ছাত্র রা

আমাদের জানা দরকার এই ছাত্রসরকার সরকারের কোথায় কোথায় তাদের আয়ের টাকার ভাগ পৌঁছে দেয়। পৌঁছে অবশ্যই দেয়। আর যদি পৌঁছে না দেয়, সরকারের সতর্ক হওয়া উচিত, কারণ এর অর্থ দাঁড়ায় – কোথাও আছে এক সমান্তরাল সরকার, যার সাথে নিয়মিত চলে ছাত্রসরকারের লেনদেন।[...]

ছাত্ররাই জাতির ভবিষ্যৎ। ছাত্ররা রাজনীতিরও ভবিষ্যৎ। রাজনীতি কি জাতির ভবিষ্যৎ? তাহলে ছাত্র রাজনীতি জাতির ভবিষ্যতের সবকিছু? কিন্তু এখন ছাত্র রাজনীতি উবে গেলে ভবিষ্যতে রাজনীতিও মরে যাবে? রাজনীতি মরে গেলে জাতিও মরে যাবে? মৃত্যু অপরিহার্য। কিন্তু ধর্ম মরেনি, শাসন মরেনি, শোষণ মরেনি : রাজনীতি তাহলে কেন মরবে? মৃত্যু অপরিহার্য নয়, ধর্ম শাসন শোষণ রাজনীতি অমর। কেন? প্রক্রিয়া বড় শক্ত জিনিস।

ছাত্ররাই প্রথম একসাথে চলা। এরাই ঝাঁকে ঝাঁকে চলে। এরাই সংঘবদ্ধতা। তাই এরা রাজনীতির ক্যাডার। এরাই প্রাণভোমরা। কিন্তু জনমত দিনে দিনে ছাত্র রাজনীতির বিরুদ্ধে চলে গেছে। এদিকে জনমত রাজনীতির সপক্ষেও নেই। তাহলে সরকার? ভোট ব্যক্তির অধিকার হিসেবে টিকে আছে। তাই সরকার তৈরি হচ্ছে। ছাত্র রাজনীতির সাথে ব্যক্তির ভোটের সম্পর্ক নেই। তাই বলে ফেলি – ছাত্র রাজনীতি চাই না। রাজনীতি চাই না, এটাও বলি, কিন্তু ভোট দিতে ঠিকই হাজির হয়ে যাই। রাজনীতি আর থাকে না। কিন্তু সরকার থাকে। আর ওদিকে ছাত্ররা কী করে? এরাও আর রাজনীতি করে না। যা করার তাই করে তাদের প্রবল প্রতিনিধিরা ছাত্রসরকার চালায়। এটা নিয়ন্ত্রণ করে ওটা নিয়ন্ত্রণ করে, এখান থেকে খায় ওখান থেকে খায়, একে ধরে নিয়ে যায় ওকে ধরে নিয়ে যায়। তাহলে এই প্রবল ছাত্রসরকারকে কে প্রতিহত করবে? সরকারই করবে। কিন্তু আমরা তো তেমন কিছু দেখতে পাচ্ছি না। তাহলে সরকারের সাথে ছাত্রসরকারের নিয়মিত বোঝাপড়া চলছে। ছাত্রসরকারের অর্জন সরকারের কাছে নিশ্চয়ই পৌঁছে যাচ্ছে। সরকার প্রধান ছাত্রসরকারের দায়িত্ব ছেড়েছেন, কিন্তু সংঘবদ্ধতা তো ছাড়েননি। সংঘং শরণং গচ্ছামি।

শুধু সরকার। তাই শুধু ছাত্রসরকার। আমাদের জানা দরকার এই ছাত্রসরকার সরকারের কোথায় কোথায় তাদের আয়ের টাকার ভাগ পৌঁছে দেয়। পৌঁছে অবশ্যই দেয়। আর যদি পৌঁছে না দেয়, সরকারের সতর্ক হওয়া উচিত, কারণ এর অর্থ দাঁড়ায় – কোথাও আছে এক সমান্তরাল সরকার, যার সাথে নিয়মিত চলে ছাত্রসরকারের লেনদেন। লেনদেন কখনোই গোষ্ঠীহীন নয়, শরণ নিতেই হয়, সংঘং শরণং গচ্ছামি।

রাজনীতিই এর সমাধান। সরকার ছাত্রসরকারের রাশ টেনে রাখতে পারে রাজনীতি। আমাদের রাজনীতি যে নেই তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ আমাদের সরকার ছাত্রসরকারের দাপটেই সবকিছু চলছে। জীবন যাপনে যে পরিমাণ দাপটের নীচে আমাদের বসবাস, যে সংঘবদ্ধ লোলুপতা আমাদের চারপাশ কুরে কুরে খাচ্ছে, তার কাছ থেকে বাঁচতে হলে রাজনীতিকে সরকারের চেয়ে শক্তিশালী হতে হবে। সংঘের শক্তিকে প্রতিহত করার প্রথম ধাক্কা দিতে পারে ছাত্ররাই – সংঘবদ্ধতা নয়, রাজনৈতিক চেতনা : সেখানে যেতে পারে প্রথমে ছাত্ররাই।

মাসুদ করিম

লেখক। যদিও তার মৃত্যু হয়েছে। পাঠক। যেহেতু সে পুনর্জন্ম ঘটাতে পারে। সমালোচক। কারণ জীবন ধারন তাই করে তোলে আমাদের। আমার টুইট অনুসরণ করুন, আমার টুইট আমাকে বুঝতে অবদান রাখে। নিচের আইকনগুলো দিতে পারে আমার সাথে যোগাযোগের, আমাকে পাঠের ও আমাকে অনুসরণের একগুচ্ছ মাধ্যম।

৬ comments

  1. মোহাম্মদ মুনিম - ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (১:৩৫ পূর্বাহ্ণ)

    ছাত্রলীগের এই দশার কথা প্রধানমন্ত্রীও জানেন, মাঠ পর্যায়ের নেতারাও জানেন। কিন্তু তাঁরা কিছুই করবেন না, করবেন না মানে করতে পারবেন না। কারণ, আবার ভোটের সময় বা রাজনীতির মাঠ গরম হলে পলিটিক্যাল শো ডাউনে এদেরই লাগবে। বিএনপি আমলের শেষে লগী বৈঠার যে ব্যাপারটা হলো, সেটা তো ক্যাডার ছাড়া হয় না। দুয়েকটা লাশ না পরলে তো কেউ গা করে না।
    বাংলাদেশের মফস্বলগুলোতে এখন হাজার হাজার কলেজ, এই কলেজগুলো থেকে পাশ করে কোন চাকরী জোটে না, আবার বিএ পাশ করে তো কৃষিকাজও করা যায় না। তারচেয়ে ছাত্রজীবনে টেন্ডারবাজী করে কিছু টাকা জমিয়ে ব্যবসা করা যায়, নাহলে মালয়েশিয়া যাওয়া যায়। খারাপ কিছু তো নয়।
    আমরা আওয়ামী লীগের আগের আমলে বুয়েট থেকে পাশ করলাম। আমাদের সাথে পাশ করলেন ছাত্রলীগের পাঁচ আইবুড়ো নেতা, বংগবন্ধুর নানাবিধ স্বপ্নের বাস্তবায়ন করতে করতে তাঁরা পাশ করতে করতে বয়স তিরিশ পার করে ফেললেন। এবং তার সাথে সাথে আমরা যারা নিয়মিত ছাত্র তারাও আধা আইবুড়ো হয়ে গেলাম। তিরিশ পার হয়ে গেলেতো আর বিসিএস দেয়া যায় না, তাই ঢাকা সিটি কর্পোরেশনে তাঁদের জন্য পাঁচটি পদ তৈরী হয়ে গেলো। সিটি কর্পোরেশনের অফিস বুয়েটের কাছাকাছি হওয়াতে পেশাদার দায়িত্ব পালনের সাথে সাথে তাঁরা বুয়েটের দেখাশোনা করতে লাগলেন।
    আঠারো বছরের নবিন তরুণ বুয়েটে আসে, এক দুই টার্ম মন দিয়ে পড়াশোনা করে, তার পরে জয় বাংলা বা লক্ষ জিয়া ঘরে ঘরে এই জাতীয় স্লোগান দিয়ে মিছিলে যাওয়া শুরু করে। মিছিল শেষে হলের ক্যান্টিনে দল বেঁধে খাওয়া, বিল দেওয়ার বালাই নেই। বিল দিলে আবার নেতা কিসের। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিকাদারদের সাথে কুশল বিনিময়, জিয়া এবং বংগবন্ধুর স্বপ্নের বাস্তবায়নে কত টাকা যাবে, তার রেট তো বাঁধাই আছে। পাশেই যেহেতু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সেখানকার জিয়া আর মুজিব সৈনিকদের সাথে বোঝাপড়ার ব্যাপার আছে। মাঝে মাঝে দল বেঁধে ধানমন্ডিতে ফুল দিতে আর সংসদ ভবনের মাজারে যাওয়া। এই হচ্ছে মোটামুটি রাজনৈতিক কর্মকান্ড। তবে মাসুদ ভাই যেভাবে বলেছেন, এই কর্মকান্ডের মাঝের রাজনীতি নেই, আছে সংঘবদ্ধতা। একমাত্র রাজনীতিই পারে এই সংঘবদ্ধতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে।

  2. মাসুদ করিম - ২১ মার্চ ২০১০ (১০:১৫ পূর্বাহ্ণ)

    আজকের কালের কণ্ঠের খবর:

    ছাত্রলীগের উচ্ছৃঙ্খল কাজে কয়েক মন্ত্রীর ইন্ধন আছে
    নিজস্ব প্রতিবেদক
    ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণহীন কর্মকাণ্ডের পেছনে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সারির কিছু নেতা এবং কয়েকজন মন্ত্রীর ইন্ধন রয়েছে বলে দাবি করেছেন দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ওবায়দুল কাদের। সেই নেতাদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন এই নেতা। তবে তিনি ইন্ধনদাতা নেতাদের নাম জানাতে রাজি হননি।
    আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর থেকে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা সংঘর্ষ, সন্ত্রাস, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, খুন, ভর্তিবাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজিসহ বিতর্কিত কর্মকাণ্ড করেই চলেছে। ছাত্রলীগের এই কর্মকাণ্ডে শিক্ষাঙ্গনের পাশাপাশি সমাজেও অস্থিরতা বিরাজ করছে। ক্ষুণ্ন হচ্ছে সরকারের ভাবমূর্তি।
    ছাত্রলীগের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে কালের কণ্ঠের সঙ্গে আলাপকালে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে জিরো-টলারেন্স দেখানোর কথা বললেও ছাত্রলীগকে থামানো যাচ্ছে না। কারণ কয়েকজন মন্ত্রী, বিভিন্ন পর্যায়ের কিছু নেতা, সেটা জেলা পর্যায়েরও আছেন, আবার কেন্দ্রীয় নেতাও আছেন_যারা ছাত্রলীগকে মদদ দিচ্ছেন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে। এর ফলে বিশৃঙ্খল কর্মকাণ্ডের জন্য গ্রেপ্তার হলেও পরে জামিনে বেরিয়ে আসছে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা। তিনি বলেন, ‘না হলে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ উপেক্ষিত হয় কিভাবে?’
    কাদের বলেন, গুটিকয়েক নেতার কারণে পুরো দল ও সরকার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সুতরাং, এই নেতাদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ, এ ধরনের নেতার সংখ্যা খুব কম।
    দলের পক্ষ থেকে এক সময় ছাত্রলীগের দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন ওবায়দুল কাদের। তাঁর এই মন্তব্যের বিষয়ে জানতে আওয়ামী লীগের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাঁরা এ বিষয়ে কিছু বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

  3. মাসুদ করিম - ২১ জুলাই ২০১০ (১:৩৬ পূর্বাহ্ণ)

    বিডিনিউজ ২৪ ডট কমে ছাত্ররাজনীতি নিয়ে খালিকুজ্জামান ইলিয়াসের মতামত : ছাত্ররাজনীতি: বাগানের সাপ।

    সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যে গোলাগুলি, হল দখল, চারতলা থেকে ছুঁড়ে ফেলা, সবুজ ঘাসের বিছানায় অচেতন হয়ে বিক্ষিপ্তভাবে শুয়ে থাকার ঘটনা ঘটলো তা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়, ছাত্ররাজনীতির একটা ধারাবাহিক উত্তরাধিকার। এই উত্তরাধিকার কর্কটরোগাক্রান্ত এবং সবার স্বার্থেই একে উৎপাটন করতে হবে। ছাত্ররা যত খুশি রাজনীতি করুক কিন্তু সেটা তারা করবে দেশের সচেতন শিক্ষিত সমাজের অংশ হিসেবে, ছাত্র হিসেবে নয়, নয় কোন রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠনের সদস্য হিসেবে। এজন্য প্রথমেই প্রয়োজন খুঁটিতে বাঁধা দড়িটাকে সরিয়ে ফেলা। কিন্তু সরাবেটা কে? বর্তমান সরকার যেহেতু মৌখিকভাবে তাদের অসংগঠনকে পরিত্যাজ্য ঘোষণা করেছে এবং সংসদেও তাদের বিপুল সংখ্যাধিক্য। এই সুযোগে একটা আইন করে কি লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা যায় না? লেজুড়বৃত্তির রাজনীতির বিকল্প হিসেবে যে রাজনীতি বিশ্ববিদ্যালগুলোতে চালু হতে পারে তা হলো বিষয় কিংবা কর্মকান্ডভিত্তিক বিভিন্ন সংগঠনের রাজনীতি। এই সব সংগঠন হবে বহুলাংশে স্বায়ত্বশাসিত, এদের প্রত্যেকের জন্য থাকবে প্রয়োজন মাফিক অর্থ বরাদ্দ; এদের পরিচালনা কমিটি হবে নির্বাচনের মাধ্যমে কিংবা সর্ব সম্মতি ক্রমে, এবং প্রত্যেক সংগঠনের পরামর্শক হিসেবে থাকবেন একজন শিক্ষক। এই সব সংগঠন হতে পারে বিচিত্র বিষয়ক, যেমন সমাজসেবা, সংস্কৃতি, রাজনৈতিক পর্যালোচনা, কম্পিউটার, বিজ্ঞান, নাটক, সিনেমা, আলোকচিত্র ইত্যাদি। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক কার্যক্রম পর্যালোচনা এবং ছাত্রদের বিষয়ে পরামর্শদানের কিংবা হলের ব্যবস্থাপনায় সীমিত আকারে অংশগ্রহণের জন্যও সংগঠন থাকতে পারে। পড়াশোনাকে মুখ্য ভূমিকায় রেখে লেখাপড়ার বাইরে ছাত্রদের এইসব কার্যক্রমে নিয়োজিত রাখলে তারা মোটামুটি দায়িত্বশীল মানুষ হিসেবে ছাত্রত্ব শেষ করে কর্মজীবনে প্রবেশ করতে পারবে। আমার এক স্বনামধন্য শিক্ষক বলতেন বিশ্ববিদ্যালয়ে যে হারে গোলাগুলি, মারপিট হয় তাতে একজন ছাত্র কোনো রকমে বেঁচে জীবন নিয়ে পার হতে পারলেও সেশন জটের কারণে যৌবন নিয়ে বেরুতে পারে না। খুঁটির রাজনীতি যদি উৎপাটন করা যায় তাহলে সে তার জীবন যৌবন জয় নিয়েই বেরুতে পারবে কারণ তখন ভর্তি-বাণিজ্য, টেন্ডারবাজী, চাঁদাবাজী, ফেরেববাজী ইত্যাদির রাজনীতি উৎপাঠিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেবে। ছাত্রত্বের সঙ্গে এই “বাজী” প্রত্যয় নিতান্তই বেমানান। একমাত্র রাজনৈতিক নেতৃত্বের সদিচ্ছা ও শুভ বুদ্ধির জয় হলে এবং শিক্ষক নেতৃত্বেও তা সঞ্চারিত হলে ছাত্র সমাজ এই নষ্ট প্রত্যয় থেকে মুক্ত হতে পারে।

  4. মাসুদ করিম - ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৯ (৪:০২ পূর্বাহ্ণ)

    ছাত্রলীগের পর এবার যুবলীগকে ধরেছি: শেখ হাসিনা

    সরকার যে উন্নয়ন করেছে, তাতে কালিমা লাগাবে, এমন কোনো কর্মকাণ্ড সহ্য করবেন না বলে দল ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদের সাফ জানিয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা।

    ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে পদচ্যুত করার পর যুবলীগের ঢাকার এক নেতাকে গ্রেপ্তারের প্রেক্ষাপটে তিনি বলেছেন, “আমি ছাত্রলীগের পর এখন যুবলীগকে ধরেছি।”

    বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় এবং ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য্যের নেতৃত্বে সংগঠনটির কয়েকজন নেতা গণভবনে দেখা করতে গেলে শেখ হাসিনা তার এই কঠোর মনোভাব প্রকাশ করেন।

    প্রধানমন্ত্রীর উপ প্রেসসচিব হাসান জাহিদ তুষার সাংবাদিকদের বলেন, “উনি বলেছেন, ‘আমি কষ্ট করে দেশের উন্নয়ন করছি, এটার উপর কোনো কালিমা আসুক, সেটা আমি হতে দেব না, আমি কাউকেই ছাড়ব না’।”

    সহযোগী সংগঠন যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাদের নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে বিভিন্ন সময় বিব্রত হতে হয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে।

    সম্প্রতি ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে উন্নয়ন প্রকল্প থেকে চাঁদা দাবির অভিযোগ উঠলে কঠোর মনোভাব দেখান আওয়ামী লীগ সভানেত্রী।

    গত শনিবার আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সংসদের বৈঠকে শেখ হাসিনা তা নিয়ে বিরক্তি প্রকাশের পর পদত্যাগ করেন ছাত্রলীগের দুই শীর্ষনেতা। ওই বৈঠকে যুবলীগের কয়েক নেতার কর্মকাণ্ডেও অসন্তোষ ঝরে তার কণ্ঠে।

    এরপর যুবলীগের নেতাদের জুয়ার আখড়া চালানোর খবর চাউর হওয়ার মধ্যে বুধবার ঢাকায় চারটি ক্যাসিনোতে অভিযান চালায় র‌্যাব। গ্রেপ্তার করা হয় যুবলীগের ঢাকা মহানগরের শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতাকে।

    ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে কথায় প্রধানমন্ত্রী অবৈধ ক্যাসিনো চালানোর প্রসঙ্গও তোলেন।

    তার বরাত দিয়ে হাসান জাহিদ তুষার বলেন, “উনি বলেছেন, ক্যাসিনো নিয়ে মারামারি, খুনোখুনি সহ্য করব না।

    “ক্যাসিনোর সাথে যারা যারা জড়িত, তারা এদেশে কীভাবে আসল? কীভাবে ভিসা পেল? তাদের বেতন কীভাবে দেওয়া হয় ক্রেডিট কার্ডে নাকি ক্যাশে? কে ভিসা দিয়ে আনল, সবকিছু তদন্ত করা হচ্ছে।”

    “সবাইকে ধরা হবে। কাউকেই ছাড়া হবে না,” হুঁশিয়ারি দেন সরকার প্রধান।

    সংগঠনের ভাবমূর্তি ও দেশের ভাবমূর্তি বাড়াতে ছাত্রলীগকে কাজ করার তাগিদ দেন তাদের ‘সাংগঠনিক নেত্রী’ শেখ হাসিনা। সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত সম্মিলিতভাবে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নেওয়ারও পরামর্শ দেন তিনি।

    ছাত্রলীগের নেতাদের উদ্দেশে শেখ হাসিনা বলেছেন, “মোটর সাইকেল নিয়ে চলতে হবে, প্রটোকল নিয়ে চলতে হবে, ক্ষমতার সাথে চলতে হবে, এগুলো করা যাবে না। এগুলো করলে সাময়িকভাবে কিছু টাকা-পয়সা হবে। কিন্তু হারিয়ে যাবে। সেটা হবে দুঃখজনক। এটা আমি তোমাদের কাছে চাই না।”

    ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের কাছে নিজের রাজনৈতিক জীবনের নানা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হওয়ার অভিজ্ঞতাও তুলে ধরেন বঙ্গবন্ধুকন্যা হাসিনা।

    “যত প্রতিকূল অবস্থা আমার জীবনে মোকাবেলা করতে হয়েছে, এটা বাংলাদেশে আর কারও মোকাবেলা করতে হয়নি। আমাকে অনেক অফার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু জীবনে কখনও কম্প্রোমাইজ করিনি।”

    এখনও ষড়যন্ত্র অব্যাহত আছে জানিয়ে ছাত্রলীগ নেতাদের সজাগ থাকার আহ্বানও জানান শেখ হাসিনা।

    মানুষের আস্থা নষ্ট হয়ে যায়, এমন কোনো কাজে যুক্ত না থাকতে ছাত্রলীগ নেতাদের পরামর্শ দেন তিনি।

    “মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসের মূল্য দিতে হবে। পাওয়ারে গিয়ে পাওয়ার শো আপ করা ছাত্রনেতাদের থেকে আশা করি না। তাদের বিনয়ী হতে হবে। সাধারণ মানুষ বিরক্ত হলে সরকার যে সুন্দর পদক্ষেপগুলো নিচ্ছে, সেটা নষ্ট হবে।”

    শেখ হাসিনা বলেন, তার সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রমের কারণে এক সময় বাংলাদেশের সমালোচনা করত যারা, তারাই এখন প্রশংসা করছে।

    যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, “যারা বলেছিল এদেশ বটমলেস বাস্কেট হবে..পাকিস্তান বলেছিল বাংলাদেশে নাকি বোঝা। আজকে তাদের ওখানে আলোচনা হচ্ছে বাংলাদেশে এখন এমন হলো কীভাবে।”

    ছাত্রলীগকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ নিয়ে চলার পরামর্শ দিয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, “সত্যিকারে নীতি-আদর্শ নিয়ে রাজনীতি করলে সংগঠন একটা শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড়াবে। তাহলে মানুষের আস্থা বিশ্বাস ছাত্রলীগের উপর অনেক বাড়বে।”

    ছাত্রলীগ নেতাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “তোমাদের উপর বিশ্বাস-আস্থা নিয়ে দায়িত্ব দিয়েছি। নীতি, আদর্শ, সততা, সংযম নিয়ে রাজনীতি করতে হবে। যদি সেটা না কর, একটি আদর্শ নিয়ে যদি না চল, তাহলে ভবিষ্যতে দেশকে কার কাছে রেখে যাব?”

    বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের মতো আচরণ না করতে ছাত্রলীগের নেতাদের পরামর্শ দেন শেখ হাসিনা।

    “(বিএনপি) সরকারে আসার পর ছাত্রদল যেমন আচরণ করেছিল, তেমন করা যাবে না। সরকারে থাকার সময় যদি ওদের মতো আচরণ করা হয়, তাহলে আমাদের অবস্থাও তাদের মতো হবে।”

    এই সাক্ষাৎ অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক, আব্দুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, বি এম মোজাম্মেল হক উপস্থিত ছিলেন।

  5. Pingback: রাজনৈতিক বিরতি | প্রাত্যহিক পাঠ

  6. মাসুদ করিম - ২৩ মে ২০২৩ (১:৫৬ অপরাহ্ণ)

    ছাত্রলীগের জয়, ছাত্রলীগের ক্ষয়
    শহিদুল ইসলাম
    https://protidinerbangladesh.com/opinion/43858/%E0%A6%9B%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%B2%E0%A7%80%E0%A6%97%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%9C%E0%A7%9F-%E0%A6%9B%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%B2%E0%A7%80%E0%A6%97%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B7%E0%A7%9F

    বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলায় এসএসসি পরীক্ষাকেন্দ্রে কর্মীসভার আয়োজন করে আবার আলোচনায় এসেছে ছাত্রলীগ। ১৮ মে বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা থেকে শুরু হয় সারিয়াকান্দি পাইলট বালিকা উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে জীববিজ্ঞান ও অর্থনীতির পরীক্ষা। পরীক্ষার্থীরা যখন কক্ষের ভেতরে পরীক্ষা দিচ্ছে, তখন ১৪৪ ধারা ভেঙে মঞ্চ ও প্যান্ডেলের সাজসজ্জার কাজ করা হয় বিদ্যালয়ের মাঠে। ছাত্রলীগের বর্তমান এসব কার্যকলাপ দেখে অনেকেই বিস্মিত হন, দুঃখ করেন। আক্ষেপ করে বলেন, ‘এই কি সেই ছাত্রলীগ!’ ১৯৪৮ সালে জন্ম নেওয়া পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের পাকিস্তান আমলের ভূমিকা লক্ষ্য করেই তাদের এই বিস্ময়, আক্ষেপ ও দুঃখ। পাকিস্তানি শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগের যে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা, তা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। পাকিস্তান জন্মের মাত্র এক বছরের মধ্যে যে এমন একটি প্রতিবাদী ছাত্রসংগঠনের জন্ম হবে, তা সত্যিই ছিল অভাবনীয়। ভূমিষ্ঠ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাকে পাকিস্তানি শাসন শোষণের বিরুদ্ধে কোমর বেঁধে দাঁড়াতে হয়। তার চেয়ে এটা বলা বোধহয় সঠিক হবে যে, পাকিস্তানি শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করার উদ্দেশ্যেই ছাত্রলীগের জন্ম। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের নির্বাচন, ১৯৬২ সালের শরীফ শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান ও সর্বশেষ মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রলীগের অসামান্য ভূমিকা ইতিহাসে সোনার অক্ষরে লিখিত আছে। ওই ইতিহাস কারও পক্ষেই মুছে ফেলা সম্ভব নয়।

    কিন্তু স্বাধীনতার পর সমগ্র জাতি সম্পূর্ণ নতুন এক বাস্তবতার সম্মুখীন হয়। সেই সঙ্গে ছাত্রলীগও। কাজেই নতুন উদ্ভূত পরিস্থিতির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ ছাড়া ছাত্রলীগের আজকের অবস্থা বোঝা যাবে না। বিচার করতে হবে পাকিস্তান আমলে ছাত্রলীগ কার বিরোধিতা করেছিল এবং কার পক্ষে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছিল? বাহ্যিকভাবে এ প্রশ্নের উত্তর সহজ। কিন্তু অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে উত্তরটা অত সহজ মনে হবে না। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর পাকিস্তানে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসন-শোষণের অবসান ঘটে। কিন্তু পাকিস্তান নামের আরেকটি শাসন-শোষণের মধ্যে পড়ে দেশটির পূর্ব অংশ পূর্ব পাকিস্তান। ইসলামি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে মুসলিম শাসকরা ব্রিটিশের স্থলাভিসিক্ত হয় মুসলিম লীগ নামের একটি সাম্প্রদায়িক দলের নেতৃত্বে।

    শুরু থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকশ্রেণি পূর্ব পাকিস্তানে আধিপত্য কায়েম করে। পাকিস্তান আমলে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের দ্বন্দ্বই ছিল প্রধান দ্বন্দ্ব। অর্থনীতির ভাষায় বলতে হয়, পশ্চিম পাকিস্তানের বড় পুঁজির সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের ছোট পুঁজির দ্বন্দ্ব। যেকোনো ইতিহাস, অর্থনীতির বই খুললেই দেখা যাবে পাকিস্তানের উভয় অংশের ভয়াবহ বৈষম্যের তথ্য। এ দেশের ছোট বুর্জোয়া শ্রেণি পশ্চিম পাকিস্তানের বড় বুর্জোয়ার অধীন কন্ট্রাক্টর, ব্যবসায়ী ছাড়া অন্য কিছু নয়। পশ্চিমের ধনিকশ্রেণির দয়া-দাক্ষিণ্য ছাড়া তাদের অস্তিত্ব সংকটে পড়তে হতো। পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়ন পরিকল্পনার শিকড় পর্যন্ত ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি বড় বুর্জোয়ার দখলে। স্বভাবতই ওই অবস্থা এ দেশের অধীনস্থ পুঁজিবাদীরা মেনে নিতে পারেননি। তাই এ দেশের ছোট-বড় যেকোনো আন্দোলনে অর্থ জোগান দিতে তারা কখনোই কার্পণ্য করেননি। তারা একে ফজলুল হক, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও সর্বশেষ শেখ মুজিবুর রহমানের হাতকে শক্ত করতে সাধ্যমতো চেষ্টার ত্রুটি করেননি।

    ১৯৬৬ সালের ছয় দফা ঘোষণার পর সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে সভা সমিতি অনুষ্ঠানে তারা আওয়ামী লীগের পাশে ছিলেন। মাত্র চার বছরের মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের অবিসংবাদী নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতি-ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি নির্বিশেষে এ দেশের সব মানুষকে এক ঐক্যবদ্ধ শক্তিতে পরিণত করেন। এই ঐতিহাসিক কাজে তার সবচেয়ে বড় সহায়ক শক্তি ছিল ছাত্রসমাজ, বিশেষ করে ছাত্রলীগ। আমরা সবাই জানি পাকিস্তানি আমলে ছাত্ররাই ছিল সব আন্দোলন- সংগ্রামের পুরোভাগে; বিশেষ করে ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’। ১৯৫৩ সালে ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন’-এর প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তারাও পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ লুন্ঠনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। সমাজতন্ত্রের কথা বললেও ইতিহাস প্রমাণ করে যে তাদের আন্দোলন এ দেশের বুর্জোয়া শ্রেণির হাতকেই শক্তিশালী করেছে। ১৯৬৯ সালে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের সমন্বয়ে গঠিত হয় ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’। শেখ মুজিবুর রহমান তাদের ১১ দফার প্রতি অকুন্ঠ সমর্থন জানান। দেখা যায় ছাত্ররাই ছিল সব আন্দোলন-সংগ্রামের চালিকাশক্তি।

    এ দেশ যতদিন বিদেশি পশ্চিম পাকিস্তানি শক্তির অধীন ছিল, ততদিন ছোট পুঁজির এক প্রগতিশীল চরিত্র ছিল। পশ্চিমের বড় পুঁজির বিরুদ্ধে এ দেশের ছোট পুঁজির লড়াই তাই এ দেশের সর্বস্তরের মানুষের সমর্থন লাভ করে। যদিও সামান্য কিছু মানুষ ও এনএসএফের কিছু ছাত্র পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকশ্রেণির পক্ষাবলম্বন করেছিল। তাদের পেছনে সব সময় সরকারি সমর্থন ছিল। প্রগতিশীল বাঙালি জাতীয়তাবাদের লড়াইয়ে সম্পৃক্ত হয়ে ছাত্রলীগও একটি প্রগতিশীল চরিত্র অর্জন করছিল। এ দেশের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের আন্দোলনের সঙ্গে ছাত্রলীগের আন্দোলন মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। সৃষ্টি হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের মহিমামণ্ডিত ইতিহাস। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর স্বাধীন বাংলাদেশ এক অভূতপূর্ব সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থার সম্মুখীন হয়। মুসলমান বাঙালি এই প্রথম একটি স্বাধীন দেশের শাসন ক্ষমতায় আসীন হয়। ১৯৭২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরে আসেন এবং প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করেন।

    বাহাত্তরেই ছাত্রলীগ দ্বিধাবিভক্ত হয়, সমাজতন্ত্রের স্লোগান মুখে নিয়ে জন্ম হয় জাসদ ছাত্রলীগের। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুজিববাদী ছাত্রলীগের সম্মেলন উদ্বোধন করেন এবং তাঁর সমর্থন জ্ঞাপন করেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মেজর জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সৃষ্টি হয় জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। মেজর জিয়াউর রহমানের হত্যার পর মেজর জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে আরও একটি ছাত্র সংগঠনের জন্ম হয়। ছাত্রসমাজ। লক্ষ করার বিষয়, গণতান্ত্রিক বা সামরিক স্বৈরশাসন নির্বিশেষে সবাই ছাত্রসমাজের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছে এবং ছাত্রসমাজও তাদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে।

    দুই.

    সত্তর সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের প্রচার-প্রচারণায় একটি পোস্টারের কথা মনে করুন। ‘গরুটি ঘাস খাচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানে আর দুধ দুয়ে নিচ্ছে এক হাজার মাইল দূরের পশ্চিম পাকিস্তান’। স্বাধীনতার পর পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষে আর দুধ দুয়ে নেওয়া সম্ভব ছিল না। ভিন্ন জাতির বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর। এ দেশে যদিও ৪৫টি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষ বসবাস করে আসছেন হাজার বছর ধরে, তাদের ধর্তব্যের মধ্যে না নিয়ে দেশটি বাঙালি জাতির দেশ হিসেবে ঘোষিত হয়। তাহলে ওই দুধ কে বা কারা খেল? বিগত একান্ন বছরে প্রমাণ হয়েছে ওই দুধ খেয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের নব উত্থিত ধনিক শ্রেণি। সংখ্যায় তারা অতি নগণ্য। ফেসবুকে কার পোস্টে যেন পড়েছিলাম, পাকিস্তানের ২২ পরিবারের স্থানে বাংলাদেশে বাইশ হাজার পরিবারের জন্ম হয়েছে, যারা বৈধ-অবৈধ পথে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। ১৯৭২ সালে এ দেশে মাত্র দুজন কোটিপতি ছিলেন। যদি বাইশ হাজার কোটিপতি হয়, তাহলে তাদের স্নেহধন্য ও আশীর্বাদপুষ্টদের নিয়ে ওই শ্রেণির সংখ্যা যদি ১০ শতাংশও ধরি, তাহলে ৯০ শতাংশ মানুষ সেই শ্রেণির বাইরেই রয়ে গেছে।

    স্বাধীনতার পর সব সরকারই শুধু নিজেদের নিয়েই ভেবেছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠন বুঝতে চেষ্টা করেনি যে পাকিস্তান আমলে তারা যেসব দলের পেছনে শক্তি জুগিয়ে গেছে, স্বাধীনতার পর তাদের অবস্থান্তর ঘটেছে। পাকিস্তান আমলে তারা শুধু বিরোধী দলের ভূমিকাই পালন করেছে। ১৯৫৬ সালে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য পূর্ব পাকিস্তানে খান আতাউর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার অধিষ্ঠিত ছিল। শেখ মুজিবুর রহমান ওই মন্ত্রিসভার একজন সদস্য ছিলেন। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে তারাই রাষ্ট্র পরিচালনার গুরুদায়িত্ব পালন করেন।

    ছাত্রসমাজের একাংশ ছাত্রলীগের কথা লিখতে বসেছি। গত এক দশকেরও বেশি সময় আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায়। এই সময়ে সরকার অনেক ভালো কাজ করেছে। সে জন্য তারা কৃতিত্ব দাবি করতে পারে, গর্ব করতে পারে। সে গর্বের দাবিদার ছাত্রলীগও। কিন্তু একটি দল দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে যা হয়, তা থেকে আওয়ামী লীগও রক্ষা পায়নি। গত এক দশকেরও বেশি সময়ের ছোটখাটো ভুলগুলো আজ একত্রিত হয়ে সরকারকে কঠিন সমালোচনার সম্মুখীন করেছে। সেগুলো নাকচ করার জন্য সরকার জোর তৎপরতা চালাচ্ছে। রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা দেশে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ঝড় তুলেছে। সরকারের সঙ্গে বাঁধা ছাত্রলীগ সরকারের ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য সামান্য বিরোধিতাও সহ্য করতে পারছে না। তাদের তৎপরতা সরকারের জন্য আরও নাজুক অবস্থার সৃষ্টি করছে। সরকার ক্রমেই বৃহত্তর জনগোষ্ঠী থেকে দূরে চলে যাচ্ছেÑএই অভিযোগ অনেকের। ছাত্রলীগের জয়ের খতিয়ান যেমন অনেক বিস্তৃত তেমনি ক্ষয়ের চিত্রও কম স্ফীত নয়।

    পাকিস্তান আমলে যখন আপামর জনসাধারণের সঙ্গে ছাত্রলীগের মেলবন্ধন ঘটেছিল, তখন জনগণ বিপদে-আপদে ছাত্রদের পাশে দাঁড়িয়েছে। আজ ছাত্রলীগ মাত্র ১০ শতাংশ মানুষের স্বার্থরক্ষার জন্য ৯০ শতাংশ মানুষের বিরাগভাজন হয়ে পড়েছে। স্বাধীনতার পর জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে ভাটা পড়েছে। আজ কোনো বিদেশি শাসক বাংলাদেশকে শোষণ করছে না। বাঙালি জাতিই আজ শত্রু মিত্রে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ আজ শ্রেণি-সংগ্রামের স্তরে উন্নীত হয়েছে।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.