ব্রায়ান মুর একটি উপন্যাস লিখেছিলেন ‘দ্য স্টেটমেন্ট’ নামে; যুদ্ধাপরাধী পল ট্রভিয়েরের জীবন ছিল তাঁর সে কাহিনীর ভিত্তি। পরে মুরের ওই পাণ্ডুলিপিকেই নতুন এক রূপ দেন রোমান পোলানস্কির হলোকাস্টভিত্তিক চলচ্চিত্র দ্য পিয়ানিস্ট-এর চিত্রনাট্য লেখক রোনাল্ড হারউড। আর রোনালেন্ডর ওই চিত্রনাট্য নিয়ে পরিচালক নরমান জুইসন নির্মাণ করেন ২০০৩ সালে চলচ্চিত্র ‘দ্য স্টেটমেন্ট’। পল ট্রভিয়ের এখানে যুদ্ধাপরাধী পিয়ের ব্রোসার্ড। ১৯৪০ সালে জার্মান বাহিনী ফ্রান্সের ভিসি শহর দখল করে নেয়ার পর ১৯৪৩ সালে তাদের সহায়তা করার জন্যে ভিসি সরকার মিলিচ নামে একটি আধা-সামরিক বাহিনী গড়ে তোলে; যাদের কাজ ছিল নাজী দখলদারদের বিভিন্ন হুকুম তালিম করা, নানাভাবে সহায়তা করা। পিয়ের ব্রোসার্ড ছিলেন সেই মিলিচ নামের আধা-সামরিক বাহিনীর একজন। তরুণকালের ব্রোসার্ডকে দিয়েই শুরু হয়েছে এ চলচ্চিত্র; দেখি আমরা ১৯৪৪ সালের ফ্রান্সের ডোমবে,- মানুষজনকে রাতের অন্ধকারে ঘর থেকে তুলে আনার কাজে সেখানে নেতাগিরি করছে ব্রোসার্ড, গণহত্যার জন্যে তাদের দাঁড় করাচ্ছে সারিবদ্ধভাবে এবং আদেশ দিচ্ছে ‘ফায়ার’।
এরপরই আমরা দেখি ১৯৯২ সালের ব্রোসার্ডকে। তাঁর বয়স এখন প্রায় ৭০। তাঁর জীবনের একমাত্র সাধনা এখন নিজের অতীতকে লুকিয়ে রাখা। স্যালন ডি প্রোভিন্স-এর একটি মঠে বসবাস করে সে। সংগোপনে বসবাসকারী ব্রোসার্ডের খোরাকী জোগায় ক্যাথলিক চার্চের বন্ধুচক্র, অপরিসীম সহানুভূতি যাদের ব্রোসার্ডের মতো যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি। এইভাবে বেশ ভালোভাবেই বেঁচে থাকে ব্রোসার্ড। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হতেই মার্শাল পিটেইনের নেতৃত্বে গঠিত আধা-সামরিক বাহিনীতে কর্মরত এরকম সব যুদ্ধাপরাধী ফ্রান্স থেকে ভাগতে থাকেন, কেউ কেউ আবার আদালত থেকেও ব্রোসার্ডের মতো পার পেয়ে যান। কেননা রাষ্ট্রকাঠামো ও চার্চের মধ্যে স্থান করে নেয়া সমমনা রাজনৈতিক ও নীতিনির্ধারক ব্যক্তিরা সহায়তা করেন তাদের। ব্রোসার্ডের ক্ষেত্রেও দেখি, অপরাধ করার পরও তাঁর কোনও সাজা হয় না, চার্চের সহায়তায় রাষ্ট্রপতির বিশেষ ক্ষমা পেয়েই আত্মগোপনে চলে যায়, এক মঠ থেকে অন্য মঠে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে ধর্মচর্চায় মন দেয় সে। ধর্মকর্ম করে, অতীত লুকিয়ে রাখে, আর বৃদ্ধ হতে থাকে। অবশ্য যত বৃদ্ধই হোক না কেন, কর্মক্ষমই থাকে ব্রোসার্ড। নিজের গাড়ি নিজে চালায়, দৈনিক গাল কামায় এবং প্রার্থনাও করতে পারে কোনও কষ্ট ছাড়াই। কিন্তু তারপরও বৃদ্ধ সে। মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করা ছাড়া এখন আর কিছুই করার নেই পিয়ের ব্রোসার্ডের।
কিন্তু এরকম এক সময়ে হঠাৎ করেই পাল্টে যায় পিয়ের ব্রোসার্ডের পৃথিবী। মন্টানা বারে প্রতিবারের মতো ১৯৯২-এর এপ্রিলে খোরাকীর টাকাভর্তি খামটি আনার জন্যে গিয়ে একটি বিয়ার নিয়ে চেয়ারে বসে ব্রোসার্ড। তারপর অনুভব করে বিপদের গন্ধ। দ্রুত বেরিয়ে আসেন সে সেখান থেকে খোরাকীর টাকাভর্তি খামটি নিয়ে, গাড়ি চালিয়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা করে তার নিরাপদ ডেরাতে। কিন্তু সেটি সম্ভব নয় বুঝতে পেরে থেমে পড়ে, গাড়ি নষ্ট হয়ে যাওয়া অসহায় যাত্রীর ভান করে দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর পেছনের গাড়িতে থাকা অনুসরণকারীকে হত্যা করে। অনুসরণকারীর কাগজপত্রের মধ্যে সে খুঁজে পায় একটি কাগজ, ‘দ্য স্টেটমেন্ট’ ছাপমারা সেই কাগজে লেখা আছে ‘জাস্টিস ফর দ্য জিউস অব ডোমবে।’
অতীতকে লুকিয়ে রাখার ব্যর্থতা আতঙ্কিত করে তোলে যুদ্ধাপরাধী ব্রোসার্ডকে। এইভাবে দ্যা স্টেটমেন্ট-এর কাহিনীতে থ্রিলারের ছাপ পড়ে, কিন্তু মূল বার্তাটি কিছুতেই নষ্ট হয় না তাতে। আতংকিত ও অরক্ষিত ব্রোসার্ড একদিকে মৃত্যু অন্যদিকে আইনের হাত থেকে বাঁচার জন্যে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পালিয়ে বেড়ায়। কিছুতেই বুঝতে পারে না, এতদিন পরে কেন তার ভাগ্যবিপর্যয় ঘটল।
এদিকে এ ঘটনা ঘটার আগেই মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ আইনের সূত্র ধরে প্যারিসের প্যালেস ডি জাস্টিস-এ আইনের ফাঁক গলে বেঁচে যাওয়া যুদ্ধাপরাধী ব্রোসার্ডের বিচার করার প্রত্যাশায় নতুন তদন- শুরু করেছিলেন বিচারক অ্যানিম্যারি লেভি। পুলিশের তদন্তে যেহেতু ফাঁক ছিল, চার্চ যেহেতু ব্রোসার্ডের সাধারণ ক্ষমার জন্যে ওকালতি করেছিলেন, রাষ্ট্রপতিও যেহেতু ব্রোসার্ডকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন, সেহেতু লেভি অনুমান করেন, এইসব ক্ষেত্রগুলি থেকে তেমন কোনও সাহায্য পাওয়া যাবে না। তাঁর এ-ও মনে হয়, চার্চের এ ধরণের ভূমিকার পেছনে হয়তো অন্য কোনও সংঘবদ্ধ শক্তি রয়েছে এবং জিউস কমান্ডোর ছাপ লাগিয়ে অন্য কেউ চাইছে ব্রোসার্ডকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে। তদন্ত করবেন কি, নতুন পরিস্থিতিতে তাঁর কর্তব্য দাঁড়ায় গুপ্তহত্যার শিকার হওয়ার আগেই ব্রোসার্ডকে রক্ষা করা, নিরাপদ হেফাজতে নেয়া, যাতে ব্রোসার্ডের কাছ থেকে তাঁর অতীত সংযোগগুলির বিভিন্ন তথ্য জেনে নেয়া যায়। পুলিশের কাছ থেকে যথাযথ সাহায্য পাওয়া যাবে না জন্যে লেভি নিজের সহায়তাকারী হিসেবে খুঁজে নেন কর্নেল রক্সকে।
কিন্তু কোথায় আছে ব্রোসার্ড? লেভি তাঁকে খুঁজে পান না। ওদিকে কোনও কোনও শুভানুধ্যায়ী যখন ব্রোসার্ডকে পরামর্শ দেন ধরা দিতে, তখন তিনি সোজাসাপ্টা জানিয়ে দেন, যত কষ্টই হোক, জেলের মধ্যে জীবনের বাকি জীবন কাটিয়ে দেয়ার কোনও ইচ্ছেই নেই তাঁর, তিনি চান চার্চের কোনও যাজক তাঁর পাপমুক্তির ঘোষণা করুক, অ্যাবসলুশান দিক। এদিকে চার্চে কর্মরত এক বন্ধুর মাধ্যমে লেভি জানতে পারেন যে, কার্ডিনাল অব লিওন এক সময় ব্রোসার্ডের অপরাধ তদন্তের জন্যে একটি কমিশন গঠন করেছিল। কিন্তু ওই পর্যন্তই, কেউই সঠিক তথ্য দিতে নারাজ, এমনকি কমিশনের সদস্যরাও। লেভি এবং রক্স যেখানেই যান না কেন, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একটি কথাই জানানো হয়, ওটা তো পুরানো ব্যাপার,- ঠিক যেভাবে আমাদের দেশেও কেউ কেউ বলে থাকে, ওইসব পুরানো কাসুন্দি।
কিন্তু এই অনুসন্ধানযাত্রার মধ্যে দিয়েই বেরিয়ে আসে এসব ঘটনার রাজনৈতিক মাত্রা। আমরা জানতে পারি, ব্রোসার্ডের স্ত্রীর ভাই ছিল কমিউনিস্ট। কমিউনিস্টরা তখন ফ্রান্সে চেষ্টা করছিল নাৎসীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধ গড়ে তোলার। কিন্তু তাতে কী? তথ্যানুসন্ধান করতে আসা রক্সকে এক চার্চের ধর্মযাজক বোঝানোর চেষ্টা করেন, ‘ব্রোসার্ডের কী অপরাধ? ওইসব ইহুদিরা তো কম্যুনিস্ট ছিল! ব্রোসার্ড তাদের পার পেতে দেবে না, সেটাই তো স্বাভাবিক। কম্যুনিস্টরা তো অ্যানার্কিস্ট, কর্নেল। অন্যদিকে ব্রোসার্ড হলো নিবেদিতপ্রাণ খ্রিস্টান।’
এমনকি বিচারক অ্যানিম্যারি লেভিকে পারিবারিক সম্পর্কের সূত্রে ডেকে পাঠান দেশের এক মন্ত্রী। গাঢ় স্বরে তিনি বলতে থাকেন, বন্ধুর মেয়ের এই সাফল্যে তিনি আনন্দিত, কেননা ব্রোসার্ডের এই মামলা লেভির পেশাদারি জীবনের জন্যে একটি বড় অর্জন। মিডিয়ার চোখ এখন লেভির দিকে, ক’জন পায় এমন সাফল্য!
কিন্তু লেভি নিজে তো এ মামলাকে ব্যক্তিগত সাফল্য অর্জনের নিরিখে বিচার করেন না, সোজাসাপটা জানান তিনি, এই ধরণের কথাবার্তা তার ভালো লাগে না। কিন্তু মন্ত্রী বলতে থাকেন, ‘আমি তোমার সঙ্গে কথা বলছি একজন পুরানো পারিবারিক বন্ধু হিসাবে, সরকারের মন্ত্রী হিসেবে নয়।’ তিনি জানিয়ে দেন, ভয়ংকর এক বিপদে পড়তে যাচ্ছেন অ্যানিমেরি। বন্ধুকন্যাকে পরামর্শ দেন তিনি, ‘কেউ তোমার হাতে বিষভরা চ্যালিস (যিশুর শেষ নৈশভোজে ব্যবহৃত পানপাত্র) তুলে দিলে তোমার জন্যে সবচেয়ে ভালো প্রতিদান হবে সেই বিষভরা চ্যালিস তার হাতেই ফিরিয়ে দেয়া।’
অ্যানিমেরিকে মন্ত্রী বলেন, ‘আইন আর রাজনীতির মধ্যে যখন ধাক্কাধাক্কি লাগে, আইন তখন সবসময়েই বাজে পরিণতির দিকে এগোয়।’
অ্যানিমেরি জানতে চান, আর যখন ন্যায়বিচার ও রাজনীতির মধ্যে ধাক্কাধাক্কি লাগে?
মন্ত্রী জানান, একই ব্যাপার ঘটে। তবে আরও বাজে হয় তা।
অতএব তিনি অ্যানিমেরিকে উপদেশ দিতে থাকেন, আমার কথা শোন। তুমি খুব বাজে এক জালে আটকা পড়েছো।
শুনে অ্যানিমেরি জানতে চান, মাকড়শাটা কে? ক্ষিপ্ত মন্ত্রী বলেন, তুমি ধ্বংস হয়ে যাবে, অ্যানিম্যারি।
ধ্বংস অবশ্য হয় না অ্যানিম্যারি। কিন্তু কেউই সাহায্য করে না তাকে। না দেয় তথ্য, না দেয় কোনও সূত্র। তদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ভ্যালেনটিনের মাধ্যমে চার্চের প্রিস্টের মুখোমুখি হয়ে অ্যানিম্যারি যখন বলেন, তাঁকে নির্দেশ দিতে হবে যে কোনও প্রিস্ট, অ্যাবোট অথবা প্রায়োরই ব্রোসার্ডকে আশ্রয় দিতে পারবে না, তখন তিনি খুব শাদামাটা গলায় জানিয়ে দেন, সে আদেশ তিনি দিয়ে-দিয়েছেন। শুনে অ্যানিমেরির সঙ্গী রক্স বলেন, ওই নির্দেশ নিয়ে তাঁদের সন্দেহ রয়েছে, কেননা ব্রোসার্ডকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। হঠাৎ করেই সে যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। অ্যানিমেরি তাকে জানান, এর আগে বিভিন্ন সময় ব্রোসার্ডকে কবে, কখন এবং কোথায় কোথায় থাকতে দেয়া হয়েছে তার প্রতিটি বিবরণ তাঁকে দিতে হবে। যাজক তখন বলেন, এই ক্ষেত্রে তাঁর দুটি দায়িত্ব রয়েছে। একটি দায়িত্ব হলো, এটি সবাইকে নিশ্চিত করা যে, চার্চ মানবাধিকার ক্ষুণ্ন করার দায়ে অভিযুক্ত কাউকে রক্ষা করছে না। দ্বিতীয় দায়িত্বটি হলো, কে তাঁকে (ব্রোসার্ডকে) আশ্রয় দিয়েছে তা খুঁজে বের করা এবং সেটি (আশ্রয় দেয়া) বন্ধ করা। যখন তাঁর বিচারে মনে হবে যে সঠিক সময় এসেছে, তখন অ্যানিম্যারির কাঙ্ক্ষিত সব তথ্যই তাঁকে দেয়া হবে।
অ্যানিম্যারি তাঁকে বলেন, এইসব দায়িত্ববর্ণনার মারপ্যাঁচে তথ্য না দিয়ে বরং তা গোপন করে চেয়ারম্যান ন্যায় বিচারের পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছেন। উত্তরে যাজক জানিয়ে দেন, সে ক্ষেত্রে অ্যানিমেরি চাইলে তাকে গ্রেফতার করতে পারে। এইভাবে যাজক ‘ধর্মেও আছি, জিরাফেও আছি’ অবস্থান নেন। চার্চকে তিনি মুক্ত করতে চান ব্রোসার্ডকে পুষবার গ্লানি থেকে, আবার এটাও চান যে ব্রোসার্ড মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বিচারকারীদের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাক। যতদিন না ব্রোসার্ড চলে যেতে পারবে, ততদিন নীরব থাকার নীতি গ্রহণ করেন তিনি।
কিন্তু অ্যানিম্যারির পক্ষে কি সম্ভব তাঁর নীরবতা ভাঙার জন্যে তাঁকে গ্রেফতার করা? বিশেষ করে তিনি যখন বোঝেন এর অর্থ চার্চকে নাড়িয়ে দেয়া? তারপরও ব্রোসার্ড আছে জানতে পেরে এক মঠে অভিযান চালান তিনি। ধর্মের ঘরে এ ভাবে অভিযান চালানো যায় না, ধর্মের ঘরে কোনও মেয়ে ঢুকতে পারে না বলে তারস্বরে চিৎকার করতে থাকেন অ্যাবোটটির রক্ষক। তাঁর কাছে যখন জানতে চাওয়া হয়, ব্রোসার্ড কোথায়, তখন তিনি ভাবলেশহীন কণ্ঠে জানান, অ্যাসাইলাম সম্পর্কে ধর্মে যা বলা হয়েছে সে-অনুযায়ী তিনি এ প্রশ্নের উত্তর দিতে অক্ষম! এইভাবে চার্চ প্রকারান্তরে ক্রমাগত যুদ্ধাপরাধী ব্রোসার্ডের পক্ষে দাঁড়াতে থাকে।
এসব কথাবার্তা যখন হচ্ছে, ব্রোসার্ড তখন পালাচ্ছে পেছন দরজা দিয়ে!
অ্যানিম্যারির তদন্ত এগুতে থাকে এবং একপর্যায়ে খুব স্পষ্টভাবেই বোঝা যায়, নিজেকে রক্ষার জন্যে ব্রোসার্ডের ওপর থেকে সমর্থন তুলে নিয়েছে পর্দার অন্তরালে থাকা আরও দাগী এক যুদ্ধাপরাধী। সে এখন চায়, আইনপ্রয়োগকারীদের হাতে ধরা পড়ার আগেই ব্রোসার্ড বিদায় নিক পৃথিবী থেকে, যাতে চিরজীবনের জন্যে নিরাপদ হতে পারেন আরও কয়েকজন যুদ্ধাপরাধী। এরকম সমর্থন তুলে নেয়ার পরিণতি যা হয়,- ব্রোসার্ডকে শেষ পর্যন্ত জীবন দিতে হয় তাঁরই পরিচিত ও বিশ্বস্ত একজনের হাতে। অথচ ব্রোসার্ড মনে করেছিলেন, বিশ্বস্ত ওই মানুষটিই তাকে সীমান্ত অতিক্রম করে অন্য একটি দেশে চলে যাওয়ার ব্যাপারে সাহায্য করবে। ব্রোসার্ডকে গুলি করে হত্যার পর সে সটকে পড়ল লাশের ওপর ‘দ্য স্টেটমেন্ট’ ছাপ দেয়া কাগজ রেখে। ‘দ্য স্টেটমেন্ট’ শেষ হয় একটি পার্টির মধ্যে দিয়ে। ওই পার্টিতে আবারও মুখোমুখি হন মন্ত্রী এবং অ্যানিমেরি লেভি। ক্ষিপ্ত অ্যানিম্যারি বলেন বটে, ব্রোসার্ড মারা গেছে বলে মন্ত্রীর মনে করার কারণ নেই যে, সকলেই নিরাপদ; কিন্তু তিনিও জানেন, তাঁর হাতে এমন কোনও তুরুপ আপাতত নেই যা দিয়ে তিনি যুদ্ধাপরাধীদের কাউকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেন।
দুই.
‘দ্য স্টেটমেন্ট’-এ যেমনটি দেখছি, তার সঙ্গে তেমন বড় কোনও পার্থক্য কি রয়েছে এ-বাংলাদেশের? যারা মতিউর রহমান নিজামী, মুজাহিদ, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী, মঈনউদ্দীন, আশরাফদের মতো যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে ওকালতি করছেন, তাদেরও বলতে শোনা যাচ্ছে, ওদের কোনও অপরাধ নেই, মুক্তিযুদ্ধের সময় তারা যা করেছেন, তা তাদের রাজনৈতিক অবস্থান, তাদের মনে হয়েছিল ভারতের হাতে ‘দেশ’ চলে যাচ্ছে, তাই তারা সাহায্য করেছে পাকিস্তানি খানসেনাদের।
কী অদ্ভূত কথা,- কোটি কোটি মানুষের কাছে মনে হলো ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে, কেবল এই গোলাম আযম থেকে চৌধুরী মঈনউদ্দীন আর আশরাফরাই বুঝতে পারল যে, ভারত পাকিস্তানকে দুই ভাগ করছে! কেবল মঈনউদ্দীন আর আশরাফদেরই মনে হলো, শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীরা বাঙ্গালি, কমিউনিস্ট, ভারতের দালাল; অতএব, তাদের খুন করে রায়ের বাজারের বধ্যভূমিতে ফেলে রাখা হোক! এখন আবার শোনা যাচ্ছে গোলাম আযম নাকি স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে বিশেষ করে একাত্তরের স্মৃতিই ভুলে গেছেন! অতএব পালের গোদাকে আপনি কখনোই পারবেন না জিজ্ঞাসাবাদ করতে, কেননা স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়া রোগীকে তো জিজ্ঞাসাবাদ করা ঠিক নয়! তবে স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়ার আগেই তিনি নাকি যুদ্ধাপরাধী বিচার ইস্যুটির বিরোধিতা করে একটি বুকলেট লিখে গেছেন, যা পৌঁছে দেয়া হচ্ছে কোটি কোটি মানুষের কাছে।
এইসব যুদ্ধাপরাধীরা যুদ্ধাপরাধ করার জন্যে ধর্মজ রাজনীতির বর্ম পরেছিল, এখন ওই একই বর্মটি পরেছে নিজেদের সুরক্ষিত করতে। শুধু তাই নয়, গত তিন যুগ ধরে তারা ধর্মজ রাজনীতির বর্মটি পরিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের হাজার হাজার নতুন বালক ও তরুণের গায়ে,- যাতে কখনও বিচারের মুখোমুখি হলে এসব বালক ও তরুণরা কথিত আদর্শবোধের টানে ছুটে আসে তাদের রক্ষা করতে। প্রায়ই আমাদের বলা হয়, ‘যারা যুদ্ধের পর জামায়াতে ইসলামী কিংবা ইসলামী ছাত্র শিবির করছে, তাদের তো কোনও দোষ নেই, তারা তো এ দেশেরই সন্তান। তারা তো রাজাকার, আলবদর অথবা আলশামস নয়।’ এরা বলছেন না, জন্মসূত্রে এরা এ-দেশের সন্তান হলেও যে-রাজনৈতিক চেতনা তারা ধারণ করছে, তা যুদ্ধাপরাধীদের রাজনৈতিক চেতনা এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পাশাপাশি ওই রাজনৈতিক চেতনাধারীদের বিরুদ্ধেও। তাই যে-চেতনা রাষ্ট্রগঠনের শুরুতেই একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে নাকচ করে দেয়া হয়েছে, সেই রাজনৈতিক চেতনায় রাজনীতি করার অর্থ নতুন কোনও যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত করার প্রস্তুতি নেয়া।
এবং আমরা দেখেছি, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র শিবির ১৯৭১ সালের রাজনৈতিকবোধের জায়গায় দাঁড়িয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, মহাবিদ্যালয়ে একের পর এক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছে, হাত-পায়ের রগ কেটেছে, মাথা ও হাতের মধ্যে ড্রিলিং মেশিন দিয়ে ড্রিল করেছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লতিফ হলকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে আমাদের সামনে তাদের যুদ্ধপ্রস্তুতির উদাহরণও রেখেছে। প্রতীকীঅর্থে এসবও যুদ্ধাপরাধই বটে। তারা চাইছে ১৯৭১-এর মতোই সশস্ত্র ও রক্তাক্ত উপায়ে ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনাকে হত্যা করতে, নির্মূল করতে। স্বাধীন দেশে ড. আবু তাহেরকে হত্যাকারী ইসলামী ছাত্র শিবিরের নেতা সালেহ-কে তো নতুন এক যুদ্ধাপরাধীই বলতে হয়, কেননা সে-যে রাজনৈতিক বোধ থেকে কাজ করে চলেছে, সেই রাজনৈতিক বোধের সঙ্গে ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধী চৌধুরী মঈনউদ্দীন ও আশরাফদের রাজনৈতিক বোধের কোনও পার্থক্য নেই।
সময় এসেছে মুক্ত বাংলাদেশে গত ৩৮ বছর ধরে সংঘটিত জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র শিবিরের এই সব নতুন নতুন অপরাধগুলির তথ্যসমূহও সংগ্রহ ও সংকলিত করার, কাঠগড়ায় দাঁড় করার। নিছক রাজনৈতিক সন্ত্রাস হিসেবে এসব অপরাধগুলিকে দেখার কোনও কারণ নেই। সিনেমার অ্যানিম্যারির হাতে এমন কোনও প্রামাণিক উপাদান ছিল না, যা দিয়ে তিনি যুদ্ধাপরাধীদের মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ আইনের আওতায় আনবেন। কিন্তু আমাদের জন্যে আশাব্যঞ্জক ঘটনা হলো, তেমন অনেক প্রমাণ এমনকি সংগৃহীতই হয়ে আছে আমাদের, এমনকি বিচার করার মতো একটি যথোপযুক্ত আইনও রয়েছে এ-দেশটিতে। অবশ্য নিরাশার দিকও আছে; এখানেও মন্ত্রী থেকে শুরু করে অনেক রাজনীতিক আছেন, যারা যুদ্ধাপরাধীদের প্রশ্রয় দিচ্ছেন, যুদ্ধাপরাধীদের পাশাপাশি তারাও চাইছেন আইন ও রাজনীতির মধ্যে, ন্যায় বিচার ও রাজনীতির মধ্যে একটা ধাক্কাধাক্কি লাগুক। ওই ধাক্কাধাক্কিটি ঠিকমতো লাগাতে পারলেই মাঠে মারা যাবে যুদ্ধাপরাধ বিচারের প্রক্রিয়াটি এবং তার বদলে সম্ভব হবে নতুন রূপে এমন একটি দলকে সর্বস্তরে প্রতিস্থাপন করা, যাদের মাথার মধ্যে গিজগিজ করছে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের কথিত রাজনৈতিক মূল্যবোধ ও নীতি।
এই নিরাশার দিক রয়েছে বলেই, আমরা মনে করি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হতেই হবে। কেননা এই বিচারের মধ্যে দিয়েই কেবল সম্ভব আমাদের যুথবদ্ধ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আশাবাদী মননটিকে জাগিয়ে তোলা, সম্ভব মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধসমূহের শাস্তি দেয়া, সম্ভব পুরানো মগজ নিয়ে নতুন করে বেড়ে ওঠা যুদ্ধাপরাধ-প্রবণ রাজনৈতিক শক্তিকে দুর্বল করার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও আইনগত ভিত্তি সুদৃঢ় করা।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
১৩ comments
বিনয়ভূষণ ধর - ২৫ আগস্ট ২০০৯ (৬:১৪ পূর্বাহ্ণ)
ইমতিয়ার শামীম-কে অনেক ধন্যবাদ। লেখাটা পড়ে আসলেই খুব ভালো লাগলো। এখানে ২৫শে আগষ্ট,২০০৯ তারিখে দৈনিক “যায় যায় দিন” পত্রিকায় প্রকাশিত রনেশ মৈত্র-র “যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে গড়িমসি” কলামখানি এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে তুলে দেয়া হলো……
ইমতিয়ার - ২৮ আগস্ট ২০০৯ (৮:১৪ অপরাহ্ণ)
ধন্যবাদ বিনয়ভূষণ ধর। প্রাসঙ্গিক হওয়ায় আরও একটি লিংক দেখতে পারেন। এখানে মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানীর একটি লেখা আছে। লেখাটি ছাপা হয়েছে গত ১৯ আগস্টের দৈনিক ডেসটিনিতে।
রায়হান রশিদ - ২৫ আগস্ট ২০০৯ (১:১৮ অপরাহ্ণ)
@ ইমতিয়ার ভাই,
ধন্যবাদ এই ছবিটির কথা আমাদের জানানোর জন্য। এটির কথাই তো সেদিন বলছিলেন ফেসবুকে। অবশ্যই দেখতে হবে। আপনি তো বেশ কয়েকবার দেখে ফেলেছেন এরই মধ্যে। তুলনামূলক মিলগুলো কি অবিশ্বাস্য! ভাবাই যায়না। সময় বদলায়, মানুষ বদলায়, পৃথিবী বদলায়। কিন্তু যুদ্ধাপরাধ, যুদ্ধাপরাধী আর তাদের নিয়ে রাজনীতির চেহারা বুঝি সব কালে সব দেশেই একই রকম থাকে। আপনার লেখাটা পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল ছবিটিকে বাংলায় ডাবিং করে পাত্র পাত্রী আর জায়গাগুলোর নাম একটু বদলে নিয়ে কত সহজেই না ‘দি স্টেটমেন্ট’-কে বাংলাদেশের পটভূমিতে গড়া কোন ছবি হিসেবে চালিয়ে দেয়া যায়।
আর বাংলাদেশের ব্রোসার্ডদের প্রতিপালন এবং সমর্থন দানের জন্য তো রয়েছে গোটা এক ধর্মীয় ইন্ডাস্ট্রি। ১৯৭১ এর যুদ্ধাপরাধীরা মানুষের গলা কেটেছিল আল্লার নামে, ‘পাক পবিত্র মুমীনগণের রাষ্ট্র’ পাকিস্তান রক্ষার নামে; আর ‘৭১ এর পর তাদের হয়ে লড়ার জন্য ছিল (এবং আছে) “নারায়ে তাকবীর” বলে স্লোগান দেয়ার দল। ইদানিং তো এমনও কথা বলা হচ্ছে যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নাকি এই দেশের মুসলিম সমাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। আরও কত কিছু দেখতে আর শুনতে হবে আগামী দিনগুলোতে।
বাংলাদেশের ব্রোসার্ডরাও বেঁচে বর্তে বেশ ভাল আছেন। তারা ক্ষমা পান, পুনর্বাসিত হন। অর্থনৈতিক সামাজিক রাজনৈতিক – সব অর্থে প্রতিষ্ঠাও লাভ করেন স্বাধীন বাংলাদেশে। ধর্ম কর্মে মন দেন। পরকালের ব্যাপারটা হিসাবে রাখতে হবে না! সে লক্ষ্যে এরা তরুণ প্রজন্মকে গড়ে তোলার “কোশিশ” করেন আগামী দিনের ব্রোসার্ড হিসেবে; কেননা দো জাহানের নেকি হাসিল করিবার খায়েশ থাকিলে তাহাই মূমীনকূলের জন্য অনুসরণীয় জেহাদী পথ, সত্যের পথ, এসলামের পথ!
সেই সাথে যোগ করি, অবস্থা কিছুটা বেগতিক দেখলে বয়সের দোহাই আর স্মৃতি হারানোর দোহাই দেয়ার পথ তো সবসময়ই খোলা। বুদ্ধিমান (যেমন: শ্রীমান গোলাম আযম) মাত্রই জানেন – আসামীর সপক্ষে বিচারের কাঠগড়ায় স্মৃতিভ্রষ্টতা, সাময়িক উম্মাদনা – এসব খুব জুতসই অস্ত্র। হাজার হলেও আমরা তো আর অতটা অসভ্য হয়ে উঠতে পারিনি যতটা হলে মনোবিকলকে ফাঁসিতে চড়ানো যায়। আর ছড়ানোর মত অর্থ থাকলে দু’কলম সার্টিফিকেট দেয়ার কি লোকের অভাব পড়েছে? আমেরিকা ইউরোপে তো মনরোগ বিশেষজ্ঞদের জন্য এসব লিখে দেয়া একরকম বাধা উপার্জনের উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। রীতিমতো একটা কুটির শিল্প সেটা। এই বার কিন্তু আমরা সত্যি সত্যিই উন্নত বিশ্বের পদান্ক অনুসরণ করতে যাচ্ছি।
২.
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে হবে। যতটুকু বুঝতে পারছি তাতে এটা স্পষ্ট যে সামনে পাহাড় প্রমাণ চ্যালেঞ্জ, পুরো জাতির জন্যই। এটা এমনই কাজ, যা মনে হয় না কোন সরকার বা কোন প্রশাসনের পক্ষেই এককভাবে সামাল দেয়া সম্ভব। এ জন্য এই ইস্যুতে আরও সংঘবদ্ধ কাজ দরকার এবং সেগুলোকে সারা দেশ এবং বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়া দরকার। দ্রুত। কারণ, অনেকের কাছে শুনতে হয়তো কিছুটা আবেগতাড়িতই শোনাবে, কিন্তু আমার কেবলই আশংকা হয় জাতির সামনে এটাই প্রথম এবং সম্ভবত শেষ সুযোগ এদের বিচার করার। সেজন্য যা কিছুই এই দেশ এবং জাতি এখন করবে – সেখানে ভুলের কোন জায়গা নেই, তা সে যত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্রই মনে হোক না কেন।
এ তো গেল প্রয়োজনীয়তার বাস্তবতা। কিন্তু তার বিপরীতে আমাদের মাঠের সংগঠনগুলোর যে পরিমান প্রফেশনালিজম এবং অভিনিবেশ দরকার, সেটা কিন্তু এখনো অনেকটাই অনুপস্থিত মনে হচ্ছে। এখনো মূল ইস্যুগুলোর অনেকগুলোতেই প্রয়োজনীয় ঐকমত্য গড়ে ওঠেনি বিচারপ্রার্থীদের মধ্যে। যতদূর জানি যুদ্ধাপরাধের বিচার অঙ্গনে কিছু কিছু প্রভাবশালী সংগঠনের (এবং ব্যক্তির) মধ্যে তো এমনকি মুখ দেখাদেখিও বন্ধ, মহোত্তর উদ্দেশ্যে এক টেবিলে বসে সিদ্ধান্তগ্রহণ তো আরও দূরবর্তী বিষয়। ইগো এবং আত্মম্ভরিতা দ্বারা তাড়িত হলে হয়তো এই-ই হয়। মিডিওক্রিটির পাহাড় বানানো হয়। আর অন্য দিকে কিছু কিছু সংগঠন তো আছেই যারা কাজ করার চেয়েও বিবৃতি প্রদান, প্রিম্যাচিউর নিবন্ধবাজি এবং আত্মপ্রচার নিয়েই বেশী ব্যস্ত। আর এত সবের মধ্যে যারা এখনো এই ইস্যুতে কিছু না কিছু কাজ করতে চান, বিশ্বাস করেন “বিচার” সম্ভব, তাদের জন্য রথি মহারথীদের রোষানল বাঁচিয়ে ধারালো ক্ষুরের ওপর দিয়ে ভারসাম্য রেখে হাঁটা আয়ত্ব করা ছাড়া আর উপায় কি? নগন্য এদের না আছে বাহুবল, না আছে বংশবল, না আছে পত্র-পত্রিকা মিডিয়াকে কাঁপিয়ে বেড়ানোর মতো “স্মার্টনেস”। এমন পরিস্থিতিতে “গুরুত্বপূর্ণ” ব্যক্তিরা যত দ্রুত নিজেরা একটা সম্মিলিত ঐকমত্যের জায়গায় পৌঁছোবেন, ততোই মঙ্গল এই দেশ আর দেশের মানুষের জন্য।
১৯৭১ এ এদেশের তরুণ সমাজ সব ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল দেশ স্বাধীন করবে বলে। আবার ওদের বেরিয়ে পড়ার সময় এসেছে মনে হয় অসম্পন্ন কাজগুলো শেষ করার জন্য। এলএমজি স্টেনগান হাতে নয়, এবারের অস্ত্র হতে হবে একদম আলাদা কিছু। সেটা হতে পারে চেতনা, সেটা হতে পারে বুদ্ধিমত্তা। কারণ যুদ্ধাপরাধীরা বসে নেই। পূর্ব-পশ্চিমের সব ধরণের বুদ্ধির ফেরীওয়ালাদের দ্বারে ওরা ধর্ণা দিয়ে বেড়াচ্ছে – তাও আজ প্রায় এক বছর হতে চললো। এজন্যই শুধু পাশেই নয়, অগ্রনী ভূমিকায় দরকার তরুণ প্রজন্মকে – যারা যুদ্ধ দেখেনি কিন্তু যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ দেখেছে। সব ধরণের মিডিওক্রিটি, সব ধরণের মতলববাজি, সব ধরণের ইগোবাজি বানের জলে বঙ্গোপসাগরে ভেসে যাবে, একবার যদি ওরা সত্যিকার অর্থে বেরিয়ে আসে আর করণীয় কাজগুলো হাতে তুলে নেয়। ওদের ঔজ্জ্বল্য ম্লান করে দিতে পারে খোদ সূর্যকে।
দুঃখিত, লেখার তাড়নায় অনেক কিছুই লিখে ফেললাম। বিক্ষিপ্ত চিন্তাগুলো ভাগাভাগি করতে ইচ্ছে হল তাই। হতাশা থেকে লিখিনি কিন্তু। এমনকি হতাশায় নিমজ্জিত হবার মতোও বাড়তি সময় নেই এখন আমাদের হাতে।
৩.
আরেকটা ছবির কথা মনে পড়ছে – Marathon Man (1976); জন শ্লেশিংগার পরিচালিত, ডাস্টিন হফম্যান এবং লরেন্স অলিভিয়ে অভিনীত। এক যুদ্ধাপরাধীকে নিয়ে। ছবিটি যদিও ঘরানার দিক থেকে একটি থ্রিলার এবং এর বক্তব্যের গভীরতা কিংবা প্রাসঙ্গিকতা The Statement এর সাথে তুলনা করার মতো না, তবুও আবার দেখতে ইচ্ছে করছে।
ইমতিয়ার - ১ সেপ্টেম্বর ২০০৯ (৭:৫২ অপরাহ্ণ)
Marathon Man-এর মতো এটিও কিন্তু একটি থ্রিলারধর্মী চলচ্চিত্র, এমনকি মূল উপন্যাসটিও আসলে থ্রিলারধর্মী; কিন্তু রাজনৈতিক বিবেচনাগুলি এই থ্রিলারধর্মিতাকে এক অনন্য স্বাদ দিয়েছে।
অগ্রণী ভূমিকায় দরকার তরুণ সমাজকে,- আপনি ঠিকই বলেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, এক শ্রেণির বৃদ্ধদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে এদের অনেককেও বলতে শোনা যায়, এত বছর বাদে কী আর হবে! শুধু তাই নয়, এর পাশাপাশি গজিয়ে উঠেছে একশ্রেণীর সংঘবদ্ধ নতুন তরুণ, যাদের কাজ যুদ্ধাপরাধীদের মতোই সবাইকে বিভ্রান্ত করা, কিন্তু নিষ্ঠুরতায় যুদ্ধাপরাধীদের মতোই দক্ষতা দেখানো। এ লেখার শেষদিকে আমি এদের প্রসঙ্গও টেনেছি। আশির দশকের শিবিরকে যারা দেখেনি, তারা এদের ভয়াবহতার প্রস্তুতি উপলব্ধি করতে পারবেন না। এখন এরা চুপ আছে;তার মানে আরও ভয়াবহতা সৃষ্টির প্রস্তুতি নিচ্ছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, তখনকার পরাজয়ের জের ধরে এরা ভবিষ্যতে একটি গৃহযুদ্ধ সৃষ্টি করবে কি না, তা নির্ভর করছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে আমরা কত দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারব, একটি অপরিবর্তনীয় রাষ্ট্রীয় অবস্থানের সূচনা করতে পারব, তার উপরে।
কাজটি কঠিন, কিন্তু অবশ্যই আমাদের করতে হবে।
মাসুদ করিম - ২৭ আগস্ট ২০০৯ (৩:২৬ অপরাহ্ণ)
বিচার করা আসলেই খুব কঠিন। অপরাধ করা এতই সোজা, বিচারের কথা শুনলে সবসময় কেন যেন আমার হাসি পায়। হ্যাঁ, সত্যিই হাসি পায়।
তবে এটা ঠিক, এবারই প্রথম ও এবারই শেষ, যুদ্ধাপরাধীর বিচার এবার না হলে আর কখনো হবে বলে আমারও মনে হয় না।
‘ধর্মনিরপেক্ষতা হারাম’, ‘নামাজ পড়বেন তো নিজের ভালোর জন্য; কিন্তু ইমান ঠিক রেখে, মুসলমানের ক্ষতি হয়, এমন কাজ ঠেকানোই মুসলমানের আসল কাজ; আমরা জামাতিরা অনেকেই নামাজ পড়িনা, কিন্তু আমাদের ইমান শক্ত; এজন্যই আমলের চেয়ে ইমানের জোর বাড়ান, মুসলমানের ইমানি জোর কমে গেলে সে আর মুসলমান থাকেনা’–এদের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে আমাদের সমাজে।
আমি আমার এক ৭০ বছরের বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করলাম, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে তো? তিনি আমাকে বললেন, শফিক চায় এখন তোমাদের হাসিনা চাইলেই হয়ে যাবে। আমি বললাম, বুড়োদের নিয়ে এই সমস্যা–রাজা উজির না মারলে তাদের চলে না! তিনি কিছুক্ষণ চালশেদের গালাগালি করলেন তারপর বললেন, রাজা উজির ছাড়া এই কাজ হবেই না।
রায়হান রশীদের গণপন্থাই আসল পথ, আমার মতামত ওর মতোই, কিন্তু এ একবারেই চালশে মত। বুড়ো বলছে এ কাজ শুধুই রাজা উজিরেরই।
রেজাউল করিম সুমন - ২৮ আগস্ট ২০০৯ (২:৩৮ অপরাহ্ণ)
ইমতিয়ার ভাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক একটি চলচ্চিত্র নিয়ে আলোচনার সূত্রে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি সামনে নিয়ে আসার জন্য। মন্তব্যকারীদেরও ধন্যবাদ।
রায়হানের মন্তব্যের সঙ্গে সকলেই একমত হবেন :
এ ছবিটি সম্প্রচারের কোনো উদ্যোগ কি নেবে আমাদের কোনো টিভি চ্যানেল? নিদেনপক্ষে বিটিভি? আলিফ লায়লা, সিনবাদ, রবিনহুড-এর মতো সিরিয়াল বাংলায় ভাষান্তরিত করে দিনের পর দিন দেখানোর অপরাধ খানিকটা ক্ষালন হতো তাহলে।
আমাদের চলচ্চিত্র সংসদগুলোও হয়তো একটা ভূমিকা রাখতে পারে এক্ষেত্রে। ‘ডাব’ করার ঝামেলা এড়িয়েও এ ছবি দেশের বিভিন্ন জেলায় দেখানো সম্ভব।
২
নরমান জুইসনের The Statement (২০০৩) ছবিটি আমার দেখা নেই। তাঁর পরিচালিত অন্য একটি ছবি দীর্ঘদিন ধরেই আছে আমাদের প্রিয় ছবির তালিকার শীর্ষে – Fiddler on the Roof (১৯৭১)। শলোম আলেইকেম-এর (১৮৫৯-১৯১৬) ইডিশ-ভাষায় লেখা উপন্যাস Tevye the Dairyman (১৮৯৪-১৯১৪) অবলম্বনে তৈরি হয়েছিল Fiddler on the Roof (১৯৬৪) নামে একটি ব্রডওয়ে মিউজিক্যাল, আর তারই ওপর ভিত্তি করে নির্মিত একই নামের এই অসামান্য মিউজিক্যাল ফিল্মে আনাতোভ্কা নামের এক প্রত্যন্ত পল্লীর কন্যাদায়গ্রস্ত দরিদ্র গোয়ালা তেভিয়া-র বয়ানে, নানা জনের গানে, বিবৃত হয় তার পরিবারের আর গ্রামবাসীর সুখ-দুঃখের কাহিনি। ধর্মভীরু নিরক্ষর এই মানুষটির পরিবারেও কিয়েভ্ থেকে আসা এক বিপ্লবীর আগমনে আঁচ লাগে ১৯০৫-এর বিপ্লবের, … দীর্ঘদিনের প্রথা আর ঐতিহ্যের সঙ্গে দ্বন্দ্ব বাধে নতুন ধ্যান-ধারণার, … ছবির শেষ পর্যায়ে গ্রাম-গ্রামান্তর থেকে বিতাড়িত হয় ইহুদিরা, শুরু হয় তাদের দেশ-দেশান্তরে উদ্বাসন।
৩
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের গণদাবির সঙ্গে দেশের অধিকাংশ তরুণ-তরুণীর যে কোনো সক্রিয় সম্পৃক্ততা গড়ে ওঠেনি, তা অস্বীকার করা যায় না। নিজের দিকে তাকালে, নিজের চারপাশে তাকালে, সেরকমই তো মনে হয়। নিজ নিজ বিবর ছেড়ে এখনই বেরোতে হবে সবাইকে …
মোহাম্মদ মুনিম - ২৯ আগস্ট ২০০৯ (৫:২৫ অপরাহ্ণ)
ইমতিয়ার ভাইয়ের লেখাটির সুত্র ধরে Wikipedia তে ভিচি সরকার বিষয়ক প্রবন্ধটি পড়লাম। দেখা যাচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বেশ কিছু দেশেই দালাল সরকার ছিল এবং তারা নাতসীদের কুকর্মে সহযোগীতা করেছে। যুদ্ধের পরে অবশ্য এসব দালালদের বিচার হয়েছিল, আদালত এবং আদালতের বাইরে। ছবি ও কবিতার ফরাসী দেশে ১০০০০ দালাল কে গনবিচারে মেরে ফেলা হয়েছিল, বাকিদের বিচার হয়েছে আদালতে, কিছু বিচার চলেছে ৮০, এমনকি ৯০ এর দশক পর্যন্ত। আমাদের দেশে কিছুই হয়নি। গোলাম আযম বা সা কা চৌধুরী ফাঁসীতে ঝুললে, তাদের জন্য দুঃখ করার মত খুব বেশী লোক দেশে পাওয়া যাবে না। কিন্তু দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের এতে খুব আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না। সা কা চৌধুরীর মেয়ের বিয়েতে যারা দল বেঁধে, ‘রাজনৈতিক’ বিভেদ ভুলে গিয়ে দাওয়াত খেয়ে আসেন, তাঁরাই আবার তাকে ফাঁসীতে ঝুলাবেন, এটা আশা করা বাড়াবাড়ি। সা কা চৌধুরী শেখ হাসিনার বাড়ীতে গেছে, ‘পারিবারিক ব্যাপারে’ আলাপ করতে, এমন একটা খবর দেখেছিলাম প্রথম আলোতে, বছর তিনেক আগে, লিঙ্কটা খুঁজে পেলাম না। মুক্তিযুদ্ধে যারা নিহত, ধর্ষিত এবং লুন্ঠিত হয়েছেন, তাঁরা প্রায় সবাই নিম্নবিত্ত, আমাদের বর্তমান নেতাদের পরিবারের কেউ মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, এমন কাউকে মনে পড়ছে না। এই জন্যই কি বিচার বিলম্বিত হচ্ছে?
রায়হান নতুন প্রজম্নের কথা বললেন, আমিও তাই আশা করি। ক্যাডেট কলেজের ব্লগে ক্রিকেট নিয়ে আলোচনাটা দেখে তাই মনে হচ্ছে, ক্যাডেট কলেজের আশির দশকে জম্ন নেয়া ছেলেরা, মুক্তিযুদ্ধের দশ খন্ডের ইতিহাস হয়তো পড়েনি (আমি নিজেও পড়িনি), কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ নিয়ে প্রবল অহঙ্কার আছে, ‘ক্রীড়ামোদী’ পাকিস্তানের সর্মথকদের ছেড়ে কথা বলছে না। একটি লেখার সুবাদে যখন চল্লিশটি তরুনের দৃষ্টিভংগী জানা যায়, তখন আরো চার কোটি তরুন কি ভাবছে, সেটা আন্দাজ করা যায়।
রায়হান রশিদ - ২৯ আগস্ট ২০০৯ (৯:১৮ অপরাহ্ণ)
@ মুনিম,
আপনি একদম ঠিক মূল্যায়ন করেছেন। আশির দশকে জন্ম নেয়া ক্যাডেট কলেজের ছেলেমেয়েরা অনেক আলাদা, সেটা আমারও মনে হয়েছে। এদের সাথে অনেক মিল পঞ্চাশ কিংবা ষাটের দশকে জন্ম নেয়ার দল। এঁরা স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে, স্বাধীন দেশে (৭০ এবং ৮০’র দশকে) ক্যাডেট কলেজের আধা-সামরিক নিয়ম কানুনের তোয়াক্কা না করে সময় সময় প্রতিবাদ করেছে, আন্দোলন করেছে। সে জন্য শাস্তিও পেয়েছে প্রচুর। আমাদের ব্লগেই শাহীন ভাই আছেন (অনেক দিন দেখা যাচ্ছে না তাঁকে!!), যিনি এবং তাঁর সময়কার ক্যাডেটরা এরশাদ বিরোধী প্রতিবাদ গড়ে তোলার চেষ্টার কারণে সে সময় শাস্তিও ভোগ করেছিলেন। উল্টোদিকে, তাঁদের উত্তরসূরীরা যারা আশির দশকের শেষ থেকে মধ্য-নব্বই সময়কালের ভেতর মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক দিয়েছেন, তাদের মূল অংশ ছিল রাজনীতি বিমূখ এবং অনেক বেশী আত্মকেন্দ্রিক। কিছু কিছু ভিন্ন মতাবলম্বী এবং প্রগতিশীল মানসিকতার ছাত্র-ছাত্রী এই সময়েও ছিল কিন্তু তারা ছিল একেবারে সংখ্যালঘু এবং কোণঠাসা, এমনকি নিজেদের বন্ধু মহলেও। তখনকার সংখ্যাগরিষ্টদের খুব কমই কিন্তু পাল্টেছে পরবর্তী বছরগুলোতে।
সে তুলনায় নতুন প্রজন্মের এঁরা অনেক আলাদা। ক্যাডেট কলেজে থাকার দিনগুলোতে (সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে সম্ভবত) এরা হয়তো রাজনীতি ও দেশভাবনার অনেক ব্যাপারেই কিছুটা পিছিয়ে থাকে। কিন্তু সেটা সাময়িক। কারণ, মন মানসিকতায় এরা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশী স্বচ্ছ এবং নতুন চিন্তার প্রতি উম্মুক্ত। এটা হয়তো এই পুরো প্রজন্মটারই বৈশিষ্ট্য, শুধু ক্যাডেট কলেজেই নয়। একটা কারণ সম্ভবত – এদের মাথায় আমাদের পূর্ব-প্রজন্মের হস্তান্তরিত “চিন্তার আবর্জনা” (৭১-৮১ নিয়ে ব্যক্তিগত হতাশা এবং ফলতঃ অন্ধতা) সবচেয়ে কম ঢোকার সুযোগ পেয়েছে। এ কারণে নতুন যে কোন ভাবনা, যুক্তিসঙ্গত চিন্তা, বিচারপদ্ধতি – তরুণদের এই দল অনেক দ্রুতই গ্রহণ করে, যেটা আমাদের প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের মধ্যে অনেকটাই অনুপস্থিত ছিল বলে এখনো মনে করি। এখন দরকার কেবল ওদের কাছে ঠিকভাবে পৌঁছানো; আমাদের সময়কার ভুলগুলোর ব্যাপারে ওদের আগে থেকেই সতর্ক করে দেয়া এবং সে অনুযায়ী উদ্বুদ্ধ করা।
[সতর্কতা: এটা অবশ্যই খুব মোটা দাগের একটি পর্যবেক্ষণ, এতে ভুল থাকা অসম্ভব না]।
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর - ১৮ অক্টোবর ২০০৯ (৪:৩৬ অপরাহ্ণ)
ইমতিয়ার শামীমের লেখা বরাবরই আমার কাছে বেশ দরকারি কাজ মনে হয়। `দি স্টেটমেন্ট‘ ফিল্মটিকে কেন্দ্র করে এই দেশের স্বাধীনতা বিরোধীদের সাথে যু্দ্ধাপরাধীদের সাথে যে ব্রোসার্ডের মিল দেখিয়েছেন, তা বেশ প্রয়োজনীয় কাজ মনে হয়েছে। তবে এ প্রশ্নটি অন্তত আমার কাছে খুব দরকারি মনে হয় যে, এদের বিচার কি শুধুমাত্র কোনো বড়ো অপরাধের বিচারের জন্যই দরকার। নাকি এর ভিতর দিয়ে কোনো সাংস্কৃতিক সংযোজন অতি দরকারি এক কাজ?
৭১ সালে ধর্মের নামেই মানুষের উপর সামগ্রিক নিপীড়ন চালানো হয়েছিল। ধর্মের রূপটিো আমাদের চেনা দরকার। পৃথিবীর কোনো ধর্মই নিরীহ কোনো বিষয় নয়। ধর্ম সদাসর্বদা অন্যকে সরিয়ে নিজের কর্তৃত্ব কায়েম করে।
কাজেই অপরাধীদের বিচারের পাশাপাশি, ব্যক্তিক-সামাজিক শুদ্ধতা আরো বেশি প্রয়োজন।
তবে কথা হচ্ছে, বিচার হবে তো? যু্দ্ধাপরাধীদের বিচার করলে পর, এদের নিয়ে যারা ভোটের রাজনীতি করে তাদের কি হবে!!!
ইমতিয়ার - ১৯ অক্টোবর ২০০৯ (৫:২৫ পূর্বাহ্ণ)
জাহাঙ্গীর ভাই, আপনাকে এখানে পেয়ে ভাল লাগল। খুব সঙ্গত একটি প্রশ্ন তুলেছেন,
না, শুধুমাত্র অপরাধটি বড় বলেই এর বিচার হওয়া উচিত, সেরকম আমি মনে করি না। এর মধ্যে দিয়ে নিশ্চয়ই সাংস্কৃতিক চেতনায়ও নতুন এক মাত্রা যুক্ত হবে এবং সেটিই গুরুত্বপূর্ণ। যে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হচ্ছে এই দাবি আদায়ের জন্য, সাংস্কৃতিক মাত্রা যদি না থাকত, অনেক আগেই আমরা রণে ভঙ্গ দিতাম। এর সাংস্কৃতিক দিকটি অপরিমেয় বলেই বোধহয় এত কিছুর পরও আমরা হাল ছাড়ি নি এবং ছাড়ার প্রশ্নও আসে না।
আর আমার মনে হয়, যারা এটি নিয়ে ভোটের রাজনীতি করছেন বা করেছেন, তাদের মধ্যেকারও একটি বড় অংশ এখন মনে করেন যে, এই ইস্যুটি জিইয়ে রেখে আর ভোট পাওয়া সম্ভব নয়। বরং দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ নেয়ার মধ্যে দিয়েই সম্ভব, একে কেন্দ্র করে ভোটের রাজনীতিকেও এগিয়ে নেয়া। সমস্যা হলো, নীতিনির্ধারকদের অনেকেই এখনও দ্বিধান্বিত।
যাই হোক, মুক্তাঙ্গন-এ আপনার লেখা পড়ার অপেক্ষায় রইলাম।
মোহাম্মদ মুনিম - ২০ অক্টোবর ২০০৯ (১:০৮ পূর্বাহ্ণ)
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সাথে সাথে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হবে কিনা এটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ইউরোপের দেশে দেশে দালালদের বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। অনেকের বিচার বিলম্বিত হয়েছিল, কিন্তু দালালদের রাজনৈতিকভাবে মৃত্যু হয়েছিল। আমাদের দেশে সেটি হয়নি। দালাররা পরে রাজনৈতিকভাবে পূর্নবাসিত হয়েছিল। অন্যদের উদাসীনতার সুযোগে তারা নিজেদের পূর্নবাসন করেছিল তা নয়, তাদের সচেতনভাবে পূর্নবাসিত করা হয়েছিল। জিয়াউর রহমান করেছেন, এরশাদ আমলে তারা নিশ্চিন্তে নিজেদের ঘর গুছিয়েছে, আশির দশকে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি তরতাজা ছিল, দালালদের বিচারের জন্য তেমন কোন আন্দোলন হয়েছিল এমন মনে পড়ে না। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে বেশ একটা শক্ত আন্দোলন হয়েছিল, জামাত শিবির বিরোধী আন্দোলনও দানা বেঁধেছিল, কিন্তু পরে সবকিছুরই গতি হারিয়ে যায়। ২০১০ সালে আওয়ামী লীগ যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা বলে, তখন এটাকে যতটা না সদিচ্ছা, তার চেয়ে বেশী ভোট কামানোর কৌশল বলে মনে হয়।
বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করে খুব একটা লাভ হবে বলে মনে হয় না। মিসরে, আলজিরিয়া, সিরিয়াতে ইসলামী দলগুলোকে ব্যাপক নিপীড়ন নির্যাতন করা হয়েছে, কিন্তু আন্ডারগ্রাউন্ডে দলগুলো আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে যেমন জেএমবিকে নিষিদ্ধ করে জেএমবির কার্যকলাপ বন্ধ করা যায়নি, তেমনি জামাতকে নিষিদ্ধ করে জামাতের রাজনীতিকেই শক্তিশালী করা হবে। পশ্চিমা বিশ্বেও চরমপন্থী দলগুলো (ব্রিটেনে যেমন বিএনপি) প্রকাশ্যে রাজনীতি করছে। একটি রাষ্ট্রে সুস্থ রাজনীতির চর্চা থাকলে চরমপন্থী রাজনীতি এমনিতেই রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে, বাংলাদেশে সেটাই হবে আশা করা যায়।
মাসুদ করিম - ২০ অক্টোবর ২০০৯ (৩:০২ অপরাহ্ণ)
তারেক জিয়া ব্রিটেনে ‘বিএনপি’র দীক্ষাই নিচ্ছেন, আমার কিছু দিন আগের এক পোস্টে খালেদা জিয়ার কিছু কাল্পনিক পদক্ষেপের কথা লিখেছিলাম, সেসব পদক্ষেপ যে বাস্তবে নেয়া হবে না তাতো আমরা সবাই জানি, কিন্তু সুস্থ রাজনীতির মাধ্যমে ‘বিএনপি’কে যদি উগ্র জাতীয়তাবাদ থেকে সরানো না যায়, তবে বাংলাদেশের জন্য জামাত-জেএমবি থেকেও ভয়ংকর হয়ে উঠবে তারেক জিয়ার ‘বিএনপি’। কারণ ‘নাৎসি’রাও তাই ছিল ‘উগ্র জাতীয়তাবাদী’। উপমহাদেশের জন্য ‘সন্ত্রাসবাদ’ এখন এক বড় সমস্যা, তাতে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু তারচেয়েও বড় সমস্যা– বাংলাদেশের বিএনপি, ভারতের বিজেপি এবং পাকিস্তানের মুসলিম লিগ।
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর - ১৯ অক্টোবর ২০০৯ (৪:২০ অপরাহ্ণ)
প্রিয় ইমতিয়ার শামীম, আপনার সাথে এধরনের যোগাযোগও ভাল লাগছে। আপনার এখনকার যুক্তির সাথে একমত।
আপনার মৌলিক লেখার অপেক্ষায় থাকলাম।
কথার কাজও চলছে। আরো কথা হবে।