যখন কোনো সাধারণ নির্বাচনে ৮০ শতাংশের বেশি বাস্তব ভোট পড়ে তখন নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে জল্পনা কল্পনা শুধুমাত্র মিডিয়ার নিজের অস্তিত্বকে সারাক্ষণ জানান দেয়ার অসুস্থ উপসর্গ ছাড়া আর কীই বা বলা যায়। পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার ৬ দফায় ভোটগ্রহণ শেষ হয়েছে ১০ মে ২০১১ – আশা করেছিলাম ১১ ও১২ তারিখ হবে সম্পূর্ণ শান্তির – পত্রিকাগুলো নির্বাচনী স্পেশাল চেহারা থেকে দুদিনের জন্য প্রতিদিনের স্বাভাবিক চেহারায় ফিরে আসবে, ফলাফল পরবর্তী সরকার স্পেশালের জন্য শক্তি সঞ্চয় করবে। কিন্তু না, ১১ ও ১২ তারিখেই পত্রিকাগুলো জ্যোতিষ শাস্ত্রে যার যার ব্যূৎপত্তি দেখাতে এতোই উঠে পড়ে লাগল তাদরেকে আর পত্রিকা বলেই মনে হচ্ছিল না – মনে হচ্ছিল তারা সবাই গণক টিয়াপাখির ঠোঁটে ওঠার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে : এ বলছে আমায় নাও, ও বলছে আমায়! কী হবে সংখ্যাতত্ত্বের নামে এই আগাম ফলাফল ফলিয়ে – এর মধ্যে ফলাফল ঘোষণার পর যার বা যাদের ফলাফল ফলানো ঘোষিত ফলাফলের যত কাছাকাছি যাবে সে তত সত্যবাদী বা বাস্তববাদী হিসেবে পরিচিত হবে ? মানুষ সত্যবাদী ও বাস্তববাদী পড়ব বলে পরবর্তীতে বেশি বেশি করে ওদের কিনবেন বা ওদের খবর অনুসরণ করবেন ? এটা গেল পত্রিকাওয়ালাদের বিশ্বযুদ্ধ।
পশ্চিমবঙ্গে এবার নির্বাচন হচ্ছে বামফ্রন্ট ও তৃণমূল-কংগ্রেস জোটের মধ্যে – কাজেই জয় পরাজয় যেমন সুনিশ্চিত এবং সেখানে ঝুলে থাকা ফলাফলের কোনো সম্ভাবনাই নেই। তারপরও সেখানে কিছু কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির মধ্যে অত্যন্ত করুণ টেনশন খেয়াল করছি – কারা সরকার গঠন করবে, সরকার কীভাবে গঠিত হবে, সরকার গঠনের প্রক্রিয়ায় তাদের নিজেদের ফায়দাগুলো সব ঠিকঠাক মাপেজোঁকে হবে কি না – এই করে করে ঘুম আরাম সব লাটে তুলেছেন। এই হল আরেক বিশ্বযুদ্ধ।
আবার কেউ কেউ এতই বিমর্ষ হয়ে আছেন যেন বামফ্রন্ট হেরে গেলে সারাবিশ্বের বাম রাজনীতি হেরে যাবে। যেন সারাবিশ্বের বাম রাজনীতির প্রাণভোমরা সোভিয়েত রাশিয়া পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকারের কাছে গচ্ছিত রেখে বিশ বছর আগে ঠাণ্ডাযুদ্ধের অবসান ঘটিয়েছিল। এরা কেমন যেন দিকভ্রান্ত, হেরে গেলে কাকে কাকে দোষ দেবেন, কাকে কাকে শূলে চড়াবেন, কাকে কাকে অক্ষমতাহেতু শুধু শাপ শাপান্ত করবেন – এই নিয়ে সারাক্ষণ বিড়বিড় করছেন। এদেরই মধ্যে কেউ কেউ আবার ভাবটা এমন ভাবছেন – এই যে আবার একটা নির্বাচন জিতে সরকার গঠন করবে বামফ্রন্ট, এই যে পাঁচ বছরের জন্য আবার বড় সুখের জীবনে গা ভাসিয়ে রাজা উজির মারবেন, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মিছিলে আবার কলকাতার চাক্কা জ্যাম করে দিয়ে নিজেকে জয়ী ভাববেন – সেই ভাবটা বা আরো ভালো শব্দে সেই ঘ্যামটা জেতার পর কেমন ধরবেন আদ্যপান্ত তাই ভাবছেন বারবার করে। এটা গেল এক দলের বিশ্বযুদ্ধ।
উদারনীতিতে আবিষ্ট একেবারে চিন্তাভাবনাহীন জীবনযাপনের কিছু অত্যন্ত সুবিধাপ্রাপ্ত লোক – ভাবছেন এই যে পশ্চিমবঙ্গের বুক থেকে ৩৪ বছরের এক জগদ্দল পাথর নামিয়ে দেবেন অচিরেই – তাদেরকেই তো লোকে এই পরিবর্তনের আইকন ভাববেন, তারাই তো হবেন নতুন যুগের নতুন উদারনীতির ধারক ও বাহক। তাদের কল্যাণে স্বাধীনতা বিভৎস মজা ঝরে ঝরে পড়বে চারিদিকে – এই সুখের উদারনীতি যে জৌলুশ আনবে জীবনে তাই ভাবতে ভাবতে তিনি আকণ্ঠ ডুবে আছেন – ফলাফল ঘোষণার দিন পর্যন্ত এই টালমাটাল অবস্থাটা রাখা চাই, এই অভিভূতি নিয়ে মাদকের গুণে রক্তিম চোখমুখ নিয়ে শ্যাম্পেনের হল্লা করতে পারলেই তো সবচেয়ে দেখার মতো হয় চেহারাটা, শুধু ছিপি খুললাম আর হল্লা করলাম – এ তো অশিক্ষিতের আনন্দ। শিক্ষিত উদারনীতির আইকন হল্লা করার আগে নিজেকে বিশেষ ভাবে মজিয়ে ঠিক মুহূর্তে দৃষ্টিনন্দন হল্লা করেন – এ সকলে বুঝবে না। এদেরই মধ্যে যারা দিন রাত খেটেছেন, এর মধ্যে মমতাও পড়েন – তারা ক্ষণে ক্ষণে বিষাদাক্রান্ত হচ্ছেন ভিমরি খাচ্ছেন, হেরে গেলে আর দাঁড়াতে পারবেন না। বামফ্রন্টের অষ্টম জয়ে একবারে অষ্টবক্র হয়ে পড়ে থাকবেন এরা – এদের দিকে কেউ আর ঘুরেও তাকাবে না। এটা হল আরেক দলের বিশ্বযুদ্ধ।
মাসুদ করিম
লেখক। যদিও তার মৃত্যু হয়েছে। পাঠক। যেহেতু সে পুনর্জন্ম ঘটাতে পারে। সমালোচক। কারণ জীবন ধারন তাই করে তোলে আমাদের। আমার টুইট অনুসরণ করুন, আমার টুইট আমাকে বুঝতে অবদান রাখে। নিচের আইকনগুলো দিতে পারে আমার সাথে যোগাযোগের, আমাকে পাঠের ও আমাকে অনুসরণের একগুচ্ছ মাধ্যম।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৮ comments
john romel - ১৩ মে ২০১১ (২:১২ পূর্বাহ্ণ)
এই হচ্ছে বুঝি পশ্চিম বঙ্গে, জানলাম। ধন্যবাদ আপনাকে।
মাসুদ করিম - ২৭ মে ২০১১ (১১:৩১ পূর্বাহ্ণ)
২০০৯ এর লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের ভোট বিপর্যয় দিয়ে শুরু তারপর একে একে পঞ্চায়েত পৌর সব নির্বাচনেই বাজে ভাবে হেরেছে ফ্রন্ট আর এবার বিধানসভা নির্বাচনে ন্যাক্কারজনক পরাজয় দিয়ে শেষ হল বামফ্রন্টের তিন দশকের বেশি সময়ের ক্ষমতার রেকর্ড। প্রতিটি নির্বাচনে হারের পর দুনিয়াজোড়া বাম বিরোধী ষড়যন্ত্রের কথা বড় বড় করে বলেছে বামফ্রন্ট বিশেষত সিপিএম, সেই সাথে আত্মসমালোচনা বা আত্মশুদ্ধির মধ্য দিয়ে এক নতুন সিপিএম এক নতুন ফ্রন্টের কথা শুনিয়েছেন তারা — কিন্তু কাজের বেলায় কিছুই হয়নি, তাই পশ্চিমবাংলার বিধানসভার আসন সংখ্যায় সিপিএম আজ তৃতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ ( কংগ্রেস ৪২ সিপিএম ৪০)। বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক পরঞ্জয় গুহ ঠাকুরতা আবারো বলছেন বামশক্তিতে আত্মবিশ্লেষণ বা আত্মশুদ্ধি বা আত্মসমালোচনার মধ্য দিয়ে ভবিষ্যতের পথ ঠিক করতে হবে। জানি না সত্যিই সেই পথে যাবে কি না বামফ্রন্ট। কিন্তু পরঞ্জয় গুহ ঠাকুরতা আমার একটি মনের কথা বলেছেন, ভারতের স্বাধীনতা লাভের ছয় দশক পার করেও সিপিএম তথা বামফ্রন্ট শুধু কেরালা, পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা আঁকড়ে কেন বসে রইল?
পরঞ্জয় গুহ ঠাকুরতার সাক্ষাৎকারটি দেখুন ও সাক্ষাৎকারের ট্রান্সক্রিপ্ট পড়ুন এখানে।
মাসুদ করিম - ৬ অক্টোবর ২০১২ (৬:২৫ অপরাহ্ণ)
সাম্রাজ্যবাদের ভয় পশ্চিমবঙ্গের দেয়াল থেকে আর গেল না। কমিউনিস্টদের বিদায়ের পর তৃণমূলের ঘরেও সেই সাম্রাজ্যবাদের ভয়। পশ্চিমবঙ্গের পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী তৃণমূলের ফিরহাদ হাকিম বলেছেন
সেই একই পশ্চিমবঙ্গীয় সুর, মুখে মারি বিশ্ব! আলোচনাহীন, ভাবনাহীন, কুয়োবাদী উদারতার গলাবাজি।
মাসুদ করিম - ২১ এপ্রিল ২০১৩ (১২:৪০ অপরাহ্ণ)
মাসুদ করিম - ২৫ এপ্রিল ২০১৩ (১০:০০ পূর্বাহ্ণ)
মাসুদ করিম - ২৪ আগস্ট ২০১৩ (৫:০৯ অপরাহ্ণ)
মমতা, তিনি মজা করে বলেন, ‘আমি জিজিটিটি’ — ‘যখন যেমন তখন তেমন’ ব্যাখ্যা করেও বলেন। ঠিকই আছে, তিনি চলছেন তার পথে কার কী বলার আছে!
মাসুদ করিম - ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪ (১০:২৬ পূর্বাহ্ণ)
মাসুদ করিম - ২১ অক্টোবর ২০১৪ (২:২০ অপরাহ্ণ)