তখনকার পঞ্জিকায় দুটিতে বেশ ভাবসাব করে একত্রেই থাকত। কিন্তু তার পরে আজকাল দেখি সেই ইংরেজি তারিখে বাংলা তারিখে ঝগড়া বেধে গেছে, তাদের মুখ দেখাদেখি বন্ধ। এটা কি ভাল হচ্চে?[...]

এটা তো একটা বড় আক্ষেপ যে আমরা এপার বাংলা ওপার বাংলা আসাম ও ত্রিপুরার বাঙালিরা বাংলা বছরের প্রথম দিন একই দিনে পালন করতে পারি না। বাংলাদেশে আজকে হলে তার পরদিন সাধারণত পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরায় বাংলা নববর্ষ পালিত হয়। শহীদুল্লাহর পঞ্জিকা সংস্কার বাংলাদেশে চালু করা হলেও মেঘনাদ সাহার পঞ্জিকা সংস্কার এখনো পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরায় চালু করা হয়নি

১৯১৯ সালের মে মাসে রাণু অধিকারী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিনে একটা রুমাল বানিয়ে উপহার হিসেবে পাঠান এবং তার সাথে এই চিঠিটি পাওয়া যায়।

আমার ভানুদাদা,
আমি আপনার জন্মদিনের জন্য একটা রুমাল বানিয়েছি। সেই রুমালটার সারাটাই আমি নিজেই বানিয়েছি। তাতে আপনার নামও লিখেছি। আশাদের ইস্কুলে একটা পার্শী মেয়ে পড়ে। তার নাম হোমাই। আমি তার কাছে বানাতে শিখে এই রুমালটা বানিয়েছি। এইটে যদি আপনার জন্মদিনের দিন পৌঁছোয় তো কি মজা হয়। আর শুনুন। এই রুমালটা নিশ্চয় আপনার জন্মদিনের সারাদিইন পকেটে কোরে রাখবেন। যদি না রাখেন তো আপনার সঙ্গে জন্মের মতন আড়ি। বুঝলেন। আপনার নিশ্চয় খুব আনন্দ হচ্ছে। জন্মদিন কিনা। আমি তো জন্মদিনে সারা দিনই লাফিয়ে বেড়াই। আপনি তা বলে লাফাবেন না যেন। বুকে বড় স্ট্রেন লাগবে। আমি যদি আপনার কাছে থাকতাম তো আপনাকে এমন সুন্দর তো আপনাকে এমন চমৎকার করে সাজিয়ে দিতাম। আপনি নিজের রূপ দেখে মুগ্ধ হোয়ে যেতেন। আপনাকে সাজিয়ে গুজিয়ে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিতাম। আমি যখন আপনার প্রাইভেট সেক্রেটারী হব তখন আপনাকে জন্মদিনের দিন পৃথিবীর মধ্যে সুন্দর কোরে সাজিয়ে দেব। আর সেদিন মীরাকে বলে দেবেন পরমোন্ন করতে। জন্মদিনের দিন পরমোন্ন না খেলে পাপ হয়। আমরা শিগ্গিরিই ‘সোলানে’ যাব। সেখানে গিয়ে আপনাকে আমি ঠিকানা দেব। আমি বৈতালিক পেয়েছি আর খুব খুসী হয়েছি।
রাণু।।
আপনার জন্মদিনে আপনাকে প্রণাম কচ্ছি।।
রাণু।

রবীন্দ্রনাথ রাণুকে এই চিঠির উত্তরে ৭ মে ১৯১৯ সালে শান্তিনিকেতন থেকে লিখেছেন।

কল্যাণীয়াসু
রাণু ইংরেজি মতে আজ আমার জন্মদিনের পরের দিন, বাংলা মতে আগের দিন। আমার আসল জন্মদিনে ইংরেজি তারিখ ছিল ৬ মে, বাংলা তারিখ ছিল ২৫শে বৈশাখ। তখনকার পঞ্জিকায় দুটিতে বেশ ভাবসাব করে একত্রেই থাকত। কিন্তু তার পরে আজকাল দেখি সেই ইংরেজি তারিখে বাংলা তারিখে ঝগড়া বেধে গেছে, তাদের মুখ দেখাদেখি বন্ধ। এটা কি ভাল হচ্চে? যাই হোক তোমার রুমালটি বৃদ্ধিপূর্ব্বক সেই দুটো দিনের মাঝখানে এসে সেই ঝগড়াটে তারিখ দুটোকে সখ্যবন্ধনে বাঁধবার চেষ্টা করেচে। সে চেষ্টা সফল হোক আর না হোক রুমালটি আমার পকেটের ভিতরে দিব্যি গুছিয়ে বসেচে। জন্মদিনের সারাদিন এই রুমালটি আমার পকেটে রাখতে বলেচ – কিন্তু দেখ, তার পকেট-বাসের মেয়াদ অনেক বেড়ে গেল। কাল পরমান্ন খাব – সাজ সজ্জা করবারও চেষ্টা করব কিন্তু এ সম্বন্ধে আমার না আছে বিদ্যা না আছে উপকরণ। বর্তমানে যিনি আমার প্রাইভেট সেক্রেটারি, তিনি যদিচ কেমব্রিজ য়ুনিভার্সিটিতে ডিগ্রি পেয়েচেন কিন্তু চুল আঁচড়ে দিতে একেবারেই পারেন না। এই সব দেখে তাঁর উপরে আমার শ্রদ্ধা একবারেই চলে গেছে। অতএব এখন থেকে ন বছর কয় মাস আমার সাজটা অসম্পন্নই থেকে যাবে। দশটা জন্মদিন বই ত নয় – সবুরে সইবে। কিন্তু দেখো, কলেজে ডিগ্রি নিতে নিতে তুমি যেন চুল আঁচড়াবার বিদ্যা ভুলে গিয়ে এন্ড্রুজ সাহেবের মতো হয়ে যেয়ো না, এই চিঠি জুড়ে আমার আশীর্ব্বাদ রইল। ইতি ২৪ বৈশাখ ১৩২৬
তোমার ভানুদাদা

এবছর পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরায় ২৫শে বৈশাখ পালিত হবে ৯ মে আর বাংলাদেশে প্রত্যেক বছর ২৫ শে বৈশাখ পালিত হয় ৮ মে। রবীন্দ্রনাথের সেই জন্মের ৬ মে আর ফিরিয়ে দেয়া যাবে না, কিন্তু ওই পহেলা বৈশাখের মতো পঁচিশে বৈশাখও যদি সব বাঙালির একই দিনে পালন করতে হয় তাহলে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরায় পঞ্জিকা সংস্কার ছাড়া কোনো গতি নেই। আমরা চাই রবীন্দ্রনাথের ১৫০তম বর্ষপূর্তিতে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরায় বাংলা পঞ্জিকা সংস্কারের কঠিন নীতিগত সিদ্ধান্তটি হয়ে যাক। যেরকম রবীন্দ্রনাথের ১০০তম বর্ষপূর্তিতে আমরা এই বাংলাদেশের মানুষ পাকিস্তানের মতো বৈরী পরিবেশেও রবীন্দ্র শতবার্ষিকী সম্ভব করার আরো কঠিন সংগ্রামে জয়ী হয়েছিলাম।

আমার আরো রবীন্দ্রনাথ : চীনে অপমানিত রবীন্দ্রনাথ, অহিফেন ঠাকুর, মুখের কথা লেখা, উপন্যাস : যোগাযোগ, রবীন্দ্রনাথ

মাসুদ করিম

লেখক। যদিও তার মৃত্যু হয়েছে। পাঠক। যেহেতু সে পুনর্জন্ম ঘটাতে পারে। সমালোচক। কারণ জীবন ধারন তাই করে তোলে আমাদের। আমার টুইট অনুসরণ করুন, আমার টুইট আমাকে বুঝতে অবদান রাখে। নিচের আইকনগুলো দিতে পারে আমার সাথে যোগাযোগের, আমাকে পাঠের ও আমাকে অনুসরণের একগুচ্ছ মাধ্যম।

৩ comments

  1. Pingback: মুক্তাঙ্গন | রবীন্দ্রনাথ | মাসুদ করিম

  2. মাসুদ করিম - ১৭ এপ্রিল ২০১৮ (৮:৫৮ অপরাহ্ণ)

    বাংলা সনের ইতিকথা

    বর্তমান বাংলা পঞ্জিকা দক্ষিণ এশিয়ায় হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসা একটি ফসলি পঞ্জিকা এবং নাক্ষত্রীয় পঞ্জিকা। এর প্রথম দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত সময়ে রয়েছে বাংলার তিনটি ফসল মৌসুম, যথা— আউশ, আমন ও রবি। বাংলা পঞ্জিকার বছরকে চার মাস ধরে ভাগ করে সহজেই এ ফসল মৌসুমগুলো চিহ্নিত করা যায়। ব্যবসায়ীরা এ পঞ্জিকার প্রথম দিন পহেলা বৈশাখে হালখাতা করেন নববর্ষ হিসেবে, শেষ দিন ব্যবসায়িক লেনদেনের হিসাব বন্ধ করেন এবং চৈত্রসংক্রান্তি হিসেবে সারা বাংলায় যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে পালিত হওয়ায় এটি আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। লক্ষণীয়, ফসলি পঞ্জিকার প্রথম দিনে নববর্ষ পালনের ঐতিহ্য দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কম্বোডিয়া, লাওস, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, মালয়, সুমাত্রা, শ্রীলংকা এবং তামিলনাড়ু, অন্ধ্র প্রদেশ, কেরালা, ওড়িশা, বিহার, আসামসহ সারা উত্তর ও উত্তর-পূর্ব ভারত, নেপাল, পাঞ্জাব ও কাশ্মীর ইত্যাদি স্থানেও রয়েছে। এ বিশাল অঞ্চলটি মৌসুমি বায়ু প্রভাবিত বিধায় ধারণা করা যায়, সুদূর অতীত থেকেই এ অঞ্চলে ফসলি পঞ্জিকা বিরাজ করছে।

    দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জনগণ মূলত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। রাজা অশোকের সময় থেকে শুরু করে খ্রিস্টীয় প্রথম সহস্রাব্দে এসব দেশে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার ঘটে। বাংলায়ও ওই সময়ে বৌদ্ধ ধর্ম ছিল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যে সনটি প্রচলিত রয়েছে (বুদ্ধাব্দ), তার বয়স বর্তমানে ২ হাজার ৫৬১ বছর। এটি ৫৪৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গৌতম বুদ্ধের যুবরাজ পদে রাজ্যাভিষেকের বছর ধরে গণনা করা হয়। রাজা অশোকের সিংহাসন আরোহণের সময় ২৭৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ ধরেও একটি সন গণনা ছিল। এই উভয় সনই সৌরপঞ্জিকা। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সৌরপঞ্জিকার ভিত্তিতে আরো যেসব সন প্রচলিত ছিল বলে জানা যায়, সেগুলোর মধ্যে নেপালি ৫৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে (নেপালি বিক্রমাব্দ), শকাব্দ ৭৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে, গুপ্তাব্দ ৩১৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে, বিক্রমাব্দ ৩৮৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে, হর্ষাব্দ ৬০৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে, ত্রিপুরাব্দ ৫৯০ খ্রিস্টাব্দ থেকে, মাঘী ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে, বিষ্ণুপুরী মলাব্দ ৬৯৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে, পালাব্দ ৭৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে, লক্ষ্মণাব্দ ১১৭৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে, চৈতন্যাব্দ ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে গণনা শুরু হয়। ওইসব সন ১২ মাসের হলেও সব সনের নতুন বছর শুরুর দিন ১ বৈশাখ থেকে হতো না। যেমন— শকাব্দ শুরু হতো ১ চৈত্র থেকে।

    প্রকৃতপক্ষে বাংলার সৌরপঞ্জিকাটি একটি অতিপ্রাচীন ঐতিহ্য। অন্য সব রাজার মতোই যারা সিংহাসনে বসেছেন, তারা বছরের যে দিনেই সিংহাসনে বসুন না কেন, ওই বছর থেকে চলতি পঞ্জিকার ভিত্তিতে নতুন করে সন গণনা শুরু করেছেন। তবে বাংলার বর্তমান সন গণনার গোড়ায় আজ থেকে ১ হাজার ৪২৪ বছর আগে পৌঁঁছলে আমরা যে রাজার অভিষেকের বছর পাই, তার নাম শশাঙ্ক। তার নামে কোনো সন প্রচলনের নিদর্শন নেই। বাংলা পঞ্জিকা নিয়ে নানা ধরনের বিতর্ক আছে, যেমন— কারা এ পঞ্জিকাটি উদ্ভাবন করেছেন, দুই বাংলায় দুদিনে নববর্ষ পালন হয় কেন, বাংলা পঞ্জিকার সংস্কার সঠিক হয়েছে কিনা ইত্যাদি। বাংলা পঞ্জিকার বয়স এখন ১ হাজার ৪২৫ বছরে পড়েছে। এ পঞ্জিকা সম্পর্কে অনেক ঐতিহাসিক বলেন, ইংরেজি ১৫৮৪ সালে মোগল সম্রাট আকবরের সভাসদ আমির ফতেউল্লাহ সিরাজী এর উদ্ভাবন করেন। তারা বলেন, হিজরি সন অনুযায়ী খাজনা আদায়ের অসুবিধা দূর করতে চান্দ্র হিজরি পঞ্জিকাকে সৌরপঞ্জিকায় রূপান্তর করে তিনি বাংলা পঞ্জিকার জন্ম দেন। এ কথাটি অসত্য, কারণ এর সপক্ষে প্রকৃতই কোনো ইতিহাস নেই। আইন-ই-আকবরি থেকে যে ইতিহাস উল্লেখ করা হয়, তা মোটেই বাংলা পঞ্জিকার জন্ম নিয়ে নয়; তা হলো আকবর কর্তৃক ‘ইলাহি সন’-এর জন্ম নিয়ে। প্রকৃত সত্য হলো, বাংলা পঞ্জিকা দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশে হাজার হাজার বছর ধরে প্রচলিত সৌরপঞ্জিকাগুলোরই একটি। মোগল সম্রাট আকবরের সভাসদ ফতেউল্লাহ সিরাজী বাংলা পঞ্জিকা উদ্ভাবন করেননি, বরং তিনি বাংলার সমতলে প্রচলিত বাংলা পঞ্জিকাকে খাজনা আদায়ের বছর হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।
    এ বিষয়ে তথ্য পেতে হলে মূল ফরাসি থেকে এইচ ব্লকমান কর্তৃক অনূদিত আইন-ই-আকবরি গ্রন্থটি পড়ে দেখতে হবে। বাংলা একাডেমি থেকে আহমদ ফজলুর রহমান কর্তৃক এ ইংরেজি গ্রন্থের বিশেষ অংশগুলোর একটি অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে (এপ্রিল ২০০৩)। এ আইন-ই-আকবরি গ্রন্থের মূল লেখক আবুল ফজল আল্লামী তার পুস্তকের দ্বিতীয় খণ্ডে আকবরের সময় প্রচলিত হিন্দু ও হিজরিসহ ২০টি পঞ্জিকার বর্ণনা দিয়েছেন। ওই সময় জনগণের মধ্যে ফসলি সন গণনারও প্রচলন ছিল বলে জানা যায়। বইটির ১২৭ পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে, আকবর তার রাজত্বের ২৯ বছরের প্রারম্ভে ইলাহি সংবৎসরের প্রবর্তন করেন হিজরি ৯৯২ সালের ৮ রবিউল আওয়াল, ১০ মার্চ ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দ। আবুল ফজল আল্লামী রচিত এ গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডের তৃতীয় অধ্যায়ে ইলাহি সন প্রবর্তনের ভূমিকা ও চতুর্থ অধ্যায়ে আকবরের ফরমানের বিবরণ আছে। ওই বিবরণ পড়ে জানা যায়, ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় লক্ষ্মণ সেনের সিংহাসনে আরোহণের ৪৬৫ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে (৪৬৬ লক্ষ্মণাব্দ), দাক্ষিণাত্য ও গুজরাটে শালিবাহনের ১৫০৬ শকাব্দ এবং দিল্লি ও মালওয়াতে ১৬৪১ বিক্রমাব্দ চলছে। ওই অধ্যায়ে বলা হয়, যেহেতু ভারতের সনগুলো সৌর কিন্তু মাসগুলো চান্দ্র, তাই যে পবিত্র ‘ইলাহি সন’ চালু করা হলো, তার মাসগুলোও হবে সৌর। আকবর প্রবর্তিত এ সনের শুরু হয় আকবরের সিংহাসনে আরোহণের বছর ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে এবং মাসগুলো হয় পারসিক মাসের নাম থেকে, যথা— ফারওয়ারদিন, আর্দিবিহিশত, খুরদাদ, তীর, আমুরদাদ, শাহরেয়ার, মিহর, আবান, আজার, দাই, বাহমান ও ইসফানদারমাজ।

    আকবরনামা পড়ে স্পষ্টতই জানা যায়, ওই সময় বাংলার মানুষের জন্য নিজস্ব পঞ্জিকা ছিল। তবে ওই পঞ্জিকায় বছর কবে শুরু হতো, তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। কারণ ‘আইন-ই-আকবরি’ গ্রন্থে শকাব্দের বছর চৈত্র মাস থেকে শুরু দেখা যায়। ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে ১৯৮০ সালে এম আকবর আলী রচিত ‘আল বেরুনি’ নামের একটি পুস্তক প্রকাশিত হয়। ওই পুস্তকের ১০১ পৃষ্ঠায় আল বেরুনির লেখা ‘কিতাবুত তাফহিম’ গ্রন্থ থেকে বলা হয়েছে, চৈত্র মাস থেকে শুরু হিন্দু মাসগুলো ৩০ দিন করে। সৌরবছরের সঙ্গে সামঞ্জস্য আনার জন্য যে মাসকে দুবার গণনা করা হয়, তার নাম অধিমাস। পারসিক বছরটিও সৌর এবং এর বছর শুরুর দিন, যেদিন সূর্য পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধের দিকে যাত্রাপথে বিষুব রেখার উপরে এসে পড়ে (মহাবিষুব)। শকাব্দও একটি ক্রান্তীয় পঞ্জিকা, যার বছর শুরুর দিন মহাবিষুবের দিন থেকে। এটি সাধারণত ২১-২২ মার্চ নাগাদ ঘটে। কিন্তু বাংলা পঞ্জিকার শুরুর দিন হচ্ছে সূর্য তার যাত্রাপথে যেদিন নাক্ষত্রিক মেষ রাশিতে প্রবেশ করে সেদিন থেকে। এটি সাধারণত ১৪/১৫ এপ্রিল নাগাদ ঘটে। বাংলা পঞ্জিকা তাই একটি নাক্ষত্রীয় পঞ্জিকা। আকবরের সময় বাংলায় লক্ষ্মণাব্দ চালু থাকায় বাংলার পঞ্জিকাটি বৈশাখ মাসে শুরু হতো ধারণা করা যায়।

    দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অতীতের অধিকাংশ সৌরসনেরই বছর শুরুর দিন হয় বৈশাখ মাসে, ১০-১৫ এপ্রিলের কাছাকাছি। কোনো রাজার রাজ্যাভিষেকের বছর ধরে যেসব সন গণনা শুরু করা হয়, সেসব বছরে যেদিনই রাজার অভিষেক হোক না কেন, ঐতিহ্যের খাতিরে পঞ্জিকার শুরুর দিন অপরিবর্তিত রাখা হয়। আকবরনামা থেকে জানা যায়, ইলাহি সনের ফরমান জারির সময়ে বাংলায় লক্ষ্মণাব্দ চালু ছিল, যা সৌরবছর ছিল এবং যার বছরের শুরু হতো বৈশাখ মাসে। এতে প্রতীয়মান হয় যে, আমির ফতেউল্লাহ সিরাজী ১৫৮৪ সালে বাংলা অঞ্চলে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যে আগে আরোপিত হিজরি সনের পরিবর্তে ঐতিহ্যগত বাংলা পঞ্জিকা গ্রহণ করেন। এর ফলে বাংলা অঞ্চলে কৃষকদের খাজনা জমা দেয়ার মেয়াদ তিন চান্দ্রমাস ও ১০ দিন বর্ধিত হয়।

    ব্রিটিশ রাজত্বের অবসানের পর সারা দেশের জন্য একটি একই প্রকার পঞ্জিকা প্রণয়নের উদ্দেশ্যে ভারত সরকার ১৯৫২ সালের নভেম্বরে ড. মেঘনাদ সাহার নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে। মেঘনাদ সাহা কমিটি সরকারের কাছে সুপারিশ করে, ১. প্রচলিত নাক্ষত্রীয় পঞ্জিকার পরিবর্তে ক্রান্তীয় পঞ্জিকা চালু করা; ২. বছরের শুরু বৈশাখের পরিবর্তে চৈত্র থেকে শুরু করা; ৩. চৈত্র মাস ছয়-সাতদিন দেরি করে শুরু করা এবং ৪. শকাব্দকে জাতীয় পঞ্জিকা ঘোষণা করা হোক। ভারত সরকার ২২ মার্চ, ১৯৫৭ সালে সাহা কমিটির রিপোর্ট গ্রহণ করে শকাব্দ ভিত্তিতে জাতীয় পঞ্জিকা চালু করে। এ পঞ্জিকার মাসগুলো হয় চৈত্র, বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ ও ফাল্গুন। বৈশাখ থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত ৩১ দিনের এবং অন্যগুলো ৩০ দিনের হয়। খ্রিস্টীয় পঞ্জিকার অধিবর্ষের বছরে চৈত্র মাস ৩১ দিনে হয়। পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে বাংলা পঞ্জিকা সংশোধনের জন্য অনুরূপ একটি কমিটি গঠন করা হয়। বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৭ সালে বাংলা পঞ্জিকার ক্ষেত্রে শহীদুল্লাহ কমিটির সুপারিশ গ্রহণ করে। ১৪ এপ্রিল বছর শুরুর দিন ধার্য করা হয় এবং মাসগুলো সাহা কমিটির ন্যায় বৈশাখ থেকে ভাদ্র ৩১ দিনের এবং অন্যগুলো ৩০ দিনের হয়।

    ভারত ও বাংলাদেশে পঞ্জিকা সংস্কারের নামে যা ঘটেছে, তা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বাংলার সুপণ্ডিত ও নীতিনির্ধারকরা জনগণের ঐতিহ্য তথা বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনা না করে গাণিতিক হিসাব করেছেন এবং জনগণের ওপর তা চাপিয়ে দিতে চেয়েছেন। বিশ্বের সঙ্গে আর্থিক লেনদেনে তাল রাখা এবং দেশে ঋতুভিত্তিক বছর চালু রাখতে বাংলা নাক্ষত্রীয় পঞ্জিকা ক্রান্তীয় পঞ্জিকায় রূপান্তর করা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ঐতিহ্যবাহী নতুন বছর উদযাপনের দিন পাল্টে দিয়ে সাহা কমিটি প্রদত্ত পঞ্জিকাটি জনপ্রিয় করতে পারেনি। ভারতের এ জাতীয় পঞ্জিকা ২০১৫ সালে নরেন্দ্র মোদির সরকার বাদ দিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশ মহান ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির গুরুত্ব অপরিসীম। ওই দিনটি ছিল ৮ ফাল্গুন ১৩৫৮। বাংলাদেশের বর্তমান বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে একুশে ফেব্রুয়ারি ৯ ফাল্গুন হয়। শহীদুল্লাহ কমিটির সুপারিশ বিবেচনাকালে এই যে মারাত্মক পরিবর্তন হয়ে গেল, তা আমাদের নীতিনির্ধারকরা কেন হিসাবে আনেননি?

    আমি বাংলাদেশের বর্তমান বাংলা পঞ্জিকার কিছুটা সংস্কার করে ১ বৈশাখ ১৪ এপ্রিলের পরিবর্তে ১৫ এপ্রিল করতে বলছি। এর ফলে একুশে ফেব্রুয়ারি ৮ ফাল্গুন হবে এবং দুই বাংলার মানুষ একই দিন নববর্ষ উদযাপন করতে পারবে। এ সংশোধিত পঞ্জিকায় নাক্ষত্রিক তিথি সন্নিবেশ করলে অদূর ভবিষ্যতে সারা বাংলায় এ পঞ্জিকাই গৃহীত হতে পারে। আর বাংলা নববর্ষের দিন আমরা যদি সবার মঙ্গল কামনা করতে চাই, তাহলে মঙ্গলযাত্রা করুন আর না করুন, আসুন এই দিন আমরা দু-চারটে দেশীয় গাছের চারা লাগাই। ফ্ল্যাটবাড়িতে থাকলে টবে লাগাই। মাস দুয়েক ওই চারাগুলোকে জল দিয়ে যত্ন করা লাগবে। এরপর বর্ষা এসে গেলে চারাগুলো এমনিতেই টিকে যাবে। ওই গাছগুলো বড় হয়ে গেলে আপনি গর্ববোধ করবেন ও তৃপ্তি পাবেন।

  3. মাসুদ করিম - ১৩ এপ্রিল ২০২৪ (৫:২২ পূর্বাহ্ণ)

    https://twitter.com/urumurum/status/1779000767246188890

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.