জয়বাংলা- আবারও জীবন্ত হয়ে উঠেছে এই স্লোগান, যেটি ছিল বাংলাদেশের জীবনদায়িনী স্লোগান; আরো ফিরে এসেছে তোমার আমার ঠিকানা/পদ্মা মেঘনা যমুনা, ফিরে এসেছে তুমি কে, আমি কে/ বাঙালি, বাঙালির মতো স্লোগানগুলোও। রক্তের বন্যায় অন্যায়কে ভাসিয়ে দেয়ার স্লোগানে, লড়াই করে বাঁচতে চাওয়ার স্লোগানে প্রকম্পিত হচ্ছে আকাশ-বাতাস।
কাদের দেয়া এসব স্লোগানে প্রকম্পিত হচ্ছে আজ শাহবাগ থেকে শুরু করে সারা বাংলা? এসব তো পরিণত হয়েছিল মৃত স্লোগানে, পরিণত হয়েছিল দলীয় স্লোগানে- আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ আর যুবলীগ তাদের টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি আর সহিংসতার মধ্য দিয়ে তো জয়বাংলা স্লোগানকে করে তুলেছিল মূর্তিমান আতঙ্কে। তাহলে রাজনীতি-সমাজ-সংস্কৃতির কোন বাস্তবতা আবারো ফিরিয়ে এনেছে এসব স্লোগানকে?
একটি দিন-৫ ফেব্রুয়ারির দিনটি আমাদের ইতিহাসকে পাল্টে দিতে চলেছে। মানুষ জেগে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শাণিত হয়ে একাত্তরের সময় সংঘটিত ম্যাসাকারের জন্য অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে। না, একদিনে তৈরি হয়নি ৫ ফেব্রুয়ারি, তৈরি হয়েছে তিলে তিলে এবং তার প্রকাশ ঘটেছে একটি দিনে- ৫ ফেব্রুয়ারিতে। এ দিনটি আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে সেই ঐতিহাসিক কথাটিকে, ইতিহাসে কখনো কখনো এমন বন্ধ্যা সময় আসে যখন ১ দিনের কাজ ১শ দিনেও সম্পন্ন হয় না, আবার এমন উর্বর সময় আসে যখন ১শ দিনের কাজ একদিনেই সম্পন্ন হয়। শাহবাগ ফিরিয়ে আনতে চলেছে ইতিহাসের সেই উর্বর সময়। আর এজন্য আমরা আজ শ্রদ্ধায় নত হয়ে আছি তারুণ্যের এ শক্তির কাছে, তারুণ্যের এ উত্থানের কাছে- কেননা বিস্ময়কর তাদের এ জাগরণ। কেননা মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই শুরু হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে ভিন্নমুখী করার, বিকৃত করার নানা চক্রান্ত। মুক্তিযুদ্ধে বাম সংগঠনগুলোর অবদানকে অস্বীকার করার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে ভিন্নমুখী করার চক্রান্ত শুরু হয়েছিল। পরে মুক্তিযুদ্ধের এমনকি সাধারণ তথ্যগুলোও বিকৃত করা হতে থাকে মৌলবাদী-ডানপন্থী রাজনীতির স্বার্থে। বছরের পর বছর ধরে আমাদের শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীরা তাদের পাঠ্যবইয়ে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে অনেক মিথ্যা তথ্য পড়েছে, এক বছর একরকম পড়েছে তো অন্য বছর পড়েছে আরেকরকম, স্কুলে গিয়ে শিক্ষকদের কাছ থেকে শুনেছে একরকম আবার ঘরে ফিরে মা-বাবার কাছে শুনেছে অন্যরকম। এত পরস্পরবিরোধিতার মধ্য দিয়ে কারো পক্ষে সত্য জানা প্রায় অসম্ভব- কিন্তু আমাদের নতুন প্রজন্ম সেই অসম্ভব কঠিন কাজটিই করেছে, তারা অসত্যের নিরেট দেয়াল ভেঙে সত্য জেনেছে। কোনো কোনো সংগঠন এজন্য নিরন্তর কাজ করেছে বটে, কিন্তু তারপরও অস্বীকার করা ভুল হবে যে এ কাজটি তারা করেছে মূলত নিজেদের দায়িত্বেই, নিজেদের উদ্যোগেই। তারপর ইতিহাস উন্মোচন করে পাওয়া সত্যের ভিত্তিতে তারা উচ্চকিত হয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে। আর এখন রাজপথে ঝাঁকে ঝাঁকে নেমে আসার মধ্য দিয়ে তারা আমাদের জানিয়ে দিচ্ছে, তারাও আবহমান কালের পতাকা হাতে।
এরাই ফিরিয়ে এনেছে সেই পুরনো স্লোগান, বাংলাদেশের জীবনদায়িনী স্লোগান- জয়বাংলা। কেননা তারা কারো ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছা কিংবা ভালোলাগা বা না-লাগার জন্য নয়, তারা জেগে উঠেছে ইতিহাসের উত্তরাধিকার হিসেবে, কালের ধারাবাহিকতায়। আমাদের বিনম্র সশ্রদ্ধ ভালবাসা তাদের প্রতি।
এতদিন যারা মনে করতেন করপোরেট-ডিজুস সংস্কৃতি গ্রাস করে নিয়েছে তারুণ্যকে, তরুণেরা ভুলে গেছে রাজনৈতিকতা, ব্যক্তিস্বার্থবোধই তাদের জীবনের চূড়ান্ত সত্য- তাদের ধারণায় একটি বড় ধরনের আঘাত হেনেছে গত সপ্তাহের শাহবাগের আন্দোলন। এটি সত্য যে, শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে পরিচালিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলন তরুণ সমাজকে নতুন করে উজ্জীবিত করে, রাজনৈতিক দলগুলোকেও এ নিয়ে পুনর্চিন্তায় বাধ্য করে। দেশের একটি অন্যতম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ গত ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের লক্ষ্যে ট্রাইব্যুনাল গঠনের অঙ্গীকার করে আর তার পরেই বদলে যায় দৃশ্যপট- নির্বাচনে জয়ী হয় আওয়ামী লীগ- যে জয়ের পেছনে আওয়ামী লীগের ওই নির্বাচনী অঙ্গীকারে উদ্বুদ্ধ তরুণ ভোটাররা একটি নিয়ামক ভূমিকা পালন করেছে বলে মনে করা হয়। আওয়ামী লীগের এই প্রতিশ্রুতিতে কিংবা পরবর্তী সময়ে ট্রাইব্যুনাল গঠনে ও ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রমে সহায়তার ক্ষেত্রে দলীয় রাজনৈতিক ম্যারপ্যাঁচ আছে এবং অথবা থাকতে পারে; কিন্তু সত্য হলো, এতদিন অন্য কোনো রাজনৈতিক দলই ট্রাইব্যুনাল গঠনের ক্ষেত্রে কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখেনি এবং কোনো দলই তারুণ্যের এই মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক আবেগের জায়গাটিকে দরদ দিয়ে উপলব্ধি ও বিশ্লেষণ করেনি, করতে চায়নি। নব্বইপরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের তোড়ে তরুণ সমাজ রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, ঐতিহ্যময় ছাত্ররাজনীতি হয়ে উঠেছিল মানুষের আতঙ্ক ও ঘৃণার বিষয়। সামরিক শাসনের পতন ঘটলেও এ ধরনের শাসন একটি সমাজ ও সংস্কৃতিতে যে নষ্ট ছাপ ফেলে যায়, শাসক রাজনৈতিক দল তো বটেই অপেক্ষাকৃত ছোট দলগুলোর কোনোটিও সেগুলো মুছে ফেলার উপযোগী রাজনৈতিক সংস্কৃতির চর্চা করেনি। এ রকম পরিস্থিতিতে ছাত্ররাজনীতি তো বটেই, গোটা রাজনীতি থেকেই তরুণরা মুখ ঘুরিয়ে নেয়। তারা তাদের পুরো মনোযোগ নিবদ্ধ করে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের দিকে। শুধু ষুশীল বাবাজীরাই নয়, রাজনীতিকদের অনেকেই এমনকি কোনো কোনো রাজনৈতিক দলও যখন বারবার সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে যে, অতীতের দিকে তাকিয়ে থাকলে হবে না- ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে হবে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আগামী ১৫/২০ বছর কথাবার্তা বলা বন্ধ রাখতে হবে, তবেই নাকি বাংলাদেশের উন্নয়ন হবে, বাংলাদেশ বদলে যাবে- তখন এই তরুণরা তাদের সেই আত্মবিনাশী কথা না শুনে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে জানার চেষ্টা করে, সে সময়ের মানুষদের আবেগের জায়গাটিকে বোঝার চেষ্টা করে, ধারণ করার চেষ্টা করে সেই ইতিহাস ও ইতিহাস-চেতনাকে। তাদের চেতনায় নিভৃতে যোগ হয় এ দেশের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল সময়টিতে জন্ম না-নেয়ার দুঃখবোধ, যুক্ত হয় মুক্তিযুদ্ধের অসমাপ্ত কাজগুলো সমাপ্ত করার স্বপ্ন। তারা তাদের স্বপ্নগুলোকে লালন করে চলে নিভৃতে।
কিন্তু চিরদিন কোনো স্বপ্ন তো নিভৃতে থাকতে পারে না। ৫ ফেব্রুয়ারি- এই একটি দিন তাদের স্বপ্নকে রাজপথে নিয়ে আসে, সমগ্র জনতার মধ্যে প্রকাশিত করে এবং ফলে জনতাও হয় উদ্বেলিত, কেননা তারা তাদের বুক খুলে দেখতে পায় একই স্বপ্ন আর একই আকাক্সক্ষাকে।
কী তাদের সেই স্বপ্ন, কী তাদের সেই আকাক্সক্ষা, কিইবা ঘটেছিল ৫ ফেব্র“য়ারিতে, যা তাদের করে তুলেছে বিস্ফোরণোন্মুখ?
একাত্তরের গণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের যাবজ্জীবন দণ্ড দেয়ার রায় শোনার পর থেকেই এ দেশের প্রতিটি মানুষ অপেক্ষা করছিল একটি স্ফুলিঙ্গের জন্য। সে স্ফুলিঙ্গ জ্বালিয়ে দেয় অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ও ব্লগাররা। তারা পরস্পরের প্রতি আহ্বান জানায় শাহবাগের মোড়ে একত্রিত হওয়ার। এ দেশের কম মানুষই অনলাইনে সক্রিয়- কিন্তু পথচারীদের মুখে মুখে, মোবাইল ফোনে ফোনে অচিরেই বিভিন্ন স্থানে এ খবর ছড়িয়ে পড়ে যে, বিক্ষুব্ধ সবাই শাহবাগ মোড়ে সমবেত হচ্ছে। খুব দ্রুতই শাহবাগ তারুণ্যের আবাহনে দুলে ওঠে- আর সন্ধ্যা পেরুতে না পেরুতেই স্যাটেলাইট চ্যানেলের মাধ্যমে এ খবর ছড়িয়ে পড়ে সারা বাংলায়। তারপরও অনেকের মনে দ্বিধা ছিল, বিভ্রান্তি ছিল। কিন্তু সময় যত এগোতে থাকে, ততই জেগে ওঠা মানুষের স্রোতে দ্বিধা ও বিভ্রান্তি ভেসে যেতে থাকে। অপ্রত্যাশিত রায়ে বিক্ষুব্ধ মানুষজন তাদের প্রতিবাদের ভাষা খুঁজছিল, সেই ভাষার সূত্র ধরিয়ে দেন ব্লগার ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা, যে কাজটি করার কথা ছিল রাজনীতিক ও নাগরিক সংগঠকদের, সেই কাজটি করেন তারা- বিক্ষুব্ধ গণমানুষের স্রোতকে ঘরের বাইরে নিয়ে আসেন, সমবেত করেন এক দাবিতে- শাহবাগ হয়ে ওঠে আন্তর্জাতিক অপরাধের বা একাত্তরের গণহত্যা বিচারের ন্যায়বিচারের দাবিতে ফুঁসে ওঠা মানুষের মহামিলন কেন্দ্র। স্ফুলিঙ্গ থেকে জ্বলে ওঠে অগ্নিশিখা।
শাহবাগ আন্দোলন নিয়ে দ্বন্দ্ব আছে, বিভিন্ন ধরনের ভাষ্য আছে এবং থাকাটাই স্বাভাবিক। কেননা সবার পর্যবেক্ষণের ভঙ্গি এক নয়, রাজনৈতিক অবস্থান এক নয়, এক নয় সাংস্কৃতিক গন্তব্য। এ ধরনের দ্বন্দ্ব এবং বিতর্ক ততক্ষণই ইতিবাচক যতক্ষণ তার উদ্দেশ্য থাকে চলার পথ তৈরি করা। কিন্তু সমস্যা হয় তখনই, যখন অপচেষ্টা চালানো হয় মূল উদ্দেশ্যকেই ভিন্ন খাতে বইয়ে দেয়ার। যেমন, এ আন্দোলন শুরুর পর একটি শ্রেণি অপচেষ্টা চালাচ্ছে ট্রাইব্যুনালকে ভেঙে দেয়ার দাবি তোলবার। বিএনপির স্থায়ী কমিটির নেতা তরিকুল ইসলামকে এই কয়েকদিন আগেই বলতে শোনা গেছে, তারা জামায়াতে ইসলামীর ট্রাইব্যুনাল ভেঙে দেয়ার দাবির সঙ্গে একমত নয়, সেই বিএনপিরই আরেক নেতা এবং খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা খন্দকার মাহবুব হোসেন আবার দাবি জানাচ্ছেন ট্রাইব্যুনাল ভেঙে দেয়ার। বলছেন, জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ট্রাইব্যুনাল গঠন করার। অথচ কেন জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ট্রাইব্যুনাল গঠন ও পরিচালনা সম্ভব নয়, সে বিষয়টি অনেক আগেই মীমাংসিত হয়ে গেছে। খন্দকার মাহবুব ট্রাইব্যুনাল ভেঙে দেয়ার দাবি তুলে, মওদুদ আহমেদ ট্রাইব্যুনালকে অস্বচ্ছ বলে শাহবাগের তারুণ্যের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন যে- তারা চান না যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হোক। মুক্তিযুদ্ধ যখন শেষ পর্যায়ে তখন হিংস্র দানব পাকিস্তান তাদের পরাজয় ও পতনের আশঙ্কায় জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে শান্তি আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছিল-বিএনপি-জামায়াত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সব পথ রুদ্ধ করার অপচেষ্টায় একইভাবে এখন জাতিসংঘকে টেনে আনতে চাইছে। জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে এ সমস্যার সমাধান তো হবেই না, উল্টো জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীতে আমাদের দেশের সেনা ও পুলিশ পাঠানো বন্ধ হয়ে যেতে পারে। খালেদা জিয়া যেভাবে জিএসপি সুবিধা বাতিলের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছে খোলা নিবন্ধ লিখেছেন, তার উপদেষ্টা এখন একইভাবে জাতিসংঘকে হস্তক্ষেপের আমন্ত্রণ জানানোর মধ্য দিয়ে বিদেশে সেনা ও পুলিশ পাঠিয়ে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির ও বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের পথ বন্ধ করার পরিস্থিতি তৈরি করতে চাইছেন।
এভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রসঙ্গ প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠবে, শাহবাগ আন্দোলনের তারুণ্য কতটুকু রাজনৈতিক? রাজনীতি ছাড়া তো সম্ভব হয়নি এ দেশকে স্বাধীন করা- আর শুধু এ দেশ কেন পৃথিবীর কোনো দেশের মুক্তিযুদ্ধই সংঘটিত হয়নি রাজনীতি ছাড়া। এদেশে একটি নির্দিষ্ট ধারার রাজনীতিও এখন অপচেষ্টা চালাচ্ছে মরা গাছে ফুল ফোটানোর, অপচেষ্টা চালাচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করার। তাহলে সম্ভব কি রাজনীতি ছাড়া শাহবাগের আন্দোলনকে বাঁচিয়ে রাখা? এই তারুণ্যের খুব সামান্য অংশই রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত এবং প্রতিদিন মানুষের যে ঢল নামছে তাদেরও প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্ক নেই। তার মানে এই নয়, এই তরুণেরা রাজনীতি অসচেতন; বরং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসচর্চা তাদের রাজনীতি সচেতন করে তুলেছে। যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে তারা ঘরে না-ফেরার প্রতিজ্ঞা করেছে- অন্যার্থে মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আকাক্সক্ষাই জেগে আছে তাদের চেতনাতে। আর সে চেতনার বহিঃপ্রকাশ হিসেবেই তাদের আমরা দেখছি, জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতিকে নিষিদ্ধ করার দাবি। কেউ কেউ এ চত্বরকে বলছেন গণজাগরণ মঞ্চ, কেউবা বলছেন স্বাধীনতা প্রজন্ম চত্বর, আবার কেউবা বলছেন প্রজন্ম চত্বর কিংবা শাহবাগ স্কয়ার; কিন্তু এ ধরনের পার্থক্যগুলো ছাপিয়ে প্রকাশ পাচ্ছে তাদের মুক্তিযুদ্ধের অসমাপ্ত আকাঙ্ক্ষা পূরণের প্রত্যাশা।
এই তরুণ-গণজাগরণকে কি তুলনা করা যায় আরব বসন্তের সঙ্গে? আরব বসন্তের শুরু হয়েছিল গণতন্ত্রের আকাক্সক্ষায়, কিন্তু তা পর্যায়ক্রমে ইসলামী রাজনীতির পদানত হয়েছে, উত্থান ঘটেছে মৌলবাদী অপশক্তির- মানুষের রাজনৈতিক আবেগের অপব্যবহার করছে তারা। এখানেও অবশ্য সেরকম অপচেষ্টা চলছে। প্রতিদিন বিভিন্ন সংবাদপত্রে, বিভিন্ন চ্যানেলের টক শোতে সেই অপচেষ্টা লক্ষ করা যাচ্ছে। গত ৯ ফেব্রুয়ারি সাদেক হোসেন খোকা বিএনপির সমাবেশে বলেছেন, শাহবাগে অবস্থানরত তরুণদের দেশপ্রেম ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আবেগকে তারা সম্মান করেন। তবে একই সঙ্গে তাদের তিনি দেখতে চান ‘দুর্নীতি, হত্যা-গুম খুনসহ একদলীয় নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকে থাকার সরকারি ষড়যন্ত্রবিরোধী’ ভূমিকায়। কেননা তার মতে, ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের চেয়ে এটা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।’ একই দিন বিকেলে শাহবাগে দেখা গেছে ইসলামী আইন অনুযায়ী কাদের মোল্লাকে বিচার করার আহ্বানসংবলিত এক লিফলেট বিলি করতে। টক শোগুলোতে ট্রাইব্যুনালকে কীভাবে আরো সুরক্ষিত করা যায় তা বলার বদলে কেউ কেউ বার বার বলছেন, ট্রাইব্যুনাল নাকি স্বচ্ছ নয়। তাদের কাছে স্বচ্ছতার মানে এই ট্রাইব্যুনালগুলো ভেঙে দেয়া- চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি দেয়া, যেমন ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর দালাল আইন বাতিল করার পাশাপাশি মুক্তি দেয়া হয়েছিল সাজাপ্রাপ্ত, অভিযুক্ত ও বন্দি দালালদের। কাজেই শাহবাগের আন্দোলনকে আরব বসন্তের পরিণতির দিকে এগিয়ে যেতে দেয়া যাবে না। কোনো কোনো পত্রিকায় বলা হচ্ছে, শাহবাগে নাকি শোনা যাচ্ছে ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি। প্রসঙ্গত মনে পড়ে যাচ্ছে, ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল ট্রাইব্যুনালে ২০০৫ সালে ক্রোয়েশিয়ার সাংবাদিক জোসেফ জোভিক ও মারিজান ক্রিজিককে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। গত বছর একটি তদন্তে সার্বিয়ার বিভিন্ন মিডিয়ার প্রায় ৩০ জন সাংবাদিক ও সম্পাদককে যুদ্ধাপরাধসংক্রান্ত অপপ্রচার চালানোর জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছিল। শাহবাগকে ঘিরে মিডিয়া ও অনলাইনের এ ধরনের অপপ্রচারকেও তুলনা করা যায় সেরকম অপরাধের সঙ্গে।
শাহবাগে প্রতিদিন যারা আসছেন, তাদের দেখে মনে পড়ে যায় শামসুর রাহমানের ঐতিহাসিক সেই কবিতা- ‘আমরা সবাই/এখানে এসেছি কেন? এখানে কী কাজ আমাদের?/কোন সে জোয়ার/ করেছে নিক্ষেপ আমাদের এখন এখানে/এই ফাল্গুনের রোদে? বুঝি জীবনেরই ডাকে/ বাহিরকে আমরা করেছি ঘর, ঘরকে বাহির।’ এই তারুণ্য ঘরকে বাহির করে দাঁড়িয়ে আছে রাষ্ট্রশক্তির সামনে, সরকারের সামনে; আপাতদৃষ্টিতে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে তারা উচ্চকিত, কিন্তু তাদের হৃদয়ের তলদেশে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। আমরা দেখেছি এই তরুণরা স্লোগান দিচ্ছে ‘জয়বাংলা’ কিন্তু পাশাপাশি একবারও বলছে না ‘জয় বঙ্গবন্ধু’; সম্ভবত এভাবে তারা দেশের প্রতি ভালবাসাকেই প্রাধান্যে নিয়ে আসছে, বঙ্গবন্ধুর প্রতি নীরব শ্রদ্ধা ও ভালবাসা প্রকাশের পাশাপাশি রাষ্ট্র গঠনের জন্য নতুন কোনো রাষ্ট্রনায়কের প্রত্যাশারও ইঙ্গিত দিচ্ছে। সরকারের ভয়টাও বোধকরি ওখানেই- কেননা প্রচলিত রাজনৈতিক ধারা তো চায় তরুণদের করপোরেট-ডিজুস সংস্কৃতিতে আবদ্ধ করে রাখতে; কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এরা যত উচ্চকিত হবে, ততই তারা প্রচলিত ধারারও প্রতিপক্ষ হয়ে উঠবে। তবে আশা এখানেই যে, কোনো দল বা ব্যক্তিবিশেষের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় নয়, শাহবাগের আন্দোলন শুরু হয়েছে ইতিহাসের ধারায়। শাহবাগের আন্দোলন স্বল্পস্থায়ী কিংবা দীর্ঘস্থায়ী যেটাই হোক না কেন, এর একটি সুনির্দিষ্ট বার্তা আছে। তার নিয়তিও তাই পূর্বনির্ধারিত- ইতিহাস এ আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাবে যৌক্তিক অবসানের দিকে। ইতিহাস কখনো ব্যর্থ হয় না- আজ না হোক, কাল সে সফল হবেই এবং শাহবাগের আন্দোলনও সফল হবে।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
২ comments
মাসুদ করিম - ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ (২:৩১ অপরাহ্ণ)
sumon ahammed - ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ (১:০৭ পূর্বাহ্ণ)