(পূর্বাংশ পড়তে হলে এখানে দেখুন)
চার
চেতন-চিন্তায় অত দূরত্ব থাকার পরও বিশেষত অ্যানির মৃত্যুই কি ডারউইন আর এমাকে দিয়েছিল নিবিড়তর সখ্য? শুধু প্রতিকূল এক দ্বন্দ্ব-বিতর্কে জড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকেই কি ডারউইন চেয়েছিলেন, দিনের পর দিন ধরে সযত্নে লেখা বইটি তাঁর মৃত্যুর পর ছাপা হোক, যাতে নশ্বর তাঁকে এইসব ধকল আর সহ্য করতে না হয়? নাকি তখন এমার মানসিক কথাও চিন্তা করেছিলেন তিনি? দুই দশক ধরে একসঙ্গে তাঁরা ভাগাভাগি করেছেন অসুস্থতা, আত্মসংশয় আর পারিবারিক সব বেদনা। আর তাই একথা এমার চেয়ে ভালো করে আর কে জানত যে, ডারউইন কী গভীর সততার মধ্যে দিয়েই উপনীত হয়েছেন ধর্মের সৃষ্টিতত্ত্বের বিপরীত ওই সিদ্ধান্তে? ইতিহাস বলছে, প্রকৃতির আরসব সৃষ্টির মতো মানুষও একটি সৃষ্টিমাত্র,-এ-সত্যে পৌঁছানোর মধ্যে দিয়ে ডারউইন নিজের জন্যে যে-ঝুঁকি ও বিপদাশঙ্কা তৈরি করেন, সেই ঝুঁকি ও শঙ্কাপূর্ণ সময়ে তাঁর পাশে থাকাই শেষ পর্যন্ত বড় হয়ে উঠেছিল নিষ্ঠাবতী আস্তিক এমার কাছে।
আর ডারউইন নিজেও তো জানতেন সেই ঝুঁকির কথা। কালো আলখাল্লা-পরা পুরোহিতরা, যারা ছিল ডারউইনের ভাষায় ‘কালো শুয়োর’,-তিনি জানতেন প্রতিবাদ আসবে তাদের কাছ থেকে। বিশেষত তিনি নিশ্চিত ছিলেন, জীববিদ্যার অধ্যাপক দ্য রেভারেণ্ড অ্যাডাম সেজউইক এর প্রতিবাদ অবশ্যই করবেন।
অন্যদিকে, এই সেজউইক-ই হয়ে উঠেছিলেন এমার শেষ ভরসা। ডারউইনের বই পড়ে তিনি কী বলেন, তা জানার জন্যে উদগ্রীব হয়ে ছিলেন তিনি। তাঁর কি মনে হয়েছিল, সেজউইক ডারউইনের পাশে দাঁড়াবেন? অথবা এমন কোনো যুক্তি দাঁড় করাবেন, যাতে ডারউইন তাঁর আন্তরিক সততা দিয়ে যে-সত্যের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন, তা থেকে আবারও ফিরে আসবেন পুরোনো সত্যের কাছে?
সপ্তদশ শতাব্দীতে ব্রিটেনে বিজ্ঞান আর ধর্মকে একই পাল্লায় তুলে বিচার-বিবেচনার এক অস্বাভাবিক চর্চা শুরু হয়, যার অবশিষ্ট পৃথিবীতে এখনও দেখি আমরা। এখনও অনেকেই মনে করেন, বিজ্ঞান ও ধর্মে কোনো তফাত নেই; মনে করেন, বিজ্ঞান ও ধর্ম একে অপরের পরিপূরক। এখন যেমন, তখনও অনেকে মনে করতেন, এ-দুয়ের সম্মিলনের মধ্যে দিয়ে সম্ভব মানুষ ও জগতের মুক্তি। তখন, সেজউইক ছিলেন সেই সম্মিলনের নেতৃস্থানীয় প্রতিনিধি। বিজ্ঞান ও ধর্মকে তাঁরা বিন্যস্ত করেছিলেন শ্রমবিভাজনের ছকে। তাই যাঁরা প্রকৃতি নিয়ে অধ্যয়ন করতেন, তাঁদের তাঁরা ঈশ্বরপাঠের বাণী শোনাতেন। এই পাঠের অন-র্গত ছিল ঈশ্বরের অস্তিত্ব, মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব এবং জগতের সকল সৃষ্টির ওপর ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব। অন্যদিকে যাঁরা বাইবেলকে অনুসরণ করে ঈশ্বরের বাণী (রেভেলেশান) সম্পর্কে অধ্যয়ন করতেন, তাঁদের কাছে তাঁরা তুলে ধরতেন ঈশ্বরবিশ্বাসের কার্যকারণ ও অপরিহার্যতার বিভিন্ন কথিত বিজ্ঞানসম্মত যুক্তি। ঈশ্বর মানুষের সামনে জগৎকে কীভাবে মেলে ধরেছেন এবং কীভাবে বেহেশতে যাওয়া সম্ভব, তা ছিল এই পাঠের প্রধান বিষয়। প্রকৃতি কীভাবে ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ দিচ্ছে, সেটাই ছিল এই অধ্যয়নের অন্তর্ভুক্ত। এই শিক্ষার মাধ্যমে জানানো হত, প্রকৃতি যদিও আমাদের বেহেশতে যাওয়ার শিক্ষা দেয় না, কিন্তু প্রকৃতির কাছ থেকেই প্রমাণিত হয় যে নিশ্চয়ই তার কোনো স্রষ্টা আছে; তাই সে-স্রষ্টার কাছে পৌঁছবার জন্যে অবশ্যই বাইবেল বা ধর্মকে অনুসরণ করতে হবে। অর্থাৎ মানুষটি ধর্মীয় অথবা বিজ্ঞানভিত্তিক যে-ধারারই হোক-না কেন, তাঁর কাছে ধর্মের সৃষ্টিতত্ত্ব তুলে ধরাই ছিল এই সম্মিলনধারার মানুষদের মূল লক্ষ্য।
এরকম এক সম্মিলনধারার মানুষদের সমালোচনা এড়াতে ডারউইন বেছে নিয়েছিলেন নিভৃত জীবনযাপনের পথ, তাঁর বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফল না-প্রকাশের পথ। কিন্তু ডারউইন চুপ করে থাকলেও সময় চুপ করে বসে ছিল না। দ্য লণ্ডন টাইমসের এক বিজ্ঞাপন থেকে অক্টোবর ১৮৪৪ সালে ডারউইন জানতে পারেন, ‘দ্য ভেস্টিজেস অভ দ্য ন্যাচারাল হিস্ট্রি অভ ক্রিয়েশান’ নামে একটি বই ছাপা হয়েছে; কিন্তু বইটির লেখকের নাম গোপন রাখা হয়েছে। বিবর্তন বা অভিব্যক্তিবাদই এ-বইয়ের বিষয়। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই বইটি সাড়া জাগায়। আর পাঠক হিসেবে বইটি পায় রানি ভিক্টোরিয়া থেকে কবি টেনিসন, এরকম বিচিত্র পর্যায়ের সব মানুষকে। কে লিখেছে তা না জানা গেলেও বিষয়বস্তু কারণেই তা হয়ে ওঠে আলোচিত-সমালোচিত। মূলত বইটির লেখক ছিলেন স্কটিশ সাংবাদিক রবার্ট চেম্বারস। কিন্তু দ্য রেভারেণ্ড অ্যাডাম সেজউইকদের কাছ থেকে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়তে হবে বলেই তিনি তাঁর নাম গোপন করেন এবং বইটির লেখক হিসেবে তাঁর নাম প্রকাশ করা হয় আরও ৪০ বছর পর। এবং সত্যিই সেজউইকদের সমালোচনার মুখে পড়ে এ-বই। বইটির ট্রান্সমিউটেশন দর্শনকে সেজউইক ‘এক অসত্য দর্শনের সর্পকুণ্ডলী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। বইটির প্রকাশকে তিনি আখ্যায়িত করেন ‘অশ্লীল গর্ভপাত’ হিসেবে।
নাম গোপনকারী এক লেখক সম্পর্কে সেজউইকের এরকম প্রতিক্রিয়া জানার পর ডারউইন বুঝতে পারেন, তাঁর সিদ্ধান্ত খুবই সঠিক,-নীরবতাই হিরণ্ময় এক্ষেত্রে। যদিও তাঁর ঝুলিতে ছিল রবার্ট চেম্বারসের চেয়ে অনেক অনেক যুক্তিগ্রাহ্য তূণ। আর এইসব তূণ সংগ্রহের জন্যে কী না করেছেন তিনি! সারাজীবনে বিভিন্নজনের সঙ্গে চিঠি বিনিময় করেছেন সাত হাজারেরও বেশি। আর এইসব মানুষের দলে ছিলেন শুয়োরপ্রজননবিদ আর কৃষক থেকে শুরু করে বিভিন্ন রকমের জ্ঞানী-বিজ্ঞানী মানুষ। নিজের ধারণাকে পরিস্ফুটিত করার জন্যে, স্বচ্ছ ও নিঃসংশয়ী এক সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্যে বার বার প্রশ্ন তৈরি করেছেন, প্রশ্নের উত্তর খুঁজে নিয়েছেন। এমনকি তাঁর অনুসন্ধিৎসার ধরন, আবেগ আর রসবোধেরও বিশেষ উদাহরণ এসব চিঠি। এর ওপর ছিল চিন্তাপথ থেকে আহরিত জ্ঞানভাণ্ডার। কিন্তু’ রবার্ট চেম্বারসের বইটি প্রকাশের এক যুগ পরে আবারও এমন এক ঘটনা ঘটতে চলল, যা থেকে ডারউইনের নিজের মনেই প্রশ্ন জাগল, তা হলে সারাজীবনের সাধনায় যে-জ্ঞান তিনি খুঁজে পেলেন, তা অর্জনের কৃতিত্ব থেকেই কি তিনি বঞ্চিত হবেন নিজেকে গোপন রাখার ফলে?
ডারউইন, চার্লস লিয়েল আর জোসেফ হুকারের যেসব চিঠি প্রদর্শনের জন্যে রাখা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে দিয়ে খুব সহজেই ফুটে উঠেছে ডারউইনের এই উদ্বেগ আর সে-উদ্বেগের মুখে তাঁর প্রিয় মানুষদের সহানুভূতি ও পরামর্শ। আর পাশাপাশি বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পেয়েছেন আরও একজন মানুষ,-আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস। জীবনের প্রতিকূল পথ ডারউইনের চেয়ে অনেক বেশি হেঁটেছেন ওয়েলস-এর স্কটিশ বংশোদ্ভূত এ-মানুষটি। বার বার তিনি তাঁর গবেষণার উদ্যোগ নিয়েছেন, ছুটে বেড়িয়েছেন ব্রাজিল, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ইত্যাদি স্থানে, বার বার বিভিন্ন নিদর্শন সংগ্রহ করেছেন। কিন্তু বার বার তা নষ্ট হয়ে গেছে নানা দুর্বিপাকে। যেমন, ১৮৪৮ সালে তিনি ব্রাজিল যান, চার বছর ধরে ঘুরে বিভিন্ন নমুনা সংগ্রহ করেন। কিন্তু ফেরার সময় সমুদ্রে জাহাজডুবিতে হারিয়ে যায় তাঁর সংগৃহীত সমস্ত উপকরণ, তিনি এবং তাঁর সহযাত্রীরা কোনোমতে জীবন বাঁচান। এর পরও হাল ছাড়েননি ওয়ালেস। ভিক্টোরিয়ান এই প্রকৃতিবিদ নিজের সংগৃহীত বিভিন্ন নমুনার ভিত্তিতে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তনের সিদ্ধান্তে পৌঁছান। এবং সেই সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে তিনি লেখেন, অন দ্য ল দ্যাট হ্যাজ রেগুলেটেড দ্য ইনট্রোডাকশন অভ নিউ স্পেসিস। ডারউইনকেও জানতেন ওয়ালেস। ১৮৫৮ সালে এক চিঠিতে ডারউইনকে তিনি তাঁর গবেষণার কথা জানান। আরও জানান, তাঁর ইচ্ছা এ-তত্ত্বটি লিনাইয়ান সোসাইটিতে তুলে ধরার।
ওয়ালেসও নিজের মতো করে তাঁর (ডারউইনের) অভিন্ন উপসংহার খুঁজে পেয়েছেন,-এই সত্য আরও উদ্বিগ্ন ও অস্থির করে তোলে ডারউইনকে। পরামর্শ চান তিনি ঘনিষ্ঠ বন্ধু জোসেফ হুকারের কাছে। হুকার তাঁকে বলেন, অনেকবার পরীক্ষা করে নিশ্চিত না হয়ে প্রজাতি সম্পর্কে নতুন কোনো সিদ্ধান্ত দেয়ার অধিকার তাঁর নেই। তা শুনে ডারউইন আরও অস্থির হয়ে ওঠেন। শেষ পর্যন্ত চার্লস লিয়েল এবং জোসেফ হুকারের পরামর্শক্রমে লিনাইয়ান সোসাইটিতে ডারউইন আর ওয়ালেসের গবেষণাকর্ম উপস্থাপিত হয় একইসঙ্গে। তাঁদের দুজনকে তত্ত্বের সারসংক্ষেপ একই বৈঠকে পর পর উপস্থাপন করতে দেন লিনেইয়ান সোসাইটির জ্যেষ্ঠ সদস্যরা, যদিও দুজনেই অনুপস্থিত থাকেন তাঁদের প্রতিবেদন উপস্থাপনসভায়। এ-উপস্থাপনার ১৩ মাস ১০ দিন পর বই আকারে প্রকাশ পেল ডারউইনের দ্য অরিজিন অভ দ্য স্পেসিস। আর কেউ হলে হয়তো এ-বই দেখে ঈর্ষান্বিত হতেন, কিন্তু জীবনের অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ ওয়ালেস যখন দেখলেন ডারউইন তাঁরও চেয়ে অনেক বেশি যুক্তিগ্রাহ্য তূণ নিয়ে প্রাকৃতিক নির্বাচনের তত্ত্ব বিন্যাস করেছেন, তখন ডারউইনকে পথিকৃতের স্বীকৃতি দিতে একটুও দ্বিধা করলেন না তিনি।
ওয়ালেস ওই স্বীকৃতির মধ্যে দিয়ে ডারউইনের কাছ থেকে আদায় করে নেন নিজেরও যথাযথ সম্মান। চিঠি দেখি, সকৃতজ্ঞ হৃদয়ে তাঁর কাছে ডারউইন লিখেছেন, সচরাচর এক বিজ্ঞানী আরেক বিজ্ঞানীর প্রতিদ্বন্দ্বী হন এবং একজন আরেকজনকে সহ্য করতে পারেন না। কিন্তু ওয়ালেস সেই পর্ব অতিক্রম করে মহৎ এক মানুষের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
প্রাকৃতিক নির্বাচনতত্ত্বের যৌথ উপস্থাপনার মধ্যে দিয়ে ডারউইন আর ওয়ালেস একদিকে বন্ধু হয়ে উঠছেন, অন্যদিকে এমা তখন অপেক্ষা করছেন সেজউইকের প্রতিক্রিয়ার। অবশেষে বহুল প্রতিক্ষিত সেই প্রতিক্রিয়া এল। সেজউইক বইটি সম্পর্কে লিখলেন, এ-বই হল ‘স্রষ্টার বাস্তবতা আর প্রাকৃতিক এই বিশ্বের অন্তর্বর্তী সংযোগ ভেঙে দেয়ার প্রচেষ্টা।’ ডারউইনের কাছে চিঠি লিখলেন তিনি,
আনন্দের চেয়েও অনেক অনেক কষ্ট নিয়ে তোমার এ-বই পড়েছি আমি। এ-বইয়ের খানিকটা আমার খুবই পছন্দের, খানিকটায় আমি হেসেছি আমার পাঁজরগুলি টনটন করে না ওঠা পর্যন্ত, খানিকটা আমি পড়েছি পুরোপুরি দুঃখ নিয়ে,-কেননা সেগুলিকে আমি পুরোপুরি মিথ্যা এবং ভয়ানক ক্ষতিকর মনে করি। (I have read your book with more pain than pleasure. Parts of it I admired greatly, parts I laughed at till my sides were almost sore, parts I read with absolute sorrow because I think them utterly false and grievously mischievous.)।
শিক্ষকের কাছ থেকে শিক্ষার্থীর পথ কখনো কখনো আলাদা হয়ে যায়। তাতে কে কতটুকু নীলকণ্ঠ হয়ে ওঠেন, সেজউইক আর ডারউইনের চিঠির খণ্ডাংশগুলি তারই সাক্ষী যেন।
সেজউইকের ওই চিঠির পাশেই রাখা হয়েছে ডারউইনের প্রত্যুত্তরটিও। তেমন কোনো যুক্তি দিতে যাননি তিনি, কারণ তিনি তো ভালো করেই জানেন, কী অমীমাংসিত বৈপরীত্য তাঁদের দুজনের মধ্যে! তবে চিঠিটি পড়তে পড়তে যে-কেউই বুঝতে পারেন, ডারউইনও ব্যথিত সেজউইক কষ্ট পাওয়ায়। মাথাটা খানিকটা অবনমিত সেই কষ্টে, তার পরও নিজের অবস্থানে অনড় তিনি :
আমি শুধু এটুকুই বলতে পারি, বিশ বছরের বেশি সময় ধরে ক্রীতদাসের মতো এ-বিষয়টির ওপর আমি কাজ করেছি এবং যে-উপান্তে এসে দাঁড়িয়েছি তাতে পৌঁছবারও সচেতনভাবে কোনো উদ্দেশ্যের প্রণোদনা ছিল না আমার। যে-মানুষটিকে আমি আন্তরিকভাবে সম্মান করি, এই প্রাপ্তির মধ্যে দিয়ে তাঁকে আহত করায় আমার নিজেরও কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু আমি মনে করি না যে আপনি প্রত্যাশা করেন, একজন মানুষ তার পক্ষের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টার মধ্যে দিয়ে যেখানে উপনীত হয়েছে সেটা সে গোপন রেখে দেবে। (I can only say that I have worked like a slave on the subject for above 20 years and am not conscious that had motives have influenced the conclusions at which I have arrieved. I grieve to have shocked a man whom I sincerely honor. But I do not think you would wish anyone to conceal the results at which he has arrived after he has worked, according to the best abilitiy which may be in him.)
পাঁচ
ডারউইনের এ-আবিষ্কার, লেখাই বাহুল্য, স্পর্শ করেছে জ্ঞানজগতের প্রতিটি ক্ষেত্রকে। ম্যালথাসের তত্ত্ব খণ্ডন করলেও ডারউইনের তত্ত্বকে কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিক এঙ্গেলস গ্রহণ ও প্রয়োগ করেছেন তাঁদের রাজনৈতিক অনুশীলনের পথে। সাধারণ মানুষের সঙ্গে ডারউইন ও ডারউইনের তত্ত্বকে প্রত্যক্ষ বিজ্ঞানচর্চা যতটুকু না পরিচিত করিয়েছে, মার্কসবাদী-লেনিনবাদীরা করিয়েছেন তারও ঢের গুণ বেশি। আর বুর্জোয়ারা রাজনৈতিকভাবে ম্যালথাসের তত্ত্বকে গ্রহণ ও প্রচার করলেও ডারউইনকে কখনো সরবতার সঙ্গে, কখনো আবার নীরবতার মধ্যে দিয়ে প্রত্যাখ্যান করেছেন। ডারউইনের তত্ত্ববিরোধী অযৌক্তিক প্রচারণা সবচেয়ে বেশি সংঘবদ্ধ রূপ পেয়েছে সাম্রাজ্যবাদী যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচনতত্ত্বের প্রতিপক্ষ হিসেবে ইনটেলিজেণ্ট ডিজাইন তত্ত্বটিকে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে। রিপাবলিকান ও জর্জ বুশরা এই প্রচেষ্টার রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষক। কিন্তু রাজনৈতিক উদ্যোগে বিজ্ঞানশিক্ষায় বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেও ডারউইনের তত্ত্বকে ঠেকিয়ে রাখা যায়নি। অপরিহার্য এই তত্ত্বকে ভিত্তি ধরে বরং সম্ভব হয়েছে বিজ্ঞানের অনেক গুরুত্বপূর্ণ রহস্যের মীমাংসা করা, নতুন নতুন তথ্য ও বিষয় উন্মোচন করা। কী ন্যাশনাল মিউজিয়াম কী ব্রিটিশ লাইব্রেরি দুস্থানের প্রদর্শনীতেই দেখানো হয়েছে উত্তর প্রজন্মের গবেষক ও বিজ্ঞানীদের গবেষণা ও উদ্ভাবনে এই অর্জনের সুদূরপ্রসারী প্রভাব। তাতে দেখা যাচ্ছে আধুনিক পথিকৃৎ সব বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার সম্ভব হয়েছে কেবল ডারউইনের তত্ত্বকে স্বীকৃতি দিয়ে এগুনোর ফলেই। যেমন, বহুল আলোচিত ডিএনএ গবেষণায় মুখ্য ভূমিকা রেখেছে ডারউইনের এ-অর্জন। ডারউইনের অনুসারী ক্রিক এবং ওয়াটসন বিবর্তনতত্ত্ব থেকে সমপ্রসারিত অনুমিত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে উৎসাহিত হন বিশেষ এই বৈজ্ঞানিক গবেষণাকর্মে,-যার ফলে ১৯৫৩ সালে আবিষ্কৃত হয় ডিএনএ।
এই আবিষ্কার এবং এর সূত্র ধরে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নতুন নতুন আবিষ্কার মানুষের দর্শন ও নৈতিকতাকে পালটে দিতে চলেছে। ডারউইনের দ্বিশততম জন্মবার্ষিকীতে বিশেষ করে ইউরোপে নিরীশ্বরবাদীরা বেশ আটঘাট বেঁধেই নিরীশ্বরবাদী প্রচারণায় নেমেছে, দেখা যাচ্ছে। গত কয়েক মাস ধরে লণ্ডন শহরে মাঝেমধ্যেই এমন কোনো দোতলা বাসে চোখ আটকে যাচ্ছে, যেটার গায়ে জ্বলজ্বল করছে অবিশ্বাস্য একটি বিজ্ঞাপন। এ-বিজ্ঞাপনের ভাষা এমন : দেয়ার’স প্রোবাবলি নো গড/ নাউ স্টপ ওরিং অ্যাণ্ড এনজয় ইওর লাইফ।’ এভাবে অনেক বছর পর আবারও সরবে নিজেদের উপস্থিতি ঘোষণা করছেন নিরীশ্বরবাদীরা। বিজ্ঞান ও যুক্তি দিয়ে প্রকাশ্যে ব্যাখ্যা করছেন নিজেদের দর্শনগত অবস্থান। গত শীতের,-যেমনটি বলছেন লণ্ডনের বার্কবেক কলেজের দর্শনের অধ্যাপক এ সি গ্রেইলিংগ্,-অন্যরকম এক উজ্জ্বলতম অর্জন হল ন্যাশনাল ফেডারেশন অভ অ্যাথেইস্ট, হিউম্যানিস্ট অ্যাণ্ড সেক্যুলার সোসাইটিস-এর উদ্বোধন। এ-সংগঠনের উদ্যোক্তাদের তিনি মনে করেন আগামী দিনের নেতা। গ্রেইলিংগ্-এর সুপ্ত আশা, এঁরাই গড়ে তুলবেন আগামীর কুসংস্কারমুক্ত যৌক্তিক ও নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি। ব্রিটেনের অন্যতম দৈনিক ইনডিপেনডেণ্ট-এর ২০ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ সংখ্যায় তিনি লিখেছেন,
বিশ্বাস,-যা শেষ পর্যন্ত যুক্তিরই বিপরীত, এবং ডগমা পথচ্যুত করতে পারবে না জনবিতর্ককে সেক্টারিয়ান প্রিজুডিস-এর সংকীর্ণ স্বার্থে, বরং জননীতি থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত সুখী জীবন গঠন অবধি সবকিছুই হবে মুক্ত এবং খোলা মনের কাজ, এমন এক পৃথিবীর অঙ্গীকার করছে এ-সংগঠন।
এমন এক ফেডারেশনের আত্মপ্রকাশ জানাচ্ছে, মানুষের মুক্তি ও বাক্স্বাধীনতার অন্তর্র্নিহিত তাগিদ থেকে ক্রমবিকশিত সেক্যুলারিজমের সপক্ষে গড়ে ওঠা জনমত নতুন এক মোড় নিতে চলেছে। আর এই জনমত বিকাশের সূত্রপাত বছর তিনেক আগে, যখন ব্রিটেনের বাজারে আসে রিচার্ড ডকিনস-এর বই ‘দ্য গড ডিলুশান’। তারও আগে, ২০০৩ সালে, রিচার্ড ডকিনস এবং স্টিভেন পিংকার মিলে উদ্যোগ নেন ধর্মের বিকল্প এক সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার। ষাট আর সত্তরের দশকেও ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে খুব শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল বিভিন্ন নাস্তিক গোষ্ঠী। একইসঙ্গে সেগুলি সামন্তবাদী চিন্তাচেতনা ও সংস্কৃতিকে খণ্ডন করার মধ্যে দিয়ে পরিপূরক হয়ে উঠেছিল কোথাও ব্যক্তি ও বাক্স্বাধীনতার, কোথাও জাতীয় মুক্তি ও সমাজ-বদলের রাজনীতির। বিশ্ববিদ্যালয়গুলির কাছ থেকে যেমনটি প্রত্যাশা করা হয়,-সেখানে মুক্তচিন্তার চর্চা হবে, জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা হবে,-ঠিক তেমনটিই ঘটেছিল বিশেষত ষাট দশক জুড়ে। ‘আমরা এখন যিশুখ্রিস্টের চেয়েও জনপ্রিয়। আমি জানি না রক অ্যাণ্ড রোল না যিশু কে আগে বিদায় নেবে; কিন্তু বিদায় তাঁদের নিতেই হবে’-ষাটের দশকে জন লেননের উচ্চারিত এমন কথাগুলি থেকেই বোঝা সম্ভব, মুক্তচিন্তা ও বাক্স্বাধীনতার চর্চা তখন কী তুঙ্গে পৌঁছেছিল। কিন্তু বিজয়ের আনন্দে শিথিল হতে হতে একসময় মিইয়ে পড়ে মুক্তচিন্তার সে-আন্দোলন। রিচার্ড ডকিনস-এর এই বইয়ের প্রকাশ, আর তার ঠিক কয়েক বছরের মধ্যেই লণ্ডনসহ ইউরোপের বিভিন্ন জনবহুল শহরে বাসের গায়ে লেখা প্রচার-স্লোগান হয়ে উঠেছে কৌতূহলজনক ব্যাপার। এই সেক্যুলারিস্টরা মনে করছেন, পাশ্চাত্যের কথিত সভ্যতার সংঘাত আর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ধর্মজ রাজনীতি মানুষের জীবনকে অনিশ্চিত ও অস্থির করে তুলেছে, তাই সময় এসেছে নতুন এক ধর্মের-‘আ লাইভ-অ্যাণ্ড-লেট-লাইভ’ ব্র্যাণ্ড-এর হালকা নিরীশ্বরবাদিতা ছড়িয়ে দেয়ার।
নাস্তিকদের এ ফেডারেশনটির নতুন সভাপতি মাত্র ২৪ বছরের ছাত্র নর্মান রালফ। ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ ফেডারেশন উদ্বোধনের দিন তিনি ব্যাখ্যা করছিলেন, কেন ব্রিটেনে এখন সেক্যুলারদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। তিনি বলছিলেন, ব্রিটেনের সেক্যুলার ঐতিহ্য এখন কীভাবে খোলাখুলি চ্যালেঞ্জের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে এবং এত কিছুর পরও তা কীভাবে ক্রমশই তরঙ্গিত হচ্ছে গোটা ব্রিটেনে। রালফের মতে,
আমাদের দরকার ওই তরঙ্গে চড়ে বসা। ৯/১১-র পর জনগণের দিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়া হয়েছে, যে-কোনো একটি পক্ষ বেছে নেয়ার। এই মুহূর্তে এখানে এমন এক চাপ রয়েছে যে মনে হয়, রাজনৈতিকভাবে এই ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিটির স্বীকৃতি মিলেছে যে যাঁদের কোনো ধর্ম নেই, তাঁরা প্রকৃতপক্ষে অধিকারহীন।
বাসের গায়ের ওই বিজ্ঞাপনের জনপ্রিয়তাই বলছে, রালফের কথা নেহাত ফেলনা নয়, সেক্যুলাররা এখানে চাইছেন সংঘবদ্ধভাবে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে। এ-বিজ্ঞাপনের টানে রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে উপেক্ষিত লণ্ডনবাসী নিরীশ্বরবাদীরা নড়েচড়ে উঠেছেন। অথচ এই বিজ্ঞাপন-পরিকল্পনা করা হয়েছিল অনেকটা সাদামাটাভাবেই। তরুণী এক কমেডিয়ান নাস্তিক অ্যারিয়েন শেরিন খানিকটা চটুলতা নিয়েই প্রস্তাব করেছিলেন, প্রচারণাকৌশল হিসেবে বাসের গায়ে বিজ্ঞাপন দেয়ার জন্যে নাস্তিকরা সবাই পাঁচ পাউণ্ড করে চাঁদা দিক। তাঁর যুক্তি ছিল, বাসের গায়ের এই বিজ্ঞাপন বাইবেলের গতানুগতিক বাণীর বদলে একটি হালকা সেক্যুলার বার্তা ছড়িয়ে দেবে সবার কাছে এবং তা আলোচনার বিষয় হয়ে উঠবে। ফলে ঈশ্বর আছে কি নেই তা নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় মুক্ত বিতর্কের সূত্রপাত ঘটবে। সবাই ভেবেছিলেন, তেমন কোনো সাড়া পাওয়া যাবে না; কিন্তু দেখা গেল তরুণী শেরিনের কাছে এ-প্রস্তাবের সমর্থনে চিঠির পর চিঠি আসছে। সঙ্গে অনুদানও আসছে এবং এত অনুদান যে তাতে তিনি গা ভাসিয়ে দিতে পারবেন। শেরিনের লক্ষ্য ছিল, সারা লণ্ডন শহরে চার সপ্তাহ জুড়ে ৩০টি বাসবিজ্ঞাপন দেয়ার জন্যে প্রয়োজনীয় পাঁচ হাজার পাঁচশো পাউণ্ড তোলা। কিন্তু মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তাঁর কাছে এসে জমা হলো ১৫০ হাজার পাউণ্ডেরও বেশি চাঁদা। আর এই অভাবনীয় অনুদানের জোরে সেই জানুয়ারি মাস থেকে ৮০০র বেশি বাস লণ্ডন শহরটায় ঘুরপাক খাচ্ছে, যেসব বাসের গায়ে লেখা রয়েছে ‘দেয়ার’স প্রোবাবলি নো গড।’ কিছুদিনের মধ্যেই এ-বিজ্ঞাপন প্রচার করা হবে এক হাজারেরও বেশি টিউবসিস্টেমে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র আর স্পেনের নাসি-করাও বেছে নিয়েছেন এই বিজ্ঞাপন প্রচারপদ্ধতি।
নাস্তিকদের এ-ফেডারেশনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন স্বয়ং ডকিনস। বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে যাঁরা নিরীশ্বরাদী সমাজ গঠন করতে চান, তাঁদের সর্বতোভাবে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন ওইদিন,
বিশ্ববিদ্যালয় হল এমন এক জায়গা যেখানে মানুষ চিন্তা করে, যেখানে মানুষ প্রমাণিত সত্যেরও মূল্যায়ন করে।
তিনি বলেছেন,
জনসমক্ষে অবিশ্বাসের কথা প্রকাশ করলে তা ধার্মিকতার প্রতি অবমাননাকর ও হুমকিস্বরূপ মনে করা হয়। অথচ এর বিপরীত অবস্থাও যে সত্য হতে পারে, তা কখনো মনে করা হয় না।
সরকার, সংস্কৃতি ও মিডিয়া ধর্মকে যে-পরিমাণ গুরুত্ব দিয়ে ধর্মকে উপস্থাপন করে, তাতে ডকিনস উদ্বিগ্ন। আবারও দাবি তুলেছেন তিনি, ধর্মসংশ্লিষ্ট নৈতিক বিবেচনায় কোনো মতকেই সমালোচনার ঊর্ধ্বে রাখা যাবে না।
অক্সফোর্ডের সেইণ্ট হিলডা থেকে গ্র্যাজুয়েট-করা ছাত্রী ক্লোয়ে ক্লিফর্ড-ফার্থের মন্তব্যও মনে রাখার মতো। সে বলছিল,
এমন এক পৃথিবীতে আমরা আছি, যেখানে ধর্মবাদী সরকারও ব্যাভিচারিতা আর সমকামিতায় সায় দিচ্ছে। অথচ নারী আর সংখ্যালঘিষ্ঠ গোষ্ঠীগুলির মৌলিক স্বাধীনতাকে অস্বীকার করছে, জন্মনিরোধক ও বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা সম্পর্কে প্রতারণামূলক প্রচারণা চালাচ্ছে। তারা এমন সব আইন প্রণয়ন করছে যা তাদের সমালোচনার হাত থেকে বাঁচাবে।
মনে রাখার মতো আর-একটি কথাও বলেছে ফার্থ,
এরকম পৃথিবীতে এমন এক দেশে (ব্রিটেন) আমরা বাস করার সুযোগ পেয়েছি যেখানে এইসব নিয়ে বিতর্ক করতে পারি। আর তাই, আমাদের দায়িত্ব এ-বিষয়টি (নাস্তিকতা) বিশ্ববিদ্যালয় ও এর চারপাশে নিয়ে আসা, ছড়িয়ে দেয়া।
ফার্থদের জন্যে একটি সুখবর হল, নিউজিল্যাণ্ডের শতকরা ৪০ শতাংশ মানুষই ধর্মহীন। আর যাঁরা ধর্ম ও ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন, তাঁদেরও প্রায় অর্ধেকের মনে ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে খানিকটা সন্দেহ আছে। সতেরো বছর আগে এদেশটিতে ধর্মহীন মানুষের সংখ্যা ছিল ২৯ শতাংশ। ধর্মহীন মানুষের সংখ্যা সেখানে ক্রমাগত বাড়ছে, যদিও ধর্মপ্রবণ যে-কোনো রাষ্ট্রের তুলনায় এ-রাষ্ট্রটি পুরোপুরি স্থিতিশীল, আর মানুষগুলোও সাদাসিধা ও খোলামেলা।
ছয়
একটি ধারণায় পৌঁছানোর জন্যে একজন মানুষকে কি নীরব রক্তক্ষরণের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যেতে হয়! আর সেই ক্ষরণ কি তীব্র থেকে তীব্রতর হয় না, যখন তাঁর নিজের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে-থাকা প্রতিষ্ঠিত ধারণাগুলিই ভেঙে পড়তে থাকে নিজের সব আবিষ্কারের ফলে? কেবল প্রতিষ্ঠিত ধারণাই কি ভেঙে পড়ে তাতে? ভেঙে পড়ে নিজের সামাজিক সব বন্ধন, আত্মিক সব বন্ধন, প্রশ্নবিদ্ধ হয় প্রেমের মধুরতম বন্ধন, চারপাশ থেকে ধেয়ে আসে বিদ্রূপ ও হিংসা।
ন্যাশনাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের ডারউইন প্রদর্শন-পরিকল্পনায় এই নীরব রক্তক্ষরণ দেখি। ডারউইন, এমা, ইটি, অ্যানি, কিংবা স্যাণ্ডওয়াকে ডারউইনের নিত্যসঙ্গী কুকুর পলি এদের সবাই এখন হারিয়ে গেছে। কিন্তু রয়ে গেছে ওই নীরব রক্তক্ষরণ। এবং এখনও যাঁরা সত্যের ওই পথ খুঁজতে বেরুবেন, তাঁদের যেতে হবে ডারউইন ও এমাদের মতোই এক নীরব রক্তক্ষরণের মধ্যে দিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রে যে-বিজ্ঞানীরা, যে-শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা ইনটেলিজেণ্ট ডিজাইনের বিরুদ্ধে শিক্ষা আন্দোলন করছেন, বাংলাদেশসহ বিশ্বের দেশে-দেশে যাঁরা তাঁদের পাঠ্যসূচিতে প্রাকৃতিক নির্বাচনতত্ত্ব সংযুক্ত করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন ঘরে-বাইরে সবখানে তাঁরা এই নীরব রক্তক্ষরণের শিকার।
সেই রক্তক্ষরণের স্মৃতি নিয়ে আমি বাইরে আসি। পর্যটক-দর্শনার্থীদের কাউকে অনুরোধ করায় তাঁরা সানন্দে আমার ছবি তোলে ডারউইনের ভাস্কর্যের পাশে, বিশাল ডাইনোসরের পাশে। হঠাৎ আমার মনে পড়ে, ডারউইনের গ্রেট গ্রেট গ্রাণ্ডডটার শিল্পী সারাহ্ ডারউইন এ-জাদুঘরেই কাজ করেন এখন। ১৯৯৫ সালে ৩২ বছর বয়সে সারাহ্ তাঁর পূর্বসূরি ডারউইনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে গ্যালাপাগোসে যান দ্বীপটির বিভিন্ন গাছগাছালির ছবি আঁকতে। তার পর সেখান থেকে ফিরে এসে তিনি দ্বীপটির ২০টি বিলুপ্তির মুখে দাঁড়ানো গাছ সংরক্ষণের আন্দোলন গড়ে তোলেন। এইভাবে এক তরুণী শিল্পী রূপান্তরিত হন প্রকৃতিবিদে। গ্যালাপাগোস টমাটোর একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে সারাহ্ এখন এ-জাদুঘরে কাজ করছেন। আমি তাঁর খোঁজ করতে থাকি।
প্রদর্শনী
ডারউইন : বিগ আইডিয়া, বিগ এক্সিবিশান, ১৪ নভেম্বর ২০০৮-১৯ এপ্রিল ২০০৯, ন্যাশনাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম, লন্ডন।
ডারউইন অ্যান্ড দ্য স্টোরি অব ইভোল্যুশান, ১০ ডিসেম্বর ২০০৮-২২ মার্চ ২০০৯, ব্রিটিশ লাইব্রেরি, লন্ডন।
ব্যবহৃত ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত।
(সমাপ্ত)
Have your say
You must be logged in to post a comment.
১১ comments
মুয়িন পার্ভেজ - ১৮ ডিসেম্বর ২০০৯ (১২:৪৮ অপরাহ্ণ)
প্রত্যাশিত দ্বিতীয় বা শেষ পর্বটি অল্প সময়ের মধ্যে উপহার দেওয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ। লেখার উপসংহারে উল্লেখিত ডারউইনের উত্তরসূরি শিল্পী সারাহ ডারউইন সম্পর্কে আরও জানার আগ্রহ বোধ করছি। তাঁর আঁকা গ্যালাপাগোস দ্বীপের ছবিগুলো কি পাওয়া যায়?
ইমতিয়ার - ২৪ ডিসেম্বর ২০০৯ (৭:৫১ পূর্বাহ্ণ)
না ভাই, সারাহ ডারউইনের আঁকা ছবিগুলির সন্ধান এই মুহূর্তে দিতে পারছি না। আর তার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎও ঘটেনি শেষ পর্যন্ত। মিউজিয়ামের পাশাপাশি ইউনিভার্সিটি কলেজ, লন্ডনে আছেন তিনি; গত সেপ্টেম্বর থেকে বিগলস যাত্রায় বেরিয়েছেন। টুইটারে পাওয়া যায় তাকে, কিন্তু অনিয়মিতই মনে হয়। পেশাগতভাবে পুরোদস্তর বোটানিস্ট, পাশাপাশি শিল্পী। খুবই ব্যস্ত মানুষ (ব্যস্ত অবশ্য আমরাও, তবে এই ব্যস্ততার সঙ্গে তো ওই ব্যস্ততার তুলনা হয় না)।
সঙ্গতকারণেই বিগলস যাত্রা শেষ হতে সময় লাগবে তার। হয়তো তারপর আমরা বিশেষ কিছু পাব তার কাছ থেকে। নতুন কিছু জানতে পারলে এবং কোনও ছবি বা বইয়ের সন্ধান পেলে জানানোর আশা রাখি।
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর - ১৮ ডিসেম্বর ২০০৯ (৩:০২ অপরাহ্ণ)
এটি পাঠ করার পরই রবি ঠাকুরের কাব্যকথা মনে পড়ছে, শেষ হয়েও হইল না শেষ। মনে হচ্ছে, বিবর্তন-ইতিহাসে নিমজ্জিত হয়ে আছি। ইমতিয়ার শামীমকে অফুরন্ত ভালোবাসা।
সৈকত আচার্য - ১৮ ডিসেম্বর ২০০৯ (৫:১৪ অপরাহ্ণ)
ইমতিয়ার শামীমের অসাধারন বর্ননার গুনে, দু’টো পর্বই এক নিশ্বাসে পড়ে নিলাম। বিজ্ঞানী ডারউইনের ব্যক্তি জীবনের ছোট ছোট দুঃখ-বেদনা ও আনন্দের কথা এবং নানা বিষয়ে তাঁর উপলদ্ধির কথা নিপুন দক্ষতার সাথে ইমতিয়ার তুলে এনেছেন। মাঝে মধ্যে একটু আধটু ডারউইনের জীবন কথা পড়লেও, এরকম সমন্বিতভাবে তাঁকে দেখতে পারিনি কখনো। নতুন ভাবে ডারউইনকে জানা হলো। ইমতিয়ার শামীমের প্রতি অনেক ভালোবাসা।
রশীদ আমিন - ২০ ডিসেম্বর ২০০৯ (২:০৬ অপরাহ্ণ)
উন্নত দেশ গুলো বিস্তর কার্বন নিঃসরন করে যখন গরিব দেশগুলোকে এক দুঃস্বপ্নের দিকে ঠেলে দিয়েছে , তখন একমাত্র ব্যতিক্রম ইমতিয়ার শামীম , তিনি খোদ বিলাতে বসে আমাদের জন্য জ্ঞান নিঃসরন করছেন । আমরা আলো্কিত হচ্ছি ।
ধন্যবাদ শামীম ভাই আপনার লেখা পড়ে যারপর নাই আনন্দ পেলাম ।
ইমতিয়ার - ২৪ ডিসেম্বর ২০০৯ (৮:১৬ পূর্বাহ্ণ)
২. # ধন্যবাদ্ ও কৃতজ্ঞতা জাহাঙ্গীর ভাই।
কিন্তু বিবর্তন-ইতিহাসে নিমজ্জিত হয়ে থাকলে কি চলবে? ব্রিটেনে ছাপানো পাউন্ডে হয় রানী না হয় ডারউইনের ছবি শোভা পায়। আমাদের দেশে রাষ্ট্রের স্থপতির ছবি শোভা পাক আপত্তি নেই, কিন্তু আরজ আলীর মতো মানুষের ছবি যাতে শোভা পায়, আদৌ সে ব্যবস্থা করতে কি আমরা পারব কেবলই নিমজ্জিত হয়ে থাকলে?
২. # সৈকত আচার্য
আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ। প্রসঙ্গত আমিও কৃতজ্ঞতা জানাই এঙ্গেলস, দেবীপ্রসাদ ও দ্বিজেন শর্মাকে,- যাদের লেখা পড়তে গিয়ে আমি ডারউইন নামের মানুষটির সন্ধান পেয়েছি এবং তারপর থেকে তাকে ক্রমাগত জানছি।
৩. # রশীদ আমিন
আমিন ভাই, ‘বাকী চাহিয়া লজ্জা দিবেন না।’ আলো এবং ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণের জন্যে অনেক বড় বড় মহাজন রয়েছেন। তাই আমরা ‘যতবার আলো জ্বালাতে চাই/ নিবে যায় বারে বারে’। আপনার চেয়ে আর কে ভালো জানে বলুন, ডারউইনের আসন আমাদের হৃদয়ের গভীর অন্ধকারে…
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর - ২৪ ডিসেম্বর ২০০৯ (২:৩১ অপরাহ্ণ)
হাহাহা, ধন্যবাদ প্রিয় ইমতিয়ার শামীম। আসলে আমি আমার ভালোবাসাকে সর্বোত্তম ফিলিংসই বুঝাতে চাইলাম। আমি যে ব্যক্তিগতভাবে বিজ্ঞানের ব্যাপারে মোটেই নিমজ্জিত নই, তা আমার কাছাকাছি অবস্থান করা মানুষজন ভালোই জানেন। আপনার পোস্টটিই বেশ কজনকে পড়তে বলেছি। আমার বড়োভাই খালেকুজ্জামান মতিনকে ইমেইল করে পাঠিয়েছি। ফেসবুকে তা পড়তে আহ্বান জানিয়েছি।
যাই হোক, আপনাকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা।
মোহাম্মদ মুনিম - ২২ ডিসেম্বর ২০০৯ (৬:০৭ পূর্বাহ্ণ)
ইমতিয়ার ভাইকে অনেক ধন্যবাদ এই পরিশ্রমসাধ্য পোস্টটি লেখার জন্য। বুয়েটে ছাত্রফ্রন্টের পক্ষ থেকে আমরা বারটোল্ড ব্রেশটের লেখা গ্যালিলিও নাটকটি মঞ্চস্থ করেছিলাম। সে নাটকের রিহার্সালের সময় ব্যক্তি গ্যালিলিওর জীবনের অনেক কিছু জানার সুযোগ হয়েছিল। নীরব রক্তক্ষরন গ্যালিলিওর জীবনেও ছিল, তাঁর কন্যার বিয়ে ভেঙ্গে গিয়েছিল তাঁর ঈশ্বরবিরোধী অবস্থানের কারণে। খানিকটা আপোষ করে কারাদন্ড আর সম্ভাব্য প্রাণদন্ডের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন, সে নিয়ে নিদারুণ লজ্জা ছিল। গ্যালিলিও বেঁচে গেলেও ব্রুনো বাঁচেন নি, জীবন দিয়েছেন সাত বছরের সুকঠিন কারাবাসের পরে।
ছোটবেলায় ‘উভচর মানুষ’ নামে একটা অতি চমৎকার রুশ উপন্যাস পড়েছিলাম, ডঃ সালভাতোর নামে এক খেয়ালী বিজ্ঞানী এক আদিবাসি শিশুকে বাঁচানোর জন্য তাকে শরীরে ফুলকা সংযোজন করেন, এর ফলে শিশুটি উভচর মানুষ হিসাবে বেড়ে উঠে। ডঃ সালভাতোর এ জাতীয় আরো পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন, তাঁকে শেষমেষ আদালতে নেয়া হয় এবং ঈশ্বরের সৃষ্টি মানুষের শরীরের উপর পরীক্ষা নিরীক্ষা করার অপরাধে তাঁর পরীক্ষাগার বন্ধ করে দেয়া হয়। ডঃ সালভাতোর তাঁর জবানবন্দিতে বলেন তাঁর সাথে কাঠগড়ায় আরো একজন আছেন, তিনি হলেন স্বয়ং ডারউইন। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে স্টেম সেল গবেষনার ব্যাপারেও ডারউইনকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়। ক্রিয়েশনিশম বিদ্যালয়ে পড়ানোর বিতর্কে আরো একবার। তাঁর মৃত্যুর শত বছর পরেও তিনি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক, সেটা কেবল বিবর্তনবাদের তত্ত্বের জন্যের নয়, বিজ্ঞানের সাথে, যুক্তির সাথে, ধর্মীয় গোঁড়ামির চিরকালের লড়াই, সে লড়াই আগামিতেও থাকবে, যতদিন থাকবে, ততদিন ডারউইনও থাকবেন।
খালেকুজ্জামান মতিন - ২৩ ডিসেম্বর ২০০৯ (২:৫০ পূর্বাহ্ণ)
ইমতিয়ার শামীমের লেখাটি অসাধারণ। আমরা যারা ডারউনের জীবনী এবং কাজের সাথে কম বেশী পরিচিত তারও জীবনের ঘ্রানযুক্ত এ লেখাটি বেশ উপভোগ করেছি। পশ্চিমা দুনিয়ায় মনে হয় মার্কিন যুক্তরাস্ট্রেই ডারউইন সবচেয়ে অবহেলিত। এখানে রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব এতোটাই প্রকট যে, এদেশে তথাকথিত প্রগতিশীলদেরও ডারউনের মতবাদের সমর্থনে সরাসরি অবস্থান নিতে দেখা যায়না। জীব বিজ্ঞানের ভিত্তিই যেখানে বিবর্তনবাদ, সেখানে জীব বিজ্ঞানের অনেক অধ্যাপকদেরও দেখেছি ধর্মীয় রক্ষণশীলদের মন যুগিয়ে আপষের মনোভাব নিয়ে সরাসরি আলোচনা এড়িয়ে যেতে। আমি এ পর্যন্ত অনেক সেমিনারে গিয়েও খুব বেশী সাহসী নিরীশ্বরবাদী দেখা এখানে পাইনি। সবাই অনেকটা স্ব্রণালী মাঝপথে চলতেই বেশী স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। সেই দিক থেকে বাংলাদেশের প্রগতিশীলরা অনেক বেশী স্পষ্টবাদী এবং স্পষ্টভাষী। মুক্তাঙ্গনে এমন আরও সাহসী লেখা পড়তে চাই। সবাইকে শুভেচ্ছা।
ফাহমিদা হক - ৪ জানুয়ারি ২০১০ (১০:৩৫ অপরাহ্ণ)
ইমতিয়ার শামীম ভাই,
কয়েকদিন আগে মম্তব্যটি পাঠিয়েছিলাম। মনে হলো সেটা ঠিকমত পাঠানো হয়নি তাই আবারো লিখলাম। আপনার লেখাটি পড়ে বিষন্ন সময়ে ভাল লাগলো। যে কোন বৈজ্ঞানিক সত্য ধর্মের বিপরীতে ঐশ্বরিকতার বিপরীতে যে যুক্তিবোধের উন্মেষ ঘটায় তা প্রকাশের প্রতিকুল পরিবেশ যে রক্তক্ষরণের যন্ত্রণা বয়ে বেড়ায় তা প্রতিনিয়ত উপলদ্ধি করি কিন্তু তা এমন করে প্রকাশ করতে পারি না। আপনার সাহসী প্রয়াস, সত্য উচ্চারণ (কলমের কণ্ঠে) প্রেরণা যোগালো উদ্দীপিত হতে।
ফাহমিদা
রেজাউল করিম সুমন - ১৮ জানুয়ারি ২০১২ (১২:০৩ পূর্বাহ্ণ)
দেড় শতাধিক বছর পর খুঁজে পাওয়া গেছে ডারউইন ও তাঁর ঘনিষ্ঠজনদের সংগৃহীত ফসিল!
খবরের লিংক : দ্য টেলিগ্রাফ, ইয়াহু নিউজ