সম্ভবত আমি ছোটগল্প খুবই কম পড়েছি, এমনও হতে পারে আমার পড়া উপন্যাসের চেয়েও পড়া ছোটগল্পের সংখ্যা কম, অথবা এমনও হতে পারে – এটা মিথ, ব্যক্তিগত – যাতে পড়েও অস্বীকারের প্রবণতা বিশেষ প্রকট বিশেষ বস্তুরাশির উপর মানসিক অবজ্ঞাতির সাধারণ কারণে।
এনিয়ে যখন তৃতীয় কি চতুর্থবার গল্পটি পড়লাম, বিশেষত লেখক মরে যাবার পরে, কোন লেখাটি পড়ব ভেবে যখন ‘অন্ধ বেড়াল’ পড়তে শুরু করেছি, তৃতীয় কি চতুর্থবার, তখন থেকেই ভাবছি ঠিক কেন এছোটগল্পটি পড়তে আমার ভাল লাগে – সেই প্রথম যখন পড়েছি আজ থেকে কয়েক বছর আগে আর এবার যখন পড়লাম ঠিক একই রকম লাগল, একই রকম দ্রুততায় পুরো গল্পটা ভুলে গেলাম, একই রকম আচ্ছন্নতায় উদ্বেগ জেগে রইল, একই রকম নিঃসঙ্গতার হানা হানা আক্রমণ থেকে থেকে অন্ধকারকে ঠেলে আরো অন্ধকারে নিয়ে গেল, আমি দূরেই থাকলাম, শুধু হোটেলটাকে মনে হল খুব চেনা, আমিও থাকতাম হয়তো – থেকেছি অনেক দিন, এপ্রসঙ্গ কোনোদিন আসতই না – তবে এটা কি ঠিক ছোটগল্প, বিশেষত ‘অন্ধ বেড়াল’-এর মতো ছোটগল্প সেরকম কিছুই প্রথম থেকেই করতে পারে, যা আমাকে পথের ধারে নিয়ে যায়, যেপথের ধারে উদ্বেগ দাঁড়িয়ে আছে শুঁয়োপোকা প্রজাপতি হওয়ার দিকে প্রাণিত হচ্ছে, জলরাশি শুয়ে আছে এবং সবচেয়ে বড় কথা আমি নিজেই পথের ধার হয়ে পড়ে আছি।
সব ছোটগল্পের শুরুর মতোই এছোটগল্পেও আমার এপরিণতির দায় কার দিয়েই শুরু হয়েছে, পরিবেশটা ফুটে উঠেছে কিছুমাত্র দেরি না করেই, যা বোধের অতীত বা যা বোধেরই অধিগম্য সেসব একে একে আসতে শুরু করেছে , শুরু থেকেই শুরুটাকে জানিয়ে দেয়ার ক্লাসিক অবস্হানটাকে কোনো ছোটোগল্পই কোনো কালেই অস্বীকার করেনি, কোনো কালেই বলতে কোনো আধুনিক কালেই , যেহেতু ছোটগল্প ফিল্মের মতোই একটি আধুনিক প্রকাশ মাধ্যম, তাই খুব একুরেট, হতে চেয়েছে – হতে হয়েছে, এটা নিতান্তই এক ধরনের অনিশ্চিত নির্দিষ্টতা, বলতে গেলে – এজন্যই শিল্পের সৃষ্টি তার অস্তিত্ব, তাই শুরুতেই সেআবেশ কাজ করে রূপান্তরের মতো।
অন্য কোনো বেড়ালের সঙ্গে লড়াই করে সে অন্ধ হয়ে গিয়েছিল না জন্ম থেকেই অন্ধ ছিল তা আর জানার উপায় নেই। সে শহরের বেড়াল নয়। নদীর ধারে মাছের আঁশটে গন্ধমাখা একটা ছোটো গঞ্জের বেড়াল। এরকম বেড়ালদের গল্পও অন্যরকম হয়। সে যে-হোটেলটায় থাকত তার মেঝেটা ছিল কাঠের তক্তার। নদীর পাড়ে এই হোটেলটার একটা টাল ছিল নদীর দিকে। এর জন্যে দোতলা হোটেলটার পুরোটাই নদীর দিকে কিছুটা ঝুঁকে ছিল।
প্রকল্পগুলোই সংহার করে আমাদের, ছোটগল্পে প্রবিষ্ট রাখে, এই এদিক ওদিক দেখার মতো করে জমে ওঠে, তাড়াও দেয়, শাঁসটা ছুঁতে দেয়, আমরা এও বুঝতে পারি আদ্যন্ত দেখা যাচ্ছে এবার – শেষ হবে কাছাকাছি, মিলবে হয়তো আরো কিছু তবে মূলত ঝোঁকটা বিনাশী, ‘অন্ধ বেড়াল’-এর মতো ছোটগল্পে এ যেন অনিবার্য, স্বীকার করতেই হবে লেখক বিন্যাসটাকে বিপর্যস্ত করছেন আবার গল্পের ধরনে মোহগ্রস্তও করছেন।
তিনটে লোক ওই ট্রলার মালিকের মার্ডারের দিন বোয়াল মাছের ঝোল দিয়ে ভাত মেখে লঙ্কা পেঁয়াজ দিয়ে তারিয়ে তারিয়ে খাচ্ছিল। মার্ডারটা হতে তখনো দেড় ঘণ্টা বাকি। ওরা খেতে বসার সময় একটা পুরনো চেন ছেঁড়া কিট ব্যাগ মেঝেতে রেখেছিল। ব্যাগটা যে প্রায় অন্ধ বেড়ালের গা ছুঁয়ে রয়েছে সেটা ওরা খেয়াল করেনি। ব্যাগটার মুখটা গামছা দিয়ে ঢাকা ছিল। ভেতরে ছিল নতুন বানানো একটা লোডেড দেশি পিস্তল, দুটো ভোজালি আর আটটা হাতবোমা। খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে ওরা ঠারেঠোরে যে কথা বলছিল তা শুনলে আন্দাজ করা খুবই কঠিন যে ওরা একটা খুন করবে বলেই এসেছে এবং করতেও চলেছে। ওরা হোটেল মালিককে দিয়ে বাইরে থেকে মিস্টি দইও আনিয়েছিল। পরে হাত ধুয়ে, রুমালে মুখ মুছে দাম মিটিয়ে দেয়ার পরে একজন নিচু হয়ে কিট ব্যাগটা তোলবার সময় অন্ধ বেড়ালকে দেখে ভয় পেয়ে যায়।
আকস্মিকতা ও আক্রমণ ও অনঅস্তিত্ব দিয়ে শেষ হতে পারে বা শেষে এমনই হতে পারে – অন্ধ বেড়ালের থাকা না থাকার মতো গুরুত্বপূর্ণ গুরুত্বহীনতায় ছোটগল্পটি দাঁড়িয়ে থাকে, আমি জানি না কতজন আমার মতো দ্রুততায় গল্পটি ভুলে যাবেন উদ্বেগে অন্ধকারে স্বেচ্ছায় অজ্ঞাতে বসে থাকবেন।
মাসুদ করিম
লেখক। যদিও তার মৃত্যু হয়েছে। পাঠক। যেহেতু সে পুনর্জন্ম ঘটাতে পারে। সমালোচক। কারণ জীবন ধারন তাই করে তোলে আমাদের। আমার টুইট অনুসরণ করুন, আমার টুইট আমাকে বুঝতে অবদান রাখে। নিচের আইকনগুলো দিতে পারে আমার সাথে যোগাযোগের, আমাকে পাঠের ও আমাকে অনুসরণের একগুচ্ছ মাধ্যম।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৬ comments
Pingback: অন্যরকম হয় | প্রাত্যহিক পাঠ
রায়হান রশিদ - ৭ আগস্ট ২০১৪ (৭:৫৭ অপরাহ্ণ)
এভাবে তাৎক্ষণিক চিন্তাস্রোত (নাকি চিন্তার সারি?) পর পর সাজিয়ে লেখেন এমন আর কোন ব্লগার দেখিনি। মাঝে মাঝে প্রুস্তের গদ্য মনে করিয়ে দেয়।
মাসুদ করিম - ৮ আগস্ট ২০১৪ (১:৪৯ অপরাহ্ণ)
স্রোত নয় সারিও নয় – চিন্তা ও শব্দের নিরন্তর সৃষ্টিশীলতা, তাই করি – তাই আরাধ্য। প্রুস্ত, হ্যাঁ – আচ্ছা আপনার জয়েস পড়া আছে? বহুদিন যেহেতু ইংরেজদের প্রতিবেশে আছেন, যদি জয়েস পড়া থাকে, তাহলে তার গদ্যের স্বনন কেমন বিন্যাস দেয় মনে?
মাসুদ করিম - ১১ আগস্ট ২০১৪ (৫:৩১ অপরাহ্ণ)
মাসুদ করিম - ১৪ আগস্ট ২০১৪ (৪:৫০ অপরাহ্ণ)
শাহ আলম বাদশা - ১৯ আগস্ট ২০১৪ (১০:৩৩ অপরাহ্ণ)
এনিয়ে যখন তৃতীয় কি চতুর্থবার গল্পটি পড়লাম, বিশেষত লেখক মরে যাবার পরে, কোন লেখাটি পড়ব ভেবে যখন ‘অন্ধ বেড়াল’ পড়তে শুরু করেছি, তৃতীয় কি চতুর্থবার, তখন থেকেই ভাবছি ঠিক কেন এছোটগল্পটি পড়তে আমার ভাল লাগে – সেই প্রথম যখন পড়েছি আজ থেকে কয়েক বছর আগে আর এবার যখন পড়লাম ঠিক একই রকম লাগল, একই রকম দ্রুততায় পুরো গল্পটা ভুলে গেলাম, একই রকম আচ্ছন্নতায় উদ্বেগ জেগে রইল, একই রকম নিঃসঙ্গতার হানা হানা আক্রমণ থেকে থেকে অন্ধকারকে ঠেলে আরো অন্ধকারে নিয়ে গেল, আমি দূরেই থাকলাম, শুধু হোটেলটাকে মনে হল খুব চেনা, আমিও থাকতাম হয়তো – থেকেছি অনেক দিন, এপ্রসঙ্গ কোনোদিন আসতই না – তবে এটা কি ঠিক ছোটগল্প, বিশেষত ‘অন্ধ বেড়াল’-এর মতো ছোটগল্প সেরকম কিছুই প্রথম থেকেই করতে পারে, যা আমাকে পথের ধারে নিয়ে যায়, যেপথের ধারে উদ্বেগ দাঁড়িয়ে আছে শুঁয়োপোকা প্রজাপতি হওয়ার দিকে প্রাণিত হচ্ছে, জলরাশি শুয়ে আছে এবং সবচেয়ে বড় কথা আমি নিজেই পথের ধার হয়ে পড়ে আছি। এটা কি একটা বাক্য হয়ে গেলোনা? বাক্য যতো ছোট হবে ততোই সহজবোধ্য ও শ্রুতিমধুর হয়। দাড়ি-কমা কিছুই নেই!!