পুরনো বইপ্রস্থ
বইপ্রস্থ ২৫ আগস্ট ২০০৯
বইপ্রস্থ ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১০
বইপ্রস্থ ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১০
বইপ্রস্থ ২৬ জুন ২০১২
অধিবিদ্যাসংহারকাব্য
উত্তর-আধুনিক চিন্তা ও কয়েকজন ফরাসি ভাবুক।। অমল বন্দ্যোপাধ্যায় ।। এবং মুশায়েরা, কলকাতা।। প্রথম প্রকাশ জানুয়ারি ২০১১ ।। মূল্য ২৫০ ভারতীয় টাকা ।।
মূলত অমল বন্দ্যোপাধ্যায় চারজন ফরাসি দার্শনিকের দর্শন নিয়ে আলোচনা করেছেন, Jacques Derrida | জাক দেরিদা (১৯৩০ – ২০০৪), Michel Foucault | মিশেল ফুকো (১৯২৬ – ১৯৮৪), Jacques Lacan | জাক লাকঁ (১৯০১ – ১৯৮১) ও Gilles Deleuze | জিল দ্যলজ (১৯২৫ – ১৯৯৫)। বইয়ের একবারে শেষে তিনি আরেক ফরাসি দার্শনিককে নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেছেন, তিনি হলেন, Jean Baudrillard | জঁ বোদ্রিয়ার (১৯২৯ – ২০০৭)। এছাড়া জার্মান দার্শনিক Friedrich Nietzsche | ফ্রিডরিশ নিৎসের (১৮৮৪-১৯০০) দর্শন নিয়ে জাক দেরিদা ও জার্মান দার্শনিক Martin Heidegger | মার্টিন হাইডেগারের (১৯৮৯ – ১৯৭৬) দার্শনিক আলোচনা নিয়ে অমল বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি বক্তৃতার সারাংশও স্থান পেয়েছে।
দর্শনপাঠের একটা ঝুঁকির দিক হল এর ক্রমাগত গোলকধাঁধা, এবং আনন্দ এখানে, যদিও আমার ব্যক্তিগত, এই গোলকধাঁধায় প্রবিষ্ট হতে ভাল লাগে এবং এই বইটিও আমার অন্যান্য পছন্দের দর্শন ও দর্শন বিষয়ক বইয়ের মতো আমাকে টানা আবিষ্ট রেখেছে শুরু থেকে এর শেষ ২৩১ পৃষ্টাংক পর্যন্ত।
অমল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষা যদিও সৃষ্টিশীল উচ্চাঙ্গের বাংলা নয়, কিন্তু তার ভাষা দার্শনিক চিন্তা প্রকাশের উপযুক্ত এবং পরিশ্রমী। ছোটবেলা থেকে অমল বন্দ্যোপাধ্যায় ফরাসি ভাষা শিখেছেন, উপনিবেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, চন্দননগরে এবং সে চর্চা তিনি অক্ষুন্ন রেখেছেন এবং উত্তাল মে৬৮-এর পর সেবছরের সেপ্টেম্বর থেকে কয়েক বছর তিনি প্যারিসেও ছিলেন ফরাসি সরকারের দীর্ঘমেয়াদি বৃত্তি নিয়ে। আরো গুরুত্বপূর্ণ হল তিনি জার্মান ভাষাও ভালই জানেন এবং ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমফিল করেছেন এবং পরবর্তীতে কর্মসূত্রে দুদশক লন্ডনে কাটিয়েছেন এবং সেসময় বৃটিশ বিবিধ জার্নালে তার ভাষা ও দর্শন বিষয়ক প্রবন্ধও ছাপা হয়েছিল। কয়েকটি দর্শনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভাষা জানার ফলে তার আলোচনায় একটা চমৎকার পটভূমি অনায়াসে নাটকের দৃশ্যপটের মতো উপস্থিত থাকে। বইয়ের একবারে শুরুতে অমল বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিজের সম্বন্ধে একথাগুলো আমাকে খুবই আকর্ষণ করেছে
প্রচলিত অর্থে আমি লেখক নই। যেহেতু কপট বিনয় আমার চরিত্রানুগ নয় আমি নিজেকে অলেখক আখ্যাও দিতে পারি না। আমি বাংলা ও ইংরেজী, এ-দুই ভাষাতেই লিখেছি কিন্তু লেখা আমার নেশা বা পেশা, এ-দুয়ের কোনটাই নয়। বরং পড়াটাই আমার একটা নেশা এবং আমি আজীবন ছাত্র হয়ে আছি। আমার জীবনের একটা বড় অংশ কেটেছে ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে। উনিশ শতকের তরুণ জার্মানদের মতো, এক বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা বিষয় পাঠ করে, অন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্য এক বিষয়ে অধ্যয়ন। তাই আমার আর লেখক হওয়া হয়ে ওঠেনি।
কিন্তু ‘হয়ে ওঠা’ই উত্তরআধুনিক দর্শনের মূল কথা। উত্তরআধুনিক শব্দের কোনো নির্দিষ্ট অর্থ নেই এর কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্যও নেই। এর ব্যাপ্তির অনুপুঙ্খ অনুসন্ধান বৃথা – ঋজু, বক্র, বৃত্ত কোনভাবেই এর সংকলন সম্ভব নয়। এটি একটি বহুত্ববাদী সংকট এবং এসংকট আধুনিকতার পরবর্তী আর এর কোনো সমাধান নেই – কোনো বিকল্প নেই – এটি গতিশীল হয়েও স্থবির হতে পারে, স্থবির হয়েও দুর্দমনীয় গতির শিকার হতে পারে। উত্তরআধুনিকতা আঞ্চলিক, আন্তর্জাতিক, মহাজাগতিক।
কেন ফরাসি ভাবুক এবং কেন উত্তরআধুনিকতা নিয়ে বই?
ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে, ফ্রান্সে যে দার্শনিক আন্দোলন মাথা চাড়া দেয় এবং যা এক বিদ্রোহে পরিণত হয়, তার এক বিবরণ ও বিশ্লেষণ। গত আড়াই হাজার বছর যাবৎ, পাশ্চাত্যে বিশেষতঃ ইউরোপে, দর্শিনিক চিন্তার মাধ্যমে যা বিবৃত ও শেখানো হয়েছে, এই বিদ্রোহ তার আসল রূপকে উদঘাটিত করে এটা দেখাবার চেষ্টা করেছে, কী পরিমাণ অসত্য ও ভ্রান্তি ওই দীর্ঘদিনব্যাপী চিন্তাস্রোতের আড়ালে রয়ে গেছে এবং কোনো কোনো পরিস্থিতিতে ওই পরিকল্পিত অসত্যকে রাষ্ট্রের, বা জাতির বা ধর্মের স্বার্থে কাজে লাগানো হয়েছে।
এই বইয়ে অমল বন্দ্যোপাধ্যায় যে দার্শনিকদের নিয়ে আলোচনা করেছেন তারা দার্শনিক দিক দিয়ে বহুধাবিভক্ত। কিন্তু এরা সবাই দর্শনের ক্ষেত্রে একটা একক কাজ করেছেন, পুরো বইটি পড়ে আমার কাছে এটাই তাদের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রচেষ্টা মনে হয়েছে, এরা সবাই তার নিজের নিজের মতো করে অধিবিদ্যাসংহারকাব্য রচনা করেছেন।
মাসুদ করিম
লেখক। যদিও তার মৃত্যু হয়েছে। পাঠক। যেহেতু সে পুনর্জন্ম ঘটাতে পারে। সমালোচক। কারণ জীবন ধারন তাই করে তোলে আমাদের। আমার টুইট অনুসরণ করুন, আমার টুইট আমাকে বুঝতে অবদান রাখে। নিচের আইকনগুলো দিতে পারে আমার সাথে যোগাযোগের, আমাকে পাঠের ও আমাকে অনুসরণের একগুচ্ছ মাধ্যম।