ওরকম আমারও ঘটেছে,
যখন গায়ক নিজে অথবা গায়িকা হ’য়ে ওঠে গান কথা সুর,
আর শ্রোতা হয়ে যায় অধরা সে গানের বিষয়,
আধেয় আধার একাকার শরীর ও অশরীরী প্রাণ;
তখন মুহূর্তে ধুয়ে যায় অসমাপ্ত বর্তমান সমস্ত জঞ্জাল।
একবার মনে আছে একটি টপ্পার মধ্যে
উদভাসিত হয়েছিল আসমুদ্রহিমালয়
প্রাচীন বিশাল ভারতবর্ষের অন্তরের ঘনিষ্ঠ আকাশ
মালতী ঘোষাল তাঁর স্পষ্ট স্বরে গাইলেন যখন এই
পরবাসে রবে কে এ পরবাসে
আজীবন দীর্ঘ পরবাস—
…
গানের বাস্তবে মাঝে-মাঝে এরকম ঘটে,
মনে পড়ে একবার কয়েকটি পড়া শোনা কথা
দেবব্রত বিশ্বাসের উদাত্ত গলার একাত্তীকরণে
কী দরদী ঢেউ তুলেছিল এক সভাঘরে, সভ্যভব্য মনে,
গায়কের দুই চোখ অন্তরঙ্গ, সমগ্র চেতনা শুধু গানে,
কথার গলার বৃষ্টিতে বিদ্যুতে সুরে একাকার,
বাইশে বা অন্য কোনো দিন হয়তো-বা দোসরা শ্রাবণে
…
‘আজকাল’ ১৮ জুলাই ২০০৯-এর উত্তর সম্পাদকীয়তে বিষ্ণু দে-র জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে লিখেছেন দেবেশ রায়। তাঁর কাছে “ বিষ্ণু দে আমাদের সবচেয়ে মৌলিক আধুনিক কবি। সে আধুনিকতার কোনও ‘আমি’ নেই। তাই তাঁর দায়—বাছাই ঝাড়াই উপকরণগুলো খুলে দেওয়া, সাজিয়ে দেওয়া।” বিস্তারিত পড়ুন…
দোসরা শ্রাবণে
দেবেশ রায়
বিষ্ণু দে জন্মেছিলেন ১৮ জুলাই, সেদিন ছিল দোসরা শ্রাবণ। এবার ১৮ জুলাই পড়েছে বাংলার পয়লা শ্রাবণে।
এ বছরের ১৭ জুলাই বিষ্ণু দে তাঁর জীবনের আয়ুক্ষেত্রের একশো বছর পূর্ণ করলেন।
১৮ জুলাই বা দোসরা শ্রাবণ থেকে বিষ্ণু দে তাঁর আয়ুর দ্বিতীয় শতকে পা দিলেন।
এখন থেকে তাঁর বয়সের হিসেব হবে শতক দিয়ে। এখন থেকে তাঁর জন্মদিনের উৎসব কর্তব্যকর্মের কর্মসূচির বাইরে চলে যাবে। হয়ত আরও ছড়িয়ে যাবে সেই জন্মদিন পালন। আমরা যেমন অপক্ষোয় থাকি তিন-চার শতক বা সহস্রক পূর্তিতে কোনও মহাশিল্পীর সঙ্গে আমাদের আত্মীয়তা গড়তে। ততদিনে তাঁরা নিজের ভাষার ও দেশের সীমা ও সময়ের সীমা পেরিয়ে মানব সভ্যতার মাইলফলক হয়ে যান। সেই ফলকগুলি দিয়ে আমরা মানব সভ্যতার বাঁকগুলি চিনে নিতে চাই। বাঁক ও পথ।
এই প্রথম একশো বছরে আমরা যারা আছি—তাঁর প্রায় সমান বয়েসি, বা অসমান বয়োবৃদ্ধরাও, বা পুত্র-কন্যা তুল্য বয়েসিরা, বা তাদের সন্তান-সন্ততি, এমনকি, যারা তাঁর বয়স থেকে এতটাই দূরে যে, তাঁর বয়সের কোনও অনুগামিতা বোধ করেন না—তাদের সকলেরই একটা দায় থাকে জানানোর যে, আমরা কিন্তু খেয়াল রেখেছি সেই দায়। কাকে জানানো? সমাজকে জানানো। কেন জানানো? বিষ্ণু দে-র আমাদের বাঙালিদের যে প্রাথমিক অধিকার সেটা মনে করিয়ে দিতে। সম্পত্তি মনে না করিয়ে দিলে রক্ষা হয় না। সম্পত্তি মনে করিয়ে দিতে হলেও তো জানা চাই। তাই প্রথম একশো বছরে কিছু স্মারকলিপি তৈরি করতে হয়। এই তো মাত্র ২৭ বছর আগেই তিনি ছিলেন এই শহরে, আমাদের দৈনন্দিনে। এখনও তো আমরা সময়ের সেটুকু দূরত্ব পেরোয়নি, দৈনন্দিনের অভ্যাস, সংস্কার বা আচরণ যে-দূরত্বে আর মনে থাকে না। এই নৈকট্যে কবি আর আমাদের মধ্যে শুধুই স্মৃতি নেই, কিছু বিস্মৃতিও থাকে। বা কারও কারও ঘটে যায় বিস্মৃতি। বা ঘটিয়ে ফেলতেও পারে বিস্মরণ।
যাঁরা ছিলেন একদিক থেকে তাঁর সমকালীন, তাঁরা তাঁদের পুরনো দূরত্ব ও অনিশ্চিত সম্পর্ককে এখন বদলে দিয়েছেন, রসিক স্মৃতিকথার আত্মীয়তায়। এর বিপরীতে, যাঁরা ছিলেন একদিক থেকে তাঁর সমকালীন, তাঁরা নিজেদের মধ্যেই আর খুঁজে পান না সম্পর্কের পুরনো আগুন। যাঁরা তাঁর পরবর্তী কবি—তাঁদের কারও মধ্যে এখনও আছে বিষ্ণু দে-র কবিতার তাপ। কিন্তু সেই তাপকেও আড়াল করে দেয় হালের কোনও রাজনৈতিক ছুঁতমার্গ—প্রাণের টানেও যাঁরা জাত্যভিমানে সব আমন্ত্রণ করতে পারেন না। যাঁরা তাঁকে দেখেনই নি, বা যাঁরা বিষ্ণু দে-র একটি নতুন কবিতা পড়ার শিহরনের শারীরিকতা যাঁদের সঞ্চয়ে নেই, তাঁদেরও কেউ বেশ সরলতায় বলে দিতে পারেন—তাঁদের সামগ্রিক বা আংশিক বর্জন বেশ সৎসাহসে। আবার, এমনও যাঁরা, কবিতা লেখেন না, পড়েনও না হয়ত তত, কিন্তু ছবি আঁকায় বা থিয়েটার সিনেমায় সাবালক ক্ষমতায় প্রবল—তাঁরা বিষ্ণু দে-কে নিয়ে শোনা কথা কত-যে বলেন। সংলাপে নির্ভুল দাপুটে অভিনেতা বিষ্ণু দে-র কবিতার বাক্যগুলিকে ধরতে না-পেরে হো হো হেসে নিজেকেই ঠাট্টা করেন, ‘এ কেমন কবি, যার বাংলা, বাংলার মতো পড়া যায় না?’ দু-চারদিনের নিভৃত পরিশ্রমী চর্চায় তার শিল্পচর্চার দক্ষতায় সম্মুখের এই বাধা তিনি কেমন অনায়াসে উতরে যান, আবার বাক্যের সেই অনভ্যস্ত কিন্তু একেবারে বাংলা মোচড়টুকু বলে নিজেকেই বাহবা দেন, ‘আ-হা-হা, এ কেমন কবি, যার বাংলা এতই বেশি বাংলা, যা বাঙালি মোচড় ছাড়া বলাই যায় না।’
বিষ্ণু দে-র এই সব নিয়ে কত-যে রসিকতা বা বিস্ময় বাংলা সাহিত্যে ছড়িয়ে আছে! প্রেমেন্দ্র মিত্র একবার এক সভাতেই বলে ফেলেছিলেন, ‘বিষ্ণুর কবিতা ইংরেজি করার আগে বাংলা অনুবাদ করে নিলে হয় না?’ সভাটি ছিল বাঙালি কবিদের কবিতার ইংরেজি অনুবাদ নিয়ে। জীবনানন্দ দাশ তাঁর একটি উপন্যাসে বিষ্ণু দে-র নামটি শুধু ব্যবহার করেননি, তা ছাড়া অভ্রান্তভাবে তাঁর সম্পর্কিত ব্যঙ্গচিত্র ছকে ছিলেন। সমর সেন তো লিখেইছেন, কী করে যে তিনি তাঁর কবিতার স্থিরবিন্দু খুঁজে পান! সুচিত্রা মিত্র একদিন তাঁকে নিয়ে লেখা বিষ্ণু দে-র কবিতাটির কথায় হাসতে হাসতে ( আমাকেই) বলেছিলেন, ‘আমার গান কি এতই কঠিন!’ কমিউনিস্ট আন্দোলনে যাঁরা ছিলেন স্বীকৃত সাহিত্যিক-নেতা তাঁরা তো পাসপোর্ট-নাকচের ভঙ্গিতে ফরমান দিয়েই গেছেন, বিষ্ণু দে কমিউনিস্ট কবি নন। এ নিয়ে সবচেযে বড় রঙ্গটি ঘটল তাঁর প্রকাশিত ‘কবিতা সমগ্র’(৩)-এর পরিশিষ্টে ‘বিশিষ্টার্থবাচক শব্দ ও তথ্যপঞ্জি’তে। সম্পাদকদ্বয়ের বিপুল পরিশ্রমে পাঠকরা উপকৃত হবেন—দুরাশা করি। কিন্তু এই ‘সমগ্র’ তো বেরল ১৯৯৫-এ—বিষ্ণু দে তার মাত্র ১২ বছর আগেও তো বেঁচে আছেন। যা ছিল এককালে মুখফেরতা রসিকতা, তাই ঘটল—বিষ্ণু দে-কে পড়তে আলাদা ডিকশনারি দরকার।
আবার, এমন পাঠক সমাজও তো তাঁর ছিল সেই প্রথম কবিতা থেকে, যাঁরা তাঁর আধুনিকতার ও মৌলিকতার অনুরাগী ছিলেন আমরণ, থাকবেন আমরণ, আর ভবিষ্যতে শিল্প-স্রষ্ঠাদের কাছে যিনি হয়ে উঠবেন কঠিনতম চ্যালেঞ্জ। তাঁরা নিজেদের শিল্পচর্চায় স্নাতক হতে পারবেন না—যদি বিষ্ণু দে-র বাঙালি বাক ও ব্রত উদ্ধার করতে না পারেন।
সংস্কৃতি চর্চার স্টেইনলেস স্টিলের মরচে না-পড়া উজ্জ্বল শিকলের কলোনিয়্যাল প্যাঁচে আমরাই পড়ে গিয়েছি বিষ্ণু দে-কে নিয়ে, যেমন প্যাঁচে আমরা পড়েছিলাম সদ্য ইংরেজি শিখে মধুসূদনকে নিয়ে, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে পুরনো আখ্যান কাব্যগুলি নিয়ে, ভারতচন্দ্র ও ঈশ্বর গুপ্তকে নিয়ে। এঁরা কেউ সাহেবেদের তৈরি ছাঁচে আঁটছিলেন না—সে ছাঁচ উনিশ শতকের শেষ ৪০-৫০ বছরে ব্রাহ্ম ও ব্রাহ্মণ্যের আত্মতাসর্বস্ব ও সাম্প্রদায়িক পালিশে আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছিল এমন মায়ায়—এই তাহলে খাঁটি স্বদেশ ও স্বধর্ম। এই ধাঁধানো চোখ নিয়েই আমরা আধুনিকতর হয়ে উঠলাম শিল্প-সাহিত্যে। এমনকি, যেন মনে হল, সেই মায়া দিব্যালোকে যেন মধুসূদন-রবীন্দ্রনাথকেও পূর্ণ আকারেই দেখা গেল। যেন কলোনি-সর্বস্বতা থেকে আমরা মুক্ত হয়ে গেলাম—কিছু কলোনির মননে ও রসে সবসময়ই অগ্নিমান্দ্য ঘটে। ফলে, বিষ্ণু দে-কে নিয়েও কোনও ঝামেলা থাকবে না, কাউকে নিয়েই থাকবে না—এমন এক আত্মতুষ্টির অম্ল ঢেকুরে আমরা বললাম—এততেও যাদের মন ভরল না, তাদের নিয়ে সঙ সাজাও।
আমরা সঙ সাজালাম। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে সাজিয়েছি, বিষ্ণু দে-কে নিয়েও। সঙ-সাজানোয় এই এক উদ্ভট ঘটনা ঘটে। আমাদের বাস্তব থেকেই সঙ সেজে ওঠে। যে-সঙে বাস্তব নেই, সেই সঙ সঙই নয়। আর, সঙশেষে সত্যিকারের সেই সঙদের আবার আমরা যার যে-বেদি তাতে বসিয়ে দিতে পারি।
বিষ্ণু দে আদ্যন্ত মৌলিক। কবিতায় ও মননে। কবিতা কোনও অর্থ দিয়ে তৈরি হয় না, বিশিষ্টার্থ দিয়েও না। অর্থ তৈরি করা কবিতার হীন কাজ। বিশেষ করে কলোনির জন্য বরাদ্দ আধুনিকতায়।
কবিতা শুধু পারে একটা আকার গড়ে তুলতে—যেমন পাখি পারে তার বাসা বানাতে। আর, কী আশ্চর্য, বাবুইয়ের বাসাবোনার চিরন্তন বাহার সত্ত্বেও সে-বাসায় ঢোকার পথ বাবুই-ছাড়া আর-কোনও পাখি খুঁজে পাবে না। বাসার ‘ধারণা’, ‘গড়ন’ এগুলো তো বাবুইয়ের জানা থাকে না, মাথায়ও থাকে না, থাকে তার শরীরের ভিতরের রক্তে ও সূক্ষ্ম সব শিরা ও নালিতে। এমনকি কোন গাছের কোন ডালে সে বাসা ঝোলাবে, আর সে-বাসা বানাতে কী কী উপকরণ তার লাগবে ও লাগবে না, এটাও জমা থাকে ওই শিরায় ও নালিতে, শরীরের ভিতরে।
কবিতাই শুধু পারে—পাখির মতোই, একটা আকার গড়ে তুলতে। কিন্তু কবিতা তো এক মানুষই পারে বানাতে। মানুষের মাথা-র প্রোটিন রহস্যে ঠাসা। সেই প্রোটিন যখন আকার বানাতে বসে, তখন উপকরণ-সংগ্রহ ঘটে যায় রহস্যময়তায়। এতই রহস্য যে প্রতিটি কবিতারই আকার মৌলিক, অদ্বিতীয় ও নির্বিকল্প।
বিষ্ণু দে আমাদের সবচেয়ে মৌলিক আধুনিক কবি। সে আধুনিকতার কোনও ‘আমি’ নেই। তাই তাঁর দায়—বাছাই ঝাড়াই উপকরণগুলি খুলে দেওয়া, সাজিয়ে দেওয়া। সেই খোলা ও সেই আপাতবিন্যাস দেখে-দেখে পাঠক যেন নিজেই পাখায় আন্দাজ পায় কোন দূরে ও উঁচুতে তাকে উড়তে হবে এই আকার বানাতে।
বিষ্ণু দে-ই পারলেন তাঁর পাঠককে কবি করে তুলতে।
আর তিনি পেরেই যাবেন, যেমন পারেন মহত্তম সব কবি শিল্পী সভ্যতার দিকগুলোকে দিক দেখাতে।
মাসুদ করিম
লেখক। যদিও তার মৃত্যু হয়েছে। পাঠক। যেহেতু সে পুনর্জন্ম ঘটাতে পারে। সমালোচক। কারণ জীবন ধারন তাই করে তোলে আমাদের। আমার টুইট অনুসরণ করুন, আমার টুইট আমাকে বুঝতে অবদান রাখে। নিচের আইকনগুলো দিতে পারে আমার সাথে যোগাযোগের, আমাকে পাঠের ও আমাকে অনুসরণের একগুচ্ছ মাধ্যম।