এক একর সবুজ ঘাস

শহুরে জীবন একেবারেই উন্নীত হলো না নাগরিক জীবনে। এখানেই নিজেকে বড়ো নিঃস্ব মনে হয় আমার। গত এক যুগ আমি শুধু গ্রামের সাথে সংযোগহীন নই, এ সময়কালে আমি নিজেকে গড়েও তুলেছি নাগরিক মূল্যবোধে। আমার চিন্তায় চেতনায় আমি কৃষির চেয়ে বেশি শিল্পলগ্ন, জীবনে যেমন, জীবনাচরণেও[...]

নিজের গ্রামে যাই না এক যুগ হয়ে গেছে। আবার আমার শহুরে জীবনেরও তিন দশক হতে চলল। জীবনের গত এক যুগে হারিয়েছি গ্রামের সেই মাঠ জল বাগান বাতাস, আর শহরে হারিয়েছি আমার নিজের কৈশোর যৌবনের কয়েকটি খেলার মাঠ, কিছু প্রিয় খোলা জায়গা, কিছু মোহমায়ার পাহাড়। কী হারিয়েছি, কেন গত কয়েক বছর নিজের নিভৃতে হাহাকার ওঠে, কী বলি তখন, কোথায় যেন দৃষ্টিহীনভাবে তাকিয়ে থাকি, বারবার কীসের কথা ভাবি, কী প্রেমটাই হারালাম, কে চলে গেল এ জীবন থেকে, কত হাজার বার কত রকম করে কত স্বরে কত অনুযোগে, আমি জানি নেই আমার শুধু : এক একর সবুজ ঘাস।

শহুরে জীবন একেবারেই উন্নীত হলো না নাগরিক জীবনে। এখানেই নিজেকে বড়ো নিঃস্ব মনে হয় আমার। গত এক যুগ আমি শুধু গ্রামের সাথে সংযোগহীন নই, এ সময়কালে আমি নিজেকে গড়েও তুলেছি নাগরিক মূল্যবোধে। আমার চিন্তায় চেতনায় আমি কৃষির চেয়ে বেশি শিল্পলগ্ন, জীবনে যেমন, জীবনাচরণেও। আমার প্রিয় বিষয়ের মধ্যে দুটি উল্লেখযোগ্য আগ্রহ হলো চিত্রকলা ও আর্কিটেকচার। প্রকৃতির পাশাপাশি আমি সচেতন নির্মাণ ভালোবাসি। একটি শহর এই সচেতন নির্মাণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই নগর হয়ে ওঠে। ডেভেলপার, মেয়র, নগর উন্নয়ন কর্তা এরাই হলো শহরকে নগর করে তোলার মূল চালিকাশক্তি, এদের চূড়ান্ত অসচেতনতাই দেশের প্রধান দুই শহরের নগর হয়ে ওঠার পথ অবরুদ্ধ করে রেখেছে যুগের পর যুগ। কনক্রিট সত্যিই এক ভালোবাসার বস্তু, কিন্তু তার পাশেও থাকতে হয়, এক একর সবুজ ঘাস, কনক্রিটকেও ভাবতে হয় পাহাড়ের কথা, বহতা দখলমুক্ত নদীই সবচেয়ে প্রাণবন্ত করে কনক্রিটকে, নদী বা সমুদ্র পাড়েই গড়ে ওঠে কনক্রিট হটস্পট। আমাদের দুর্ভাগ্য, আমাদের প্রধান দুই শহর, একটি নদীর পাড়ে ও আরেকটি মোহনা এবং পাহাড়ের সমন্বয়ে, প্রতিভাদীপ্ত প্রাকৃতিক অবস্থান পেয়েও আজ শহর হতে শহরের জঞ্জালে পর্যবসিত।

জলবায়ু পরিবর্তনের কথা যতই বলা হচ্ছে, বিশ্বের বড় বড় কর্তারা বারবার এর ‘উপশম’-এর কথা বলছেন, মানে রোগনির্ণয় হয়ে গেছে এখন এর চিকিৎসার কথা বলছেন। রোগনির্ণয়ে ক্ষতগুলো সব ধরা পড়েছে এশিয়ায় আফ্রিকায় ও দক্ষিণ আমেরিকায়। এ অঞ্চলগুলো থেকে এখন কার্বন নির্গমন কমানোর লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করতে হবে। এর মধ্যে চীন ৪০ শতাংশ ও ভারত ২০-২৫ শতাংশ কার্বন নির্গমন কমানোর লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করেছে, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ব্রাজিলও হয়তো কোপেনহেগেনে তাদের লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করবে। কিন্তু আমরা কী করব, আমরা আমাদের ক্ষতি নির্ণয় (মূলত, কর্তার ইচ্ছায়, আমাদের কোনো হিসেব নেই) করে জলবায়ু তহবিলের টাকা নেব শুধু? কিন্তু সে টাকার সাথে যদি এমন কিছু জড়িয়ে থাকে যে এটাকা শুধু ক্ষত নিরাময়ের জন্য দেয়া, শিল্পায়নের দিকে আগাতে গেলেই পদে পদে জলবায়ু পরিবর্তনের বাধা দেয়া হবে, তখন আমরা কী করব?

তাই আমার মনে হয় সংরক্ষণের দিকে ঝুঁকে, শিল্পায়নের দিকে আমাদের মনোনিবেশ করা উচিত। আমাদের নদীগুলো দখলমুক্ত রাখা, নিয়মিত ড্রেজিং-এ এগুলোর বর্তমান বহমানতার অবস্থার উন্নতি সাধন, জনসংখ্যার রাশ টেনে ধরা, পাহাড় না কাটা, প্রতিটি শহরে পর্যাপ্ত খেলার মাঠ ও খোলা জায়গার বন্দোবস্ত করা – এই সংরক্ষণনীতির ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে অবকাঠামো নির্মাণ ও শ্রমঘন শিল্পায়নের পরিকল্পনাই জাতীয় পুঁজির সর্বোচ্চ ব্যবহার ঘটাতে পারে। কারণ শিল্পায়ন ছাড়া আমাদের উন্নতি সম্ভব নয়, এবং সংরক্ষণনীতির ভিত্তির ওপর না দাঁড়ালে আমাদের দ্বারা শিল্পায়ন সম্ভব নয়।

সেই শিল্পায়নের উন্নতি সাধন সম্ভব হলেই প্রকৃত নগরায়নের সম্ভাবনা অনেক বাড়বে। শহরের জঞ্জাল থেকে মুক্তি পেতে হলে এদিকে আগানোটাই সবচেয়ে জরুরি। গ্রামের প্রকৃতি এবং বসবাসের উন্নত ব্যবস্থা ও শহরের কনক্রিট এবং এক একর সবুজ ঘাস পেতে হলে এই পথের কোনো বিকল্প আছে বলে আমার জানা নেই।

মাসুদ করিম

লেখক। যদিও তার মৃত্যু হয়েছে। পাঠক। যেহেতু সে পুনর্জন্ম ঘটাতে পারে। সমালোচক। কারণ জীবন ধারন তাই করে তোলে আমাদের। আমার টুইট অনুসরণ করুন, আমার টুইট আমাকে বুঝতে অবদান রাখে। নিচের আইকনগুলো দিতে পারে আমার সাথে যোগাযোগের, আমাকে পাঠের ও আমাকে অনুসরণের একগুচ্ছ মাধ্যম।

২ comments

  1. রায়হান রশিদ - ৬ ডিসেম্বর ২০০৯ (১০:১৩ পূর্বাহ্ণ)

    এমন একটা লেখার অপেক্ষাতেই ছিলাম মাসুদ ভাই। এমন লেখাতেই আপনাকে যেন অনেক বেশী বেশী করে পাওয়া যায়। গ্রাম শহর নগর জীবন, নিসর্গ, এই সব কিছুর টানাপোড়েন আর জমে ওঠা জঞ্জাল, আর তার সাথে আধুনিক ব্যক্তি মানুষের প্রাত্যহিক বোঝাপড়া মানিয়ে চলা, অন্যদিকে পরিবর্তিত জলবায়ু, বিশ্ববিবেকের শংকাধ্বনি – সব কেমন সাবলীল সংক্ষিপ্ততায় উঠে এসেছে আপনার লেখায়। অনেক ধন্যবাদ।

    আপনি লিখেছেন:

    তাই আমার মনে হয় সংরক্ষণের দিকে ঝুঁকে, শিল্পায়নের দিকে আমাদের মনোনিবেশ করা উচিত। আমাদের নদীগুলো দখলমুক্ত রাখা, নিয়মিত ড্রেজিং-এ এগুলোর বর্তমান বহমানতার অবস্থার উন্নতি সাধন, জনসংখ্যার রাশ টেনে ধরা, পাহাড় না কাটা, প্রতিটি শহরে পর্যাপ্ত খেলার মাঠ ও খোলা জায়গার বন্দোবস্ত করা – এই সংরক্ষণনীতির ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে অবকাঠামো নির্মাণ ও শ্রমঘন শিল্পায়নের পরিকল্পনাই জাতীয় পুঁজির সর্বোচ্চ ব্যবহার ঘটাতে পারে। কারণ শিল্পায়ন ছাড়া আমাদের উন্নতি সম্ভব নয়, এবং সংরক্ষণনীতির ভিত্তির ওপর না দাঁড়ালে আমাদের দ্বারা শিল্পায়ন সম্ভব নয়।

    এই বক্তব্যের ওপর একটা দারুন আলোচনার অপেক্ষায় থাকলাম।

    • কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর - ৬ ডিসেম্বর ২০০৯ (৮:২৪ অপরাহ্ণ)

      উপরোক্ত ব্রাদারযুগল, এত উচিৎ-এর স্বপ্ন আর দেখা হয় না। আমার মনে হয়, এই দেশে রোজ-কেয়ামত পর্যন্ত একখান অনুচিত মন্ত্রণালয় করা হোক। সংবিধানের পাক্কা-সংশোধনী এনে তা কার্যকর করাটাই অতি সওয়াবের কাজ হবে। এর সার্বিক দায়িত্বে থাকবেন প্রথমত দ্বিতীয়ত এবং শেষত সরকারী দলের মাননীয় ক্যাডারগণ। এই নাটকের পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করবেন মাননীয় পুলিশ ভাইসকল। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া হলেই ভালো হয়। তাহলে বড়ো বড়ো দলের ভাইজানেরা পালাক্রমে সুখে-শান্তিতে থাকতে পারবেন। আমিন!!!

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.