হরকিষেণ সিং সুরজিৎ


ভারতে যাঁদের বয়স ৯০‌-৯৫, তাঁদের মধ্যে অনন্য বিখ্যাত দুজন, জ্যোতি বসু ও হরকিষেণ সিং সুরজিৎ। গত ১ অগাস্ট ২০০৮-এ নয়ডার মেট্রো হাসপাতালে মারা গেলেন হরকিষেণ সিং সুরজিৎ, বয়স হয়েছিল ৯২ বছর, জ্যোতি বসুর চেয়ে ২ বছর কম। সেই কৈশোর হতে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রত্যক্ষ অংশগ্রণের মধ্য দিয়ে। তখন ছিলেন ভগত সিংয়ের ‘নওজওয়ান ভারত সভা’র সদস্য। ১৯৩৪-এ তিনি নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন। ১৯৩৫ থেকে ১৯৩৬-এ কংগ্রেসের স্বাধীনতা আন্দোলনের সহযোগী হিসেবে কৃষক সভার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সুরজিৎ। ১৯৩৮-এ কৃষক সভার পাঞ্জাব রাজ্য শাখার সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৩৮-এর পর পাঞ্জাবের বাইরে আসেন,উত্তরপ্রদেশের সাহারানপুর থেকে প্রকাশ করতে থাকেন মাসিক পত্রিকা ‘চিঙ্গারি’। ১৯৩৯-এ সেপ্টেম্বরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘোষণা হওয়া মাত্র ব্রিটিশ সরকার ভারতে যে-নেতৃবৃন্দকে গ্রেপ্তারের জন্য প্রথম দফার পরোয়ানা জারি করে,তাদের অন্যতম হরকিষেণ সিং সুরজিৎ। আত্মগোপন করেছিলেন সুরজিৎ। ধরা পড়ে যান ১৯৪০-এর ডিসেম্বরে। ১৯৪৪ পর্যন্ত কারাগারে ছিলেন সে-সময়। মুক্তি পাওয়ার পর আবার কৃষকদের পাশে,কৃষক সভার কাজে। দেশভাগের সময় রক্তাক্ত দাঙ্গার দিনগুলোতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য ঝুঁকি নিয়ে ছোটাছুটি করেছেন হিন্দু,মুসলিম,শিখদের গ্রামগুলোতে।  দেশভাগের বছরে সুরজিৎ ছিলেন পার্টির পাঞ্জাব শাখার সম্পাদক। স্বাধীনতার পর কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ থাকার দিনগুলোতে ১৯৪৮-৫২ পর্যন্ত ছিলেন আত্মগোপনে। পঞ্চাশের দশকের ওই সময় সরকারি সেচ বিভাগ পাঞ্জাবে সেচের জলে কর বসানোয় কৃষকদের মধ্যে অসন্তোষ ঘনিয়ে ওঠে। সুরজিৎ কৃষকদের এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ১৯৫৯-এ এই আন্দোলন তুঙ্গে উঠে গোটা দেশে ইতিহাস সৃষ্টি করে। ওই আন্দোলনের নেতৃত্বের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার স্বীকৃতি হিসেবেই তিনি প্রথমে সারা ভারত কৃষক সভার সম্পাদক ও পরে সভাপতি নির্বাচিত হন। বেশ কিছু সংবাদপত্র,পার্টি মুখপত্র প্রকাশ,সম্পাদনা করেছেন সুরজিৎ। জলন্ধর থেকে ১৯৬৬-তে সম্পাদনা করেছেন ‘দুখী দুনিয়া’, ‘দৈনিক লোক লহর’। পরে পার্টির হিন্দি মুখপত্র ‘লোক লহর’ সাপ্তাহিকের সম্পাদনা করেছেন। বেশ কয়েকটি বইও লিখেছেন তিনি। তাঁর বইগুলোর মধ্যে ‘ল্যান্ড রিফর্ম ইন ইন্ডিয়া’, ‘ফিউচার অফ কাশ্মীর’, হ্যাপেনিংস অফ পাঞ্জাব’, আউটলাইন হিস্ট্রি অফ দি কমিউনিস্ট পার্টি’ উল্লেখযোগ্য। কমিউনিস্ট পার্টি ভাগ হওয়ার সময় সিপিএমের প্রথম পলিটব্যুরোর ৯ জন সদস্যের একজন ছিলেন সুরজিৎ। অবিভক্ত পার্টিতে ১৯৫৪ সালের জানুয়ারি থেকে ছিলেন পলিটব্যুরোর সদস্য। ১৯৯২ সালে মাদ্রাজে সিপিএমের ১৪তম কংগ্রেসে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক হন। ২০০৫-এর দিল্লি পার্টি কংগ্রেস পর্যন্ত তিনি দলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ২০০৮-এর এপ্রিলে সিপিএমের ১৯তম পার্টি কংগ্রেস পর্যন্ত তিনি ছিলেন পলিটব্যুরোর সদস্য। সাম্প্রদায়িকতা, বিশেষ করে বিজেপি-র বিরুদ্ধে তাঁর দ্বিধাহীন অবস্থান তাঁকে বিশিষ্ট করেছে। ১৯৯০ সালে বিজেপি-বিরোধী জোট সরকারের অন্যতম স্থপতি ছিলেন হরকিষেণ সিং সুরজিৎ। ইউপিএ সরকারের প্রতি বাম সমর্থনের তিনি ছিলেন অন্যতম তাত্ত্বিক প্রবক্তা। বয়সের কারণে,অসুস্থতার জন্য তিনি গত এপ্রিলের পর পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য পদ থেকে অব্যাহতি নিয়েছিলেন। কেন্দ্রীয় কমিটিতে তিনি ছিলেন একজন স্থায়ী আমন্ত্রিত সদস্য। সংসদীয় রাজনীতিতে তাঁর অভিজ্ঞতা এবং বড় ধরনের জোট তৈরির ক্ষেত্রে তাঁর নমনীয়তা এবং বিভিন্ন দল ও মতকে সাধারণ কর্মসূচির ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ করে তোলার ক্ষমতার জন্য সুরজিৎ ভারতের রাজনীতিতে নিঃসন্দেহে এক বিশিষ্ট নেতার স্বীকৃতি ও পরিচিতি অর্জন করেছেন।

সুরজিৎ কিংবদন্তী হতে চাননি। তিনি ইএমএস নাম্বুদিরিপাদ এবং জ্যোতি বসুকে কিংবদন্তী বলতেন।কিন্তু সুরজিৎ যা হয়েছেন এদের দুজন তা হতে পারেননি,সুরজিৎ হয়েছেন রাজনীতির চেয়ে বড়,বিশাল সংগঠক,মহান রাজনৈতিক কারিগর,সমকালে তিনিই শুধু জানতেন বহু বর্ণময় ভারতীয় রাজনীতির সব স্বর ও চ্ছটা। তাঁর হাতেই তৈরী হয়েছেন প্রকাশ কারাত ও সীতারাম ইয়েচুরি, যাঁরা এখন সারা ভারত সিপিএমের নতুন প্রজন্মের শীর্ষ সংগঠক। তাঁর মৃত্যুর পর সীতারাম ইয়েচুরি যথার্থই লিখেছিলেন “সুরজিতের ব্যক্তিত্বে অদ্ভূতভাবে সন্নিবেশ ঘটেছিল কিছু বিরল গুণের। দূরদর্শিতায় তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়। সাদাচোখে তাঁকে মনে হতো রাজনীতিতে বড় বেশি ঢিলেঢালা, খুবই নমনীয়, প্রয়োজনের তুলনায় বেশি উদার। কিন্তু যারা এমন ভাবত তারা সুরজিৎকে সত্যিই চিনত না। অথবা দূর থেকে চিনত। যারা ওঁকে কাছ থেকে চিনেছে, জেনেছে তারা কখনও ভুলেও এসব কথা ভাবেনি। আমরা জানতাম সুরজিৎ দেশ আর দলের পারষ্পরিক হিতকে যতটা সোজা-সরল ভাবে ব্যাখ্যা করে এসেছেন, তা এক কথায় বিরল। কঠিনতম রাষ্ট্রতত্ত্বকে যেভাবে জলের মতো বুঝিয়ে দিয়েছেন তার তুলনা নেই। অন্য পাঁচটা দলের সঙ্গে যে-কোনো ইস্যুতে জোট বাঁধতে গিয়ে নিজের দলের মৌলিক অবস্থানকেই চিরকাল প্রতিষ্ঠিত করেছেন। অন্যের চাপে নিজের অবস্থান কখনও বদলাননি। এটাই বোঝা যেত না সুরজিৎকে বাইরে থেকে দেখলে। সুরজিৎ বিশ্বাস করতেন অচঞ্চলভাবে এবং আমাদের স্থিরপ্রজ্ঞা দিয়ে বোঝাতেন,দলের স্বার্থ না দেখলে তোমার হাতের অস্ত্রটাই তো ভোঁতা হয়ে গেল। তখন আর কী দিয়ে লড়বে? আর দেশের স্বার্থ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলতেন,দেশের রাজনীতির খোলনলচেটাই যদি বদলে যায়, তাহলে কি কমিউনিস্ট পার্টি থাকবে, না তার লক্ষ্য পূর্ণ হবে? সেজন্যেই চাই গণতন্ত্রের ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোটাকে আগলে রাখা। গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রকাঠামো অক্ষত থাকলে তবেই দেশ সমাজতন্ত্রের পথে এগোবে। সুতরাং, ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলোকে একসঙ্গে এক মঞ্চে যেভাবে হোক আনতে হবে। রুখতে হবে সাম্প্রদায়িকদের। ওঁর এই দিকনির্দেশ আমাদের দেশের বহু দলের অভিমুখ বদলে দিয়েছে সদর্থকভাবে। এছাড়া সুরজিৎ বলতেন,অন্যদের কথাও শুনতে হবে এবং নিজেদের পরীক্ষিত অবস্থানের সঙ্গে সমঝোতা না করেই এগোতে হবে বৃহত্তর ঐক্যের দিকে। এমন ঐক্য যা আমাদের রাজনৈতিক লক্ষ্যে পৌঁছনোর সহায়ক হবে। এজন্য নিজের জমি ছাড়ার দরকার নেই। কারো সঙ্গে মতে না মিললে,এমনকি বিচ্ছেদ হলেও সুরজিৎ মনে করতেন,এ যাত্রা পুরো পথটা একসঙ্গে হাঁটা গেল না ঠিকই,তবে এখানেই সব শেষ হয়ে যায়নি।”

আমাদের দেশে আজ যে অভাব সবচেয়ে বেশি আমাদের ক্লিষ্ট করছে তা এই সুরজিতের মতো এমন বামপন্থী নিরন্তর কর্মী ও নেতৃত্বের অভাব। আমাদের দেশীয় রাজনীতি শত বাধা বিপত্তির পর যে সংসদীয় রাজনীতির পথে পা বাড়িয়েছিল তা অচিরেই ধর্ম ও বাণিজ্য সভার রূপ নেয়াতে, আজ রাজনীতির মৃত্যু আমাদের দরজার কড়া নাড়ছে। আমাদের রাজনীতি মোটেই তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছবে না যদি না আমাদের বামপন্থী রাজনীতি তার পথ ও পরিণতির ভাবনায় গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোটার জন্য সাংগঠনিক সার্বক্ষনিক কর্মতৎপরতা ও জোট গঠনে নেতৃত্ব দেয়ার কঠিন ও দীর্ঘমেয়াদি বিশ্বাসযোগ্যতায় পথ না চলে। অচল বিপ্লবভাবনায় ও অবিচল শুদ্ধ সমাজতন্ত্রের স্বপ্নে অলস দিন কাটিয়ে আর সাহিত্যে ও শিল্পে ও অর্থনীতিতে শ্রেণীপ্রভাবের তসবিহ গুনে গুনে রোজকার দিন কাটিয়ে আখেরাতে সমাজতন্ত্রের আশায় যাঁরা পথ চলছেন তাঁদের সুমসৃণ পথের শেষ কোনোদিন হবে না বলেই মনে হয়।

সুরজিতের জীবন নিয়ে ভাবতে ভাবতে আমার মনে হয়েছে ১৪ দলের পাশাপাশি আমাদের সব বামপন্থী দলগুলো নিজেদের মধ্যে ঐক্যকে আগে আরো জোরদার করুক। শুধুমাত্র তাহলেই প্রার্থীতার জোটের চেয়ে সাংগঠনিক লাভালাভের অর্ন্তগত হিসাব নিকাশ নিয়ে নিজেদের অর্জন আরো ফলপ্রসু হবে। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি যত দ্রুত দলের ভেতর আরো সংহত হয়ে ১৪ দলীয় জোটে নিজেদের অবস্থান ঘোষণার প্রেক্ষিত তৈরী করতে পারে ততই গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোটি শক্তিশালী হবে বলেই মনে হয়।

ভারতবর্ষের রাজনীতিতে সুরজিৎ প্রভাব বাড়ুক,তাহলেই এই দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে ধর্মের অমোঘ অচল প্রভাব কমার সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। সবার অবশ্যই এটা বোঝা উচিত ধর্মের হিসাব নিকাশ শেষ না হলে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি কোনোদিন প্রগতিশীল হবে না। আর তাই যদি না হয় কোথায় তলিয়ে যাবে সব তার হদিস আমরা কেউই পাব না।

আমি হরকিষেণ সিং সুরজিৎ বিষয়ে সব সময়ই তথ্য জুগিয়ে যাব এখানে। যেমন আজ একটি তথ্য পেলাম, তিনি কৈশোরে কবি হতে চেয়েছিলেন তাই নিজের ‘হরকিষেণ সিং বাস্সি’ নাম পাল্টে রাখলেন ‘হরকিষেণ সিং সুরজিৎ’ — কবি হতে পারেননি ঠিক কিন্তু নিজের নামটিকে কী অসাধারণ ছন্দোময় করে রাখলেন চিরদিনের জন্য।

সাবস্ক্রাইব করুন
অবগত করুন
guest

10 মন্তব্যসমূহ
সবচেয়ে পুরোনো
সাম্প্রতিকতম সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত
Inline Feedbacks
View all comments
10
0
আপনার ভাবনাগুলোও শেয়ার করুনx
  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.