“তোমরা ভাত খেয়ে খেয়ে কী ফুটবল খেলবে?” শুধু বাংলাদেশের ফুটবল নয়, পুরো বাংলাদেশের ইতিহাসের ৪৭-৭১ পর্বকে এই ছোট একটি বাক্যেই বেঁধে ফেলা যায় বোধহয়। আরেক ফুটবলার মেজর জেনারেল নূরুন্নবী, আরেকটু খোলাসা করে বললেন, পাকিস্তান ফুটবল দলে কখনোই এক দুজনের বেশী বাঙ্গালীর জায়গা হয়নি, পূর্ব পাকিস্তানের খেলাধুলার বিস্তারে সরকারী ফান্ডিং ছিল না বললেই চলে। কিন্তু “তোমরা ভাত খেয়ে খেয়ে কী ফুটবল খেলবে?” জাকারিয়া পিন্টুর এই এক বাক্যে পুরো পাকিস্তান আমলের শোষণ, বঞ্চনা, জাতিগত বিদ্বেষ পুরোটাই উঠে আসে। ভাত খেয়ে খেয়ে ফুটবল খেলা চলে না, ক্রিকেট হয় না, যুদ্ধ করা যায় না, যোগ্য প্রশাসক হওয়া যায় না, কিছুই করা যায় না। কিন্তু ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে দেখা গেলো, ভাত খেয়ে খেয়েই সর্বাধুনিক অস্ত্র সজ্জিত লাখখানেক সৈন্যের সেনাবাহিনীকে যুদ্ধে হারিয়ে দেওয়া যায়। ১৯৭১ সালের পরপর ভাত খাওয়া এই জাতি কিস্যু করতে পারবে না, দেশি বিদেশি অনেক কুতুবই এমন কথা বলেছেন। কিন্তু ৭১ এর পরে এই অনেকগুলো বছর বাদে পেছনে ফিরে দেখা যাচ্ছে ভাত খেয়ে খেয়ে অনেক কিছুই অর্জন করা হয়েছে, জাতি হিসাবে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে ভাত খাওয়াটা কোন বাধা হবে না বলেই মনে হচ্ছে।
স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল কোন সাধারণ দল নয়, ‘খেলার সাথে রাজনীতি’ মেশানো দল। কলকাতা কেন্দ্রিক বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের নেতৃবৃন্দ তাঁদের অসামান্য দূরদর্শিতার কারণে যুদ্ধকেন্দ্রিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি ফুটবলের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক জনমত গঠনের পরিকল্পনা করেন। শুধু জনমতই নয়, ফুটবল খেলে যুদ্ধের জন্য টাকাও জোগাড় করতে হবে। ভারতে চলে আসা খেলোয়াড়রা তো বটেই, ঢাকায় থেকে যাওয়া খেলোয়াড়দেরও উদ্বুদ্ধ করে নিয়ে আসা হয়। কাজী সালাউদ্দিন, বাংলাদেশের একমাত্র সুপারস্টার ফুটবলার, ৭১ এ কিশোর বয়সী ছিলেন, তিনি নিজের উদ্যোগেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভারতে গিয়ে এই দলে যোগ দেন।
স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল বিষয়ক এই তথ্যচিত্রটির অন্যতম নির্মাতা জনাব আবু নঈম মাহতাব মোর্শেদ এবং সঙ্গীত পরিচালক জনাব আলমগীর কবির আমার বাল্যবন্ধু। তাঁরা কোনরকম ধারাভাষ্য ছাড়া শুধুমাত্র সাক্ষাৎকার, মুক্তিযুদ্ধের কিছু স্টক ফুটেজ আর স্থিরচিত্র ব্যবহার করে মাত্র বিশ মিনিটের মাঝে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের ঐতিহাসিক পটভূমি এবং সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড যেভাবে তুলে এনেছেন, সেটা বেশ বাহাদুরির ব্যাপার। “তোমরা ভাত খেয়ে খেয়ে কী ফুটবল খেলবে?” অথবা “ওরা যদি পনের জন থাকতো আমরা থাকতাম দুজন” এই দুটি বাক্য দিয়ে তথ্যচিত্রটি শুরু হচ্ছে, কে বলছেন আমরা দেখতে পাচ্ছি না, শুধু দেখতে পাচ্ছি কিছু ফুটবল খেলোয়াড় অনুশীলন করছেন। কিন্তু কারা বলছেন আর কি বিষয়ে বলছেন এটা ধুম করেই আমরা বুঝে ফেললাম। মানে পনের সেকেন্ডের মাঝেই স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের ঐতিহাসিক পটভূমি বলা হয়ে গেল। এর পরে আরও দেড় মিনিট এই পটভূমি ব্যাখ্যা করা হলো। এই ব্যাখ্যার খানিকটা প্রয়োজন ছিল, পাকিস্তান আমলের বৈষম্যের ব্যাপারটা তো আছেই, কিন্তু পুরো পাকিস্তান আমল জুড়ে কোন সরকারী সাহায্য ছাড়াই কিছু সংগঠকের ব্যক্তিগত আগ্রহে বাংলাদেশে ফুটবলের ভিত্তি তৈরি হওয়ার প্রসঙ্গও এখানে এসেছে।
২৫শে মার্চের গণহত্যা বিষয়ক স্মৃতিচারণায় ব্যয় হয়েছে মোটে দেড় মিনিট। কিন্তু একবারও মনে হয়নি ব্যাপারটাকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। সাড়ে তিন মিনিট থেকে সাড়ে দশ মিনিট, এই সাত মিনিট ব্যয় করে হয়েছে এই দলটির গঠন প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করতে। আমার কাছে এই অংশটিই এই তথ্যচিত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল কটা ম্যাচ কার সাথে খেলেছে আর সেইসব ম্যাচের ফলাফল কি ছিল, তা এতদিন বাদে নিতান্তই গৌণ ব্যাপার। কিন্তু তৎকালীন প্রবাসী সরকার যে মুক্তিযুদ্ধের একেবারে শুরুতেই এতসব ব্যস্ততা আর চাপের মাঝেও ফুটবল দল তৈরি করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন, আর এই দলের সংগঠক এবং খেলোয়াড়েরা কতটা ঝুঁকি নিয়ে এই দলে যোগ দিয়েছিলেন, এই তথ্যগুলো নিশ্চিতভাবেই আমাদের অনেকেরই জানা ছিল না। এর পরে নদীয়ায় প্রথম ম্যাচের বিল্ডআপ নিয়ে আলাপ হয়েছে মিনিট দুয়েক, সেটাও অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক আলাপ। এর পরের দু মিনিট প্রতাপ শঙ্কর হাজরা বিহারের মুসলমান অধ্যুষিত শহরে খেলার অভিজ্ঞতা জানান। হিন্দুদের প্ররোচনায় পাকিস্তান ভেঙ্গে যাচ্ছে বলে অনেক ভারতীয় মুসলমানই বিশ্বাস করতেন (এবং এখনো করেন)। এই স্বল্প আলোচিত এবং কিছুটা অস্বস্তিকর প্রসঙ্গটি তুলে ধরার জন্য প্রতাপ শঙ্কর হাজরা এবং পরিচালকবৃন্দের ধন্যবাদ প্রাপ্য। তথ্যচিত্রটির শেষে খেলোয়াড় এবং কর্মকর্তারা এই দল নিয়ে নিজেদের ব্যক্তিগত অনুভূতি, অভিমান, ভালবাসা এবং অহংকার বোধের কথাও বলেছেন। সেগুলোও এই তথ্যচিত্রটিকে সমৃদ্ধ করেছে।
স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল গঠনের গল্পটা তো বটেই, দল গঠন পরবর্তী কর্মকাণ্ডও যথেষ্ট রোমাঞ্চকর। প্রথম খেলাতেই স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়ানোর অনুমতি দিয়ে ভারতীয় কর্মকর্তার নাজুক পরিস্থিতিতে পড়ে যাওয়া বা বিনা রিজার্ভেশনে শুধু বাংলাদেশের পতাকা লাগিয়ে একটি পুরো বগী দখল করে অন্য শহরে যাওয়া এই জাতীয় কিছু ঘটনা এই তথ্যচিত্রে এসেছে। এই দলটির খেলোয়াড় এবং কর্মকর্তাদের সবার ঝুলিতেই এমন অসংখ্য গল্প আছে, যা সবই ইতিহাসের অংশ। এরা বিভিন্ন সময়ে নানা প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মাধ্যমে নানা স্মৃতিচারণা করেছেন। এর মাঝে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কাজী সালাউদ্দিনের নিজের স্মৃতিচারণা, তিনি আশির দশকে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে নিজের আত্মজীবনী প্রকাশ করেন, সেখানে এই স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল নিয়ে বেশ বিস্তারিত স্মৃতিচারণা আছে। তবে সরকারী ভাবে এই দল বিষয়ক তথ্যাবলী সংরক্ষিত আছে কিনা, থাকলেও সেটা কতখানি সহজলভ্য, সে প্রশ্নটা থেকেই যায়। এখন অনলাইনে ব্যক্তিগত উদ্যোগে স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিল পত্রের ইউনিকোডের কপি পাওয়া যাচ্ছে, সেখানে সার্চ করে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল সম্পর্কে একটা মোটে রেফারেন্স পাওয়া গেল।
তথ্যচিত্রটি দেখে একটা বিষয় মাথায় ঘুরছে, সেটা হচ্ছে এই দল নিয়ে এখনো কেন কোন ফিচার ফিল্ম হয়নি। কাজী সালাউদ্দিন ওরফে তুর্য, পনের কি ষোল বছর বয়স, একা একা কখনো নৌকায়, কখনো গরুর গাড়িতে বা পায়ে হেটে আগরতলায় যাচ্ছে। অন্যান্য খেলোয়াড়রাও যে যার মত ভারতে যাচ্ছেন এই দল যোগ দিতে। সব মিলিয়ে তিরিশ জন খেলোয়াড় জড়ো হলেন, কোথায় থাকবেন, কি খাবেন, প্র্যাকটিস কিভাবে হবে সবই অনিশ্চিত। কিন্তু খেলতেই হবে, এবং খেলে জিততেই হবে, বা হারলেও লড়াই করে হারতে হবে। মুক্তিযোদ্ধারা ফ্রন্টে লড়াই করছেন, লোকে তা শুনছে, কিন্তু দেখছে না, দেখছে এই স্বাধীন বাংলা দলকে। এই দলে তুর্য আছে, তসলিম আছে, সাত্তার আছে, কিন্তু সেই সাথে অমলেশ, প্রতাপ আর বিমলও আছে। মানে হিন্দু আর মুসলমান মিলে এক নতুন পতাকার হয়ে খেলছে। মুক্তিযুদ্ধ পৃথিবীর অনেক দেশই করেছে, কিন্তু কটা দেশ এভাবে খেলার সাথে রাজনীতি আর যুদ্ধ মিশিয়ে ফেলেছে? স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল নিয়ে একটি সুনির্মিত ফিচার ফিল্ম বাংলাদেশকে নিশ্চিতভাবেই নতুন করে চেনাবে।