এটা তো একটা বড় আক্ষেপ যে আমরা এপার বাংলা ওপার বাংলা আসাম ও ত্রিপুরার বাঙালিরা বাংলা বছরের প্রথম দিন একই দিনে পালন করতে পারি না। বাংলাদেশে আজকে হলে তার পরদিন সাধারণত পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরায় বাংলা নববর্ষ পালিত হয়। শহীদুল্লাহর পঞ্জিকা সংস্কার বাংলাদেশে চালু করা হলেও মেঘনাদ সাহার পঞ্জিকা সংস্কার এখনো পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরায় চালু করা হয়নি।
১৯১৯ সালের মে মাসে রাণু অধিকারী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিনে একটা রুমাল বানিয়ে উপহার হিসেবে পাঠান এবং তার সাথে এই চিঠিটি পাওয়া যায়।
আমার ভানুদাদা,
আমি আপনার জন্মদিনের জন্য একটা রুমাল বানিয়েছি। সেই রুমালটার সারাটাই আমি নিজেই বানিয়েছি। তাতে আপনার নামও লিখেছি। আশাদের ইস্কুলে একটা পার্শী মেয়ে পড়ে। তার নাম হোমাই। আমি তার কাছে বানাতে শিখে এই রুমালটা বানিয়েছি। এইটে যদি আপনার জন্মদিনের দিন পৌঁছোয় তো কি মজা হয়। আর শুনুন। এই রুমালটা নিশ্চয় আপনার জন্মদিনের সারাদিইন পকেটে কোরে রাখবেন। যদি না রাখেন তো আপনার সঙ্গে জন্মের মতন আড়ি। বুঝলেন। আপনার নিশ্চয় খুব আনন্দ হচ্ছে। জন্মদিন কিনা। আমি তো জন্মদিনে সারা দিনই লাফিয়ে বেড়াই। আপনি তা বলে লাফাবেন না যেন। বুকে বড় স্ট্রেন লাগবে। আমি যদি আপনার কাছে থাকতাম তো আপনাকে এমন সুন্দর তো আপনাকে এমন চমৎকার করে সাজিয়ে দিতাম। আপনি নিজের রূপ দেখে মুগ্ধ হোয়ে যেতেন। আপনাকে সাজিয়ে গুজিয়ে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিতাম। আমি যখন আপনার প্রাইভেট সেক্রেটারী হব তখন আপনাকে জন্মদিনের দিন পৃথিবীর মধ্যে সুন্দর কোরে সাজিয়ে দেব। আর সেদিন মীরাকে বলে দেবেন পরমোন্ন করতে। জন্মদিনের দিন পরমোন্ন না খেলে পাপ হয়। আমরা শিগ্গিরিই ‘সোলানে’ যাব। সেখানে গিয়ে আপনাকে আমি ঠিকানা দেব। আমি বৈতালিক পেয়েছি আর খুব খুসী হয়েছি।
রাণু।।
আপনার জন্মদিনে আপনাকে প্রণাম কচ্ছি।।
রাণু।
রবীন্দ্রনাথ রাণুকে এই চিঠির উত্তরে ৭ মে ১৯১৯ সালে শান্তিনিকেতন থেকে লিখেছেন।
কল্যাণীয়াসু
রাণু ইংরেজি মতে আজ আমার জন্মদিনের পরের দিন, বাংলা মতে আগের দিন। আমার আসল জন্মদিনে ইংরেজি তারিখ ছিল ৬ মে, বাংলা তারিখ ছিল ২৫শে বৈশাখ। তখনকার পঞ্জিকায় দুটিতে বেশ ভাবসাব করে একত্রেই থাকত। কিন্তু তার পরে আজকাল দেখি সেই ইংরেজি তারিখে বাংলা তারিখে ঝগড়া বেধে গেছে, তাদের মুখ দেখাদেখি বন্ধ। এটা কি ভাল হচ্চে? যাই হোক তোমার রুমালটি বৃদ্ধিপূর্ব্বক সেই দুটো দিনের মাঝখানে এসে সেই ঝগড়াটে তারিখ দুটোকে সখ্যবন্ধনে বাঁধবার চেষ্টা করেচে। সে চেষ্টা সফল হোক আর না হোক রুমালটি আমার পকেটের ভিতরে দিব্যি গুছিয়ে বসেচে। জন্মদিনের সারাদিন এই রুমালটি আমার পকেটে রাখতে বলেচ – কিন্তু দেখ, তার পকেট-বাসের মেয়াদ অনেক বেড়ে গেল। কাল পরমান্ন খাব – সাজ সজ্জা করবারও চেষ্টা করব কিন্তু এ সম্বন্ধে আমার না আছে বিদ্যা না আছে উপকরণ। বর্তমানে যিনি আমার প্রাইভেট সেক্রেটারি, তিনি যদিচ কেমব্রিজ য়ুনিভার্সিটিতে ডিগ্রি পেয়েচেন কিন্তু চুল আঁচড়ে দিতে একেবারেই পারেন না। এই সব দেখে তাঁর উপরে আমার শ্রদ্ধা একবারেই চলে গেছে। অতএব এখন থেকে ন বছর কয় মাস আমার সাজটা অসম্পন্নই থেকে যাবে। দশটা জন্মদিন বই ত নয় – সবুরে সইবে। কিন্তু দেখো, কলেজে ডিগ্রি নিতে নিতে তুমি যেন চুল আঁচড়াবার বিদ্যা ভুলে গিয়ে এন্ড্রুজ সাহেবের মতো হয়ে যেয়ো না, এই চিঠি জুড়ে আমার আশীর্ব্বাদ রইল। ইতি ২৪ বৈশাখ ১৩২৬
তোমার ভানুদাদা
এবছর পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরায় ২৫শে বৈশাখ পালিত হবে ৯ মে আর বাংলাদেশে প্রত্যেক বছর ২৫ শে বৈশাখ পালিত হয় ৮ মে। রবীন্দ্রনাথের সেই জন্মের ৬ মে আর ফিরিয়ে দেয়া যাবে না, কিন্তু ওই পহেলা বৈশাখের মতো পঁচিশে বৈশাখও যদি সব বাঙালির একই দিনে পালন করতে হয় তাহলে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরায় পঞ্জিকা সংস্কার ছাড়া কোনো গতি নেই। আমরা চাই রবীন্দ্রনাথের ১৫০তম বর্ষপূর্তিতে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরায় বাংলা পঞ্জিকা সংস্কারের কঠিন নীতিগত সিদ্ধান্তটি হয়ে যাক। যেরকম রবীন্দ্রনাথের ১০০তম বর্ষপূর্তিতে আমরা এই বাংলাদেশের মানুষ পাকিস্তানের মতো বৈরী পরিবেশেও রবীন্দ্র শতবার্ষিকী সম্ভব করার আরো কঠিন সংগ্রামে জয়ী হয়েছিলাম।
আমার আরো রবীন্দ্রনাথ : চীনে অপমানিত রবীন্দ্রনাথ, অহিফেন ঠাকুর, মুখের কথা লেখা, উপন্যাস : যোগাযোগ, রবীন্দ্রনাথ।
লেখক। যদিও তার মৃত্যু হয়েছে। পাঠক। যেহেতু সে পুনর্জন্ম ঘটাতে পারে। সমালোচক। কারণ জীবন ধারন তাই করে তোলে আমাদের। আমার টুইট অনুসরণ করুন, আমার টুইট আমাকে বুঝতে অবদান রাখে। নিচের আইকনগুলো দিতে পারে আমার সাথে যোগাযোগের, আমাকে পাঠের ও আমাকে অনুসরণের একগুচ্ছ মাধ্যম।
