ছাত্ররাই জাতির ভবিষ্যৎ। ছাত্ররা রাজনীতিরও ভবিষ্যৎ। রাজনীতি কি জাতির ভবিষ্যৎ? তাহলে ছাত্র রাজনীতি জাতির ভবিষ্যতের সবকিছু? কিন্তু এখন ছাত্র রাজনীতি উবে গেলে ভবিষ্যতে রাজনীতিও মরে যাবে? রাজনীতি মরে গেলে জাতিও মরে যাবে? মৃত্যু অপরিহার্য। কিন্তু ধর্ম মরেনি, শাসন মরেনি, শোষণ মরেনি : রাজনীতি তাহলে কেন মরবে? মৃত্যু অপরিহার্য নয়, ধর্ম শাসন শোষণ রাজনীতি অমর। কেন? প্রক্রিয়া বড় শক্ত জিনিস।
ছাত্ররাই প্রথম একসাথে চলা। এরাই ঝাঁকে ঝাঁকে চলে। এরাই সংঘবদ্ধতা। তাই এরা রাজনীতির ক্যাডার। এরাই প্রাণভোমরা। কিন্তু জনমত দিনে দিনে ছাত্র রাজনীতির বিরুদ্ধে চলে গেছে। এদিকে জনমত রাজনীতির সপক্ষেও নেই। তাহলে সরকার? ভোট ব্যক্তির অধিকার হিসেবে টিকে আছে। তাই সরকার তৈরি হচ্ছে। ছাত্র রাজনীতির সাথে ব্যক্তির ভোটের সম্পর্ক নেই। তাই বলে ফেলি – ছাত্র রাজনীতি চাই না। রাজনীতি চাই না, এটাও বলি, কিন্তু ভোট দিতে ঠিকই হাজির হয়ে যাই। রাজনীতি আর থাকে না। কিন্তু সরকার থাকে। আর ওদিকে ছাত্ররা কী করে? এরাও আর রাজনীতি করে না। যা করার তাই করে তাদের প্রবল প্রতিনিধিরা ছাত্রসরকার চালায়। এটা নিয়ন্ত্রণ করে ওটা নিয়ন্ত্রণ করে, এখান থেকে খায় ওখান থেকে খায়, একে ধরে নিয়ে যায় ওকে ধরে নিয়ে যায়। তাহলে এই প্রবল ছাত্রসরকারকে কে প্রতিহত করবে? সরকারই করবে। কিন্তু আমরা তো তেমন কিছু দেখতে পাচ্ছি না। তাহলে সরকারের সাথে ছাত্রসরকারের নিয়মিত বোঝাপড়া চলছে। ছাত্রসরকারের অর্জন সরকারের কাছে নিশ্চয়ই পৌঁছে যাচ্ছে। সরকার প্রধান ছাত্রসরকারের দায়িত্ব ছেড়েছেন, কিন্তু সংঘবদ্ধতা তো ছাড়েননি। সংঘং শরণং গচ্ছামি।
শুধু সরকার। তাই শুধু ছাত্রসরকার। আমাদের জানা দরকার এই ছাত্রসরকার সরকারের কোথায় কোথায় তাদের আয়ের টাকার ভাগ পৌঁছে দেয়। পৌঁছে অবশ্যই দেয়। আর যদি পৌঁছে না দেয়, সরকারের সতর্ক হওয়া উচিত, কারণ এর অর্থ দাঁড়ায় – কোথাও আছে এক সমান্তরাল সরকার, যার সাথে নিয়মিত চলে ছাত্রসরকারের লেনদেন। লেনদেন কখনোই গোষ্ঠীহীন নয়, শরণ নিতেই হয়, সংঘং শরণং গচ্ছামি।
রাজনীতিই এর সমাধান। সরকার ছাত্রসরকারের রাশ টেনে রাখতে পারে রাজনীতি। আমাদের রাজনীতি যে নেই তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ আমাদের সরকার ছাত্রসরকারের দাপটেই সবকিছু চলছে। জীবন যাপনে যে পরিমাণ দাপটের নীচে আমাদের বসবাস, যে সংঘবদ্ধ লোলুপতা আমাদের চারপাশ কুরে কুরে খাচ্ছে, তার কাছ থেকে বাঁচতে হলে রাজনীতিকে সরকারের চেয়ে শক্তিশালী হতে হবে। সংঘের শক্তিকে প্রতিহত করার প্রথম ধাক্কা দিতে পারে ছাত্ররাই – সংঘবদ্ধতা নয়, রাজনৈতিক চেতনা : সেখানে যেতে পারে প্রথমে ছাত্ররাই।
মাসুদ করিম
লেখক। যদিও তার মৃত্যু হয়েছে। পাঠক। যেহেতু সে পুনর্জন্ম ঘটাতে পারে। সমালোচক। কারণ জীবন ধারন তাই করে তোলে আমাদের। আমার টুইট অনুসরণ করুন, আমার টুইট আমাকে বুঝতে অবদান রাখে। নিচের আইকনগুলো দিতে পারে আমার সাথে যোগাযোগের, আমাকে পাঠের ও আমাকে অনুসরণের একগুচ্ছ মাধ্যম।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৬ comments
মোহাম্মদ মুনিম - ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (১:৩৫ পূর্বাহ্ণ)
ছাত্রলীগের এই দশার কথা প্রধানমন্ত্রীও জানেন, মাঠ পর্যায়ের নেতারাও জানেন। কিন্তু তাঁরা কিছুই করবেন না, করবেন না মানে করতে পারবেন না। কারণ, আবার ভোটের সময় বা রাজনীতির মাঠ গরম হলে পলিটিক্যাল শো ডাউনে এদেরই লাগবে। বিএনপি আমলের শেষে লগী বৈঠার যে ব্যাপারটা হলো, সেটা তো ক্যাডার ছাড়া হয় না। দুয়েকটা লাশ না পরলে তো কেউ গা করে না।
বাংলাদেশের মফস্বলগুলোতে এখন হাজার হাজার কলেজ, এই কলেজগুলো থেকে পাশ করে কোন চাকরী জোটে না, আবার বিএ পাশ করে তো কৃষিকাজও করা যায় না। তারচেয়ে ছাত্রজীবনে টেন্ডারবাজী করে কিছু টাকা জমিয়ে ব্যবসা করা যায়, নাহলে মালয়েশিয়া যাওয়া যায়। খারাপ কিছু তো নয়।
আমরা আওয়ামী লীগের আগের আমলে বুয়েট থেকে পাশ করলাম। আমাদের সাথে পাশ করলেন ছাত্রলীগের পাঁচ আইবুড়ো নেতা, বংগবন্ধুর নানাবিধ স্বপ্নের বাস্তবায়ন করতে করতে তাঁরা পাশ করতে করতে বয়স তিরিশ পার করে ফেললেন। এবং তার সাথে সাথে আমরা যারা নিয়মিত ছাত্র তারাও আধা আইবুড়ো হয়ে গেলাম। তিরিশ পার হয়ে গেলেতো আর বিসিএস দেয়া যায় না, তাই ঢাকা সিটি কর্পোরেশনে তাঁদের জন্য পাঁচটি পদ তৈরী হয়ে গেলো। সিটি কর্পোরেশনের অফিস বুয়েটের কাছাকাছি হওয়াতে পেশাদার দায়িত্ব পালনের সাথে সাথে তাঁরা বুয়েটের দেখাশোনা করতে লাগলেন।
আঠারো বছরের নবিন তরুণ বুয়েটে আসে, এক দুই টার্ম মন দিয়ে পড়াশোনা করে, তার পরে জয় বাংলা বা লক্ষ জিয়া ঘরে ঘরে এই জাতীয় স্লোগান দিয়ে মিছিলে যাওয়া শুরু করে। মিছিল শেষে হলের ক্যান্টিনে দল বেঁধে খাওয়া, বিল দেওয়ার বালাই নেই। বিল দিলে আবার নেতা কিসের। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিকাদারদের সাথে কুশল বিনিময়, জিয়া এবং বংগবন্ধুর স্বপ্নের বাস্তবায়নে কত টাকা যাবে, তার রেট তো বাঁধাই আছে। পাশেই যেহেতু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সেখানকার জিয়া আর মুজিব সৈনিকদের সাথে বোঝাপড়ার ব্যাপার আছে। মাঝে মাঝে দল বেঁধে ধানমন্ডিতে ফুল দিতে আর সংসদ ভবনের মাজারে যাওয়া। এই হচ্ছে মোটামুটি রাজনৈতিক কর্মকান্ড। তবে মাসুদ ভাই যেভাবে বলেছেন, এই কর্মকান্ডের মাঝের রাজনীতি নেই, আছে সংঘবদ্ধতা। একমাত্র রাজনীতিই পারে এই সংঘবদ্ধতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে।
মাসুদ করিম - ২১ মার্চ ২০১০ (১০:১৫ পূর্বাহ্ণ)
আজকের কালের কণ্ঠের খবর:
মাসুদ করিম - ২১ জুলাই ২০১০ (১:৩৬ পূর্বাহ্ণ)
বিডিনিউজ ২৪ ডট কমে ছাত্ররাজনীতি নিয়ে খালিকুজ্জামান ইলিয়াসের মতামত : ছাত্ররাজনীতি: বাগানের সাপ।
মাসুদ করিম - ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৯ (৪:০২ পূর্বাহ্ণ)
Pingback: রাজনৈতিক বিরতি | প্রাত্যহিক পাঠ
মাসুদ করিম - ২৩ মে ২০২৩ (১:৫৬ অপরাহ্ণ)
ছাত্রলীগের জয়, ছাত্রলীগের ক্ষয়
শহিদুল ইসলাম
https://protidinerbangladesh.com/opinion/43858/%E0%A6%9B%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%B2%E0%A7%80%E0%A6%97%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%9C%E0%A7%9F-%E0%A6%9B%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%B2%E0%A7%80%E0%A6%97%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B7%E0%A7%9F
বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলায় এসএসসি পরীক্ষাকেন্দ্রে কর্মীসভার আয়োজন করে আবার আলোচনায় এসেছে ছাত্রলীগ। ১৮ মে বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা থেকে শুরু হয় সারিয়াকান্দি পাইলট বালিকা উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে জীববিজ্ঞান ও অর্থনীতির পরীক্ষা। পরীক্ষার্থীরা যখন কক্ষের ভেতরে পরীক্ষা দিচ্ছে, তখন ১৪৪ ধারা ভেঙে মঞ্চ ও প্যান্ডেলের সাজসজ্জার কাজ করা হয় বিদ্যালয়ের মাঠে। ছাত্রলীগের বর্তমান এসব কার্যকলাপ দেখে অনেকেই বিস্মিত হন, দুঃখ করেন। আক্ষেপ করে বলেন, ‘এই কি সেই ছাত্রলীগ!’ ১৯৪৮ সালে জন্ম নেওয়া পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের পাকিস্তান আমলের ভূমিকা লক্ষ্য করেই তাদের এই বিস্ময়, আক্ষেপ ও দুঃখ। পাকিস্তানি শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগের যে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা, তা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। পাকিস্তান জন্মের মাত্র এক বছরের মধ্যে যে এমন একটি প্রতিবাদী ছাত্রসংগঠনের জন্ম হবে, তা সত্যিই ছিল অভাবনীয়। ভূমিষ্ঠ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাকে পাকিস্তানি শাসন শোষণের বিরুদ্ধে কোমর বেঁধে দাঁড়াতে হয়। তার চেয়ে এটা বলা বোধহয় সঠিক হবে যে, পাকিস্তানি শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করার উদ্দেশ্যেই ছাত্রলীগের জন্ম। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের নির্বাচন, ১৯৬২ সালের শরীফ শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান ও সর্বশেষ মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রলীগের অসামান্য ভূমিকা ইতিহাসে সোনার অক্ষরে লিখিত আছে। ওই ইতিহাস কারও পক্ষেই মুছে ফেলা সম্ভব নয়।
কিন্তু স্বাধীনতার পর সমগ্র জাতি সম্পূর্ণ নতুন এক বাস্তবতার সম্মুখীন হয়। সেই সঙ্গে ছাত্রলীগও। কাজেই নতুন উদ্ভূত পরিস্থিতির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ ছাড়া ছাত্রলীগের আজকের অবস্থা বোঝা যাবে না। বিচার করতে হবে পাকিস্তান আমলে ছাত্রলীগ কার বিরোধিতা করেছিল এবং কার পক্ষে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছিল? বাহ্যিকভাবে এ প্রশ্নের উত্তর সহজ। কিন্তু অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে উত্তরটা অত সহজ মনে হবে না। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর পাকিস্তানে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসন-শোষণের অবসান ঘটে। কিন্তু পাকিস্তান নামের আরেকটি শাসন-শোষণের মধ্যে পড়ে দেশটির পূর্ব অংশ পূর্ব পাকিস্তান। ইসলামি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে মুসলিম শাসকরা ব্রিটিশের স্থলাভিসিক্ত হয় মুসলিম লীগ নামের একটি সাম্প্রদায়িক দলের নেতৃত্বে।
শুরু থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকশ্রেণি পূর্ব পাকিস্তানে আধিপত্য কায়েম করে। পাকিস্তান আমলে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের দ্বন্দ্বই ছিল প্রধান দ্বন্দ্ব। অর্থনীতির ভাষায় বলতে হয়, পশ্চিম পাকিস্তানের বড় পুঁজির সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের ছোট পুঁজির দ্বন্দ্ব। যেকোনো ইতিহাস, অর্থনীতির বই খুললেই দেখা যাবে পাকিস্তানের উভয় অংশের ভয়াবহ বৈষম্যের তথ্য। এ দেশের ছোট বুর্জোয়া শ্রেণি পশ্চিম পাকিস্তানের বড় বুর্জোয়ার অধীন কন্ট্রাক্টর, ব্যবসায়ী ছাড়া অন্য কিছু নয়। পশ্চিমের ধনিকশ্রেণির দয়া-দাক্ষিণ্য ছাড়া তাদের অস্তিত্ব সংকটে পড়তে হতো। পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়ন পরিকল্পনার শিকড় পর্যন্ত ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি বড় বুর্জোয়ার দখলে। স্বভাবতই ওই অবস্থা এ দেশের অধীনস্থ পুঁজিবাদীরা মেনে নিতে পারেননি। তাই এ দেশের ছোট-বড় যেকোনো আন্দোলনে অর্থ জোগান দিতে তারা কখনোই কার্পণ্য করেননি। তারা একে ফজলুল হক, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও সর্বশেষ শেখ মুজিবুর রহমানের হাতকে শক্ত করতে সাধ্যমতো চেষ্টার ত্রুটি করেননি।
১৯৬৬ সালের ছয় দফা ঘোষণার পর সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে সভা সমিতি অনুষ্ঠানে তারা আওয়ামী লীগের পাশে ছিলেন। মাত্র চার বছরের মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের অবিসংবাদী নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতি-ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি নির্বিশেষে এ দেশের সব মানুষকে এক ঐক্যবদ্ধ শক্তিতে পরিণত করেন। এই ঐতিহাসিক কাজে তার সবচেয়ে বড় সহায়ক শক্তি ছিল ছাত্রসমাজ, বিশেষ করে ছাত্রলীগ। আমরা সবাই জানি পাকিস্তানি আমলে ছাত্ররাই ছিল সব আন্দোলন- সংগ্রামের পুরোভাগে; বিশেষ করে ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’। ১৯৫৩ সালে ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন’-এর প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তারাও পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ লুন্ঠনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। সমাজতন্ত্রের কথা বললেও ইতিহাস প্রমাণ করে যে তাদের আন্দোলন এ দেশের বুর্জোয়া শ্রেণির হাতকেই শক্তিশালী করেছে। ১৯৬৯ সালে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের সমন্বয়ে গঠিত হয় ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’। শেখ মুজিবুর রহমান তাদের ১১ দফার প্রতি অকুন্ঠ সমর্থন জানান। দেখা যায় ছাত্ররাই ছিল সব আন্দোলন-সংগ্রামের চালিকাশক্তি।
এ দেশ যতদিন বিদেশি পশ্চিম পাকিস্তানি শক্তির অধীন ছিল, ততদিন ছোট পুঁজির এক প্রগতিশীল চরিত্র ছিল। পশ্চিমের বড় পুঁজির বিরুদ্ধে এ দেশের ছোট পুঁজির লড়াই তাই এ দেশের সর্বস্তরের মানুষের সমর্থন লাভ করে। যদিও সামান্য কিছু মানুষ ও এনএসএফের কিছু ছাত্র পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকশ্রেণির পক্ষাবলম্বন করেছিল। তাদের পেছনে সব সময় সরকারি সমর্থন ছিল। প্রগতিশীল বাঙালি জাতীয়তাবাদের লড়াইয়ে সম্পৃক্ত হয়ে ছাত্রলীগও একটি প্রগতিশীল চরিত্র অর্জন করছিল। এ দেশের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের আন্দোলনের সঙ্গে ছাত্রলীগের আন্দোলন মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। সৃষ্টি হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের মহিমামণ্ডিত ইতিহাস। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর স্বাধীন বাংলাদেশ এক অভূতপূর্ব সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থার সম্মুখীন হয়। মুসলমান বাঙালি এই প্রথম একটি স্বাধীন দেশের শাসন ক্ষমতায় আসীন হয়। ১৯৭২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরে আসেন এবং প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করেন।
বাহাত্তরেই ছাত্রলীগ দ্বিধাবিভক্ত হয়, সমাজতন্ত্রের স্লোগান মুখে নিয়ে জন্ম হয় জাসদ ছাত্রলীগের। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুজিববাদী ছাত্রলীগের সম্মেলন উদ্বোধন করেন এবং তাঁর সমর্থন জ্ঞাপন করেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মেজর জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সৃষ্টি হয় জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। মেজর জিয়াউর রহমানের হত্যার পর মেজর জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে আরও একটি ছাত্র সংগঠনের জন্ম হয়। ছাত্রসমাজ। লক্ষ করার বিষয়, গণতান্ত্রিক বা সামরিক স্বৈরশাসন নির্বিশেষে সবাই ছাত্রসমাজের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছে এবং ছাত্রসমাজও তাদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে।
দুই.
সত্তর সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের প্রচার-প্রচারণায় একটি পোস্টারের কথা মনে করুন। ‘গরুটি ঘাস খাচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানে আর দুধ দুয়ে নিচ্ছে এক হাজার মাইল দূরের পশ্চিম পাকিস্তান’। স্বাধীনতার পর পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষে আর দুধ দুয়ে নেওয়া সম্ভব ছিল না। ভিন্ন জাতির বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর। এ দেশে যদিও ৪৫টি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষ বসবাস করে আসছেন হাজার বছর ধরে, তাদের ধর্তব্যের মধ্যে না নিয়ে দেশটি বাঙালি জাতির দেশ হিসেবে ঘোষিত হয়। তাহলে ওই দুধ কে বা কারা খেল? বিগত একান্ন বছরে প্রমাণ হয়েছে ওই দুধ খেয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের নব উত্থিত ধনিক শ্রেণি। সংখ্যায় তারা অতি নগণ্য। ফেসবুকে কার পোস্টে যেন পড়েছিলাম, পাকিস্তানের ২২ পরিবারের স্থানে বাংলাদেশে বাইশ হাজার পরিবারের জন্ম হয়েছে, যারা বৈধ-অবৈধ পথে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। ১৯৭২ সালে এ দেশে মাত্র দুজন কোটিপতি ছিলেন। যদি বাইশ হাজার কোটিপতি হয়, তাহলে তাদের স্নেহধন্য ও আশীর্বাদপুষ্টদের নিয়ে ওই শ্রেণির সংখ্যা যদি ১০ শতাংশও ধরি, তাহলে ৯০ শতাংশ মানুষ সেই শ্রেণির বাইরেই রয়ে গেছে।
স্বাধীনতার পর সব সরকারই শুধু নিজেদের নিয়েই ভেবেছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠন বুঝতে চেষ্টা করেনি যে পাকিস্তান আমলে তারা যেসব দলের পেছনে শক্তি জুগিয়ে গেছে, স্বাধীনতার পর তাদের অবস্থান্তর ঘটেছে। পাকিস্তান আমলে তারা শুধু বিরোধী দলের ভূমিকাই পালন করেছে। ১৯৫৬ সালে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য পূর্ব পাকিস্তানে খান আতাউর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার অধিষ্ঠিত ছিল। শেখ মুজিবুর রহমান ওই মন্ত্রিসভার একজন সদস্য ছিলেন। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে তারাই রাষ্ট্র পরিচালনার গুরুদায়িত্ব পালন করেন।
ছাত্রসমাজের একাংশ ছাত্রলীগের কথা লিখতে বসেছি। গত এক দশকেরও বেশি সময় আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায়। এই সময়ে সরকার অনেক ভালো কাজ করেছে। সে জন্য তারা কৃতিত্ব দাবি করতে পারে, গর্ব করতে পারে। সে গর্বের দাবিদার ছাত্রলীগও। কিন্তু একটি দল দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে যা হয়, তা থেকে আওয়ামী লীগও রক্ষা পায়নি। গত এক দশকেরও বেশি সময়ের ছোটখাটো ভুলগুলো আজ একত্রিত হয়ে সরকারকে কঠিন সমালোচনার সম্মুখীন করেছে। সেগুলো নাকচ করার জন্য সরকার জোর তৎপরতা চালাচ্ছে। রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা দেশে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ঝড় তুলেছে। সরকারের সঙ্গে বাঁধা ছাত্রলীগ সরকারের ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য সামান্য বিরোধিতাও সহ্য করতে পারছে না। তাদের তৎপরতা সরকারের জন্য আরও নাজুক অবস্থার সৃষ্টি করছে। সরকার ক্রমেই বৃহত্তর জনগোষ্ঠী থেকে দূরে চলে যাচ্ছেÑএই অভিযোগ অনেকের। ছাত্রলীগের জয়ের খতিয়ান যেমন অনেক বিস্তৃত তেমনি ক্ষয়ের চিত্রও কম স্ফীত নয়।
পাকিস্তান আমলে যখন আপামর জনসাধারণের সঙ্গে ছাত্রলীগের মেলবন্ধন ঘটেছিল, তখন জনগণ বিপদে-আপদে ছাত্রদের পাশে দাঁড়িয়েছে। আজ ছাত্রলীগ মাত্র ১০ শতাংশ মানুষের স্বার্থরক্ষার জন্য ৯০ শতাংশ মানুষের বিরাগভাজন হয়ে পড়েছে। স্বাধীনতার পর জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে ভাটা পড়েছে। আজ কোনো বিদেশি শাসক বাংলাদেশকে শোষণ করছে না। বাঙালি জাতিই আজ শত্রু মিত্রে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ আজ শ্রেণি-সংগ্রামের স্তরে উন্নীত হয়েছে।