মাঠে খেলছি, এ সময়ে হঠাৎ কোনো বন্ধু হয়তো খবর আনল : 'ওডা চল, কেরাইয়্যা-র (কেরামত আলীর) বাড়িৎ মেজ্জান চলের' (ওরে চল, কেরামত আলীর বাড়িতে মেজবান চলছে)। তৎক্ষণাৎ খেলা বন্ধ। বড় ভাই আদেশ করলেন : 'দোম্বি যা, ঘরে যাই নুন লই আয়, আন্ডা থিয়াইছি' [...]

আমার শৈশব কেটেছে চট্টগ্রাম শহরের ঈদগা-র মুন্সীপাড়ায়। ঊনআশি, আশি সাল। পুরো ঈদগা-ই তখন ছিল না-শহর না-গ্রাম। তখনও ঈদগা অঞ্চলের লোকজন নিউমার্কেটের দিকে এলে বলত : ‘শহরৎ যাইর’ (শহরে যাচ্ছি)। আজ কয়েকদিন হল মুন্সীপাড়াটা বুকের ভেতর জেগে উঠেছে। আহা কী ছিমছাম ছিল পাড়াটা। ধানক্ষেত, পুকুর, খেলার মাঠ। সকাল বেলা সবাই মিলে স্কুলে যাওয়া, দুপুরে স্কুলফেরত ‘হাজার দিঘি’তে সাঁতার কাটা, বিকেলে রঙ্গিপাড়া বিলে ফুটবল খেলা। সবচেয়ে বেশি মনে পড়ছে মেজবান খাওয়ার কথা।

ঈদগা অঞ্চলে ধনী মানুষের মূল ব্যবসা ছিল পরিবহন আর পাহাড়তলি বাজারের সওদাগরি ব্যবসা। বেডফোর্ড কোম্পানির ট্রাক ছিল তাদের। নতুন ট্রাক কিনে বারো আউলিয়ার মাজার দর্শন এবং মেজবান দেওয়া ছিল নিয়ম। আর ছিল বিভিন্ন পীরের জন্ম বার্ষিকী এবং মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষে মেজবান। মানুষ মারা গেলে চারদিনের দিন মাছ-ফাতেহা বা মেজবান। এ রকম নানান উপলক্ষের মেজবান। মেজবান খাবার সময়টাও ছিল অদ্ভুত। ফজরের নামাজ শেষে ভোরে, সকাল দশটায়, আসরের নামাজ শেষে বিকেল বেলায় এবং রাতে। আমি ও আমার বড় ভাই বাবার সাথে মেজবানে যেতাম পারিবারিকভাবে নিমন্ত্রিত হয়ে। তবে বেশির ভাগ সময়ে মেজবান খেয়েছি আমি, আমার বড় ভাই আর বন্ধুরা মিলে বিনা নিমন্ত্রণে। মাঠে খেলছি, এ সময়ে হঠাৎ কোনো বন্ধু হয়তো খবর আনল : ‘ওডা চল, কেরাইয়্যা-র (কেরামত আলীর) বাড়িৎ মেজ্জান চলের’ (ওরে চল, কেরামত আলীর বাড়িতে মেজবান চলছে)। তৎক্ষণাৎ খেলা বন্ধ। বড় ভাই আদেশ করলেন : ‘দোম্বি যা, ঘরে যাই নুন লই আয়, আন্ডা থিয়াইছি’ (দৌড়ে যা, বাসায় গিয়ে লবণ নিয়ে আয়, আমরা অপেক্ষা করছি)। আদেশ মাত্রই পালন। বাসায় গিয়ে খবরের কাগজ অথবা স্কুলের খাতার পাতা ছিঁড়ে তাতে মুড়ে লবণ নিয়ে ফিরে আসা। তারপর ‘কেরাইয়্যা’দের বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা।

মেজবান স্থলে লোকে লোকারণ্য। পুকুরে হাত ধুয়ে খেতে বসে পড়া মুখোমুখি এক লাইনে। এরকম কয়েক লাইন করে বসানো হতো মাটিতে। শুধুমাত্র মুরব্বি আর গণ্যমান্যদের জন্য ছিল চেয়ার-টেবিলে বসবার ব্যবস্থা। ছোটরা এবং সর্বসাধারণ মাটিতে। মুখোমুখি দু’জন বসায় মাঝখান বরাবর একটা প্যাসেজের মতন তৈরি হতো। সেই প্যাসেজ ধরে দুইজন লাই-এ করে মাটির সানকি নিয়ে আগে আগে যেত, আরেকজন লাই থেকে সানকি নিয়ে প্রত্যেকের সামনে রাখত। সানকি পাতার পর লাই-ভর্তি ভাত নিয়ে দুজন আগে আগে যেত, পেছন থেকে একজন একটা সানকিতে করে প্রত্যেককে ভাত বেড়ে দিত। ভাতের পেছন পেছন বালতিতে করে একজন মাংস, একজন সবজি, একজন ডাল দিয়ে যেত। শুধু লবণ দেওয়া হতো না। তখন পকেট থেকে লবণ বের করে প্রত্যেককে দিতাম আমরা নিজেদের মধ্যে। ভাত মাংস সবজি ডাল যে যতটা চাইত পেত। পেট ভরে খাবার পর আবার পুকুরে নেমে হাত ধুয়ে প্যান্টের পেছনে হাত মুছে হৈচৈ করতে করতে ঘরে ফিরতাম।

মেজবানের খাবার পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ খাবারগুলোর একটা, আমি বাজি ধরে বলতে পারি। আমার জানামতে বাংলাদেশে একমাত্র চট্টগ্রামেই মেজবানের চল আছে।

আবু নঈম মাহতাব মোর্শেদ

জন্ম ১৭ জানুয়ারি, ১৯৭৩। চাকরিজীবী। চলচ্চিত্র নির্মাণে আগ্রহী। পছন্দ করি খেতে, ঘুরতে, আড্ডা দিতে।

১৫ comments

  1. কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর - ৯ নভেম্বর ২০০৯ (৩:১১ অপরাহ্ণ)

    আসলেই চাটগাঁ’র মেজবানের তুলনা হয় না। আমরা যারা কথিত বইঙ্গে, (আমি যদ্দূর জানি, চট্টগ্রামের স্থানীয়জন অনেকটা মজা করে, অনেকটা শ্লেষের সাথে চট্টগ্রামের বাইরের লোকজনকে তাই বলে, আবার কেউ কেউ নোয়াখালীসহ অন্যান্য জায়গার মানুষকে জাপানিও বলে) তারাও এর প্রতি দারুণ নেশা অনুভব করি। এর গরুর মাংশের পাকের ধরনই আলাদা। ভাতও খুবই সুস্বাদু। যাই হোক, আমার বাল্যকাল তো আর চট্টগ্রামে কাটেনি, যারফলে মাহতাব-এর শৈশব তো আর আমার নেই। তবু মেজবানের নেশায় পড়ে আমার জিবে পানি চলে এল। এখন মেজবান কোথায় পাই!!!

  2. নুর নবী দুলাল - ৯ নভেম্বর ২০০৯ (৬:৫৮ অপরাহ্ণ)

    আবু নাঈম, আপনি আমাকে নষ্টালজিক করে দিলেন। আমার শৈশব, কৈশর, যৌবন সব কেটেছে চট্টগ্রাম-এ। চট্টগ্রামের মেজবান কি একটা দারুন খাবার, আমি তা জানি। আমার ধারনা পৃথিবীর কোন খাবারের সাথে, চট্টগ্রামের মেজবান-এর তুলনা হয় না। বিশেষ করে, মেজবানের মাংশ ; এ যেন এক অমৃত খাবার। লেখাটি পড়ে জাহাঙ্গীর ভাইয়ের মত আমারও জিহ্‌বায় জল এসে মেজবানের স্বাদের বন্যা বয়ে যাচ্ছে……..। চট্টগ্রামের মেজবানের ঐতিহ্য এখনও আছে। আমার জানামতে জাহাঙ্গীর ভাই চট্টগ্রামেই থাকেন। আপনিতো ইচ্ছে করলেই মেজবানের স্বাদ গ্রহন করতে পারেন। সামনে শীতকাল……মেজবানের সময় আসছে। আমি এখনও মেজবানের দাওয়াত পাই, আর চট্টগ্রামে থাকলে সহজে মিস্‌ করিনা………আগামী যে কোন মেজবানের দাওয়াত পেলে এবং আমি চট্টগ্রামে থাকলে, অবশ্যই জাহাঙ্গীর ভাইকে নিয়ে যাব………….

    • কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর - ৯ নভেম্বর ২০০৯ (৮:০০ অপরাহ্ণ)

      হাহাহা, আপনার সহযাত্রী হওয়ার প্রতীক্ষায় থাকলাম।
      জনাব দুলাল, আপনাকে ভালোবাসা।

  3. ইমতিয়ার - ১০ নভেম্বর ২০০৯ (৫:৪৫ অপরাহ্ণ)

    আপনার মেজবানের তপ্ত স্মৃতি ভাল লাগল। লিখেছেন,

    আমার জানামতে বাংলাদেশে একমাত্র চট্টগ্রামেই মেজবানের চল আছে।

    বিষয়টি বোধহয় ঠিক নয়। চট্টগ্রামের মেজবানের সুনাম এবং ধারাবাহিকতা অনেকদিনের, কিন্তু মেজবান আরও কোনও কোনও অঞ্চলে প্রচলিত আছে। জাহাঙ্গীর ভাইয়ের মতো আমাকেও মেজবানের গরুর মাংসের স্বাদ এখনও প্রলুব্ধ করে। কৈশোরে এই মাংসের স্বাদের কারণে, আমরা বন্ধুরা মিলে মাঝেমধ্যেই এলাকার অর্থবান মানুষদের মৃত্যুকামনায় মেতে উঠতাম! মেজবানে দাওয়াত দেয়া হয় পুরো পরিবারকে, তা ছাড়া বলা হয় আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদেরও নিয়ে আসতে,- জন্মমৃত্যুকে কেন্দ্র করে এরকম আনন্দময় সামাজিক উৎসবের উৎস হয়তো আমাদের অবচেতনে লুকিয়ে থাকা পশুশিকার সমাজের প্রবৃত্তি।

  4. গৌতম - ১০ নভেম্বর ২০০৯ (৯:০৩ অপরাহ্ণ)

    মেজবানের অনেক খবর পড়ি পত্রিকাতে। কখনও খাওয়া হয় নি, দেখাও হয় নি এর সমাহার-উৎসব-আয়োজন। আপনার পোস্ট লোভ জাগালো আবারও। অফিসিয়াল কাজে চট্টগ্রাম যেতে হয় মাঝে মাঝে। এর মাঝে কখনও মেজবানের আয়োজন দেখলে ঢুকে পড়বো— উদ্দেশ্য জানালে নিশ্চয়ই তাদের আতিথেয়তা থেকে বঞ্চিত হবো না!

  5. মুয়িন পার্ভেজ - ১১ নভেম্বর ২০০৯ (১২:৫৫ পূর্বাহ্ণ)

    মেজবানের ক্ষেত্রে দু’টি বিশেষণের প্রয়োগ দেখা যায় চট্টগ্রামে : ‘হাজিয়া’ (তাজা) মেজবান ও ‘বাই’ (বাসি) মেজবান। ‘বাই’ মেজবানের কদর বেশি, কারণ রাতে রান্না করা মাংস পরিবেশিত হয় সকালে, যা উত্তমরূপে সিদ্ধ, ফলে সুস্বাদু। রোজার মাসে আমার ছোট দাদা যে-কোনো এক রাতে মেজবানের আয়োজন ক’রে থাকেন মুসল্লিদের জন্য। সাধারণত প্রথম দুয়েক রাতে পাড়ার মসজিদে তারাবির নামাজে কাতারের জৌলুশ থাকলেও ধীরে-ধীরে ক’মে গিয়ে মাত্র এক-দেড় কাতারে এসে দাঁড়ায়, কিন্তু মেজবানের রাতে মুসল্লির অভাব হয় না। ছেলেবেলায় এমন এক মেজবানে আমার পাতে পড়ছিল দ্বিতীয়বার একবাটি মাংস, সামনে বসা জনৈক বৃদ্ধ প্রতিবেশী আক্ষেপ করলেন, ‘পোয়া ইবা এতাগ্গিন গোস্ত খাইত পারিবো না!’ ব্যস, হয়ে গেল। বহুদিন আর মাংস খেতে পারিনি (এখন ছেড়েছি স্বেচ্ছায়) — দেখলেই বিস্বাদে ভ’রে উঠত মুখ। ‘নজর লাগা’ আর কাকে বলে!


    মসজিদের মুয়াজ্জিন সন্দ্বীপের লোক, বয়স সত্তরাধিক। একদিন বাড়ির পুকুরে মাছ ধরতে গিয়ে ফুর্তির মেজাজে গেয়ে উঠলেন :

    আঁর নাতিন দিইয়ি মেজবানি
    নাতিন দেইখতে সোন্দর বইতে লাগে আধগানি

    গানের দ্বিতীয় কলি মনে গেঁথে গেল — বসার জন্য ‘আধগানি’ (আধকানি = ১০ গণ্ডা) জমি লাগে! নারীনিতম্বের প্রশংসায় বাঙালি কবিরা পঞ্চমুখ; শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-এর কবি বড়ু চণ্ডীদাস বা পদ্মাবতী-র কবি আলাওল শুধু নন, আধুনিক কবিরাও অত্যন্ত উৎসাহী, কিন্তু এমন অর্থালঙ্কারের প্রয়োগ আগে দেখিনি।

    যা হোক, মূল কথায় আসি। মেজবানের সঙ্গে ধর্মীয় প্রণোদনা ও সামাজিক মর্যাদার প্রশ্ন জড়িত, কিন্তু একজন সংবেদনশীল মানুষ কি সানন্দে মেজবান খেতে যেতে পারেন? মেজবানে যাওয়া মানেই তো নির্দোষ পশুর নির্মম হত্যাকাণ্ড সমর্থন করা, নয় কি?

    • কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর - ১৪ নভেম্বর ২০০৯ (৪:০৪ অপরাহ্ণ)

      মূল কথায় আসি। মেজবানের সঙ্গে ধর্মীয় প্রণোদনা ও সামাজিক মর্যাদার প্রশ্ন জড়িত, কিন্তু একজন সংবেদনশীল মানুষ কি সানন্দে মেজবান খেতে যেতে পারেন? মেজবানে যাওয়া মানেই তো নির্দোষ পশুর নির্মম হত্যাকাণ্ড সমর্থন করা, নয় কি?

      মুয়িন বেশ একটা মৌলিক প্রসংগই তুলেছেন। মেজবানে সানন্দে যাওয়ার বিষয়টাতে দৃশ্যত বেখাপ্পা মনে হলেও মানুষ অবচেতন মনে তো পাশবিক উল্লাস বহন করছেই। একটু ভেবে দেখুন তো, মানুষের চেয়ে হত্যামুখর প্রাণী জগতে আর দ্বিতীয়টি আছে কিনা? পৃথিবীর প্রত্যেকটা প্রাণীই প্রাণীজ বা বনজ প্রাণী বা প্রাণের অংশ ভক্ষণ করেই তাদের জীবনকে জগৎমুখি রাখতে পারছে- কিন্তু মানুষের মতো অত আয়োজন করে কে বা কারা খাওয়া-দাওয়া সাংগ করে? প্রাণীকে স্বাদমুখর করে খাওয়ার জন্য মানুষের সে কী চেষ্টা! কোরাবানির ঈদের কথা মনে করলে মুসলমান জাতিকে কত উল্লাসমুখর জাতি মনে হয়!
      তবে এতে ভিন্নমতও তুলে ধরা যায়। এই যেমন, গৌতম বুদ্ধের এক অনুসারীকে প্রাণীদের ব্যাপারে অতি সংবেদনশীল বলাতে তিনি হাসতে হাসতে বললেন, তাঁর প্রকৃত অনুসারী হতে গেলে তো একটা কদমও চলা যাবে না।
      এন্টিবায়োটিক মানে কি- মুয়িন তো নিশ্চয়ই জানেন? তাহলে তো তার মতো সংবেদনশীল মানুষের পক্ষে এই জাতীয় অসুধ খাওয়া সঠিক নয়। কারণ আপনি তো জেনে-শুনে প্রাণীহত্যাকারী সেবন করতে পারেন না। ঠিক কিনা?
      আসলে সভ্যতা, সমাজ, বিজ্ঞান, সামাজিক বিন্যাসের পরিবর্তনের সাথে সাথে ব্যক্তিক-সামাজিক বোধও পরিবর্তিত হয়ে যায়। এমনকি মানুষের সংবেদনশীলতাও ক্রমে ক্রমে বদলে যেতে থাকে।
      এবার মূল লেখার স্পিরিটের বিষয়টা স্মরণ করি, এইখানে মাহতাব স্রেফ তার বালককালের স্মৃতি অত্যন্ত প্রাণবন্তভাবে জানিয়ে গেছেন। তিনি বর্তমান সময়ের মেজবানের কথা বলেননি। তাহলে হয়ত তিনিও মুয়িনের মতো বিজ্ঞানমনস্কতা দিয়ে তার উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতেন।
      অন্তত আমি সদাসর্বাদা যুক্তি-তর্ক দিয়ে আমার শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিকে ঝামেলায় ফেলতে চাই না।

      • মুয়িন পার্ভেজ - ১৫ নভেম্বর ২০০৯ (৪:২৬ অপরাহ্ণ)

        স্পেনবিষয়ক একটি সুখপাঠ্য ভ্রমণলিপিতে বিখ্যাত ষাঁড়ের লড়াই সম্পর্কে লিখছেন দীপ্তেন্দু চক্রবর্তী :

        বুল ফাইটের জন্য করডোবা বিখ্যাত। সে অবশ্য সারা স্পেনই। বুল ফাইট ওদের জাতীয় খেলা বলা যেতে পারে। যেমন ওরা ফুটবল-পাগল তেমনি ওরা ষাঁড়ের লড়াইয়ের জন্য বিখ্যাত। বিরাট একটা গোল চত্বর বা গ্যালারি। ঠিক দেশের খেলার মাঠের মতো। আমরা টিকিট কিনলাম করডোবা থেকে। শহর ছাড়িয়ে বেশ খানিকটা দূরে ময়দান। আজ বড় যুদ্ধ। স্পেনের নাম করা মাটাডর আজ লড়াই করবে। শুধু ষাঁড় মারলে চলবে না। এ যেন আমাদের কত্থক নাচ। খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে মশকরা, হাতের, আঙুলের, চোখের নানা রকম ইশারা। ষাঁড়টাকে কী রকম বোকা বানানো যায়, কীভাবে ওকে ছুটিয়ে ছুটিয়ে দম ফুরিয়ে আস্তে আস্তে পিন ফুটিয়ে মারতে হয় তারই দক্ষ কৌশল। মাঠে আজ খুব ভিড়। আমরা বসার জায়গা পেয়েছি খুবই কাছে। আলোয় ঝলমল করছে সারা মাঠ। বেড়া দিয়ে ঘেরা। মাটাডর জমকালো পোশাক পরে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে ঘিরে জটলা। কালো লাল পোশাক, মাথায় টুপি, হাঁটু অবধি চামড়ার ঝকঝকে পালিশ করা বুট।

        একদল বাজিয়ে ব্যান্ড, বাঁশি বাজাতে বাজাতে মাঠে ঢুকল। করতালিতে ভরে গেল মাঠ। নীচে খাঁচার মধ্যে বিরাট ষাঁড় তার এক ফুট উঁচু শিং নিয়ে রাগে ফুঁসছে। মাটাডর বা খেলুড়ে এবার মাঠে নেমে পড়ল। সবাইকে মাথা নীচু করে বাও করল। হাতে তার কয়েকটা সরু বল্লমের মতো লোহার কাঠি। ভীষণ ধারালো। কাঠিগুলোকে সে এবারে কোমরে গুঁজে একটা বড় লাল চাদর নিয়ে তৈরি। ম্যাটাডর যেন আমাদের ত্রিভঙ্গমুরারি, বেঁকে আছেন লাল চাদর ধরে। শরীর থেকে দশ ইঞ্চি দূরে একহাত দিয়ে চাদর নাচাচ্ছেন। ওদিকে মহিষাসুর তার সামনের দু পায়ে আগুন জ্বালিয়ে ধুলো উড়িয়ে খানিকক্ষণ চোখ পাকিয়ে মাটাডরকে দেখে নেয়। নাক দিয়ে তার বেরুচ্ছে ঝড়ের শব্দ। তারপর শুরু করে তার দৌড়। বাঁকানো শিঙের সামনে পড়লে লরিও ফুটো হয়ে যাবে। বোকাটার লক্ষ্য ওই লাল চাদর। কত্থক-নাচিয়ে ভুরু কুঁচকে সট্ করে ঘুরে যায়। বোকা ষাঁড় চাদরটাকেও ছুঁতে না পেরে অনেক দূর গিয়ে আবার নিশানা ঠিক করে দাঁড়ায়। এবারে আর ভুল হবে না। আবারও সেই ভুল। চাদরটা ঝটকা দিয়ে ঘুরে যায় অন্যদিকে আর সেই ফাঁকে একটা কাঠি বিঁধিয়ে দেয় ওর ঘাড়ে। ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরে আর গ্যালারিতে বসা সভ্য মানুষেরা আমরা হাততালি দেই। এরকমভাবে বেশ কয়েকবার তীক্ষ্ণ শলা ষাঁড়টাকে বিদ্ধ করে করে অবশ করে দেয়। সে আর পারে না দু-পেয়ে মানুষের, জন্তুর থেকেও বেশি শয়তানি দেখে। হাঁটু গেড়ে সে পড়ে যায় মাটিতে। আকাশ-ফাটা চিৎকারে মাঠ ভরে যায়। ঠিক যেন অনেক ঘরবাড়ি পুড়ে যাওয়ার পর, প্রতিদ্বন্দ্বীর হাত-পা কাটার পর, কোনও রাজনীতির দল ভোটে জিতে আকাশ ফাটা চিৎকারে জানান দিচ্ছে যে সবাই ওদের চালাকিরই সমর্থন করে। মাটাডর ষাঁড়টার একটা কান কেটে সবাইকে দেখায়। আরও অনেকগুলো খেলা ছিল কিন্তু আমরা এই সভ্যতার অসভ্যতা দেখতে রাজি ছিলাম না।

        (‘সূর্য, সমুদ্র আর সুন্দরী স্পেন’, দেশ, বর্ষ ৭০, সংখ্যা ২১, ২ সেপ্টেম্বর ২০০৩, কলকাতা, পৃ. ৪৮)

        খেলার নামে ‘বোকা’ পশুকে নিষ্ঠুরতম পন্থায় নিধন করার এই আনন্দোল্লাসকে দীপ্তেন্দুর মনে হয়েছিল ‘সভ্যতার অসভ্যতা’, এর সঙ্গে কোনো বিরোধ নেই কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরের উপলব্ধিরও : ‘মানুষের চেয়ে হত্যামুখর প্রাণী জগতে আর দ্বিতীয়টি’ নেই! এ-আক্ষেপেই বোধহয় বিনয় মজুমদার বলেছিলেন, ‘মানুষ নিকটে গেলে প্রকৃত সারস উড়ে যায়’।

        মাস তিনেক আগে পত্রিকায় একটি ছোট্ট খবর বেরোয় :

        ঘোড়ার গাড়ি নিষিদ্ধের দাবি হেমা মালিনীর
        আনন্দ প্রতিদিন ডেস্ক

        প্রায় তিন দশক আগে ‘শোলে’ চলচ্চিত্রে ঘোড়সওয়ার বাসন্তীর ভূমিকায় অভিনয় করেন হেমা মালিনী। ছবিতে ধান্য নামের একটি মাদি ঘোড়া ব্যবহার করা হয়। অভিনয়ের সুবাদে গাড়ি টানায় ঘোড়ার কষ্ট খুব কাছ থেকে দেখেন তিনি। তাই এবার মুম্বাই শহরে ঘোড়ার গাড়ি নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছেন ভারতীয় এই অভিনেত্রী। তার [শব্দচ্যুতি] যোগ দিয়েছেন জন আব্রাহামও।

        সম্প্রতি প্রাণী অধিকার সংরক্ষণ সংগঠন পেটার পক্ষ থেকে মুম্বাই পৌর কমিশনার জয়রাজ পাঠকের কাছে ঘোড়ার গাড়ি নিষিদ্ধের দাবি সংবলিত একটি আবেদন পাঠিয়েছেন হেমা মালিনী। চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, ‘শহরের বিভিন্ন স্থানে বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু গাড়ি টানতে ঘোড়ার খুব কষ্ট হয়। মুম্বাইয়ে এ দৃশ্য দেখে ধান্যর কথা খুব মনে পড়ছে আমার। তাই এ ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানাই।’

        (সমকাল, ৮ আগস্ট ২০০৯, ঢাকা, পৃ. ৭)

        জানি না মুম্বাই শহরে ঘোড়ার গাড়ি নিষিদ্ধ হয়েছে কি না কিংবা কর্ডোবায় থেমেছে কি না ষাঁড়ের আর্তচিৎকার, তবে দীপ্তেন্দু চক্রবর্তী বা হেমা মালিনীর মতো কারও-কারও এই সংবেদনশীলতাকে আমি শ্রদ্ধা জানাই। কিন্তু যেখানে মানুষেরই মূল্য প’ড়ে যাচ্ছে দিনদিন, সামান্য ক’টি টাকার জন্য খুনখারাবি পর্যন্ত হচ্ছে (সমরেশ বসুর একটি মর্মস্পর্শী গল্প আছে : ‘হ্রেষাধ্বনি’; একটি দরিদ্র কন্যাশিশুকে গলা টিপে মারা হয় একজোড়া কানের দুলের লোভে), সেখানে পশুপ্রীতিকে বাহুল্য বা আঁতলামি মনে হওয়াই স্বাভাবিক। মেজবান বা বিবাহের ‘প্রীতিভোজ’-এর নামে চলমান সামাজিক আমিষোৎসবের প্রতি সকলেই যে বিমুখতা প্রদর্শন করবেন — এই প্রত্যাশা আমার নেই, কিন্তু বেগম রোকেয়ার এ-কথাও মনে রাখতে চাই যে বেঁচে থাকার জন্যই খাওয়া, খাওয়ার জন্য বেঁচে থাকা অর্থহীন।

  6. বিনয়ভূষণ ধর - ১১ নভেম্বর ২০০৯ (৩:০০ অপরাহ্ণ)

    বন্ধু মাহতাব!
    তোমার এই লেখাটির সাথে প্রাসঙ্গিকভাবে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের প্রখ্যাত গীতিকার ও সুরকার সৈয়দ মহিউদ্দিন(মহিয়াল ভান্ডারী) একটি বিখ্যাত গান ‘মেজ্যান দিএ’-র কয়েকটি লাইন এখানে তুলে দেয়া হল…

    মেজ্যান দিএ মেজ্যান দিএ
    ঐ তারত
    গরিবুল্যাই মেইট্যা বছি
    ডঁর মাইনচুল্যাই বাসনত
    কি সোন্দয্য বিছানত।

  7. রেজাউল করিম সুমন - ১১ নভেম্বর ২০০৯ (৮:১৬ অপরাহ্ণ)


    মাহতাবের এ লেখা অন্য স্বাদের। চট্টগ্রামের মেজবানের রান্নার স্বাদও আলাদা, বিশিষ্ট – যার কথা মনে পড়ায় অনেকেরই জিভে জল এসে যাবার জোগাড়! আর সে-রান্না যে-কোনো বাবুর্চির কাছ থেকেই পাওয়া যাবে না, তার জন্য চাই দীক্ষিত বাবুর্চি, এমনকী বিশেষ মশলাও। মেজবানের রান্নার জন্যই তৈরি বিশেষ মশলা এখন বাজারেই না কি কিনতে পাওয়া যায়। আচ্ছা, ঈদগা-র বাইরে অন্য কোথাও-ও কি নিমন্ত্রিতকে পকেটে করে লবণ নিয়ে যেতে হয়? আর চট্টগ্রামের বাইরের মেজবানের প্রধান আকর্ষণও কি গরুর মাংসই?


    ‘মেজ্যাইন্যা হাঁউদুল্লা’! দু-তিন সপ্তাহ বা মাসখানেক হলে তো বটেই, এমনকী এক-দুই দিন ঘরের বাইরে থাকলেও ফেরার পর আমার কপালে জোটে এই অভিধা। বড়ো আফসোস, ‘মেজবান-পাগল হামিদউল্লাহ্’ সম্পর্কে কোনো কিছুই এখন আর জানবার উপায় নেই; অবশ্য জানবার চেষ্টাও কখনো আমি করিনি। এই ভদ্রলোক যদি হয়ে থাকেন আমার মায়ের শৈশবকালীন কোনো চরিত্র, তাহলেও তো তিনি মেজবান খেয়ে বেড়াতেন অন্তত বছর পঞ্চাশ আগে! আর যদি তিনি হন প্রজন্মান্তরে বাহিত কোনো লোকগল্পের চরিত্র …


    শেষ মেজবান খেয়েছিলাম চট্টগ্রাম শহরেই – চট্টগ্রামের ইতিহাস-রচয়িতা আবদুল হক চৌধুরীর চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকীতে, বেশ ক’বছর আগে। সে-রাতের মেজবান ছিল আর দশটা মেজবানের মতোই; কিন্তু সেদিন দুপুরে রাউজানে তাঁর গ্রামের বাড়িতে যে-স্মরণসভার আয়োজন করা হয়েছিল সে-অনুষ্ঠান ছিল আমার জন্য সম্পূর্ণ নতুন এক অভিজ্ঞতা। স্মৃতিতর্পণ আর কবিদের স্বকণ্ঠে কবিতাপাঠ! একজন আবৃত্তিকার পরিবেশের সঙ্গে সংগতি রেখে প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় আবদুল হক চৌধুরী সম্পর্কে কয়েকটা লাইন পড়েছিলেন, মনে পড়ছে! সভায় পৌরোহিত্য করেছিলেন কবি অরুণ দাশগুপ্ত। আর মনে আছে, পুরো অনুষ্ঠানটিই হয়েছিল সুপরিসর এক মসজিদের দাওয়ায়।

  8. ইমতিয়ার শামীম - ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (৪:৩১ পূর্বাহ্ণ)

    মেজবান নিয়ে আজকের দৈনিক জনকণ্ঠে মাকসুদ আহমদ-এর খবর বেরিয়েছে :

    চাটগাঁইয়া মেজ্জাইন্না খন, খাইলে বুঝিবা ন খাইলে ফস্তাইবা (অর্থাৎ চট্টগ্রামের মেজবানের খাবার খেলে স্বাদ বোঝা যায়, না খেলে আফসোস করতে হয়) এ উক্তিটি চট্টগ্রামে সর্বৰেত্রে প্রচলিত। প্রায় চার যুগ ধরে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী মেজবান দেশব্যাপী আলোচিত হয়ে আসছে। ইদানীং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এমনকি টকশোতেও চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী এ মেজবান নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা এমনকি মেজবানের ইতিবৃত্ত নিয়েও আলোচকরা মেতেছেন। চট্টগ্রামে মেজবানের জন্য হাতেগোনা মাত্র কয়েকটি কমিউনিটি সেন্টার রয়েছে। এছাড়াও ঐতিহ্যবাহী এ মেজবানের অতিথিদের খাবারের আয়োজন করা হয়েছিল চট্টগ্রামের আউটার স্টেডিয়ামে।
    ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রামের মেজবান শুধু দেশেই নয় প্রবাসীদের কাছেও স্মরণীয়। দেশের একমাত্র চট্টগ্রামেই এ ধরনের মেজবানের আয়োজন করা হয় বলে ইতিহাস রয়েছে। প্রায় ৫০ বছর ধরে এ আয়োজনটি চট্টগ্রামে দিন দিন জমজমাট হয়ে উঠছে। প্রকৃতপক্ষে মৃত্যুবার্ষিকী, কোন প্রতিষ্ঠানের অভিষেক, পুনর্মিলনীসহ বড় বড় অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে মেজবানের আয়োজন করা হয়। চট্টগ্রামবাসীও ৫০ বছরের ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে এ মেজবান করে আসছে।
    চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী মেজবানে সিটি মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর কন্যা টুম্পার মৃত্যুবার্ষিকীতে প্রায় ৬০ হাজার নগরবাসীকে দাওয়াত দেয়া হয়। সুবিশাল এ আয়োজনের জন্য নগরীর ৫টি স্থানে একসঙ্গে খাবার পরিবেশনের মাধ্যমে অতিথিদের আপ্যায়ন করানো হয়। এরপর প্রধানমন্ত্রীর স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়ার মৃত্যুতে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের পৰ থেকে রংপুরে প্রায় ৬০টি গরু জবাই করে মেজবানের প্রথমবারের মত উত্তরাঞ্চলে আয়োজন করা হয়েছিল ঐতিহ্যবাহী চাঁটগাইয়া মেজবানের। এ মেজবানের রান্নার জন্য বাবুর্চিও নেয়া হয়েছিল চট্টগ্রাম থেকে। সম্প্রতি চট্টগ্রাম কাবে আয়োজিত রিহ্যাব মেলার শেষ দিনে ঐতিহ্যবাহী এ মেজবান এ ক্লাবকে ঘিরে জমে উঠেছিল ভিন্ন আঙ্গিকে। এছাড়াও বিজিএমইএ’র তত্বাবধানেও এ ধরনের মেজবানের আয়োজন করা হয়েছে বেশ কয়েকবার। এছাড়াও দেশের বেশ কয়েকটি জাতীয় পত্রিকাও বাজারে আসার আগে মেজবানের আয়োজন করেছে। বিশেষ করে পত্রিকাগুলো হকারদেরকে আয়ত্বে রাখার উদ্দেশ্যেই এ ধরনের আয়োজন করেছে বলে শোনা গেছে।
    মেজবানকে ঘিরে প্রয়োজন হয় বড় আঙিনার। চট্টগ্রামের সমতল থেকে সুউচ্চে গড়ে উঠা কিং অব চিটাগাং-এর আঙিনাই সবচেয়ে বড় এবং মেজবানের জন্য উপযোগী। এছাড়াও ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তন, লেডিস কাব, চট্টগ্রাম কাবের টেনিস গ্রাউন্ড, এমনকি চট্টগ্রাম আউটার স্টেডিয়ামকেও মেজবানের মিলনায়তন হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।
    চট্টগ্রামবাসির মতে, মেজ্জাইন্না খন, খাইলে বুঝিবা ন খাইলে ফসতাইবা (অর্থাৎ মেজবানের খেলে স্বাদ বুঝা যায়, না খাইলে আফসোস করতে হয়) এ উক্তিটি প্রায় শোনা যায় চট্টগ্রামে বিভিন্ন অঞ্চলে। এক সময় মেজবানের বিষয়টি শুধুমাত্র চট্টগ্রামের গ্রামাঞ্চলে ছোটখাট আয়োজনে পরিবেশন ছিল। কিন্তু তা এখন ছড়িয়ে শহরমুখী যেমন হয়েছে তেমনি বিশালতাও চলে এসেছে। বিশেষ করে বিত্তশালী ও ধনাঢ্য পরিবারের পক্ষ থেকে চট্টগ্রামের বিশাল আয়তন কমিউনিটি সেন্টারগুলো ভাড়া নেয়া হয় এ উপলক্ষে। পরিপাটি আয়োজনের মধ্য দিয়ে চলে আকনি বিরিয়ানির সঙ্গে চনার ডালে হাড্ডিসহ মাংস ও সে সঙ্গে রয়েছে গরুর নলার ঝোল। আয়োজনটি দেখে অনেকেরই জিভে পানি চলে আসে। এ মেজবান খেতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নামীদামী ও খ্যাতনামা মানুষকেও এ আয়োজনে পাওয়া যায়।

    সংবাদটি চোখে পড়তেই মনে হলো এ লেখাটির কথা। মেজবানের নৃতাত্ত্বিক-যোগ সম্পর্কে কেউ কি কোনও লেখার খোঁজ বা তথ্যসূত্র দিতে পারেন?

    • রায়হান রশিদ - ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (৫:০৮ পূর্বাহ্ণ)

      আমাদের কাটা ঘায়ে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য বড় ভাইয়ের আদেশে মাহতাব তো আগে থেকেই বাড়তি ‘নুন’ সংগ্রহ করে রেখেছিল (বড় ভাই আদেশ করলেন : ‘দোম্বি যা, ঘরে যাই নুন লই আয়, আন্ডা থিয়াইছি’)! ওর না হয় দয়া মায়া কম, এমন ‘নাজুক’ বিষয় নিয়ে পোস্ট লেখা যার প্রমাণ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আপনিও, ইমতিয়ার ভাই? এই পোস্ট আর মন্তব্যগুলো পড়ি আর হা হুতাশ করি। নিষ্ঠুর পৃথিবী!

      • ইমতিয়ার শামীম - ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (৬:২৫ অপরাহ্ণ)

        সত্যিই এখন খানিকটা অপরাধবোধে ভুগছি রায়হান, দয়ামায়ার প্রশ্ন এসে গেছে দেখে! তবে ওই সময় এতটা চিন্তা করিনি। কেবল নৃতাত্ত্বিকযোগের কথাই চিন্তা করেছিলাম। আর তার কারণ ছিল, বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনা মনে পড়ে যাওয়া।
        রাষ্ট্রধর্ম সংবিধানে সংযোজনের পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সেমিনার করা হয়েছিল (আলোচক ছিলেন শহিদুল ইসলাম, মাহমুদুর রহমান মান্না প্রমুখ)। ওই সেমিনারপত্র নিয়ে কাজ করার সময় বোখারি শরীফ থেকে অকস্মাৎ জানতে পারি, মুহম্মদ বলেছেন, ‘যার ঘরে লাঙল থাকবে, সে চিরদিন দরিদ্রই থেকে যাবে।’
        মুহম্মদ-এর এই বাণী, অনুমান করি, আরবের তখনকার কৃষিকাঠামোর সঙ্গে সম্পর্কিত। কৃষির ভিত্তি এত দুর্বল ও অলাভজনক ছিল যে অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করার জন্যে মুহম্মদ মনোযোগী হয়েছিলেন তাঁর অনুসারীদের বাণিজ্যমুখী করে তুলতে।
        কিছুদিন আগে নবান্নসংক্রান্ত একটি লেখা তৈরি করতে গিয়ে আমি এ হাদিসটিকে আবার কাজে লাগিয়েছিলাম; একই সময় অভাব অনুভব করছিলাম আরও একটি লেখার, যেটি লিখেছেন ড. নাজমুল করিম। ছাত্রাবস্থায় তিনি হলের বার্ষিকীতে ধর্ম ও বিজ্ঞান নামে একটি নিবন্ধ লেখেন। চমৎকার ওই নিবন্ধে তিনি দেখিয়েছিলেন, ধর্মভেদে স্বর্গ ও নরকের ধারণা কী করে ভৌগলিক অবস্থার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। ওইখানে মুহম্মদ-এর সময় আরবের কৃষিকাঠামোর খানিকটা বিবরণও ছিল। হজ, রোজা, কুরবানী কী করে অর্থনৈতিক সচলতা তৈরি করত, তার বিবরণও ছিল।
        জবাইয়ের নিষ্ঠুরতাসত্বেও আমাদের সমাজে বোধকরি এখনও কুরবানী ও মেজবানই দরিদ্র মানুষদের মাংস খাওয়ার অন্যতম প্রধান সময়। নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন, এই নিষ্ঠুর কাজটিতে সামর্থ্যবান ‘আশরাফ’দের পাশাপাশি কী করে মহাউৎসহে ‘আতরাফ’রাও অংশ নেন, কেননা তারা জানেন, এর ফলে সহৃদয় ‘আশরাফ’ ব্যক্তিটি হয়তো মাংস একটু বেশি দেবে! নিশ্চয়ই দেখেছেন, তিনভাগে বিভক্ত কুরবানীর মাংসের গাওয়ালার ভাগ থেকে মাংস পাওয়ার জন্যে প্রচুর মানুষ অপেক্ষা করেন।
        আমি আন্তরিকভাবেই বিশ্বাস করি, মৃত পশুর গা থেকে ছাল ছাড়ানো এই মানুষরা আসলে নিষ্ঠুর নন; কিন্তু প্রচণ্ড এক অভাববোধ তাদের সম্মিলিত করে এরকম উৎসবে। এবং তারা আনন্দিত হতে দ্বিধা বোধ করেন না। হয়তো এর উৎস আরও আদিতে, আমাদের শিকার সমাজের কালে, যখন শিকার করা পশুটিকে আগুনের কুণ্ডলীর পাশে রেখে নৃত্যরত হতো আমাদের পূর্ব পুরুষ, গুহার দেয়ালে যাদের আঁকা বাইসনের ছবির রেখার শক্তি দেখে সত্যজিৎ রায়ের আগন্তুক মামা ছবি আকার আগ্রহ হারিয়ে নৃতাত্ত্বিক হয়ে উঠেছিলেন।
        সমাজে পেশার সচলতা সৃষ্টির পর এবং মাংস সহজলভ্য হওয়ায় মেজবানের মতো উৎসবগুলি হয়তো এখন আর কেবল প্রোটিনের স্বাদ পাওয়ার ধারণাবদ্ধ নয়, তাই এখন তাতে নিষ্ঠুরতার দিকটিই প্রথমে চোখে পড়বে। তারপরও মেজবানের সাংস্কৃতিক শক্তি কীভাবে তৈরি হয়েছে এবং অন্যান্য এলাকায় ছাড়া-ছাড়াভাবে প্রচলিত থাকলেও কেন বিশেষত চট্টগ্রামেই মেজবানের পরিণত বিকাশ ও অস্তিত্ব রয়েছে, তা কিন্তু সত্যিই ভেবে দেখার বিষয়।

    • কামরুজ্জমান জাহাঙ্গীর - ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (৭:১১ পূর্বাহ্ণ)

      প্রিয়জন ইমতিয়ার শামীম,
      আবারও মজাদার মেজবানের কথা মনে করিয়ে দিলেন?! আপনাকে স্বাগতম।
      তবে একটি বিষয় হচ্ছে, মেজবানের জন্য আলাদা কোনো কমিউনিটি সেন্টার কিন্তু নেই। নানা স্থানেই এর আয়োজন হয়। এই যেমন, চট্টগ্রাম রেলওয়ে অফিসার্স ক্লাবের উদ্যোগে প্রতি বছরই বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার প্রথম রজনীতে মেজবানের আয়োজন করা হয়। এখানে আবার কিঞ্চিৎ ভিন্ন আবহ থাকে, কারণ তখন তো ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষজনের কথা চিন্তা করে খাসির মাংসেরও আয়োজন করতে হয়।
      প্রথমত, এটি মূলত মুসলমান সম্প্রদায়কেন্দ্রিক একটা কালচার। আর এখানকার ধনাঢ্য মুসলমান সমাজের ভিতর ভিন্নতর এক খান্দানি ভাব আছে। তাদের কোনো মনোজাগতিক বাসনা থেকেই হয়ত এই কালচারটির উৎপত্তি।

  9. সবুজ পাহাড়ের রাজা - ৭ অক্টোবর ২০১২ (৭:২৮ অপরাহ্ণ)

    মেজবান নিয়ে এত দারুন একটা ব্লগ!
    দারুন! দারুন!! দারুন!!!
    আজ রাতেই অবশ্য মেজবানির দাওয়াত আছে।

  10. SIDDIQUI - ১৫ অক্টোবর ২০১৩ (২:৩৬ অপরাহ্ণ)

    https://www.facebook.com/pages/MEZBAN-The-Unique-Tradition-of-Chittagong/165522360191467

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.