয়ুব খান, ইয়াহিয়া খান, সেই একই দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই, সে একই রাজনৈতিক জঞ্জাল সাফ করা, সেই একই সামরিক স্মার্টনেস, সেই একই গোয়েন্দা সংস্থার রাতের আঁধারে মিটিং, ফলাফল ঘোড়ার ডিম। এই রাজনৈতিক দর্শনের কারণেই আমাদের গণতন্ত্র দ্রুত ক্লান্ত হয়ে পড়ে, দু তিন টার্ম পরপরই সেনাবাহিনীকে এসে জঞ্জাল সাফ করে যেতে হয়। এই রাজনৈতিক দর্শনে একজন নেতা তৈরিতে কোন “process” (বঙ্গবন্ধু ডেভিড ফ্রস্টকে যেমন বলেছেন) প্রয়োজন নেই, দরকার আছে কেবল কিছু ভাল ভাল কথা, ড. ইউনুস যেমন ভাল ভাল কথা বলেন (বাংলাদেশে বসে লোকে চা খেতে খেতে ক্যামেরাতে আমেরিকার Wal-Mart পাহারা দেবে, এই তাঁর স্বপ্নের বাংলাদেশ), সুশীল সমাজ সেমিনার করে করে যাদু করে ফেলবেন। ছাত্ররা রাজনীতি ফেলে মন দিয়ে পড়াশোনা করবে। ব্র্যাকের কর্মীরা গ্রামে গ্রামে নলকুপ বসিয়ে লোকজন কে বিশুদ্ধ পানি খাওয়াবে। আর কিছুই প্রয়োজন নেই। আমিনা ব্র্যাকের মোড়া বুনবেন আর আমিনার ছেলে কিছু পড়াশুনা শিখে Wal-Mart পাহারা দিবে। মইন ইউ আহমেদ যেহেতু আলু খাওয়া শিখিয়ে গেছেন, চালের দাম বেড়ে গেলে আলু খেয়ে কাটানো যাবে। চাখার বা টুঙ্গিপাড়ার কোন কিশোরের রাজনীতিতে যোগ দেবার আর কোন প্রয়োজন নেই।

যাই হোক, ফালাচীর ইন্টারভিউ, আমার বৃদ্ধ অধ্যাপক যেমন বলেছেন, sensationalism, যা করলে বিক্রি বাড়ে। বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরেছেন, ১২ তারিখ শপথ নিয়েছেন, সারা পৃথিবীর সাংবাদিকেরা জড়ো হয়েছেন বাংলাদেশে। তাঁরা রিপোর্ট করছেন নয় মাসব্যাপী চলা হত্যা, ধর্ষণ আর লুন্ঠনের কথা, একই সাথে একটি সদ্য জন্ম নেয়া জাতির স্বপ্নের কথা। ফালাচী ওপথে গেলেন না, তাঁকে চমক লাগানো কিছু একটা লিখতে হবে, তিনি লিখে ফেললেন কাদেরিয়া বাহিনীর হাতে নিহত চার রাজাকারের কাহিনী। এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ড তিনি নাকি কখনো দেখেননি। অথচ ফালাচী নিজে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়ে পুরস্কৃত হয়েছেন (তখন তাঁর বয়স ছিল ১৪ বছর)। ১৯৪৩ সালে মুসোলিনি ধরা পড়েন, তাঁকে হত্যা করা হয় ১৫ জন সাঙ্গপাঙ্গ সহ, হত্যা করে মিলানের প্রাণকেন্দ্রে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা হয় তিন দিন। সারা মিলান শহর দেখতে এসেছে, লাশে পাথর ছুড়েছে আর থুতু দিয়েছে, এই সব কাণ্ডের শেষে মুসোলিনিকে এক অজ্ঞাত কবরে ফেলে আসা হয়। ফ্রান্সে হাজার হাজার দালালকে বিনা বিচারে হত্যা করা হয়। এতসব জেনেও ফালাচী মুক্তিবাহিনীর নৃশংসতায় শিউরে উঠেছেন। বঙ্গবন্ধুর ইন্টারভিউ নিয়ে তিনি গেলেন ভুট্টোর কাছে, ভুট্টো তাঁকে সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন, কারণ ভুট্টোর মতে “you are the only journalist who wrote the truth about Mujib Rahman”. পরাজিত ভুট্টো চালিয়ে গেলেন, ইয়াহিয়া খান “disgusting drunkard” শেখ মুজিব “congenital liar” ইন্দিরা গান্ধী “a woman devoid of initiative and imagination”. আড্ডা জমে উঠল, ফালাচী প্রশ্ন করেন “Mr. President, Mujib told you…….” রাখাল বালক মুজিব আর ‘Mr. President’ ভুট্টো, সারা বিশ্বের কোন আগ্রহ নেই ভুট্টো নিয়ে, মুজিব সম্পর্কে একমাত্র সত্যবাদী ফালাচীকে পাঁচ পাঁচটি মিটিংয়ে ভুট্টো তাঁর মনের কথা খুলে বললেন। এত সময় মুজিবের ছিল না, দেশের ব্যাঙ্কে একটা পয়সা নেই, গুদামে কোন চাল নেই, সাত কোটি লোককে খাওয়াতে হবে, চার বছর পরে তাঁকে যারা খুন করবেন তাঁদের পাকিস্তান থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে, আইনশৃংখলা ফিরিয়ে আনতে হবে। ১৮ ডিসেম্বরের চার রাজাকারের হত্যাকাণ্ড নিয়ে ফালাচীর সাথে ভ্যাজরভ্যাজরের সময় তাঁর নেই, তিনি বিরক্ত হয়ে ফালাচীকে বেরিয়ে যেতে বললেন। ফালাচী বিনা আমন্ত্রণে তাঁর বাড়িতে উপস্থিত হতে পারেন, বেগম মুজিব তার পুত্রকন্যাদের নিয়ে দুপুরে খেতে বসেছেন, সে দৃশ্য দেখতে পারেন, বাড়িতে কোন গার্ডের ব্যবস্থা নেই, রাখাল রাজা মুজিবের অফিসেও কোন গার্ড নেই, সেখানেও ফালাচী উপস্থিত হন, কোন অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়াই, কারণ রাখাল রাজা মুজিব Mr. President ভুট্টোর মত গুরুত্বপূর্ণ নন, রাখাল রাজা ভয় পেয়ে ফালাচীকে পুনর্বার বেরিয়ে যেতে বলেন। অপমানিত ফালাচী খুঁজে বের করেন মুজিবের নুইয়র্ক ফেরত কোন এক ভাগ্নেকে, সেই ভাগ্নে অশিক্ষিত মুজিবের হয়ে ক্ষমা চান, নাটকের সেখানেই শেষ নয়, মুক্তিবাহিনী তাঁকে হত্যার হুমকি দেয়। ফালাচী কোন এক জার্মান পর্যটকের সাহায্যে বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে আসেন। ফালাচী যেখানেই যান সেখানেই এমন ঘটে, ১৯৬৮ সালে মেক্সিকোতে তিনি গুলিবিদ্ধ হন, মেক্সিকান পুলিশ তাঁকে মৃত ভেবে চলে যায়। ৭০ দশকের শেষে ফালাচী এক গ্রীক বিপ্লবির সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে তাঁর প্রেমে পড়ে যান। ১৯৭৯ সালে খোমেইনীর সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে তিনি চাদর ছুঁড়ে ফেলে তাঁকে ‘tyrant’ বলে সম্বোধন করেন। সেই সময়ে মার্কিন মহিলা সাংবাদিক ডায়ান সইয়্যার খোমেনীর সাক্ষাৎকার নেন, চাদর পড়েই, কারণ ডায়ান সইয়্যার গিয়েছেন সাংবাদিকতা করতে, নাটক করতে নয়।

১৪ বছর বয়সে স্বৈরাচার মুসোলিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে পুরস্কৃত হওয়া ফালাচী তাঁর দীর্ঘ sensational সাংবাদিক জীবন শেষ করে শুরু করেন লেখক জীবন। লেখার বিষয় ইউরোপ অভিবাসী মুসলিমরা। ইউরোপের রাস্তা, বাথরুম আর রেস্টুরেন্ট পরিষ্কার করতে আসা অভিবাসী মুসলিমরা, নামাজ পড়ে আর মসজিদ বানিয়ে পশ্চিমা সভ্যতা ধ্বংস করে ফেলছে। শুধু মুসলিম অভিবাসিরাই নয়, যুক্তরাষ্ট্রে আগত মেক্সিকানরাও তাঁর দুশ্চিন্তার বিষয় (খোদ মার্কিনীরাও এত চিন্তিত নয়)। নিজের সম্পর্কে তার অভিমত হচ্ছে “…a woman not used to medals and not too keen on trophies, has an intense ethical and moral significance”. হযরত মুহম্মদ সম্পর্কে তাঁর অভিমত হচ্ছে “I will draw Mohammed with his 9 wives, including the little baby he married when 70 years old, the 16 concubines and a female camel wearing a Burqa. So far my pencil stopped at the image of the camel, but my next attempt will surely be better” (হযরত মুহম্মদ মৃত্যুবরণ করেন ৬৩ বছর বয়সে)। এতে অবশ্য জামাতিদের কিছুই যায় আসে না। কারণ যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক আসন্ন এই বিচারে কোরআণ আর সুন্নাহ তাদের রক্ষা করবে না, রক্ষা করতে পারে ওরিয়ানা ফালাচীর অমর গ্রন্থ, Interview With History

  • মোহাম্মদ মুনিম

    পেশায় প্রকৌশলী, মাঝে মাঝে নির্মাণ ব্লগে বা ফেসবুকে লেখার অভ্যাস আছে, কেউ পড়েটড়ে না, তারপরও লিখতে ভাল লাগে।

    View all posts
সাবস্ক্রাইব করুন
অবগত করুন
guest

42 মন্তব্যসমূহ
সবচেয়ে পুরোনো
সাম্প্রতিকতম সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত
Inline Feedbacks
View all comments
42
0
আপনার ভাবনাগুলোও শেয়ার করুনx
  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.