মানবপাচার, মাদকপাচার, অস্ত্রপাচার ও অর্থপাচার : কালোবাজারের এই চার ভিত্তি এখনো বহাল তবিয়তে থাকলেও, পণ্যপাচারের এক বিশাল অংশ এখন হলুদবাজারের আওতায় চলে এসেছে।[...]

মানবপাচার, মাদকপাচার, অস্ত্রপাচার ও অর্থপাচার : কালোবাজারের এই চার ভিত্তি এখনো বহাল তবিয়তে থাকলেও, পণ্যপাচারের এক বিশাল অংশ এখন হলুদবাজারের আওতায় চলে এসেছে। রাষ্ট্রীয় বাজার ব্যবস্থার বিধি নিষেধ ও উচ্চ করের কারণে যেসব পণ্য বাজারজাত করা অসম্ভব ছিল সেসব পণ্যই কালোবাজারে পাওয়া যেত। এর সাথে সংশ্লিষ্ট চক্রকে আমরা চোরাকারবারি বলতাম। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে গত বিশ বছরে আমাদের চোখের সামনেই আমাদের মতো গরীব বা ভারতের মতো আধাউন্নত দেশগুলোতে কালোবাজারে পণ্যের সমাহার কমতে কমতে হাতে গোনা সুনির্দিষ্ট কিছু পণ্যে স্থিত হয়ে গেছে। ফলে পণ্যপাচারের সাথে জড়িত চক্রগুলোর মধ্যে যারা কালোবাজারের চার ভিত্তিমূলে নিজেদের স্থান করে নিতে পারেনি তারাই আবার আমাদের চোখের সামনেই আস্তে আস্তে তাদের সঞ্চিত পুঁজি নিয়ে ঢুকে পড়েছে আমাদেরই বৈধবাজারগুলোতে। এই বিশাল পুঁজির খুঁটির জোরে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে আমাদের অঞ্চলের অপ্রতিহত হলুদবাজার। এই হলুদবাজার সরকারকে শুল্ককর, ভ্যাট, সম্পূরক কর, আয়কর সবই দিচ্ছে –কিন্তু একজন ক্রেতাকে পণ্যের রাংতায় ভুলিয়ে মানে ও মাপে সম্পূর্ণ ঠকিয়ে আদায় করছে তার কাঙিক্ষত লাভ। আর বৈধবাজারে এতদিন যারা ছিল, অসম প্রতিযোগিতার কবলে পড়ে তাদরেকেও এই হলুদবাজারের ডাকে সামিল হতে হল। এবং নতুন নতুন যারা বাজারে এসেছে তারাও শুরু থেকেই বাজারের নিয়মেই এই হলুদবাজারের অংশ হয়ে গেছে। ফলে চাকচিক্য বেড়েছে, কারণ হলুদবাজার সম্পূর্ণই আকর্ষণনির্ভর, কিন্তু ভেজালে ছেয়ে গেছে সবকিছু, ওদিকে সরকারের রাজস্বও বেড়েছে, কিন্তু এদিকে ক্রেতা কম দামের জিনিস বেশি কিনতে কিনতে কী পরিমাণ অর্থ বাজারে ঢেলে দিচ্ছে সেঅর্থনীতি সম্পূর্ণই তার আয়ত্বের বাইরে। এই হলুদবাজার চারিদিক থেকে ছেয়ে ফেলেছে আমাদের। কোনো পণ্য আজ আর মনকে টানে না, ভেজাল আজ আমাদের নিয়তি। মার্কেটে মার্কেটে সয়লাব আজ আমাদের নাগরিক জীবন।
আরো একজায়গায় কালো আছে কালোর জায়গায়, কিন্তু সেখানেও হলুদবাজার ঢুকে পড়েছে এবং সেবাজার এখন পূর্ণপ্রতিষ্ঠা পেয়েছে। চাকুরির বাজারের কথা বলছি। নিয়োগ, পোস্টিং ও প্রমোশন –এখাতগুলোতে যেপরিমাণ টাকার আদানপ্রদান আজ হচ্ছে তার হিসেব পেলে আমাদের সমাজের নীতিশূণ্যতার যেপরিচয় বেরিয়ে আসবে তাতে আমাদের সবারই, আজ আর প্রশাসন থেকে যে আমরা ভাল কিছু পাচ্ছি না, সেবিষয়ে বিস্ময়বোধ সারাজীবনের জন্য মুছে যাবে।
কালোবাজার চিহ্নিত থাকে, সেবাজার চোর, তাকে আমরা চিনি। প্রতিরোধের মাত্রার উপর কালোবাজার ও ঘুষের ব্যাপ্তি সংকুচিত বা প্রসারিত হতে পারে। কিন্তু যে ভয়ংকর হলুদবাজারের কবলে আজ আমরা আকর্ষিত ও আক্রান্ত, তার ভাগ তো আমাদের সবাইকে কম বেশি নিতে হবেই। হলুদবাজারের আগে একজন একক মানুষ চোরাকারবারি বা ঘুষখোর না হয়েও এবং কালোবাজার থেকে কিছু না কিনে বা কাউকে ঘুষ না দিয়েও জীবনযাপন করতে পারত। কিন্তু আজ এ হলুদবাজারে একজন একক মানুষ কেমন করে এই বাজারের আওতার বাইরে জীবনযাপন করবে?

মাসুদ করিম

লেখক। যদিও তার মৃত্যু হয়েছে। পাঠক। যেহেতু সে পুনর্জন্ম ঘটাতে পারে। সমালোচক। কারণ জীবন ধারন তাই করে তোলে আমাদের। আমার টুইট অনুসরণ করুন, আমার টুইট আমাকে বুঝতে অবদান রাখে। নিচের আইকনগুলো দিতে পারে আমার সাথে যোগাযোগের, আমাকে পাঠের ও আমাকে অনুসরণের একগুচ্ছ মাধ্যম।

৬ comments

  1. সাদা মন - ৬ মার্চ ২০১০ (১১:৫৯ অপরাহ্ণ)

    হলদে বাজারের নীরব ছোবলে আমাদের গোটা সমাজ জীবনটা কখন যে জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে গেছে আমরা নিজেরা কি তা টের পেয়েছি?

  2. রায়হান রশিদ - ৯ মার্চ ২০১০ (৮:০৩ পূর্বাহ্ণ)

    কালোবাজার চিহ্নিত থাকে, সে বাজার চোর, তাকে আমরা চিনি। প্রতিরোধের মাত্রার উপর কালোবাজার ও ঘুষের ব্যাপ্তি সংকুচিত বা প্রসারিত হতে পারে। কিন্তু যে ভয়ংকর হলুদবাজারের কবলে আজ আমরা আকর্ষিত ও আক্রান্ত, তার ভাগ তো আমাদের সবাইকে কম বেশি নিতে হবেই। হলুদবাজারের আগে একজন একক মানুষ চোরাকারবারি বা ঘুষখোর না হয়েও এবং কালোবাজার থেকে কিছু না কিনে বা কাউকে ঘুষ না দিয়েও জীবনযাপন করতে পারত। কিন্তু আজ এ হলুদবাজারে একজন একক মানুষ কেমন করে এই বাজারের আওতার বাইরে জীবনযাপন করবে?

    এর পর মন্তব্য করার আর তেমন সুযোগ থাকে না। শুধু কয়েকটি প্রশ্ন:

    – হলুদবাজারের কথা থাক, কোন বাজারের বাইরেই কি একক মানুষের জীবনযাপন সম্ভব?
    – সকল বাজারের অবশ্যম্ভাবী পরিণতিই হলুদ (কিংবা অন্য কোন বর্ণ) হওয়া নয় তো?
    – হলুদ কি আসলে বাজারে? নাকি আমাদের মস্তিষ্কের ভেতর? (মস্তিষ্কেরও কি জন্ডিস হয়? জানা নেই)। সেখানে হলুদবাজারে একক মানুষ কি কেবলই নিয়ন্ত্রিত ভিকটিম? একইসাথে স্বপ্নদ্রষ্টা, নির্মাতা, গ্রাহক, ভোক্তা এবং রক্ষক নন তো?

  3. বিনয়ভূষণ ধর - ৯ মার্চ ২০১০ (১১:৪৪ পূর্বাহ্ণ)

    @মাসুদ ভাই!
    আমাদের সরকারগুলোর প্রশাসনিক কর্মকর্তারা বেশ কিছুদিন পর পর একেবারে ঢাক-ঢোল বাজিয়ে বাজারে যান পণ্যে ভেজাল আছে কিনা, ওজনে কম দেয়া হয় কিনা ইত্যাদি নানান বিষয় নিয়ে কাজ করতে। কিন্তু তার কিছুদিন পর আবার আগে অবস্হায় ফিরে যায় সবকিছু। এর থেকে আমাদের সহসা মুক্তি মিলবে বলে আমার মনে হয়না। যদি মানুষের ভিতর বড় ধরনের সচেতনতা সৃষ্টি না হয় তাহলে এর থেকে আমাদের পরিত্রান নেই।

    কিন্তু আজ এ হলুদবাজারে একজন একক মানুষ কেমন করে এই বাজারের আওতার বাইরে জীবনযাপন করবে?

    আমার মনে হয় আমাদের সকলকে এই হলুদ বাজারের বাসিন্দা হয়ে থাকতে হবে।

  4. মাসুদ করিম - ২ জানুয়ারি ২০১১ (১০:২৫ অপরাহ্ণ)

    দুর্নীতি প্রসঙ্গে একটা লেখা পড়ছিলাম। শুধু ঘুষ নেয়া, টেন্ডার হাতিয়ে নেয়া, অবৈধ টাকার লেনদেন করাই দুর্নীতি নয়। কিছু লোক সবখানে ক্ষমতার কেন্দ্রে বসে বৈধভাবেই তাদের যা ইচ্ছা তা করে যাচ্ছে এই হল সবচেয়ে বড় দুর্নীতি। হলুদবাজারের মতই বৈধভাবেই সব করলাম কিন্তু ঠিক জায়গায় মানুষকে ভুল জিনিস দিয়ে ঠকালাম।

    Three of these four trends are not unique to India. A widely reported statistic shows that in 1965, CEOs of major corporations in the United States earned 24 times as much as the average worker while in 2005, the same CEO earned 262 times as much as the average worker. Statistics like these are not unique to CEO compensation; the New York Times reports that “In 1982, the top 1 per cent of pop stars, in terms of pay, raked in 26 per cent of concert ticket revenue. In 2003, that top percentage of stars – names like Justin Timberlake, Christina Aguilera or 50 Cent – was taking 56 per cent of the concert pie.”

    The same trends can be seen in media, sports etc. It is clear, especially after the current downturn in the west, that most people believe that such income disparities are unacceptable, even if they are legal. According to my definition of corruption, the prevailing CEO compensation schemes are corrupt practices. Why do CEOs get paid more and more? The answers vary, but the consensus is that companies have globalised and grown larger and wealthier, the top level talent pool is small and there is an incestuous link between those who set the compensation (the boards of companies) and those who nominate the board (often the CEO).

    Many networks spawned by globalisation are eventually controlled by a small group of people who have the density of connections, access to resources and bargaining power to reap inordinately large benefits. Corruption is a global phenomenon that comes from small groups of people having the power to leverage a whole system to their individual benefit.

    This is not a conspiracy; instead the current state of corruption is a natural outcome of the global political economy. However, the power of the small cabal at the top is not god-given or socially mandated, like the feudal societies of medieval Europe. Instead, the emergence of a small group of power centres is an impersonal process, where one set of top dogs can easily be displaced or demoted. There is always someone else to take their place, just as IBM was replaced by Microsoft that was outpaced by Google and so on. The problem is structural rather than individual.

    বিস্তারিত পড়ুন এখানে

  5. মাসুদ করিম - ১৯ এপ্রিল ২০১১ (১:০৪ অপরাহ্ণ)

    এবারের নির্বাচনের টাকা সংগ্রহের নাম করে পশ্চিমবঙ্গের মমতা ব্যানার্জি ছবি বিক্রির এক হলুদবাজার সৃষ্টি করেছেন, তার আঁকা যথেচ্ছ রঙছড়ানো ছবির প্রদর্শনী করে তিনি কয়েক কোটি টাকার ছবি বিক্রি করেছেন। অথচ একজন যথার্থ শিল্পী বিশাল পরিচয় না থাকলে প্রদর্শনী করে ২/১ টি ছবিও বিক্রি করতে পারেন না।

    • মাসুদ করিম - ১১ নভেম্বর ২০১২ (১০:০৯ পূর্বাহ্ণ)

      মমতার আরেকটি হলুদবাজার প্রবণতা জানতে পারলাম আজই, তিনি মুখ্যমন্ত্রীত্বের জন্য নির্ধারিত বেতনভাতা নেন না, তিনি তার জন্য নির্ধারিত সরকারি গাড়িতে চড়েন না। মনে পড়ে গেল বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াও যথন প্রধানমন্ত্রীরে বেতনভাতা না নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন তখন হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন, কারো বেতন লাগে না কারো বেতনে সংসার চলে না। বাজারের ভেতরে থেকে বাজারের উর্ধ্বে উঠে প্রধানমন্ত্রী/মুখ্যমন্ত্রীদের বেতন সংক্রান্ত এরকম সিদ্ধান্ত এটা হলুদবাজার প্রবণতাই — সব ঠিক আছে কালো কিছু হচ্ছে না, কিন্তু এই বাজারে এভাবে একজন চলে কীকরে? এপ্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে হলুদবাজারের ভেতরেই।

      সরকারি বেতন নেন না৷ নেন না ভাতা৷ ব্যবহার করেন না সরকারি গাড়িও৷ মুখ্যমন্ত্রিত্বের দেড় বছরে নজির গড়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ মহাকরণে অভিষেকের পরেই অবশ্য ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, এ রকমটা করতে পারেন৷ কারণ, মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর তত্‍কালীন সাংসদ মমতা লোকসভা থেকেও বেতন নিতেন না৷

      বিস্তারিত পড়ুন এখানে

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.