গতকাল সন্ধ্যারাত থেকেই আমার মনটা খারাপ। মোবাইল ফোনে খবরটা শোনার পর থেকেই। আমার পরিচিত ছোট ভাইটা মারা গেছে। মৃত্যুসংবাদের ভেতর অস্তিত্বহীনতার একটা ভয় কাজ করে। মানুষ বিষয়টাকে মায়া হিসেবে অনুভব করে। কফিল উদ্দিনের মৃত্যুসংবাদটা অন্যান্য মৃত্যুসংবাদের মতোই বেদনার, অস্তিত্বহীনতার হতে পারত। কিন্তু তা হয়নি আমার কাছে। আর আমার মন খারাপ কেন তারও ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই।
এপ্রিল মাসের শেষ দিকে বিএনপি-কর্মী কফিল উদ্দিন আওয়ামী লীগ-কর্মীদের হামলার শিকার হয়। সে তার আহত সহকর্মীকে হাসপাতালে পৌঁছে দিতে গেলে আওয়ামী লীগ কর্মীগণ তাকে অমানুষিকভাবে আহত করে। কয়েকদিন উপজেলা হাসপাতালে চিকিৎসাশেষে সে বাড়ি ফেরে। তার প্রয়োজন ছিল উন্নত চিকিৎসার। পেনশনভোগী দরিদ্র পিতার পক্ষে তাকে উন্নত চিকিৎসা করানো এক প্রকার অসম্ভবই ছিল। তবুও পিতা শেষ সঞ্চয়ের লক্ষাধিক টাকা খরচ করে নিঃস্ব হয়ে পড়েন। অন্যদিকে তার দলীয় নেতৃবৃন্দ বিরোধী দলে থাকায় বড় বিপদে দিনযাপন করছে। কেউ বাড়ির কাজ শেষ করতে পারছে না। কেউ বা গাড়ি চালানোর তেলের টাকাও যোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছে। আবার কাউকে ব্যবসা-বাণিজ্য সচল রাখতে সরকারি দলকে চাঁদা দিতে দিতে পথে বসার দশা। এর মাঝেই চিকিৎসাহীন কফিল উদ্দিনের শরীর ভেতরে ভেতরে পচতে থাকে। ‘ডিজিটাল’ পিটুনিতে তার দুটি কিডনিই অকেজো হয়ে যায়।
টনক নড়ে দলীয় নেতাদের। কফিল উদ্দিনরা যদি বিনাচিকিৎসায় মারা পড়ে, তবে সামনের ক্ষমতার যুদ্ধে, ভোটের যুদ্ধে ও লুটপাটের যুদ্ধে কে লাঠি ধরবে? কে মিছিল-মিটিং-এ মাথার সংখ্যা বাড়াবে? তারা নিজেরা চাঁদা তুলে চট্টগ্রাম শহরে পাঠায় উন্নত চিকিৎসার জন্য। শহরের একটি ক্লিনিকে তার ডায়ালাইসিস আরম্ভ হয়। চিকিৎসকরা জানান, চারদিন পর-পর ডায়ালাইসিস করে কিডনি ন্যূনতম ভালো অবস্থায় আনার পর তার শরীরে নতুন কিডনি প্রতিস্থাপন করতে হবে।
চার-পাঁচবার ডায়ালাইসিস করবার পর দেখা গেল দলীয় নেতাদের আবেগ তলানিতে এসে ঠেকতে আরম্ভ করেছে। চিকিৎসার টাকা দিতে তাদের স্বভাবজাত তালবাহানা আরম্ভ হয়েছে। আর মরার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো ডাক্তার জানালেন, তার শরীরে টিবিরোগ বাসা বেঁধেছে — চিকিৎসা পেলেও বাঁচার সম্ভাবনা ৫০ শতাংশ! অসহায় পিতা চিকিৎসকদের কথা, দলীয় নেতৃত্বের অবহেলা আর নিজের পরিবারের ঘোর অন্ধকারের কথা ভেবে সিদ্ধান্ত নেন, ছেলের আয়ু যতদিন আছে ততদিন বাঁচবে, অন্তত বাকি ছেলে-মেয়েদের দিকে তাকাতে হবে। তিনি তাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। পিতার সিদ্ধান্ত জানার পর নেতারা আবার তার পিতাকে আশ্বস্ত করতে চান। চিকিৎসার সব দায়িত্ব তাদের, তিনি যেন কফিল উদ্দিনকে বাড়ি নিয়ে না যান। কিন্তু অনড় পিতা প্রিয় সন্তানকে নিয়ে বাড়ির পথে রওনা করেন। বাড়িতে পৌঁছা মাত্রই কফিল উদ্দিন অন্যলোকে যাত্রা করে।
এখানে একটা বিষয় বলতে চাই। কফিল উদ্দিন আহত হবার পর থানায় মামলা করতে গেলে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নানান তালবাহানা করে মামলা নেওয়া থেকে বিরত থাকেন। তিনি সর্বশেষে এই বলে কফিল উদ্দিনের পিতাকে বিরত করেন : উপরের নির্দেশে মামলা নেওয়া যাবে না। কফিল উদ্দিন মারা যাবার পর তার পিতা আর কোনো মামলা করতে যাননি। যতদূর জানতে পেরেছি, এতে দলীয় নেতৃবৃন্দ তার পিতার উপর নাখোশ হয়ে আছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের শায়েস্তা করার সুযোগ হারানোর বেদনায়!
আমি গতকাল থেকে একটা প্রশ্ন মাথায় নিয়ে ক্লান্ত হয়ে আছি : কফিল উদ্দিনের মৃত্যুটা কি স্বাভাবিক মৃত্যু, না হত্যাকাণ্ড? যদি হত্যাকাণ্ড হয়ে থাকে তার, তাহলে কে মেরেছে? আওয়ামী লীগ, না বিএনপি, না তার অসহায় পিতা?

জন্ম ১৭ জানুয়ারি, ১৯৭৩। চাকরিজীবী। চলচ্চিত্র নির্মাণে আগ্রহী। পছন্দ করি খেতে, ঘুরতে, আড্ডা দিতে।
