আমার মেমো ৪ : সৈআই ওকা হাহই

তাহলে সময়ের এই ইঙ্গিতে বোঝা যায় আওয়ামি লিগের ভেতর সাধারণ সম্পাদক পদ নিয়ে জটিলতা ঘনীভূত হয়েছে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও ওবায়দুল কাদেরের মধ্যে। [...]

আপনি যদি সত্যিকারের রাজনৈতিক বিশ্লেষক হতে চান তবে প্রথমেই যেকোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের যে কোনো প্রচারিত ভাষ্যের ‘কাল’ বিবেচনা করবেন, এরপর ‘পাত্র’ (কে বলছেন কাকে বলছেন কার ঘাড়ে চাপাচ্ছেন কার উপর ঝাল ঝাড়ছেন – এরকম সম্ভাব্য সব ‘ট্যাগ’) আর ‘স্থান’ বিবেচনা করতেও পারেন নাও করতে পারেন। এবং যেজিনিশটি আপনি একদম ধর্তব্যের মধ্যে আনবেন না তা হল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বটি কী ‘বিষয়’এ কথা বলেছেন। কিন্তু আমাদের এখানে দুঃখজনক হলেও সত্য প্রায় রাজনৈতিক বিশ্লেষকই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের যে কোনো প্রচারিত ভাষ্যের ‘বিষয়’ নিয়েই লেপ্টে থাকেন। ফলে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের কী বলা উচিত ছিল তিনি কী বলেছেন সব আলোচনা এনিয়ে ঘুরপাক খেতে থাকে – মানে আমাদের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের যে কোনো প্রচারিত ভাষ্যকে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মতো মোকাবেলা করেন অথচ তারা আরো কার্যকর হয়ে উঠতেন যদি তারা রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতো মোকাবেলা করতেন।

বাংলাদেশ আওয়ামি লিগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের সাম্প্রতিক একটি প্রচারিত ভাষ্যকে উদাহরণ হিসেবে নিলাম।

মুক্তিযুদ্ধ আমাদের ইতিহাসের একটি অংশ। কিন্তু জাসদের নেতা-কর্মীরা এই সফল মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করছিল। বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার আগেই দেশকে ছিন্নভিন্ন করার চেষ্টা করেছিল। তারা যদি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার সমস্ত পরিবেশ সৃষ্টি না করত, তবে বাংলাদেশ একটি ভিন্ন বাংলাদেশ হত। বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকলে দেশ আগেই অর্থনৈতিক অগ্রসরতা অর্জন করত। শুধু হঠকারীদের কারণে তা সম্ভব হয়নি। এদের একজনকে আবার মন্ত্রিত্বও দেওয়া হযেছে, যার প্রায়শ্চিত্ত আওয়ামী লীগকে আজীবন করতে হবে।

[জাসদ থেকে মন্ত্রী করার প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে: আশরাফ]

এখন এই কথার পর আমাদের প্রায় সব রাজনৈতিক বিশ্লেষকের কথা বলার বিষয় হয়ে উঠল জাসদ, মুক্তিযুদ্ধ, শেখ মুজিব হত্যা আর ইঙ্গিতে বলা হাসানুল হক ইনু। কিন্তু একথা কখন বলা হচ্ছে সেই কালটা নিয়েই কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষককে কথা বলতে দেখলাম না। অথচ, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এমন এক সময় কথাটা বলছেন, যখন বাংলাদেশ আওয়ামি লিগের কাউন্সিল এবছর দ্বিতীয় বারের মতো পিছিয়ে দেয়া হয়েছে, এবং কে না জানে, বাংলাদেশ আওয়ামি লিগের কাউন্সিল মানেই দলের সাধারণ সম্পাদক কে হবে এই জল্পনাকল্পনা, এবং সবাই খেয়াল করবেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের এই কথার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশ আওয়ামি লিগের ওবায়দুল কাদের থেকে এসেছে, তাহলে সময়ের এই ইঙ্গিতে বোঝা যায় আওয়ামি লিগের ভেতর সাধারণ সম্পাদক পদ নিয়ে জটিলতা ঘনীভূত হয়েছে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও ওবায়দুল কাদেরের মধ্যে। এবং ওবায়দুল কাদের ছাত্রজীবনে জাসদঘনিষ্ঠ ছিলেন।

এরপর আসুন হাসানুল হক ইনুর কথায় তার সময়টার এখন বড় বৈশিষ্ট্য হল তিনি মন্ত্রিত্ব নিয়ে কী করবেন তা নয়, তিনি দল নিয়ে কী করবেন সেটাই এখন হাসানুল হক ইনুর অস্তিত্বের প্রশ্ন। তার সামনে ২০১৯ সালের নির্বাচনেরও একটা সম্ভাবনা ঝুলছে এবং সেসম্ভাবনা একটু অন্যরকম ওই জাতীয় পার্টি ২০১৪তে যে ভূমিকা পালন করেছে ২০১৯এ জাসদ সেভূমিকা পালন করতে পারে কিনা সেসম্ভাবনা, এবং আমরা এখনো বলতে পারি না, কিন্তু আদতে যদি সেটা হয় তাহলে তার অবস্থান কী হবে, বা জাসদ কী তাকে সামনে রেখেই সেসম্ভাবনার দিকে যাবে, নাকি আবারও ২০১৪এর জাতীয় পার্টির মতো সেখানে অন্য কোনো মেরুকরণ অনিবার্য হয়ে উঠবে?

এখন এ হল কাল আর পাত্র বিবেচনার ফল। তা না পুরো বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ‘বিষয়’ নিয়ে লেপ্টে আছে!

মাসুদ করিম

লেখক। যদিও তার মৃত্যু হয়েছে। পাঠক। যেহেতু সে পুনর্জন্ম ঘটাতে পারে। সমালোচক। কারণ জীবন ধারন তাই করে তোলে আমাদের। আমার টুইট অনুসরণ করুন, আমার টুইট আমাকে বুঝতে অবদান রাখে। নিচের আইকনগুলো দিতে পারে আমার সাথে যোগাযোগের, আমাকে পাঠের ও আমাকে অনুসরণের একগুচ্ছ মাধ্যম।

৪ comments

  1. Pingback: কাল্পাত্র | প্রাত্যহিক পাঠ

  2. মাসুদ করিম - ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬ (৪:০৬ অপরাহ্ণ)

    আমি প্রার্থী নই: কাদের

    আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে সংবাদমাধ‌্যমে নাম আসার পর সভাপতিমণ্ডলীর সদস‌্য ওবায়দুল কাদের বলেছেন, তিনি দলের জাতীয় সম্মেলনে ‘কোনো পদেই প্রার্থী নন’।

    সোমবার ঢাকা রিপোর্টাস ইউনিটিতে এক ‘মিট দ্যা প্রেস’ অনুষ্ঠানে তিনি সাংবাদিকদের এ কথা বলেন।

    সড়ক পরিবহনমন্ত্রী কাদের বলেন, “আমাদের পার্টিতে কোনো বিভেদ নেই। কে কী পেল তা নিয়ে মান অভিমান থাকতে পারে, এখানে নেত্রীর উপর আস্থা রয়েছে শতভাগ। আমরা সবাই তার নেতৃত্বের প্রতি আস্থাশীল।”

    আগামী ২২ ও ২৩ অক্টোবর আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন হওয়ার কথা, যার মধ‌্য দিয়ে পরবর্তী তিন বছরের জন‌্য নতুন নেতৃত্ব ঠিক করবে ক্ষমতাসীন দলটি।

    কাদের বলেন, “আমি আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন নিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ি, মাঝে মাঝে লজ্জাও পাই। সেটা হচ্ছে সম্মেলনকে সামনে রেখে নানা আলাপ আলোচনা আসে। পত্রিকায় ছবি বের হয়… ওমুকের প্রতিদ্বন্দ্বী। আমি আপনাদের স্পষ্টভাবে বলতে চাই, আমি আওয়ামী লীগের কোনো পদে প্রার্থী নই।”

    প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর থেকে এখন পর্যন্ত সপ্তমবারের মতো আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। সাধারণ সম্পাদক পদে এবার সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বদলে অন‌্য কাউকে বেছে নেওয়া হবে কি না- সে সম্ভাবনা নিয়ে সম্প্রতি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন পত্রিকায়।

    এসব প্রতিবেদনে নিজের নামও দেখার কথা জানিয়ে কাদের বলেন, “আমি বিব্রত বোধ করি… পাশাপাশি কয়েকজনের ছবি প্রকাশ হয়, এর মধ্যে আমার ছবি, সত্য করা বলতে কী এই ছবি দেখে অনেকে বলে ছবি এসেছে লিডার আমরা খুশি… আমার মনটা তখন বিষণ্ন হয়ে যায়, তখন ওই রিপোর্টের কারণে কাগজটি পড়ি না।”

    দলীয় সম্মেলনে এভাবে ‘প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়ে’ না দিতে সাংবাদিকদের প্রতি অনুরোধ করেন এই আওয়ামী লীগ নেতা।

    “আমাদের পার্টি আমাদের নেত্রী যা চাইবে, নেতা-কর্মীরা তাই চাইবে। এখানে কোনো ভিন্নমত থাকবে না। নেত্রীর চাওয়ার বাইরে কিছু নেই।

    ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর শেখ হাসিনাসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের বন্দি হওয়ার প্রেক্ষাপটে দলে সাধারণ সম্পাদকের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের ভার আসে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী সৈয়দ নজরুলের ছেলে আশরাফের উপর। ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ওবায়দুল কাদেরের নাম তার আগে আলোচিত হলেও তার ভাগ্যে সিকে ছেঁড়েনি।

    মন্ত্রী হিসাবে কাজের ধরণ নিয়ে বছর দুই আগে আওয়ামী লীগের এ দুই নেতার মধ্যে তীর্যক মন্তব্য বিনিময় হলে বিষয়টি গণমাধ্যমে নতুন আলোচনার জন্ম দেয়। অবশ‌্য কাদের এখন বলছেন, তার কোনো ‘উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই’।
    “কাকে কখন কী করতে হবে তার (নেত্রী) চেয়ে বেশি কেউ জানেন না। কাজেই আমাকে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা- প্রার্থিতার আসরে টেনে নিয়ে বিব্রত করবেন না।… আমি যেভাবে আছি নেত্রী যদি সেভাবেই রাখেন তাহলে আমি এতেই খুশি।”

    এর আগে ২০০২ সালের সম্মেলনের সময় ‘নেত্রীর নির্দেশে’ সাধারণ সম্পাদক পদে প্রার্থিতার ঘোষণা দিয়েছিলেন দাবি করে কাদের বলেন, “জলিল ভাই যখন সেক্রেটারি ছিলেন।… সম্মেলনের আগের দিন জলিল ভাই তখন হাসপাতালে, নেত্রী আমাকে বললেন হাসপাতালে গিয়ে জলিল ভাইকে বল তুমি ক্যান্ডিডেট নও।

    “এরপর আর কখনো আওয়ামী লীগের কোনো পদের জন্য আমার প্রার্থিতা ছিল না, মন্ত্রী হওয়ার জন্য কোনো লবিং ছিল না; আমি করিনি, কারণ আমার ধাতে নেই।”

    অন‌্যদের মধ‌্যে ঢাকা রিপোর্টাস ইউনিটির সভাপতি জামাল উদ্দিন এবং সাধারণ সম্পাদক রাজু আহমেদ এই ‘মিট দ্যা প্রেস’ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

  3. মাসুদ করিম - ২৩ অক্টোবর ২০১৬ (৫:২৬ অপরাহ্ণ)

    সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গী এবার ওবায়দুল কাদের

    আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে শেখ হাসিনা থাকলেও নতুন সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন ওবায়দুল কাদের।

    রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন রোববার বিকালে নির্বাচনী অধিবেশনে শীর্ষ দুই পদে তারা নির্বাচিত হন।

    সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী সভাপতি পদে শেখ হাসিনার নাম প্রস্তাব করেন।

    নির্বাচন কমিশনার ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন এ পদে আর কোনো নাম প্রস্তাব না পাওয়ায় শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে ঘোষণা করেন।

    বিদায়ী সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ওবায়দুল কাদেরের নাম প্রস্তাব করলে তাতে সমর্থন জানান জাহাঙ্গীর কবির নানক।

    এই পদেও বিকল্প কোনো নাম প্রস্তাব না আসায় সড়ক পরিবহনমন্ত্রী কাদেরকে সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত ঘোষণা করেন।

  4. মাসুদ করিম - ১১ ডিসেম্বর ২০১৬ (২:৪৭ অপরাহ্ণ)

    জাসদ ও তথাকথিত জাতীয়তাবাদীদের রাজনীতিকে এক করে দেখার অবকাশ নেই

    বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘জাসদ’ এবং ভারতের রাজনীতিতে ‘নকশালবাড়ি মুভমেন্ট’ ভারতবর্ষের ইতিহাসে দুটি বিরাট প্রশ্ন। দুই দেশের হাজার হাজার প্রগতিশীল স্বাপ্নিক তরুণ এই দুই আদর্শবাদী লড়াইয়ে আত্মদান করেছে। তাদের নেতাদের নিয়ে অসংখ্য প্রশ্ন, অসংখ্য বিতর্ক, অসংখ্য অজানা ইতিহাস থাকলেও আত্মদানকারী যুবকদের নিয়ে বিতর্ক খুব বেশি নেই।

    সমাজবদলের স্বপ্ন নিয়ে দুটি আন্দোলনেই অধিকাংশ যুবক জীবনদান করেছেন। রাষ্ট্রের সঙ্গে এই আন্দোলনের সম্পর্ক বা রাষ্ট্রবিরোধী উপাদান নিয়ে হাজার রকম বিতর্ক চলতে পারে। তবে এ কথা অনস্বীকার্য আন্দোলন দুটির পেছনে যারা জীবনদান করেছেন, তারা ছিলেন সে সময়ের সবচেয়ে ‘র‌্যাডিকেল’ যুবক সম্প্রদায়।

    আন্দোলনের হঠকারিতা, আন্দোলনের পেছনে সাম্রাজ্যবাদীদের ভূমিকা নিয়েও অনেকে প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারেন। প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে হাজার হাজার র‌্যাডিকেল তরুণের জীবন নষ্ট করার পেছনের উদ্দেশ্য নিয়েও। যে যুবক সম্প্রদায় দুটি আন্দোলনের পেছনে নিজেদের উৎসর্গ করেছিলেন তাদের পার্থিব জগতের ধ্যানধারণা এবং ভবিষ্যতের দূরদৃষ্টি নিয়ে প্রশ্ন তোলাও অস্বাভাবিক নয়।

    পৃথিবীজুড়ে ষাট ও সত্তর দশকে সমাজতন্ত্রের আকর্ষণে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে যে উন্মাদনা সৃষ্টি হয়েছিল, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও তার স্থায়ী ছাপ ছিল। আর তাই সংবিধানে ‘সমাজতন্ত্র’ শব্দটি যুক্ত হয়। ষাট ও সত্তর দশকের সেই উন্মাদনা এবং মুক্তিযুদ্ধ জাসদের পেছনে স্বাপ্নিক তরুণদের একত্রিত করেছিল। একইভাবে সমাজতন্ত্রের উন্মাদনা নকশালবাড়ির তরুণদের একত্রিত করেছিল। আর তাই কানু সান্যাল এবং কর্নেল তাহেরের মতো আদর্শবান দৃঢ় স্বাপ্নিক বিপ্লবীরা এই আন্দোলনের পেছনে জড়ো হয়েছিলেন।

    যদিও বাংলাদেশে সিরাজ সিকদারেরা নিজেদের সেই উন্মাদনার স্বাপ্নিক হিসেবে প্রমাণ করতে বারবার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু জনগণের মূল স্পিরিট বা অনেকাংশে মুক্তিযুদ্ধের মতো বিপ্লবের সঙ্গে সর্বতোভাবে না থাকতে পারার জন্য ছিটকে পড়তে হয় তাদের। উল্টো অস্থায়ী স্বাধীন বাংলার বিপ্লবী সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থানের কারণে স্বাপ্নিক প্রগতিশীল তরুণদের অধিকাংশের সমর্থন এবং অবিশ্বাসে পরিণত হয় তাঁর দল।

    অপরদিকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা আদর্শিক স্বাপ্নিক প্রগতিশীল তরুণদের বড় অংশ জড়ো হয় জাসদের পেছনে। আর তাই মুক্তিযুদ্ধের পরে রাতারাতি তৈরি হয়ে যায় দলটি। সাম্রাজ্যবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তি তারুণ্যনির্ভর এই শক্তির বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে নেপথ্যে সহযোগিতাও করে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য। অস্থির চিত্তের এই তরুণদের নানা রকম হঠকারী কাজে প্রচারসহ বিভিন্নভাবে সাম্প্রদায়িক-সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী পেছন থেকে বঙ্গবন্ধু সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে এবং অজনপ্রিয় করতে সহযোগিতা করে। মূলত এ ধরনের আদর্শবান তরুণদের নিয়ন্ত্রণে যোগ্যতার প্রমাণ রাখতে পারেননি জাসদ নেতৃবৃন্দ।

    সত্তর দশকের এই স্বাপ্নিক তারুণ্য বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের পেছনে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে আকাশচুম্বী আকাঙ্ক্ষা রাতারাতি অর্জনের স্বপ্নে বিভোর হয়। ভারতের নকশালবাড়ি আন্দোলনে বিপ্লবীরা বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা থেকে শুরু করে শিক্ষাব্যবস্থার রাতারাতি পরিবর্তনের জন্য যে অস্থিরতা প্রদর্শন করে বাংলাদেশেও জাসদ তারুণ্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবন ঘেরাওসহ নানা রকম জ্বালাও-পোড়াওয়ের মধ্য দিয়ে একই রকম অস্থিরতা প্রদর্শন করতে থাকে। সমাজের শৃঙ্খলা ভেঙে পড়াসহ নতুন করে নানাবিধ সামাজিক অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। আর এ ধরনের একটি পরিস্থিতি কাম্য ছিল সাম্রাজ্যবাদী ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর।

    মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে আকাশচুম্বী প্রত্যাশার সৃষ্টি হয়েছিল, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আদর্শবাদী তরুণ সম্প্রদায়ের সে আকাঙ্ক্ষা খুব দ্রুত বাস্তবায়ন করা পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্রের পক্ষেই সম্ভব ছিল না। আর তাই বিপ্লব, স্বাধীনতা বা ইতিহাসের বড় বাঁক পরিবর্তনের ঘটনার পর পরই সমাজ ও রাষ্ট্রে এক অস্বাভাবিক অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। আর এই অস্থিরতা স্বাভাবিক পর্যায়ে এনে সমাজ ও রাষ্ট্র তৈরি করার মধ্যেই ইতিহাসের বিপ্লব, স্বাধীনতা বা বাঁক পরিবর্তনের সর্বোচ্চ সুযোগ বাস্তবায়ন করতে হয়। আর এই সময়ে অস্থির আদর্শবাদী তরুণদের বিপথগামী বা বিভ্রান্ত করে সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী তাদের সব সম্ভাবনা নষ্ট করে দেওয়ার অপচেষ্টা চালায়। কখনও মিত্রের বেশে কখনও বিপ্লবোত্তর ক্ষমতাসীন নেতৃত্বের বিরুদ্ধে একধরনের বিদ্রোহের জন্ম দেওয়া হয়।

    পৃথিবীর সব বিপ্লব বা স্বাধীনতাত্তোর দেশকে এই সমস্যা মোকাবেলা করতে হয়েছে। আর তাই বলা হয়, বিপ্লবের পরেই প্রতিবিপ্লব আসে। বিপ্লব তার সন্তানকে প্রত্যাখ্যান করে। যেসব দেশ এই অস্থিরতাকে মোকাবেলা করে সফলভাবে বিপ্লব বা স্বাধীনতাকে সংহত করতে পেরেছে তারাই দ্রুত উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছেছে। স্বাধীন বাংলাদেশকেও সেই পর্যায় অতিক্রম করতে হয়েছে। আর এই অতিক্রমের পর্যায়ে জাসদের জন্ম।

    স্বাধীনতাত্তোর ক্ষমতাসীন বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধেই মূলত ব্যবহৃত হয়েছে এই তরুণ আদর্শবাদী স্বাপ্নিক যুবসম্প্রদায়। ভারতে নকশালবাড়ির সশস্ত্র আন্দোলনের সঙ্গে যদিও জাসদকে মেলানো অনেকাংশে দুরূহ, কিন্তু এ ক্ষেত্রে তরুণদের আকর্ষণ করার পেছনে দুই আন্দোলনেরই সাযুজ্য রয়েছে। সশস্ত্র আন্দোলনের ক্ষেত্রে অনেকাংশে নকশালবাড়ির সঙ্গে সিরাজ সিকদারদের মিল বেশি। কিন্তু জনপ্রিয়তা বা আকর্ষণ করার ক্ষেত্রে নকশালবাড়ি এবং সিরাজ সিকদারদের মধ্যে ঠিক সমপরিমাণ দূরত্ব।

    আকাশচুম্বী প্রত্যাশা, অস্থির তারুণ্য, অস্থির সামাজিক রাষ্ট্রীয় অবস্থান– এ ধরনের এক পরিস্থিতিতে ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শহীদ হন। ৩ নভেম্বর জেলখানায় হত্যা করা হয় মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী জাতীয় চার নেতাকে। পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র টালমাটাল অবস্থায় পতিত হয়। বঙ্গবন্ধু ও চার নেতা হত্যার মধ্য দিয়ে সাম্রাজ্যবাদী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী তাদের চূড়ান্ত আঘাত হানে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিজয়ী জাতি ও তার রাজনীতি গভীর সংকটে পড়ে।

    এ পরিস্থিতে ৭ নভেম্বর কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে জাসদ সিপাহি বিপ্লবের ডাক দেয়। ব্যর্থ হয় তাদের প্রচেষ্টা। ফাঁসিতে মৃত্যুবরণ করেন স্বাপ্নিক বিপ্লবী কর্নেল তাহের। ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় জাসদের তারুণ্য। জেলখানায় জাসদের একটি বড় অংশ জিয়াউর রহমানের সঙ্গে আপসের মধ্য দিয়ে মুক্তিলাভ করে। রাজনৈতিক মঞ্চে সরাসরি প্রবেশ ঘটে সাম্প্রদায়িক সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর। ছিন্নভিন্ন আদর্শবান তরুণদের কেউ পুরনো আওয়ামী লীগ আবার কেউ সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর সঙ্গে মিলে যায়।

    যে স্বপ্ন আদর্শ নিয়ে তরুণ স্বাপ্নিকেরা জীবন বাজি রাখতে চেয়েছিল ম্রিয়মান হয়ে যায় তাদের সামনের স্বপ্ন-আশা-আকাঙ্ক্ষা। অনেকটা “ঘর পোড়া আগুনে আলু সেদ্ধ” করে নেয় সাম্প্রদায়িক-সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী।

    পৃথিবীজুড়ে পুরো ষাট-সত্তর দশকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নেতৃত্বে এবং অংশগ্রহণ করেছে স্বাপ্নিক বিপ্লবীরা। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের স্বপ্ন নিয়ে একটি বড় অংশের তরুণ স্বাপ্নিক যুবকগোষ্ঠী ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বিপ্লব, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে। প্রথম পর্যায়ের পরেই খেই হারিয়ে ফেলে তারা। নানা রকম মতবাদ আদর্শ বিশ্বাসে জড়িয়ে অপমৃত্যু ঘটে সেই স্বপ্নের। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে আমেরিকান পুঁজিবাদী সমাজেও স্বাপ্নিক যুবকদের হতাশার মধ্য দিয়ে জন্মলাভ করেছিল বিটলস, হিপ্পিসহ নানাবিধ সংস্কৃতি ও আন্দোলনের।

    দুঃখজনক হলেও সত্য সাম্প্রদায়িক ও সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী বাংলাদেশে ‘জাতীয়তাবাদ’ শব্দটিকে সবচেয়ে বড় উপহাসে পরিণত করেছে। জাতীয়তাবাদের সঙ্গে একটি জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রগতিশীলতা অসাম্প্রদায়িকতা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। অথচও এখানে সাম্প্রদায়িক সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী নিজেদের পরিচয়ের জন্য জাতীয়তাবাদী শব্দটিকে ব্যবহার করেছে। আর তাই সেই তথাকথিত জাতীয়তাবাদীরা হাজার বছরের বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি পুরোপুরি অস্বীকার করে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে জাতীয়তাবাদের নতুন সংজ্ঞা তৈরি বা আবিষ্কারের অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

    এ রকম বাস্তবতায় পৃথিবীর সব সমাজে দেশে পঞ্চাশ, ষাট ও সত্তর দশকের সেই স্বাপ্নিক প্রজন্ম, স্বাপ্নিক আদর্শ, স্বাপ্নিক আন্দোলনগুলো নতুন মূল্যায়নের পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে।

    নতুন মূল্যায়নের বর্তমান পর্যায়ে এসে বাংলাদেশে অনেকের কাছে একাকার হয়ে গেছে সাম্প্রদায়িক ও সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর তথাকথিত জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে স্বাপ্নিক আদর্শবাদী তরুণদের কার্যকলাপ। ঐতিহাসিক বিচার বা মূল্যায়নের কোনো স্তরে দুটিকে একভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। পৃথিবীজুড়েই স্বাপ্নিক বিপ্লবীরা নানা রকম প্রচেষ্টা চালিয়েছে। এর পরিণতিতে কখনও কখনও মৌলবাদ সাম্রাজ্যবাদ বা সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী তাদের জায়গা তৈরি বা পোক্ত করে নিলেও একই মাপকাঠিতে দুটোকে দেখা বা মূল্যায়নের কোনো অবকাশ নেই। আর তাই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাতেও দুটোকে এক করে দেখা যায় না।

    বিশ্বব্যবস্থায় তরুণ জনগোষ্ঠী বিভিন্ন আন্দোলন আদর্শের জন্ম দিয়েছে। সেসব আন্দোলন অনেক সময়ে মধ্যপথে খেই হারিয়েছে। পরে আবারও অনেক সময় পুনরুজ্জীবন ঘটেছে সেসব আন্দোলন বা আদর্শের। একসময় বিশ্বজুড়ে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্য এক বিশাল তরুণ প্রজন্ম আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিল। এরও আগে ভারতবর্ষে বিপ্লবী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার দাবিতে আত্মোৎসর্গ করেছিল বিশাল এক তরুণ প্রজন্ম। বিপ্লবীরা স্বাধীন ভারতবর্ষের স্বপ্ন নিয়ে নিজেদের উৎসর্গ করেছিল।

    অসাম্প্রদায়িক, ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত স্বদেশের জন্যই বিশ্বজুড়ে তরুণ প্রজন্ম আত্মত্যাগের মন্ত্রে দীক্ষিত হত। সেই মন্ত্র হল, “সকলে মোরা পরের তরে”; এর বাস্তবায়ন ছিল তাদের লক্ষ্য। পথের ভিন্নতায় একে অপরকে নিধনের নেশায়ও আত্মহনন করেছে অসংখ্য স্বাপ্নিক যুবক। কিন্তু তার মানে শেষ হয়ে যায় না তাদের স্বপ্ন, তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা।

    রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা সুযোগ-সুবিধার প্রলোভনে তারুণ্যের একটি বড় অংশ বিপথে পরিচালিত হলেও বাকিরা ঠিকই থেকে যায় আদর্শ ও স্বপ্ন ধারণ করে, যদিও তারা সংখ্যায় হয়তো খুব বেশি নয়। কিন্তু মূল্যায়নের পর্যায়ে এসে সাম্রাজ্যবাদ বা সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে আদর্শবাদী স্বাপ্নিক যুবকদের একপর্যায়ে মূল্যায়ন– চিন্তা ও মেধার দৈন্য ছাড়া আর কিছু হতে পারে না!

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.