আমাদের তৃপ্তি হত তার প্রধান কারণ ওই বস্তুগুলো মানসম্পন্ন উপাদানে ও উপায়েই তৈরি হত।[...]

গ্রামে আমরা মুড়িটা মোয়াটা খইটা চিড়াটা ঘরের যেমন খেতাম বাইরেরও খেতাম। আমাদের মতো গ্রামের গরীব ঘরের যারা ছিলাম তারা তো এসব বাইরেরটা উৎসবে পরবে ঘরেরটার চেয়ে উৎসাহ নিয়ে খেতাম। সেশুধু দূরের বাদ্য মধুর শোনায় এই কারণে নয়, ঘরের চেয়ে বাইরের মুড়িটা মোয়াটা খইটা চিড়াটা আরো তৃপ্তিদায়ক ছিল – কারণ গরীব ঘরের উপকরণ তো অত ভাল ছিল না, আর গরীব ঘরের মা-দাদির হাতে অন্য আরো অনেক সাংসারিক কাজ সেরে এসব ভাল করে বানানোর মতো সময় দেয়াও কঠিন ছিল। তো এই বাইরের খেয়ে (যা উৎসব পরব ছাড়া জোটার প্রশ্নই আসে না, আমাদের হাতে কিছু পয়সা শুধু এসময়েই উঠত) যে আমাদের তৃপ্তি হত তার প্রধান কারণ ওই বস্তুগুলো মানসম্পন্ন উপাদানে ও উপায়েই তৈরি হত। সেই সহজ গ্রামীন জীবনে এনিয়ে আজকের মতো ম্যাজিস্ট্রেট ও মাননিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তাদের ছোটাছুটি করতে হত না।

এই গরীব ঘরের একমাত্র পুত্রসন্তান, আমার বাবার অক্লান্ত পরিশ্রম ও তার প্রতিষ্ঠিত বাণিজ্যের প্রসারলাভের ফলে একদিন ওই গ্রাম ছেড়ে আমরা চট্টগ্রাম শহরে বসবাস করতে শুরু করি। শহরে এসেও বাইরের হাতে বানানো ও কারখানায় বানানো খাবারে তৃপ্তি অব্যাহত ছিল। আশির দশকের মিমি চকলেট, রাস্তায় বিক্রি হওয়া কুলফি, ললিপপ, আচার মান সম্পন্ন ছিল। এছাড়া ফুটবল, র‌্যাকেট, ব্যাট, বল, ব্যান্ড এসব হয়তো এখনকার মতো এত অঢেল ছিল না কিন্তু গুণেমানে আজকের চেয়ে অনেক ভাল ছিল। আমি অতীতের গুণগান করছি না, আমি আজো উপরে উল্লেখিত প্রতিটি জিনিসের ভোক্তা – তাই বলছি মানের প্রশ্নে আমরা অনেক নিচে নেমে গেছি, আমাদের দেশে তৈরি বিদেশে তৈরি প্রতিটি কুটির ও শিল্পবস্তুতে আমরা ন্যাক্কারজনকভাবে উল্টো পথের যাত্রী হয়ে উঠেছি। একটি প্রচলিত কথা আছে, দশচক্রে ভগবান ভূত – তাই কোটি হাতে শিল্প ও বাণিজ্যে ভেজাল হওয়া খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু এটাই তো শেষ কথা নয়, যেসব দেশ শিল্প ও বাণিজ্যে উন্নত তারা কিন্তু মানের অবনমন ঘটায়নি, তারা মাননিয়ন্ত্রণে তাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। তারা বুঝতে পেরেছে গ্রামের সমাজে যা স্বতস্ফূর্ত তাকে মেট্রোপলিটন সমাজে অব্যাহত রাখতে হলে মাননিয়ন্ত্রণের সজাগ দৃষ্টি ও সংকল্প নিয়ে একদল লোকের প্রাতিষ্ঠানিক কাজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেভাবে তারা তাদের বাজারকে শাসন করেছে। আমাদের এখানে এভাবে মাননিয়ন্ত্রণের চেষ্টা দেখা যাচ্ছে না, আমাদের প্রতিষ্ঠান আছে, কিন্তু সেপ্রতিষ্ঠান সজাগ দৃষ্টি ও সংকল্প নির্ভর নয়, আমাদের এই প্রতিষ্ঠান আমাদের আর সব প্রতিষ্ঠানের মতোই, বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো। মাঝে ২০০৭-২০০৮এ সামরিক তৎপরতায় বজ্র আঁটুনির দৌরাত্মে ফস্কা গেরো আর নেই – দড়িটা ছিঁড়েই গেছে।

এখন নতুন সরকার এসে মাননিয়ন্ত্রণের অনেক কলাকৌশল বাতলাচ্ছেন কিন্তু আদতে কর্মক্ষেত্রে জটিলতা হয়রানি অর্থনাশ ও গুরুত্বপূর্ণ শ্রমঘন্টা নষ্ট হওয়া ছাড়া কিছুই হচ্ছে না।

মেট্রোপলিটন জীবনে পণ্যের মাননিয়ন্ত্রণ কঠিন চ্যালেঞ্জ। সরকারের প্রয়োজন কোনো এক বা দুটি দেশকে রোল মডেল করা এবং পরিশ্রমী ও তথ্যসমৃদ্ধ একটি ইউনিট হিসেবে বিএসটিআই (বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এন্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউট) কে গড়ে তোলা। রোল মডেল কারা হতে পারে, অবশ্যই ইউরোপিয়ান কেউ নয়, তার চেয়ে হতে পারে এশিয়ান কেউ, কিন্তু অবশ্যই ভারত বা চীন নয় – মাননিয়ন্ত্রণে দুটি দেশই হতাশাজনকভাবে ব্যর্থ – কিন্তু হতে পারে জাপান, মালেশিয়া ও সিঙ্গাপুর।

আর আমাদের দোকান মার্কেটে ভরে যাওয়া বাজার ও যেনতেনপ্রকারেণ শিল্পপতি কারখানামালিকদেরও ভাবা উচিত মানহীন সামগ্রীতে ধনলাভ হয় ঠিকই কিন্তু সম্মান পেতে মানসম্পন্ন জিনিসই বানাতে ও বেচতে হয়। আমার ছোটবেলার ময়রাপাড়ার ওই মিষ্টি খইমুড়ি যারা তৈরি করত ও বিক্রি করত তাদের যেভাবে সম্মান করতাম আমি আমার চারপাশে তেমন বিক্রেতা ও প্রস্তুতকারকদেরই দেখতে চাই।

মাসুদ করিম

লেখক। যদিও তার মৃত্যু হয়েছে। পাঠক। যেহেতু সে পুনর্জন্ম ঘটাতে পারে। সমালোচক। কারণ জীবন ধারন তাই করে তোলে আমাদের। আমার টুইট অনুসরণ করুন, আমার টুইট আমাকে বুঝতে অবদান রাখে। নিচের আইকনগুলো দিতে পারে আমার সাথে যোগাযোগের, আমাকে পাঠের ও আমাকে অনুসরণের একগুচ্ছ মাধ্যম।

৬ comments

  1. ডাঃ আতিকুল হক - ১৬ অক্টোবর ২০১০ (৬:৪৬ অপরাহ্ণ)

    ধন্যবাদ মাসুদ করিম, এইরকম একটা বিষয়ে লিখার জন্য। আসলেই জাতী হিসেবে কি আমরা ধীরে ধীরে অসম্ভব নির্লিপ্ত হয়ে জাচ্ছি সব কিছুতেই। কোনকিছুই যেনবা মানেসম্মত রাখতে আমাদের সবারই কী দারুন অনীহা। আমি মিরপুর থেকে ধানমন্ডি যাতায়াত করি ৩৬ নং রুটের বাসে। আমি আগে সবাইকেই বলতাম ঢাকা শহরের এই বাসটাই তার সেবার মান ধরে রেখেছে খুব সুন্দরভাবে। কিন্তু হায়! খুব বেশীদিন লাগলনা তার চরিত্র পরিবর্তন করতে। এখন অন্যসব লোকাল বাসের মতই তার সেবার মান। আমি যাত্রীদের দিকে লক্ষ্য করে দেখি কারও কোন মাথাব্যথা নেই এটা নিয়ে। যেন এইসব কিছু মেনে নেওয়াই আমাদের নিয়তি। গতকাল ইচ্ছে করে ৫ টাকা কম ভাড়া দিয়ে বললাম যেমন বাসের সার্ভিস তেমনই ভাড়া পাবে। সেইজন্য আমাকে শুনতে হল বাসের কন্টাকটরের মুখের কিছু অমৃত বাণী,এবং অবাক হয়ে দেখলাম কোন যাত্রী তার কথার কোন প্রতিবাদও করলেন না। এভাবেই কি আমরা নির্লিপ্ত থেকে থেকে ধীরে ধীরে একটা মানহীন জাতিতে রুপান্ররিত হব। কেউ কিছুই করব না?

  2. নুর নবী দুলাল - ১৬ অক্টোবর ২০১০ (৮:৩৬ অপরাহ্ণ)

    মান নিয়ন্ত্রন নিয়ে বাংলাদেশে বিভিন্ন সময় অনেক লম্প-জম্প পরিলক্ষিত হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। প্রতিটি নির্বাচিত সরকারের সময়ই এ নিয়ে দু’একটি মিটিং-সেমিনার ছাড়া ফলাফল আর তেমন কিছুই নেই। যদি মান নিয়ন্ত্রন নিয়ে বাংলাদেশে কোন প্রাপ্তি খুঁজি, তাহলে মেজিস্ট্রেট রোকন-উদ্দৌলার কিছু সাঁড়াসী অভিযানের কারণে জনগণের মাধ্যে কিছুটা সচেতনতা তৈরী হয়েছিল, আর ১/১১ এর ফকরুদ্দিন সরকারের সময় সেনাবাহিনী জুজু’র ভয়ে মানুষ / ব্যবসায়ী পণ্যের মান-নিয়ন্ত্রনে অভ্যস্থতা হওয়ার ভান করেছিল। মানযোগ্য পণ্য বাজারে বিপনন করা যেমন পন্য উৎপাদকের নৈতিক কর্তব্য, ঠিক তেমনি ভোক্তাদেরও বুঝা উচিৎ মানযোগ্য পণ্য পাওয়াও তাদের সাংবিধানিক অধিকার। ভোক্তা যদি তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে বাজার থেকে পণ্য ক্রয় করে, তা হলে উৎপাদক মানসম্পন্ন পণ্য বাজারজাত করতে বাধ্য। কেননা, উৎপাদকের চেয়ে ভোক্তার সংখ্যা অধিক।

    লেখকের সাথে আমিও সহমত পোষন করছি যে, বর্তমান সরকারও মাননিয়ন্ত্রন নিয়ে অনেক লম্প-জম্প করলেও ফলাফল শূন্য । তবে পণ্যের মাননিয়ন্ত্রনে সরকারের প্রতি লেখকের পরামর্শঃ

    মেট্রোপলিটন জীবনে পণ্যের মাননিয়ন্ত্রণ কঠিন চ্যালেঞ্জ। সরকারের প্রয়োজন কোনো এক বা দুটি দেশকে রোল মডেল করা এবং পরিশ্রমী ও তথ্যসমৃদ্ধ একটি ইউনিট হিসেবে বিএসটিআই (বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এন্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউট) কে গড়ে তোলা। রোল মডেল কারা হতে পারে, অবশ্যই ইউরোপিয়ান কেউ নয়, তার চেয়ে হতে পারে এশিয়ান কেউ, কিন্তু অবশ্যই ভারত বা চীন নয় – মাননিয়ন্ত্রণে দুটি দেশই হতাশাজনকভাবে ব্যর্থ – কিন্তু হতে পারে জাপান, মালেশিয়া ও সিঙ্গাপুর।

    আমি পরিপূর্ণভাবে সমর্থন করছি এবং এর সাথে সাথে বিএসটিআই’কে নির্দ্দিষ্ট নীতিমালার আওতায় একটি শক্তিশালী ও স্বাধীন-স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হবে।

  3. রায়হান রশিদ - ১৮ অক্টোবর ২০১০ (৬:৫৫ পূর্বাহ্ণ)

    ধন্যবাদ মাসুদ ভাই পোস্টটির জন্য।
    নুর নবী দুলালকেও অনেক ধন্যবাদ প্রাসঙ্গিক আইনটি সবার সাথে শেয়ার করার জন্য (মন্তব্য#২.১ দ্রষ্টব্য)। প্রায় এক দশক আগে ক্যাব (CAB – Consumers’ Association of Bangladesh) নামের একটি সংগঠন সক্রিয় ছিল বাংলাদেশে, ভোক্তাদের অধিকার বিষয়ে সচেতনতা তৈরীর লক্ষ্যে। সংগঠনটি কি এখনো সক্রিয়? কেউ কি জানাতে পারেন? অথবা আর কোন্ কোন্ সংগঠন বা মোর্চা বর্তমানে এই ক্ষেত্রটিতে সক্রিয়? কারও জানা আছে?

    • নুর নবী দুলাল - ১৮ অক্টোবর ২০১০ (১:৩৯ অপরাহ্ণ)

      @রায়হান রশীদ,
      CAB নামের সংগঠনটির অস্তিত্ব এখনো আছে। ক্যাব ঢাকাতে মাঝে মধ্যে দু’একটি কর্মসূচীর মাধ্যমে টিকে আছে। CAB-এর শাখা সংগঠন হিসাবে একসময় চট্টগ্রামে এর ব্যাপক কর্মসূচী পরিলক্ষিত হয়েছিল। এখনো মাঝে মধ্যে দু’একটি সেমিনার এর আয়োজন করে থাকে। চট্টগ্রাম ক্যাব-এর আমিও একজন সদস্য। আসলে যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে ক্যাব তার সঠিক ভূমিকা পালন করতে পারছে না বলে আমি মনে করি। CAB ইচ্ছে করলে ভোক্তাদের মাঝে মানসম্পন্ন পণ্য ক্রয়ে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি করতে পারে।

  4. মাসুদ করিম - ২৬ জুন ২০১৩ (৬:০২ অপরাহ্ণ)

    খাঁটি, নিখুঁত, মানসম্পন্ন, সেরা, বাজারের সেরা, ক্ষতিকর পদার্থ মুক্ত … এসব শব্দ বিজ্ঞাপনে নিষিদ্ধ করে দেয়া হোক। কোনো বিজ্ঞাপনে এসব শব্দ দেখা গেলেই মান নিয়ন্ত্রণ সংস্থার কাছে ওই পণ্যের মানের সার্টিফিকেট তলব করা হোক। এসব কাজের জন্য বিজ্ঞাপনের বিভিন্ন দিক দেখার জন্য রেগুলটরি বোর্ড গড়ে তোলা হোক। প্রথমে এসব ‘মান’ বিষয়ক প্রশ্নে পণ্যনির্মাতা প্রতিষ্ঠান ও বিজ্ঞাপনী সংস্থার কাছ থেকে ব্যাখ্যা দাবি করা হোক। কারণ, এটা যথেষ্টের চেয়ে বেশি হয়ে গেছে, বিজ্ঞাপনে শুধু শুনছি দেখছি সবাই মানসম্পন্ন পণ্য প্রস্তুত করে কিন্তু কাজের বেলায় তো দেখি মানহীন পণ্যে বাজার সয়লাব।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.