অনেক তপ্ত খবর আমাদের আশপাশে : আন্তর্জাতিক অপরাধ বিচারের ট্রাইব্যুনাল ভেঙে না দিলে এবং তাদের দলের অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি না দিলে গৃহযুদ্ধ শুরু করবে জামায়াতে ইসলামী, হরতালের পর হরতালের মধ্যে দিয়ে ‘জ্বালাও পোড়াও পুলিশ পেটাও’ নীতি নিয়ে মাঠে নেমেছে তাদের সব নেতাকর্মী, এ দেশের গণতন্ত্রকে নিরাপদ করার জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপ প্রত্যাশা করে দ্য ওয়াশিংটন টাইমসে একটি অভিমত-নিবন্ধ লিখেছেন দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে ক্ষুব্ধ প্রধান বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া, যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার রায় প্রত্যাশিত না হওয়ায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন দেশের মানুষ-রাজপথে নেমে এসেছে তরুণ...

অনেক তপ্ত খবর আমাদের আশপাশে : আন্তর্জাতিক অপরাধ বিচারের ট্রাইব্যুনাল ভেঙে না দিলে এবং তাদের দলের অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি না দিলে গৃহযুদ্ধ শুরু করবে জামায়াতে ইসলামী, হরতালের পর হরতালের মধ্যে দিয়ে ‘জ্বালাও পোড়াও পুলিশ পেটাও’ নীতি নিয়ে মাঠে নেমেছে তাদের সব নেতাকর্মী, এ দেশের গণতন্ত্রকে নিরাপদ করার জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপ প্রত্যাশা করে দ্য ওয়াশিংটন টাইমসে একটি অভিমত-নিবন্ধ লিখেছেন দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে ক্ষুব্ধ প্রধান বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া, যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার রায় প্রত্যাশিত না হওয়ায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন দেশের মানুষ-রাজপথে নেমে এসেছে তরুণ সমাজ, ওদিকে এতসব ঘটনার ডামাডোলের মধ্যে ফুলবাড়িতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের দূতিয়ালি করতে গোপনে গোপনে জোর তৎপরতা শুরু করেছে কর্পোরেট শক্তি। তা হলে কোনপথে এগিয়ে চলেছে এ দেশ?
সবাই জানেন, গত ৫ ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনাল-২ একাত্তরের গণহত্যা বিচারের আরেকটি মামলার রায় দিয়েছে। এতে জামায়াতে ইসলামীর নেতা আবদুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। লেখাই বাহুল্য, জামায়াতে ইসলামীর নেতা হওয়ার জন্যে তাকে এ দণ্ড দেয়া হয়নি; বিএনপি কিংবা জামায়াতে ইসলামীর নেতা হওয়ার জন্যেও কাউকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়নি-ট্রাইব্যুনাল থেকে যাদের এ পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয়েছে, যাদের বিরুদ্ধে রায় দেয়া হয়েছে কিংবা যাদের বিচারপ্রক্রিয়া চলছে, তাদের প্রত্যেককেই আন্তর্জাতিক অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধের কারণেই গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধের এসব অভিযোগ আজকের নয়, মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই এসব অভিযোগ সচেতন ও ভুক্তভোগী মানুষজন বার বার করে আসছেন। অধুনাবিলুপ্ত সাপ্তাহিক বিচিত্রার পাঠকপ্রিয়তার একটি অন্যতম কারণ ছিল এই যে সত্তর ও আশির দশকে এ পত্রিকাটি এসব যুদ্ধাপরাধীদের অপরাধগুলি সম্পর্কে, তাদের রাজনৈতিকভাবে সংঘবদ্ধ হওয়ার প্রচেষ্টাগুলি সম্পর্কে জনগণকে বিভিন্ন সময় অবহিত করেছে। যুদ্ধাপরাধী কেউ বিএনপি কিংবা জামায়াতে ইসলামীর নেতা হলেই তারা ওই সব অভিযোগের সূত্রে পরিচালিত বিচারের উর্ধ্বে উঠে যায় না। কিন্তু বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে জনগণকে বার বার এরকমই বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনের উদ্দেশ্যে না কি এ বিচার হচ্ছে। এইভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে রাজনীতিকরণের অপচেষ্টা করেছে তারা। ট্রাইব্যুনালে কয়েকটি মামলার যুক্তিতর্ক শেষ হওয়ার দিকে এগুতে শুরু করতেই মরণছোবল দিতে মাঠে নেমেছে জামায়াতে ইসলামী ও দলটির সহযোগী ছাত্রসংগঠন ছাত্র শিবির। পুলিশের ওপর অব্যাহত হামলার মধ্যে দিয়ে তারা চাইছে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে তুলতে। গত ৪০ বছরের বাংলাদেশে অনেকবার রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেখা দিয়েছে, অনেকবার পুলিশের সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের কর্মীদের সংঘর্ষ হয়েছে-কিন্তু এসবের কোনওটিতেই এত নিষ্ক্রীয় থাকতে দেখা যায়নি পুলিশ প্রশাসনকে।
এর নিষ্ক্রীয়তার পরস্পরবিরোধী অর্থ থাকতে পারে। যেমন, বিগত বছরগুলোতে প্রশাসনের রাজনীতিকরণ ও দলীয়করণ আমাদের সবাইকে উদ্বিগ্ন করেছে-হতে পারে, এই নিষ্ক্রীয়তা সেই রাজনীতিকরণ ও দলীয়করণেরই ফসল। এমনও হতে পারে, যেরকম কয়েকদিন হলো শোনা যাচ্ছে, গোপন একটি সমঝোতায় পৌছে গেছে সরকারপক্ষ ও জামাতপক্ষের নীতিনির্ধারকরাÑযার প্রতিফলন ঘটতে শুরু করেছে পুলিশ ও জামায়াতে ইসলামী উভয়ের আচরণেই। পুলিশের দিকে ফুল হাতে এগিয়ে যাচ্ছে শিবির নেতারা। আবার হতে পারে, সরকারের কাছে সত্যিই এরকম তথ্য থাকতে পারে যে পুলিশকে উত্তপ্ত করে জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্র শিবির চাইছে সহিংসতাকে অসহনীয় একটি পর্যায়ে নিয়ে যেতে। চাইছে, জামাত-শিবিরবিরোধী যে সচেতন জনগোষ্ঠী ও তরুণ সমাজ রয়েছে তারা মাঠে নেমে আসুক, যাতে তাদের সঙ্গেও সংঘাতে জড়িয়ে পড়া যায়। এ বিশ্বাস আমাদের আছে যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রত্যাশী তরুণ সমাজের মাঠে নামার মতো প্রস্তুতি রয়েছে। তবে বাস্তবতা হলো, এখন মাঠে নামার অর্থ একটি বড় ধরণের সংঘাতে জড়িয়ে পড়া, সহিংসতার বিস্তারে জড়িয়ে যাওয়া-কিন্তু এটিও আরেকটি বাস্তবতা যে, মাঠে না নামলেও এ সংঘাতের বাইরে থাকা সম্ভব নয়-অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ থাকে না, জামায়াতে ইসলামী যে একতরফা সংঘাত চালিয়ে যাচ্ছে, আমরা তার শিকার হচ্ছি এবং স্বপ্নের বাংলাদেশ পেতে হলে রুখে দাঁড়াতে হবে। আমাদের চোখের সামনেই তো জামায়াতে ইসলামী গৃহযুদ্ধের হুমকি দিচ্ছে-আমরা না চাইলেও কি সম্ভব কেউ আগবাড়িয়ে যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি করলে তার বাইরে অবস্থান করা? এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার একটি উপায় হলো, কঠোর হাতে আইনশৃক্সক্ষলা প্রতিষ্ঠিত করা, যে উদ্যোগ নেয়ার কথা সরকারের এবং যে উদ্যোগ নিলে অনিবার্যভাবেই পুলিশের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর সংঘাত আরও বাড়বে-পুলিশকে কঠোর হওয়ার জন্যে প্রস্তুত থাকতে হবে এবং নীতিনির্ধারক ও জনগণকেও পুলিশের সে ভূমিকার সপক্ষে থাকতে হবে। এমন হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে, এ অবস্থায় জামায়াতে ইসলামী সাধারণ মানুষের ওপরও আক্রমণ পরিচালনা করে ভীতি ছড়ানোর অপচেষ্টা চালাবে (যে চেষ্টা তারা আসলে শুরু করে দিয়েছে সাধারণ মানুষের জানমালের ক্ষতি করার মধ্যে দিয়ে)। এরকম এক পরিস্থিতিকে মাথায় নিয়েই ট্রাইব্যুনাল-২ থেকে দেয়া হয়েছে কাদের মোল্লার মামলার রায়-যা সচেতন ও ভুক্তভোগী মানুষদের কাউকেই সন্তুষ্ট করেনি। যাবজ্জীবন নয়, যে ধরণের অপরাধ ও অপরাধসমূহের প্রমাণ তার বিরুদ্ধে পাওয়া গেছে তাতে ফাঁসির মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার রায় আসবে-এরকমই ধারণা ছিল সকলের। বিজ্ঞ বিচারকমণ্ডলী স্বাধীনভাবে যে রায় দিয়েছেন, তা আমাদের খুশি করতে পারেনি-এটিই হলো বাস্তবতা। যুগ যুগ ধরে জিইয়ে রাখা ন্যায়বিচার পাওয়ার প্রত্যাশা এর ফলে আহত হয়েছে এবং আমরা আশা করব, আপিল বিভাগে আবেদন করা হলে বিচারকমণ্ডলী এই প্রত্যাশার যৌক্তিকতা তলিয়ে দেখবেন এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবেন।
সাধারণ জনগণ এ রায়ে খুশি হতে পারেনি এবং এ বিষয়টিকেই এখন সুকৌশলে কাজে লাগাতে চাইছে জামায়াতে ইসলামী। জনতার বিক্ষোভের মাত্রাকে উস্কে দিতে তারা হরতাল ডেকেছে, সেই হরতালকে কেন্দ্র করে সারা দেশে তাণ্ডব সৃষ্টি করেছে-যাতে বিক্ষুব্ধ জনগণ তাদের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে এবং তারা যে গৃহযুদ্ধের হুমকি দিয়েছে তার বাস্তব রূপায়ন ঘটাতে তাদের কোনও সমস্যা না হয়। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে জামায়াতে ইসলামী এ দেশে যে পরিস্থিতি তৈরি করে রেখেছে, তাতে বিএনপি অবশ্য উল্লসিতই-বিএনপির এক নেতাকে আমরা বলতে শুনেছি যে, এক জামায়াতে ইসলামীকেই সরকার সামলাতে পারছে না, আমরা মাঠে নামলে তো পালানোর পথ খুঁজে পাবে না। অনেকে বলার চেষ্টা করছেন, মনে হচ্ছে না দেশে কোনও সরকার আছে। তবে একটি কথা কেউই ভাবছেন না, এ হচ্ছে জামায়াতে ইসলামীর সর্বোচ্চ ক্ষমতাপ্রকাশের অংশবিশেষ। রাজনীতি দিয়ে রাজনীতিকে সামাল দেয়ার দিক থেকে যদি বিবেচনা করা হয়, তা হলে যে-কাউকেই স্বীকার করতে হবে যে এর চেয়ে অনেক-অনেক বড় রাজনৈতিক কর্মী-সমাবেশ ঘটানোর ক্ষমতা জামায়াত-শিবিরবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর রয়েছে এবং তারা এখনও সেরকম সমাবেশ ঘটানোর দিকে যায়নি। কেন যায় নি? এটি একটি বড় রাজনৈতিক ভুল-আমাদের সে ভুলের মাশুল দিতে হচ্ছে। আমরা চেয়েছি ট্রাইব্যুনাল যেন কোনও মনস্তাত্ত্বিক চাপের মুখে না পড়ে-কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপি তাদের বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচীর মধ্যে দিয়ে পুরো দেশবাসীর ওপর কেবল মনস্তাত্বিক চাপই নয়-সহিংস চাপও তৈরি করেছে। আমাদের বাঘা বাঘা বুদ্ধিজীবী, টকশো’র বক্তা কাউকেই তখন বলতে শোনা যায় নি যে, এভাবে ট্রাইব্যুনালের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে-বরং তারা বলেছেন, এ ধরণের কর্মসূচী পালন করা তাদের রাজনৈতিক অধিকার! অব্যাহতভাবে বড় ধরণের সমাবেশ ও রাজপথের কর্মসূচী না রেখে আমরা যে ভুল করেছি, আমাদের সে ভুল থেকে বেরিয়ে আসতে হবে-যাতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে। পাঁচ ফেব্র“য়ারির রায় এবং সে রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে জামায়াত-শিবিরের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড ওই ধরণের সমাবেশের অনিবার্যতাকেই তুলে ধরছে। জামায়াত চাইছে জনগণ বিচ্ছিন্নভাবে বিক্ষোভের প্রকাশ ঘটাতে থাকুক-যাতে তারা চোরাগোপ্তা সহিংসতার মাধ্যমে ভয়ের রাজত্ব সৃষ্টি করতে পারে; কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলি যদি রাজপথে তাদের সমাবেশ ঘটানোর মধ্যে দিয়ে জনগণকে সে সমাবেশে সম্পৃক্ত করতে পারে, তরুণদের চলমান সমাবেশগুলিকে আরও সংহত করতে সহায়তা করে এবং জনগণ ও তরুণশক্তির ক্ষোভকে ঘনীভূত করতে পারে, তা হলে জামায়াতে ইসলামীর শেষ ভিতও ধ্বসে পড়বে।
জামায়াতে ইসলামী যে পথে এগিয়ে চলেছে, তা কি বিএনপিকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে? অনেকের কাছে মনে হতে পারে, তরিকুল ইসলামের বক্তব্য ওই উদ্বেগেরই প্রকাশ, মনে হতে পারে, ‘ট্রাইব্যুনাল বাতিলের ব্যাপারে জামায়াতে ইসলামীর বক্তব্যের সঙ্গে বিএনপি একমত নয়’ জানানোর মধ্যে দিয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে জামায়াতের সঙ্গে দূরত্ব প্রকাশ করা হচ্ছে। চক্ষুলজ্জার খাতিরে হয়তো বিএনপি এরকম দাবি জানাচ্ছে না, কিন্তু স্বয়ং খালেদা জিয়া যখন দ্য ওয়াশিংটন টাইমস পত্রিকায় সন্তুষ্টিপ্রকাশ করেন যে, যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে শুধু সরকারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের বিচার করা হচ্ছে জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতও ‘শেখ হাসিনা সরকারের সমালোচনা করেছেন’, যখন লেখেন যে, ‘গত ডিসেম্বরে ইকোনমিস্ট পত্রিকায় প্রকাশিত ইমেইল ও টেলিফোনের কথোপকথন ওই বিচারকাজ নিয়ে হাসিনা প্রশাসনের পক্ষপাতদুষ্ট আচরণের এবং কীভাবে তারা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার পাঁয়তারা করছে, তারই প্রমাণ দেয়’-তখন বিচারপ্রত্যাশী আমাদের বুঝতে সমস্যা হয় না যে, জিয়াউর রহমান যেমন ক্ষমতা পেয়ে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি তৈরির নামে আমাদের জাতীয় জীবনে গভীর এক ক্ষত সৃষ্টি করে গেছেন, দালাল আইন বাতিল করেছেন, গ্রেফতারকৃত ও এমনকি সাজাপ্রাপ্ত সকল যুদ্ধাপরাধীকে ক্ষমা করে মুক্ত করেছেন, ঠিক তেমনি খালেদা জিয়াও ক্ষমতা পেলে এই ট্রাইব্যুনাল বাতিল করে দেবেন এবং অভিযুক্ত, গ্রেফতারকৃত ও সাজাপ্রাপ্ত সকলকে নিশ্চয়ই ছেড়ে দেবেন। এই আশঙ্কা আরও সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে এ কারণে যে, বিএনপির গঠনতন্ত্রে গত কয়েক বছর আগে এক সংশোধনী আনা হয়েছে-মুক্তিযুদ্ধের সময় এর বিরোধিতাকারী ও যুদ্ধাপরাধসংগঠনকারীদের সদস্যপদ দেয়ার ব্যাপারে বিএনপির গঠনতন্ত্রে পূর্বে যে নিষেধাজ্ঞা ছিল ওই সংশোধনীর মাধ্যমে তা তুলে নেয়া হয়েছে। এতদিন একমাত্র জামায়াতে ইসলামীই ছিল যুদ্ধাপরাধীদের রাজনৈতিক দলগত আশ্রয়স্থল, এ সংশোধনীর মাধ্যমে বিএনপিও একই পথে পা বাড়িয়েছে।
সে কারণেই বোধকরি, খালেদা জিয়ার পক্ষে একটুও দ্বিধা জাগে নি প্রকাশ্যে লিখিতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশে হস্তক্ষেপ করার অনুরোধ জানাতে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কী ছিল, তা কমবেশি সকলেরই জানা আছে। অথচ আমাদের কী না পড়তে হচ্ছে, খালেদা জিয়া তার এই নিবন্ধের প্রথম অনুচ্ছেদেই লিখেছেন যে, ‘১৯৭১ সালে যখন আমার এ দেশ স্বাধীনতা পায়, তখন যে দেশগুলো আমাদের স্বীকৃতি দিয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্র সেগুলোর অন্যতম।’ আমরা যতদূর জানি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হলো বাংলাদেশকে স্বীকৃতিপ্রদানকারী ৪৮তম রাষ্ট্র-১৯৭২ সালের ৪ এপ্রিল, অর্থাৎ স্বাধীনতা পাওয়ারও তিন মাস পরে সেটি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। এমনকি বাংলাদেশের সঙ্গে কোনওরকম কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই যে রাষ্ট্রটির সেই ইসরায়েলও যুক্তরাষ্ট্রের অনেক আগে এ দেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। এ নিবন্ধে খালেদা জিয়া র‌্যাবের সমালোচনা করেছেন, কিন্তু লিখতে ভুলে গেছেন যে সেই র‌্যাব গঠিত হয়েছিল তাদের শাসনামলেই এবং তখন শুধু র‌্যাবের মাধ্যমেই নয়, অপারেশন ক্লিনহার্টের মাধ্যমেও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছিল। খালেদা জিয়া লিখেছেন, গ্রামীণ ব্যাংক দারিদ্র বিমোচনে ভূমিকা রেখেছে, ড. ইউনূসকে অপসারণ করায় সমালোচনা করেছে মার্কিন কংগ্রেসের বাংলাদেশ ককাস; কিন্তু লেখেননি, গ্রামীণ ব্যাংকের অর্থ কীভাবে ও কোথায় সরানো হয়েছে মর্মে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। তিনি দেশের ভাগ্যবান ও ক্ষমতাবান মানুষদের একজন, নইলে এই অভিযোগ নিয়ে নিশ্চয়ই আরও তীব্র কথা হতো। সবচেয়ে উদ্বেগের কথা হলো খালেদা জিয়া বাংলাদেশের বাণিজ্য খাতে অগ্রাধিকারভিত্তিক সুযোগসুবিধাগুলো প্রত্যাহার করে নিতে এবং পশ্চিমা দেশগুলোতে বাংলাদেশিদের পরিভ্রমণের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অনুরোধ করেছেন। যে খালেদা জিয়াকে সব সময় ভারতের সমালোচনা করতে দেখা যায়, এখন আমরা তাকেই কি না লিখতে দেখছি, ‘ভারত বিশ্বের সর্ব বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে তার উত্থান অব্যাহত রেখেছে।’ অবশ্য এই মন্তব্যে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই, কেননা গত বছরের সেপ্টেম্বরেও খালেদা জিয়া ভারতের একটি নীতিনির্ধারণী পত্রিকা ‘স্ট্যাটেজিক অ্যানালেইসিস’-এও ‘বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া রিলেশনস, চ্যালেঞ্জেস অ্যান্ড প্রসপেক্টস’ শীর্ষক একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন-যেটিতে স্পষ্টভাবেই প্রকাশ পেয়েছিল তার পরিবর্তিত ভারতনীতির। এবার আরও একটি নিবন্ধ লিখে খালেদা জিয়া এক অর্থে বাংলাদেশে এ ‘বিশ্বকে নেতৃত্বদানকারী’ যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি হস্তক্ষেপের জন্যেই অনুরোধ করলেন। এ অভিমত-নিবন্ধ প্রকাশের মধ্যে দিয়ে ব্যক্তি খালেদা জিয়ার হয়তো তেমন কোনও ক্ষতিই হবে না, কিন্তু দল হিসেবে বিএনপির মরণকূপ খনন করা হলো।
এইসব ডামাডোলের মধ্যে হারিয়ে গেছে উল্লেখযোগ্য আরেকটি ঘটনা-ফুলবাড়ির সংগ্রামী জনগণের প্রতিবাদের মুখে সেখানে শীতবস্ত্র বিতরণের নামে জনসংযোগ গড়ে তোলার প্রচেষ্টাকারী এশিয়া এনার্জি ও গ্লোবাল কোল ম্যানেজমেন্ট জিসিএম-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) গ্যারি এন লাইকে ফিরে আসতে হয়েছে। গ্যারি এন লাইয়ের উপস্থিতির খবর উত্তেজিত করে তুলেছিল সেখানকার সাধারণ জনগণকে। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের যে অপচেষ্টা চলছে, সেই অপচেষ্টাকারী ঠিকাদারদের পাতা কোনও ফাঁদেই পড়তে রাজি নয় সেখানকার জনগণ, রাজি নয় এশিয়া এনার্জির কাছ থেকে শীতবস্ত্র নিয়ে নৈতিকভাবে বাধা পড়তে। প্রতিবাদের ভাষা কোনও না কোনওভাবে বেঁচে থাকে এবং বাংলাদেশেও বেঁচে আছে। তাই আমরা দেখতে পাচ্ছি তরুণ সমাজ শাহবাগে অবস্থান নিয়েছে কাদের মোল্লার রায়ের পর, যেমন ফুলবাড়ির প্রতি ঘর থেকে মানুষজন বেরিয়ে এসেছিল এশিয়া এনার্জির গ্যারি এন লাই-এর আসার খবর পেয়ে। গোপন গাঁটছড়া বেধে রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক সংকট উত্তরণের অপচেষ্টা করে লাভ হয় না। গৃহযুদ্ধের হুমকি দিয়ে অথবা গোপন সমঝোতার পথে এগিয়ে কিংবা বিদেশিদের কাছে হস্তক্ষেপের আঁকুতি জানিয়েও কোনও রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। এই কয়েকদিন আগেই সরকারকে আমরা দেখেছি, প্রস্তাবিত পদ্মা সেতু প্রকল্পের দুর্নীতি ও অর্থায়ন নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে গোপন সমঝোতার চেষ্টা চালাতে-যার ফল সকলেরই জানা আছে।
দুঃখজনক হলেও সত্য, মনে হয় আমাদের দেশের রাজনীতিকরা এবং নীতিনির্ধারকরা জনগণের চোখের ভাষা বোঝার, প্রতিবাদের দৃষ্টি বোঝার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের রাজপথ বলছে, সেই জনতা জেগে উঠতে শুরু করেছে, একদা রচিত গণসঙ্গীতের ভাষায় বলতে গেলে যে জনতা বিচারপতির বিচার করবে। ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা, আজ জেগেছে সেই জনতা’- আজকের শাহবাগ তারই সাক্ষী, এবং এই শাহবাগ অচিরেই ছড়িয়ে পড়বে সারা দেশে-পরাজিত করবে গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা এবং সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপের আকুতিকে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সুনিশ্চিত করার মাধ্যমে ছিনিয়ে আনবে বিজয়।

ইমতিয়ার শামীম

আপনারে এই জানা আমার ফুরাবে না...

৪ comments

  1. মাসুদ করিম - ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ (৭:৫৪ অপরাহ্ণ)

    গতকাল থেকে শুরু হওয়া ‘শাহবাগ সংহতি’ এবং নগরে বন্দরে দেশের আনাচে কানাচে আরো আরো সংহতির মোটা দাগে তিনটি কথা মনে রাখলে এই সংহতি অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠবে এবং আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচারের হাটেমাঠেঘাটের শক্তি হয়ে উঠবে।

    * আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের দ্বিতীয় রায়ে আমরা বিক্ষুদ্ধ, কিন্তু রায় প্রত্যাখান করছি না।
    * এই ট্রাইবুনাল আওয়ামী লীগের নয়, স্বাধীন।
    * এই ট্রাইবুনাল কোনো ভাবেই বন্ধ হতে পারবে না।

    কিন্তু বিচ্ছেদ রেখার অপর পাড়ে গিয়ে যদি আমরা বলি — রায় প্রত্যখান করছি, এই ট্রাইবুনাল আওয়ামী লীগের, এই ট্রাইবুনাল বাতিল করতে হবে — তাহলে আমরা কার কথা বলব, আমরা তো সহজেই বুঝতে পারছি, তাই না? এবং ট্রাইবুনালের প্রতিপক্ষ তাই চায় — অন্যের গণআন্দোলনের কাঁধে চড়ে গন্তব্যে পৌঁছতে ম্যাজিশিয়ানের মতো দাঁড়িয়ে আছে তারা, আমার পাশে, আপনার পাশে।

  2. Pingback: Bangladesh: Protesters Demand Capital Punishment for 1971 War Criminals · Global Voices

  3. সাগুফতা শারমীন - ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ (৫:১৫ অপরাহ্ণ)

    গতকাল আলতাব আলী পার্কে শিবিরের আগ্রাসনকে কাঁচকলা দেখিয়ে হাড়কাঁপানো বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে আমরা খুবসে গান গেয়েছি- বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা আজ জেগেছে সেই জনতা।”
    কলি মনে নেই সব, সঙ্গে ঢোলের বদলে একটা ভোজ্যতেলের ড্রাম, তাতে কি, বাংলাদেশ দেখলে খুশি হতো, তার কৈশিক নালী কত সুবিস্তৃত, কত দেশে তার হৃদয়ের স্পন্দন অভিঘাত তোলে।

  4. Pingback: Bangladesh: Protesters Demand Capital Punishment for 1971 War Criminals | The World I Love To See

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.