জহির রায়হান তাঁর জীবন ও শিল্পের গন্তব্যকে গ্রন্থিত করেছিলেন মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গে। জীবন ছিল তাঁর সবচেয়ে প্রিয় পরিভ্রমণের স্থান আর শিল্প ছিল সেই পরিভ্রমণ উদ্ভাসনের দীর্ঘ পথ। জীবন ও শিল্পের পরিভ্রমণ ও উদ্ভাসন তাঁকে নিয়ে গিয়েছিল আরও এক দীর্ঘ পথের বাকে, যেখানে দাঁড়িয়ে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, পরাধীন দেশে জীবন ও শিল্প অর্থময় হতে পারে না। তিনি তাই স্বাধীকার আন্দোলনের দীর্ঘতর পথ ধরে হাঁটতে থাকেন। তাঁর জীবন ও শিল্পের গন্তব্য এক ও অভিন্ন হয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে। [...]

জহির রায়হান তাঁর জীবন ও শিল্পের গন্তব্যকে গ্রন্থিত করেছিলেন মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গে। জীবন ছিল তাঁর সবচেয়ে প্রিয় পরিভ্রমণের স্থান আর শিল্প ছিল সেই পরিভ্রমণ উদ্ভাসনের দীর্ঘ পথ। জীবন ও শিল্পের পরিভ্রমণ ও উদ্ভাসন তাঁকে নিয়ে গিয়েছিল আরও এক দীর্ঘ পথের বাকে, যেখানে দাঁড়িয়ে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, পরাধীন দেশে জীবন ও শিল্প অর্থময় হতে পারে না। তিনি তাই স্বাধীকার আন্দোলনের দীর্ঘতর পথ ধরে হাঁটতে থাকেন। তাঁর জীবন ও শিল্পের গন্তব্য এক ও অভিন্ন হয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে। দীর্ঘতর ওই পথ তাঁর জীবনকে হ্রস করে দিয়েছে – কেননা মুক্তির জন্যে মানুষকে মূল্য দিতে হয়। জহিরকেও দিতে হয়েছে, তিনি নিরুদ্দেশে গেছেন, পরে উদ্ঘাটিত হয়েছে তিনি শহীদ হয়েছেন। জীবন তাঁর হারিয়ে গেছে, কিন্তু শিল্প তাঁর এখনও উজ্জল আলো ছড়াচ্ছে; কেননা মুক্তির নিরবধি সংগ্রাম এক পরম শৈল্পিকতা, ওই শৈল্পিকতায় জহির রায়হান এক হয়ে গেছেন, লীন হয়ে আছে তাঁর জীবন ও শিল্প।
প্রায়-উপনিবেশিক এক শাসন যে পূর্ববাংলায় জীবন ও শিল্পের সমস্ত পথ রুদ্ধ করে রেখেছে জহির রায়হান তা জেনেছিলেন নিজের জীবনের মধ্যে দিয়ে। সিনেমাতে তাঁর প্রথম ফুটপ্রিন্ট ছিল ‘জাগো হুয়া সাভেরা’, ১৯৫৭ সালে ছবিটিতে সহকারী পরিচালকের কাজ করেন তিনি। কয়েক বছরের মধ্যেই পরিচালক হয়ে ওঠেন, ১৯৬১ সালে নির্মাণ করেন ‘কখনো আসেনি’, ১৯৬২ তে ‘সোনার কাজল’ আর ১৯৬৩তে ‘কাচের দেয়াল’। কিন্তু পরপর তিনটি চলচ্চিত্রই অসফল হয় বাণিজ্যের দৌড়প্রতিযোগিতায়। সমাজের অবকাঠামো তার কাঠামোর উপযোগী মনস্তত্ব তৈরি করে চলে, মারাত্মক সেই মনস্তত্ব ষাটের দশকে তো বটেই, এখনও আমাদের প্রতিনিয়ত হিতোপদেশ দেয় – জীবন এত কষ্টের, সিনেমা, নাটক আর গল্প উপন্যাস যদি আমাদের একটু হাসাতেই না পারে, তা হলে কি দরকার ওসবের? অতএব জহিরকে একপা এগুনোর জন্যে দু’পা পেছাতে হলো। মুখ ফেরাতে হলো বাণিজ্যিক ছবির দিকে। ভাষা আন্দোলন গভীরতর ছাপ ফেলেছিল তার ওপরে। তিনি তাই পরিকল্পনা করেছিলেন ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ নামের একটি রাজনৈতিক চলচ্চিত্র নির্মাণের। ততদিনে বাণিজ্যিক ছবির কল্যাণে তিনি প্রযোজক হয়ে উঠেছেন। কিন্তু অর্থনৈতিক সামর্থ্য এলেও প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ালো রাজনৈতিক পরিস্থিতি। তাঁকে তাই রূপকাশ্রয়ী হয়ে নির্মাণ করতে হলো ‘জীবন থেকে নেয়া’। পরাধীন দেশে জীবন ও শিল্পের অবনমিত চেহারার সঙ্গে প্রতিনিয়ত এভাবেই মুখোমুখি হতে হয়েছে তাঁকে।
কিন্তু সেই যে স্পেন দেশের এক প্রবাদ আছে – ‘শৈশবের স্বপ্নকে অবহেলা করো না’ – জহির রায়হান ছিলেন ওই প্রবাদের একনিষ্ঠ সাধক। স্কুলে নিচের ক্লাসে পড়ার সময়েই প্রায়ই বোতাম থাকত না জন্যে একহাতে ঢোলা হাফপ্যান্ট কোমরের সঙ্গে ধরে রেখে ছাত্র ফেডারেশন ও কম্যুনিস্ট পার্টির আত্মগোপনকারী সদস্যদের মধ্যে চিঠিপত্র আর খবর আদানপ্রদানের কাজ করেছেন তিনি, খোলা রাস্তায় বিক্রি করেছেন কম্যুনিস্ট পার্টির মুখপত্র ‘স্বাধীকার’। বড়ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারের প্রতি একান্ত ভালবাসা আর আনুগত্য থেকে জীবনের যে সরল আকাঙ্ক্ষা আর উদ্দেশ্য তিনি শৈশবেই খুঁজে পেয়েছিলেন, সেটিকে হারাতে দেননি বাণিজ্যের প্রবল দাপটের মধ্যেও। বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রকেও তিনি তাই করে তুলতে চেয়েছিলেন সৃষ্টিশীলতার অপর এক প্রান্তর। একাত্তরে তাই জহিরকে দেখি শৈশবের মতোই উঠে দাঁড়াতে। সেই দাঁড়ানোয় কোনও পিছু টান নেই, কোনও আপস নেই। তাঁর ‘স্টপ জেনোসাইড’ তখন হয়ে ওঠে যুদ্ধবিধ্বস্ত প্রতিরোধময় বাংলাদেশের বিশ্বস্ত দলিল।

দুই.
আরও অনেক সিনেমা বোদ্ধাও ছিলেন তখন, কিন্তু তাদের কেউই ‘স্টপ জেনোসাইড’-এর মতো ফিল্ম তৈরি করতে পারেননি। পারেননি এমনকি বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও। জহির রায়হানের পক্ষেই কেবল সম্ভব হয়েছিল ‘স্টপ জেনোসাইড’ তৈরি করা – কেননা তিনি জীবন ও শিল্পের গন্তব্য এক করে নিতে পেরেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে। অর্থসঙ্কট তো অনেক পরের ব্যাপার, ‘স্টপ জেনোসাইড’ নির্মাণের প্রতিবন্ধকতা ছিল পদে পদে। সশস্ত্র দখলদার পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ছিল। ছিল আওয়ামী লীগের মাথামোটা নেতারা। বিভিন্ন সেক্টরে স্যুটিং করতে গিয়ে বাধার মুখে পড়েন জহির। কোনো কোনো সেক্টরে নিষিদ্ধ করা হয় তাঁকে এবং শেষ পর্যন্ত স্যুটিং করার সুযোগ পান সাত নং সেক্টরে। কিন্তু আরও এক যুদ্ধ অপেক্ষা করছিল তাঁর জন্যে, সেই যুদ্ধ চিত্রটিকে মুক্তির মুখ দেখানোর যুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের সময় এপ্রিল-মে মাসেই ‘স্টপ জেনোসাইড’ নির্মাণের প্রাথমিক ধারণা নিয়ে তিনি যোগাযোগ করেছিলেন দ্য মোশান পিকচার অ্যাসোয়িশেন অব বেঙ্গলের সঙ্গে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তাদের রাজি করান তিনি। কিছু আর্থিক অনুদান যোগায় তারা, কিছু আর্থিক অনুদান যোগান ড. এ আর মল্লিক। কিন্তু প্রামাণ্যচিত্রটি নির্মাণের পর আসে সবচেয়ে বড় বাধা। যতটা না গণহত্যা, তারও বেশি মুক্তিযুদ্ধ ও তার নেতাদের নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্রই বেশি দরকার ছিল আওয়ামী লীগ নেতাদের। তারা তাই এটির সেন্সর অনুমোদন ও প্রদর্শনের বাধা হয়ে দাঁড়ায়। মুজিবনগর সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের চলচ্চিত্র বিভাগের ইনচার্জ এমএ খায়ের তার স্মৃতি উন্মোচন করেছেন সাংবাদিক আফসার আহমেদের কাছে, ভেতরের ঘটনা ছিল অন্যরকম। আপত্তি তোলার সবচেয়ে প্রধানতম কারণ ছিল প্রামাণ্যচিত্রটিতে বঙ্গবন্ধুর কোনও উপস্থিতি না দেখানো। জহির রায়হানের লক্ষ্য ছিল, বিশ্ববাসীর কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধের স্বীকৃতি আদায় করা আর মুজিবনগর সরকারের লক্ষ্য ছিল, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বকে প্রতিষ্ঠিত করা। এমএ খায়ের বলেছেন সাংবাদিক আফসার আহমেদের কাছে, মুক্তিযুদ্ধে যে বঙ্গবন্ধুই নেতৃত্ব দিচ্ছেন, এ ব্যাপারে জহির রায়হানের কোনও সংশয় ছিল না। মুক্তিযোদ্ধারা বঙ্গবন্ধুর নামে শ্লোগান দিচ্ছেন, শপথ নিচ্ছেন, এসব কিছুই জানা ছিল তাঁর। জানা ছিল, বিদেশিদের কাছেও মুজিব নামটি কত সুপরিচিত। কিন্তু তিনি এ-ও জানতেন, বিশ্বজনমতকে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে আনতে হলে রাজনৈতিক গতিপ্রবাহ তুলে ধরার চেয়ে গণহত্যার প্রকৃতি ও মর্ম তুলে ধরা অনেক-অনেক বেশি জরুরি। অপ্রাসঙ্গিকভাবে এর মধ্যে নেতৃত্বপ্রসঙ্গ উপস্থাপন করতে তিনি রাজি ছিলেন না। রাজি ছিলেন না কথায় কথায় অপ্রয়োজনে একেকটি চরিত্রের মুখ থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম বের করে আনতে। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক দর্শনের চক্ষুশূল আরও বেশ কিছু উপাদান ছিল এতে। যেমন, চলচ্চিত্রটির শুরু হয় লেনিনের উদ্ধৃতি দিয়ে, তারপর আমরা দেখি জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদের অসহায় পরিণতি, একেবারে শেষে আবার ধ্বনিত হতে শুনি ‘জাগো জাগো সর্বহারা’ সঙ্গীতের সুর। যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী ভূমিকার বিরুদ্ধে বিভিন্ন বক্তব্য রয়েছে এ চলচ্চিত্রে, অথচ আওয়ামী লীগের একাংশ চাইছিল ওই সাম্রাজ্যবাদী অক্ষশক্তির ইচ্ছানুযায়ী মুক্তিযুদ্ধে ক্ষান্তি দিতে, আরেকটি অংশ চাইছিল ভবিষ্যতের শাসনের স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী ভূমিকার কোনও সমালোচনাই না করতে।
এরকম সব উদ্দেশ্যপ্রবণ জটিল মনস্তত্বসমূহের পক্ষে সম্ভব ছিল না জহিরের শৈল্পিকতা অনুভব করা। এদের শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গি শক্ত করে বাধা ছিল প্রতিক্রিয়াশীলতার খুঁটিতেই। এদিকে জহিরের নিজের রাজনৈতিক অবস্থানটিও ছিল জটিল। আওয়ামী লীগ সরকারের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযুদ্ধ ছিল তার কাছে রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং সে বাস্তবতা তিনিও মেনেও নিয়েছিলেন। কিন্তু মেনে নেয়ার পরও সাংঘর্ষিকতা দেখা দিয়েছিল তিনি নিজে মার্কসবাদী মতের মানুষ হওয়াতে। পিকিংপন্থী কমিউনিস্ট পার্টিতে ভাঙন ধরার পর তিনি আর সরাসরি কোনও দলে নাম না লেখালেও তাঁর সমর্থন ছিল তাদের প্রতিই। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় পিকিংপন্থী দলগুলির কোনো-কোনোটি পাকিস্তান সরকারের পক্ষ নিয়েছিল, কোনো-কোনোটি পাকিস্তান ও মুজিবনগর সরকার উভয়ের বিরুদ্ধেই রাজনৈতিক যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল – যদিও আক্রমণের পাল্লাটি ছিল মূলত মুজিবনগর সরকারের বিরুদ্ধেই – মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধেই। জহির রায়হান রাজনীতির দিকে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকে পড়েছিলেন গণঅভ্যুত্থানের সময়- এসময় তিনি মাওসেতুং-এর লেখা পড়েন এবং বিভিন্ন মাওপন্থী দলগুলির সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলেন, তাদের অর্থনৈতিকভাবে সহযোগিতাও করতে শুরু করেন। পিকিংপন্থীদের গণবিরোধী এই ভূমিকা তাই মুক্তিযুদ্ধে নিবেদিত ও একাত্ম জহির রায়হানকে নিঃসঙ্গ করে ফেলে। আবার মস্কোপন্থী কমিউনিস্টদের প্রতিও পিছুটান ছিল তাঁর, কেননা মতবাদিক দিক থেকে খানিকটা দূরত্ব থাকলেও বড়ভাই শহীদুল্লাহ কায়সার ও জীবনের প্রথম পর্বের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সূত্রে মস্কোপন্থী বিভিন্ন নেতা, লেখক ও সাংবাদিকের সঙ্গে তাঁর নিবিড় সখ্য ছিল। মুক্তিযুদ্ধ তাই জহির রায়হানের ব্যক্তিগত জীবন ও বোধকেও দেয় নতুন এক মাত্রা। মুক্তির সংগ্রামে নতুন নতুন মিত্র খোঁজেন তিনি এবং ক্ষতবিক্ষত হন মৈত্রীর বোধ ও শর্তসমূহ নির্মাণ করতে গিয়ে।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই কঠিন সংগ্রামেও জয়ী হতে শুরু করেন তিনি। আওয়ামী লীগের কয়েক নেতার পক্ষ থেকে পশ্চিমবঙ্গের সেন্সর বোর্ডকে অনুরোধ জানানো হয়েছিল ‘স্টপ জেনোসাইড’কে ছাড়পত্র না দেয়ার জন্যে। এই অনুরোধের ভবিষ্যত নিয়ে এত বেশি আশাবাদী ছিলেন যে, আওয়ামী লীগের প্রধান সারির এক নেতা ওই সময় নাকি ঘোষণা দিয়েছিলেন, ছবিটি মুক্তি দেয়া হলে তিনি বাংলাদেশ মিশনের সামনে অনশন করবেন।’ পশ্চিমবঙ্গ সেন্সর বোর্ডও প্রথমে ছবিটিকে মুক্তি দিতে অস্বীকৃতি জানায়। দিল্লী পর্যন্ত ছুটতে হয় জহির রায়হানকে, শহীদুল্লাহ কায়সারের যে-সব বন্ধু ভারতীয় সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতেন, তাদের খুঁজে খুঁজে বের করে সাহায্য চান তিনি। এইভাবে ‘স্টপ জেনোসাইড’ ভারতে প্রদর্শনের ছাড়পত্র পেয়েছিল। যদিও তারপরও সম্ভব হয়নি ছবিটি প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা।
জহির রায়হানের প্রতি মুজিবনগর সরকারের সবার দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্য এক ছিল না। এম এ খায়েরের স্মৃতিচারণ থেকেই জানি আমরা, খুব গোপনে ‘স্টপ জেনোসাইড’-এর প্রথম প্রদর্শনীর সময় উপস্থিত ছিলেন মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, এএইচএম কামরুজ্জামানসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা। ছবি দেখে তারা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময় মন্ত্রিপরিষদ জহির রায়হানকে দিয়ে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। তাজউদ্দীন এ সময় এমএ খায়েরকে বলেন, জহির রায়হানের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। জহির রায়হান সানন্দে রাজি হন ওই আহ্বানে। শুধু তাই নয়, মুজিবনগর সরকার তাঁকে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের অর্থ দিলেও তিনি তা দিয়ে নির্মাণ করেন চারটি ছবি। কলকাতায় ‘জীবন থেকে নেয়া’র প্রদর্শনী থেকে যত অর্থ পাওয়া গিয়েছিল, তার সবই তিনি দিয়ে দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধ তহবিলে। এমএ খায়ের জহির রায়হান নির্মিত সেই চারটি চলচ্চিত্রের মধ্যে ‘বার্থ অব আ নেশন’, ‘চিলড্রেন অব বাংলাদেশ’ ও ‘সারেন্ডার’ এই তিনটি ছবির নাম মনে করতে পেরেছেন, কিন্তু আরেকটি ছবির নাম ভুলে গেছেন। ছবি চারটিই মুক্তিযুদ্ধের পর কোলকাতা থেকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়েছিল, সেগুলির শিল্পমান নিয়েও কোনও প্রশ্ন ওঠেনি, প্রশ্ন কেবল একটাই – ছবিগুলি হারিয়ে গেল কেমন করে? আর কোনোদিনই কি খুঁজে পাওয়া যাবে না সেসব?

তিন.
জহিরের পথিকৃৎ ভূমিকায় সমৃদ্ধ হয়েছে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র, কিন্তু তাঁর জন্যেও মূল্য দিতে হয়েছে তাঁকে – ধীরে ধীরে সরে আসতে হয়েছে সাহিত্যচর্চা থেকে। ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে প্রথম শিল্পোত্তীর্ণ উপন্যাসটির লেখক তিনি – ‘আরেক ফাল্গুন’ কেবল রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহেরই নয়, জীবনপ্রবাহের নিদর্শন হয়ে বেঁচে আছে। শাহরিয়ার কবিরের এক লেখায় জহির রায়হানের দেয়া ভাষ্যানুযায়ী, ২১ ফেব্রুয়ারি প্রথম যে দশজন ১৪৪ ধারা ভেঙেছিলেন, জহির রায়হান তাদেরই একজন। ‘আরেক ফাল্গুন’ তাই জহির রায়হানেরই জীবনের অর্জন এবং অভিজ্ঞা। কিন্তু মানুষের জীবনকে তিনি খুঁজে নিয়েছেন ধারাবাহিকতার মধ্যে দিয়ে, তাই তাঁর পক্ষে অনায়াসেই লেখা সম্ভব হয়েছে ‘হাজার বছর ধরে।’ লেখা সম্ভব হয়েছে ‘বরফ গলা নদী’। তিনি লিখেছেন ‘কতগুলো কুকুরের আর্তনাদ’ আর ‘ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি’র মতো গল্প। জহির এক অনিঃশেষ সৃষ্টিশীল, সৃজনশীল – তাই বিস্ময়ের সঙ্গে আমরা দেখি, এসবের কোনওটাই তিনি তাঁর চলচ্চিত্রের জন্যে লেখেননি। চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লেখার আদল কোনো কোনো লেখায় ব্যবহার করলেও তিনি তাঁর সাহিত্যকে চলচ্চিত্র থেকে শেষ পর্যন্ত দূরেই রেখেছিলেন। এমনকি প্রথম চলচ্চিত্র ‘কখনো আসেনি’তেই তিনি যে প্রথাবিরোধী মেজাজ তৈরি করেছিলেন, একটি নিম্নবিত্ত পরিবারকেই শুধু নয়, সমাজ ও পরিবারে নারীর অবস্থানকে যেভাবে অবলোকন করেছিলেন, ৫০ বছর পরও তা আমাদের বিস্মিত করে। এসব দিক বিবেচনা করলে এ-ও স্পষ্ট হয়, তাঁর সমসময়ের শক্তিমান চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় ও ঋত্বিক ঘটকের থেকেও তিনি পুরোপুরি আলাদা। সত্যজিৎ ও ঋত্বিককে আমরা দেখেছি, বিভিন্ন শক্তিমান কথাসাহিত্যিকদের চলচ্চিত্রোপযোগী সাহিত্যকে আশ্রয় করতে, কিন্তু ‘আনোয়ারা’ বাদ দিলে জহির রায়হানের এমন কোনও চলচ্চিত্র নেই যেটি সাহিত্যগ্রন্থনির্ভর। চলচ্চিত্ররূপ দিয়ে এমনকি নিজের সাহিত্যগ্রন্থকেও প্রশ্নবিদ্ধ করতে রাজি ছিলেন না তিনি। চলচ্চিত্র আর সাহিত্যের আলাদা সত্বাকে মনেপ্রাণেই স্বীকৃতি দিয়েছিলেন তিনি, চাননি একটির ভাষাকে আরেকটির ওপর চাপিয়ে দিতে। তবে শেষের দিকে সাহিত্যচর্চা থেকেই অনেক দূরে চলে এসেছিলেন তিনি, যার ছাপ পড়েছে ‘আর কতদিন’-এ। অনুরোধের পর অনুরোধে বিব্রত ও অসহায় জহির রায়হান ‘লেট দেয়ার বি লাইট’-এর চিত্রনাট্যটিকেই কোনওমতে উপন্যাসের আদল দিয়ে রচনা করেন ‘আর কতদিন’, যা প্রকাশ পায় সচিত্র সন্ধানীতে। এই ‘আর কতদিন’ ও সচিত্র সমীপেষু নামের একটি পত্রিকার জন্যে ডিকটেশন দিয়ে লেখা ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ই পরবর্তী সময়ে সমালোচনাজীবীদের কাছে তাঁর চিত্রনাট্যের আদলে সাহিত্য রচনার প্রধান উদাহরণ হয়ে ওঠে।

চার.
প্রচণ্ড ও অহেতুক ভীড়ের মধ্যেও, প্রচুর আবর্জনা ও জঞ্জালের মধ্যেও জহির রায়হানের সাহিত্য ও চলচ্চিত্র (বিশেষত চলচ্চিত্র) শেষ পর্যন্ত একটি পরিণতি পেয়েছে। মুগ্ধতা ছাপিয়ে এক মগ্নতায় নিয়ে যায় তাঁর চলচ্চিত্র আর সাহিত্য স্বল্পপরিসরে হলেও মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের নিরন্তর জীবনপ্রবাহ হিসেবে আমাদের আন্দোলিত করে।
কিন্তু জহির রায়হান, আমাদের দেবার মতো অফুরান সৃজনক্ষমতা থাকার পরও, নিজেই হারিয়ে যান বড় ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে গিয়ে। বড়ভাইয়ের প্রতি তাঁর ছিল অফুরন্ত আনুগত্য ও অনুরাগ, তাই ভাইকে হারিয়ে তিনি এলোমেলো হয়ে যান। হয়তো এই এলোমেলো হওয়ার সূচনা একাত্তরেই, যখন চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত বাধার মুখে পড়তে হয়েছে তাকে, শুনতে হয়েছে পিকিংপন্থী হওয়ার গালি, নীরবে হজম করতে হয়েছে মস্কোয় যাওয়ার ভিসা না পাওয়ার গ্লানি। ১৬ ডিসেম্বরেই তিনি জানতে পারেন, শহীদুল্লাহ কায়সার ও আরো অনেক বুদ্ধিজীবী হত্যার কথা এবং ১৭ ডিসেম্বরেই ভারতীয় এক বিমানে ঢাকা চলে আসেন। ভাইকে খুঁজে পেতে তিনি মরিয়া হয়ে ওঠেন এবং তাই খুঁজতে থাকেন পাকিস্তানিদের এদেশিয় সহযোগীদেরও। সাংবাদিক সম্মেলন করে তিনি ঘোষণা দেন, ওইসব সহযোগীদের শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হবে। আওয়ামী লীগ নেতাদেরও তীব্র সমালোচনা করেন তিনি। সত্যি কথা বলতে গেলে, এই সময় জহির রায়হান হয়তো একজন মার্কসবাদী থেকে একজন অপ্রকৃতিস্থ অদৃষ্টবাদীতেই রূপান্তরিত হয়েছিলেন – কেননা তিনি এ সময় পীর-ফকিরদের কাছেও ধর্ণা দিতে থাকেন এবং আজমীর শরীফে যান খাজা বাবার কাছে ভাইয়ের জন্যে দোয়া চাইতে।
যে রাজনৈতিক অঙ্গীকার জহির রায়হানের ছিল, এভাবেই তা নিরুদ্দেশে যায়; তারপর নিরুদ্দেশে যান তিনি নিজেই। এক অদৃশ্য টেলিফোন তাকে মীরপুরে নিয়ে যায়, যে-এলাকা ছিল তখনও পাকহানাদার বাহিনী ও বিহারীদের নিয়ন্ত্রণে। কয়েক বছর আগে সাংবাদিক জুলফিকার আলী মানিকের তদন্তে উদ্ঘাটিত হয়েছে, তিনি তাদের গুলিতেই শহীদ হয়েছেন।
যদি এ নিয়ে তখনই অনুসন্ধান হতো, চিরুনি-তল্লাশ হতো, তা হলে আমরা অন্তত তাঁকে সমাহিত করতে পারতাম শ্রদ্ধার সঙ্গে; তা হলে নিরুদ্দিষ্ট ভাইয়ের মতো তাঁকেও হয়তো নামপরিচয়হীন লাশ হয়ে যেতে হতো না। কিন্তু তাকে আমরা দিনের পর দিন খুঁজেছি এবং এখনও খুঁজছি – প্রথমে দেশজুড়ে বধ্যভূমিতে, তারপর তার সাহিত্য ও চলচ্চিত্রে – কিন্তু একাগ্র সেই উদ্ভাসন আমরা আর খুজে পাইনি; কখনো পাব কি না তাও নিশ্চিত করে বলা যায় না।

মাঘ ১৪১৬/ জানুয়ারি ২০১০

সাবস্ক্রাইব করুন
অবগত করুন
guest

17 মন্তব্যসমূহ
সবচেয়ে পুরোনো
সাম্প্রতিকতম সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত
Inline Feedbacks
View all comments
17
0
আপনার ভাবনাগুলোও শেয়ার করুনx
  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.