আলফা একজন চিত্রশিল্পী, ঠিক চিত্রশিল্পী নন, একজন আর্টিজান, মানে ফরমায়েশি শিল্পী। তিনি মূলত রিকশার জন্য নানা থিমের ছবি আঁকেন, মাঝে মাঝে সিনেমার বিলবোর্ডের কাজও করেন, বোতলে নানা রকমের নকশা এঁকে বিক্রি করেন। ফরমায়েশি শিল্পী হলেও তিনি পুরাদস্তুর শিল্পী হতে চান, ছবি আঁকা ছাড়াও তিনি যন্ত্রশিল্পী হতে চান, আবার নৃত্যশিল্পীও হতে চান। তিনি ঢাকার এক বস্তির পাশে বিলের উপরে মাচা বানিয়ে থাকেন।
আলফা নির্বিরোধী শান্ত মানুষ, তাঁকে লোকজন মোটামুটি পছন্দই করে। বস্তিতে কালী নামে একজন হিজড়া তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কালী এবং বস্তীর আরেকজন নারী বাসিন্দা, গোলেনুর, বিভিন্ন অফিসে লাঞ্চ সরবরাহ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। গোলেনুরের স্বামী, একজন খুচরা মাদক ব্যবসায়ী, সন্তানদানে অক্ষম। গোলেনুরের সাথে আলফার একটা সম্পর্ক আছে, সেটা প্রেমের কিনা সেটা স্পষ্ট নয়, তবে সে সম্পর্কে শরীর আছে। বস্তিতে আরেকজন আছেন, এক অন্ধ বৃদ্ধ দোকানদার, যাকে সবাই “দাদা’ (ঠাকুরদা) বলে ডাকেন। দাদা গ্রীক পুরাণের ওরাকলের মত তাঁর দোকানে বসে সারাদিন বস্তির লোকজনকে নানা সদুপদেশ দেন।
আলফার বাবা-মা কে সেটা জানা যায়না, একেবারে শিশু অবস্থায় মহরমের মিছিলে তিনি বাবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। শিশু আলফাকে যিনি খুঁজে পান, তিনি নিজেও একজন আর্টিজান। আলফা নামটি তাঁরই দেওয়া। আলফা যখন কিশোর, সেই পালক পিতাও পুলিশের গুলিতে নিহত হন। কিশোর আলফার দায়িত্ব কে নিয়েছিলেন, তা আমরা জানতে পারি না। তবে ফ্ল্যাশব্যাকে দেখানো হয় পূর্ণবয়স্ক আলফাকে বনের মাঝে পরে থাকতে দেখে একদল আদিবাসী তাঁকে উদ্ধার করে সুস্থ করে তুলছেন।
আলফা বিলের উপরের মাচায় তাঁর নিজস্ব জগতেই থাকতে চান, ছবি আঁকেন, গান শোনেন, বাঁশী বাজান, নাচের চর্চাও করেন। চলন্ত বাসে পেট্রোল বোমা মেরে মানুষ পোড়ানো হচ্ছে, ব্লগার হত্যা হচ্ছে, গার্মেন্টসে আগুন লেগে কর্মচারীরা পুড়ে মরছে, তিনি নির্লিপ্ত ভাবেই এইসব খবর শোনেন। কিন্তু ক্রমশ বাইরের পৃথিবী তাঁর নিজস্ব জগতে হানা দিতে থাকে, বস্তির কয়েকজন তরুণী সম্ভবত আগুনে পুড়ে মরেছে, এই খবর শুনে তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। কিন্তু মাচায় ফিরে তিনি আবার নিজের জগতেই ফিরে যান, গোলেনুরের গর্ভে তাঁর সন্তান আসছে, এই খবরেও তিনি কোন প্রতিক্রিয়াই দেখান না।
এক রাতে আলফার মাচার নীচে এক অপ্রত্যাশিত অতিথি আসে, এক বেওয়ারিশ লাশ। তিনি প্রচণ্ড ভয় পেয়ে সে লাশ লাঠি দিয়ে সরাতে চান, কিন্তু পরদিন সকালে সে লাশ আবারও ফেরত আসে, তিনি পুলিশে খবর দিলে পুলিশ এসে লাশ খুঁজে পায় না। কিন্তু সে রাতেই আবারও লাশ ফেরত আসে।
আলফা এবার লাশের সাথে কথোপকথন শুরু করেন। কে তাঁকে মারল, তাঁর কি পরিবার আছে এইসব। তিনি হ্যালুসিনেট করা শুরু করেন যে লাশও তাঁর প্রশ্নের জবাব দিচ্ছে। লাশের পকেট ঘেঁটে তিনি বুঝতে পারেন মৃতের নাম সোলায়মান, একে একে তিনি তাঁর স্ত্রী, পুত্র আর মায়ের সাথেও দেখা করে আসেন। তবে তাঁদের বলতে পারেন না যে সোলায়মান মৃত। এক পর্যায়ে পুলিশ লাশ পেয়ে তা বেওয়ারিশ লাশ হিসাবে দাফন করার ব্যবস্থা করে।
এই পর্যায়ে আলফা নিজের দৈনন্দিন জীবনে ফিরে যেতে পারতেন। কিন্তু তিনি যান নি, ইতিমধ্যে লাশের সাথে তাঁর গভীর বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছে। লাশকাটা ঘরের ডোমদের সাথে আর হিজড়া কালীকে নিয়ে তিনি সেই বেওয়ারিশ লাশের শবযাত্রার আয়োজন করেন আর অনেক দূরে গিয়ে লাশ পানিতে ভাসিয়ে দিয়ে আসেন। এভাবে ছবিটি শেষ হয়।
দেড় ঘণ্টার এই ছবিটির প্রায় পুরোটাতেই লো টোনের মিউজিক ব্যবহৃত হয়েছে, একই সাথে পুরো ছবিটিতেই মিডশটের আধিক্য ছিল, প্রয়োজনের অতিরিক্ত সংলাপও নেই। মানে দর্শককে জোর করে কোন এক বিশেষ ন্যারেটিভ গেলানোর চেষ্টা করা হয় নি। সোলায়মানকে কারা হত্যা করেছেন তা আমরা জানতে পারি না, পুলিশ কর্মকর্তাও এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তে খুব আগ্রহী নন এটা আমরা সহজেই বুঝতে পারি। আরও জানতে পারি যে সোলায়মানের স্ত্রী আছে, ইসমাইল নামে একটা শিশুপুত্র আছে, গ্রামে তাঁর অন্ধ মা আছেন, সোলায়মান যার একমাত্র সন্তান। মা সোলায়মানের জন্য প্রতিদিন পিঠা বানিয়ে অপেক্ষা করেন। আলফা সোলায়মানের নিহত হওয়ার খবর তাঁর মা বা স্ত্রীকে জানাতে পারতেন, কিন্তু তিনি জানাননি, কেন জানাননি, এর সরাসরি উত্তর আমরা পাই না। সম্ভবত তিনি তাঁদের মনে সোলায়মানকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন। এটাও হতে পারে মৃত সোলায়মানের সাথে তাঁর বন্ধুত্বের অধিকারবোধ এতই তীব্র হয়ে উঠে যে তিনি নিজেই সোলায়মানকে বিদায় জানাতে চেয়েছিলেন। যে লাশকে প্রথম দিন লাঠি দিয়ে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলেন, শেষ বিদায়ের সময়ে তিনি সেই লাশের পিঠে পরম মমতায় হাত রাখেন।
ছবিটিকে আধ ঘণ্টা করে মোট তিন ভাগে ভাগ করা যায়, প্রথম অংশে আলফা এবং ছবিটির অন্যান্য চরিত্রগুলোর সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়, দ্বিতীয় অংশে লাশের আগমন ঘটে আর আলফাও সেই লাশকে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করেন, আর তৃতীয় অংশে আলফার সাথে লাশের বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। দর্শক হিসাবে এক ঘণ্টা লাশের সাথে কাটানো খুব সহজ নয়। লাশের মত একটা dark theme এ ঠিক comic relief আনা যায় না, পরিচালক relief আনার কাজটি করেছেন আলফার ফ্যান্টাসি, কীর্তন, অন্ধ দাদার সাথে মেয়েদের হাল্কা আলাপ ইত্যাদি দেখিয়ে। এই দৃশ্যগুলোর সবগুলোই ছবির থিমের সাথে ঠিক মিলে গিয়েছে সেটা বলা যায়না। প্রথম কীর্তনটিকে (বস্তির বিলবোর্ডের নীচে) খানিকটা বেখাপ্পাই মনে হয়েছে। আধুনিক ঢাকা শহরের বস্তিবাসী নিজেরাই গায়ক ভাড়া করে কীর্তন শুনছেন এটা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য নয় (আমার ধারণা অবশ্য ভুলও হতে পারে)। দ্বিতীয় (হরে কৃষ্ণ হরে রাম) এবং তৃতীয় (শবযাত্রা) কীর্তনের উপস্থাপনা অবশ্য যথাযথই মনে হয়েছে। হতভাগ্য সোলায়মানের শেষ যাত্রাকে ‘আনন্দময়’ করতে কিছু ব্রাত্য মানুষের শবযাত্রার দৃশ্যটি সত্যই মনোমুগ্ধকর।
আলফার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন আলমগির কবির। তিনি পেশাদার অভিনেতা নন। তবে তিনি একজন সঙ্গীতশিল্পী। একজন শিল্পীর পলায়নপরতা, শিল্পী মনের অন্তর্নিহিত আনন্দ এবং নিরানন্দ তাঁর অজানা থাকার কথা নয়। ফলে তাঁর পক্ষে আলফা চরিত্রটিকে ইন্টেলেকচুয়ালি এবং শৈল্পিকভাবে সহজেই বুঝে ফেলা সম্ভব হয়েছে। আলফার বডি ল্যাঙ্গুয়েজে একটি পলায়নপরতা আছে, মাচার বাইরের জগতে তাঁকে যেতেই হয়, কিন্তু সেটা নেহাতই জীবন ধারণের জন্য, তিনি এই জগতে মোটেও স্বচ্ছন্দ নন, খানিকটা কুঁজো হয়ে হেটে, উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে অস্বচ্ছন্দ ভঙ্গিটা সার্থকভাবেই ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন।
ছবিটির প্রধান চরিত্র আলফা, কিন্তু দ্বিতীয় প্রধান চরিত্র জীবিত কেউ নন, তিনি হচ্ছেন মৃত সোলায়মান, যার চেহারাও আমরা দেখি না, মর্গে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আলফাও দেখেন না, এই পচে ফুলে যাওয়া মৃতদেহের সাথে দর্শকদের বন্ধুত্ব করানোর কাজটাও আলফাকেই করতে হয়, এবং সেটা করতে হয় মূলত সংলাপের মাধ্যমে। এক কাজটাও তিনি স্বার্থকভাবেই করেছেন, তবে কিছু কিছু সংলাপের ( যেমন “তুমি আমারে মাইরা ফালাও”) ক্ষেত্রে তাঁকে দুর্বল মনে হয়েছে।
এই ছবিটিকে আলফাকেন্দ্রিক রাখার জন্য হয়তো অন্যান্য চরিত্রগুলোকে সেভাবে হাইলাইট করা হয়নি, তা সত্ত্বেও কালি হিজড়া চরিত্রটি দারুণভাবে উঠে এসেছে, আর সেটা হয়েছে অভিনেতার গুনেই। রাতে খাবার সময়ে পালক কন্যাকে “মজা হয় নাই?’ বা পোষা গাধাকে “শরীরটা খারাপ?” এই ছোট ছোট সংলাপের মাধ্যমে চরিত্রটিকে তিনি অত্যন্ত মানবিকভাবেই উপস্থাপন করেছেন।
সে অনুপাতে গোলেনুর চরিত্রটিকে দুর্বলই মনে হয়েছে। আলফার প্রেমিকা এবং সন্তানের মা, এই গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রটি ছবিটির এক ঘণ্টা ফুরোবার আগেই শেষবারের মত দেখা দেয় এবং এর পরে দর্শকদের মন থেকেও যেন হারিয়ে যায়। এর জন্য কি অভিনেত্রী না পরিচালক দায়ী, এটা বলা মুশকিল। আলফার সাথে গোলেনুরের ঘনিষ্ঠতার দৃশ্যটিকে আরোপিত মনে হয়েছে। আলফার বুকে মাথা রাখার সময় তাঁকে প্রেমিকা মনে হয় নি, মনে হয়েছে নার্স, যেন তিনি বুকে কান রেখে হার্টের রেট মাপছেন, আলফার হাতে হাত বুলানোতেও খুব তাড়াহুড়া ছিল। আলফার সাথে তাঁর সম্পর্কটা একতরফা, সেখানে প্রেম আছে, স্নেহ আছে, অভিমান আছে, সে সম্পর্ক থেকে সন্তান নেওয়ার ইচ্ছেও আছে। কিন্তু পুরো ছবিতে তাঁর সাথে আলফার দৃশ্য আছে মোটে দুটো, দুই দৃশ্যেই আলফাকে প্যাসিভ ভূমিকায় রাখা হয়েছিল, কিন্তু গোলেনূর নিজে থেকে এই সম্পর্কের বহুমাত্রিকতা তুলে আনতে সফল হয়েছেন এটা বলা যাচ্ছে না। অন্যান্য দৃশ্যেও তিনি একটিভ রোল নিতে পারেননি।
ইউটিউবে মন্তব্যগুলো পড়ে মনে হচ্ছে দর্শকদের অনেকেই এই ছবিটি দেখে বিরক্ত হয়েছেন। তাঁদের জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া দেড় ঘণ্টা ফেরত চাইছেন। ছবিতে হিন্দু ধর্মীয় থিম আনার জন্য কয়েকজন পরিচালক মহোদয়কে নাস্তিকও বলেছেন। এই প্রতিক্রিয়াগুলো খুব অস্বাভাবিক নয়। দাওয়াতে গিয়ে পাতে মাংসের বদলে নিরামিষ পরলে মেজাজ খারাপ হওয়াটা স্বাভাবিক। নিরামিষ খেতে সুস্বাদু না হতে পারে, তবে স্বাস্থ্যের পক্ষে ভাল। এই ছবিটিতে বিমূর্ত শিল্পের মাধ্যমে কি কি বার্তা দেওয়া হয়েছে তা দর্শকেরা নিজেদের মত করে বুঝে নিবেন। কিন্তু সেইসব বিমূর্ত বার্তা বাদ দিলেও একটা বার্তা একেবারে স্পষ্ট। সেটা হচ্ছে বাংলাদেশে প্রতিদিন কিছু মানুষ রুটিনমাফিক লাশ হয়ে যাচ্ছে আর সবাই সেটা মেনেই নিয়েছে। খালের মাঝে বেওয়ারিশ লাশ ভেসে এসেছে বা রেল লাইনের ধারে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির লাশ পাওয়া গিয়েছে, এমন খবর পত্রিকায় আসে, আর লোকে পরক্ষনেই ভুলে যায়। কিন্তু এই ‘বেওয়ারিশরা’ আসলে কেউই বেওয়ারিশ নন, এদের পরিবার পরিজন আছে, এদের জন্য স্ত্রীরা, পুত্র কন্যারা অপেক্ষা করেন, বৃদ্ধা মায়েরা প্রতিদিন পথ চেয়ে বসে থাকেন। এমনই একজন হচ্ছে সোলায়মান। সোলায়মানকে ভাসিয়ে দেওয়ার সাথে সাথে ছবিটি শেষ হয়ে যায়। কিন্তু আমরা যদি ভাবতে থাকি লাশ ভাসিয়ে দেওয়া শেষে আলফা কি করবেন। তিনি নিশ্চিতভাবেই তাঁর মাচায় ফিরে যাবেন, কিন্তু আগের মত পলায়নপর থাকবেন কি? তিনি কি আগের মতই বোরাক, মসজিদ, নায়ক- নায়িকা এই জাতীয় নির্দোষ ছবি আঁকবেন? নাকি সেখানে ক্রসফায়ার থাকবে, গুমখুন থাকবে, ক্রমশ মূলধারার রাজনীতি হয়ে উঠা নিরীহ মানুষকে পুড়িয়ে মারা থাকবে? একটি বেওয়ারিশ লাশের সাথে বন্ধুত্ব আলফাকে আরও মানবিক আর প্রতিবাদী করে তুলেছে, এটা ভাবাই যায়।
মোহাম্মদ মুনিম
পেশায় প্রকৌশলী, মাঝে মাঝে নির্মাণ ব্লগে বা ফেসবুকে লেখার অভ্যাস আছে, কেউ পড়েটড়ে না, তারপরও লিখতে ভাল লাগে।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
১ comment
মাসুদ করিম - ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯ (২:৫০ অপরাহ্ণ)
ফিল্মটা দেখে উঠলাম – আমার রেটিং দশে পাঁচ।