ব্রায়ান মুর একটি উপন্যাস লিখেছিলেন ‘দ্য স্টেটমেন্ট’ নামে; যুদ্ধাপরাধী পল ট্রভিয়েরের জীবন ছিল তাঁর সে কাহিনীর ভিত্তি। পরে মুরের ওই পাণ্ডুলিপিকেই নতুন এক রূপ দেন রোমান পোলানস্কির হলোকাস্টভিত্তিক চলচ্চিত্র দ্য পিয়ানিস্ট-এর চিত্রনাট্য লেখক রোনাল্ড হারউড। আর রোনালেন্ডর ওই চিত্রনাট্য নিয়ে পরিচালক নরমান জুইসন নির্মাণ করেন ২০০৩ সালে চলচ্চিত্র ‘দ্য স্টেটমেন্ট’। পল ট্রভিয়ের এখানে যুদ্ধাপরাধী পিয়ের ব্রোসার্ড। ১৯৪০ সালে জার্মান বাহিনী ফ্রান্সের ভিসি শহর দখল করে নেয়ার পর ১৯৪৩ সালে তাদের সহায়তা করার জন্যে ভিসি সরকার মিলিচ নামে একটি আধা-সামরিক বাহিনী গড়ে তোলে; যাদের কাজ ছিল নাজী দখলদারদের বিভিন্ন হুকুম তালিম করা, নানাভাবে সহায়তা করা। পিয়ের ব্রোসার্ড ছিলেন সেই মিলিচ নামের আধা-সামরিক বাহিনীর একজন। তরুণকালের ব্রোসার্ডকে দিয়েই শুরু হয়েছে এ চলচ্চিত্র; দেখি আমরা ১৯৪৪ সালের ফ্রান্সের ডোমবে,- মানুষজনকে রাতের অন্ধকারে ঘর থেকে তুলে আনার কাজে সেখানে নেতাগিরি করছে ব্রোসার্ড, গণহত্যার জন্যে তাদের দাঁড় করাচ্ছে সারিবদ্ধভাবে এবং আদেশ দিচ্ছে ‘ফায়ার’।
এরপরই আমরা দেখি ১৯৯২ সালের ব্রোসার্ডকে। তাঁর বয়স এখন প্রায় ৭০। তাঁর জীবনের একমাত্র সাধনা এখন নিজের অতীতকে লুকিয়ে রাখা। স্যালন ডি প্রোভিন্স-এর একটি মঠে বসবাস করে সে। সংগোপনে বসবাসকারী ব্রোসার্ডের খোরাকী জোগায় ক্যাথলিক চার্চের বন্ধুচক্র, অপরিসীম সহানুভূতি যাদের ব্রোসার্ডের মতো যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি। এইভাবে বেশ ভালোভাবেই বেঁচে থাকে ব্রোসার্ড। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হতেই মার্শাল পিটেইনের নেতৃত্বে গঠিত আধা-সামরিক বাহিনীতে কর্মরত এরকম সব যুদ্ধাপরাধী ফ্রান্স থেকে ভাগতে থাকেন, কেউ কেউ আবার আদালত থেকেও ব্রোসার্ডের মতো পার পেয়ে যান। কেননা রাষ্ট্রকাঠামো ও চার্চের মধ্যে স্থান করে নেয়া সমমনা রাজনৈতিক ও নীতিনির্ধারক ব্যক্তিরা সহায়তা করেন তাদের। ব্রোসার্ডের ক্ষেত্রেও দেখি, অপরাধ করার পরও তাঁর কোনও সাজা হয় না, চার্চের সহায়তায় রাষ্ট্রপতির বিশেষ ক্ষমা পেয়েই আত্মগোপনে চলে যায়, এক মঠ থেকে অন্য মঠে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে ধর্মচর্চায় মন দেয় সে। ধর্মকর্ম করে, অতীত লুকিয়ে রাখে, আর বৃদ্ধ হতে থাকে। অবশ্য যত বৃদ্ধই হোক না কেন, কর্মক্ষমই থাকে ব্রোসার্ড। নিজের গাড়ি নিজে চালায়, দৈনিক গাল কামায় এবং প্রার্থনাও করতে পারে কোনও কষ্ট ছাড়াই। কিন্তু তারপরও বৃদ্ধ সে। মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করা ছাড়া এখন আর কিছুই করার নেই পিয়ের ব্রোসার্ডের।
কিন্তু এরকম এক সময়ে হঠাৎ করেই পাল্টে যায় পিয়ের ব্রোসার্ডের পৃথিবী। মন্টানা বারে প্রতিবারের মতো ১৯৯২-এর এপ্রিলে খোরাকীর টাকাভর্তি খামটি আনার জন্যে গিয়ে একটি বিয়ার নিয়ে চেয়ারে বসে ব্রোসার্ড। তারপর অনুভব করে বিপদের গন্ধ। দ্রুত বেরিয়ে আসেন সে সেখান থেকে খোরাকীর টাকাভর্তি খামটি নিয়ে, গাড়ি চালিয়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা করে তার নিরাপদ ডেরাতে। কিন্তু সেটি সম্ভব নয় বুঝতে পেরে থেমে পড়ে, গাড়ি নষ্ট হয়ে যাওয়া অসহায় যাত্রীর ভান করে দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর পেছনের গাড়িতে থাকা অনুসরণকারীকে হত্যা করে। অনুসরণকারীর কাগজপত্রের মধ্যে সে খুঁজে পায় একটি কাগজ, ‘দ্য স্টেটমেন্ট’ ছাপমারা সেই কাগজে লেখা আছে ‘জাস্টিস ফর দ্য জিউস অব ডোমবে।’
অতীতকে লুকিয়ে রাখার ব্যর্থতা আতঙ্কিত করে তোলে যুদ্ধাপরাধী ব্রোসার্ডকে। এইভাবে দ্যা স্টেটমেন্ট-এর কাহিনীতে থ্রিলারের ছাপ পড়ে, কিন্তু মূল বার্তাটি কিছুতেই নষ্ট হয় না তাতে। আতংকিত ও অরক্ষিত ব্রোসার্ড একদিকে মৃত্যু অন্যদিকে আইনের হাত থেকে বাঁচার জন্যে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পালিয়ে বেড়ায়। কিছুতেই বুঝতে পারে না, এতদিন পরে কেন তার ভাগ্যবিপর্যয় ঘটল।
এদিকে এ ঘটনা ঘটার আগেই মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ আইনের সূত্র ধরে প্যারিসের প্যালেস ডি জাস্টিস-এ আইনের ফাঁক গলে বেঁচে যাওয়া যুদ্ধাপরাধী ব্রোসার্ডের বিচার করার প্রত্যাশায় নতুন তদন- শুরু করেছিলেন বিচারক অ্যানিম্যারি লেভি। পুলিশের তদন্তে যেহেতু ফাঁক ছিল, চার্চ যেহেতু ব্রোসার্ডের সাধারণ ক্ষমার জন্যে ওকালতি করেছিলেন, রাষ্ট্রপতিও যেহেতু ব্রোসার্ডকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন, সেহেতু লেভি অনুমান করেন, এইসব ক্ষেত্রগুলি থেকে তেমন কোনও সাহায্য পাওয়া যাবে না। তাঁর এ-ও মনে হয়, চার্চের এ ধরণের ভূমিকার পেছনে হয়তো অন্য কোনও সংঘবদ্ধ শক্তি রয়েছে এবং জিউস কমান্ডোর ছাপ লাগিয়ে অন্য কেউ চাইছে ব্রোসার্ডকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে। তদন্ত করবেন কি, নতুন পরিস্থিতিতে তাঁর কর্তব্য দাঁড়ায় গুপ্তহত্যার শিকার হওয়ার আগেই ব্রোসার্ডকে রক্ষা করা, নিরাপদ হেফাজতে নেয়া, যাতে ব্রোসার্ডের কাছ থেকে তাঁর অতীত সংযোগগুলির বিভিন্ন তথ্য জেনে নেয়া যায়। পুলিশের কাছ থেকে যথাযথ সাহায্য পাওয়া যাবে না জন্যে লেভি নিজের সহায়তাকারী হিসেবে খুঁজে নেন কর্নেল রক্সকে।
কিন্তু কোথায় আছে ব্রোসার্ড? লেভি তাঁকে খুঁজে পান না। ওদিকে কোনও কোনও শুভানুধ্যায়ী যখন ব্রোসার্ডকে পরামর্শ দেন ধরা দিতে, তখন তিনি সোজাসাপ্টা জানিয়ে দেন, যত কষ্টই হোক, জেলের মধ্যে জীবনের বাকি জীবন কাটিয়ে দেয়ার কোনও ইচ্ছেই নেই তাঁর, তিনি চান চার্চের কোনও যাজক তাঁর পাপমুক্তির ঘোষণা করুক, অ্যাবসলুশান দিক। এদিকে চার্চে কর্মরত এক বন্ধুর মাধ্যমে লেভি জানতে পারেন যে, কার্ডিনাল অব লিওন এক সময় ব্রোসার্ডের অপরাধ তদন্তের জন্যে একটি কমিশন গঠন করেছিল। কিন্তু ওই পর্যন্তই, কেউই সঠিক তথ্য দিতে নারাজ, এমনকি কমিশনের সদস্যরাও। লেভি এবং রক্স যেখানেই যান না কেন, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একটি কথাই জানানো হয়, ওটা তো পুরানো ব্যাপার,- ঠিক যেভাবে আমাদের দেশেও কেউ কেউ বলে থাকে, ওইসব পুরানো কাসুন্দি।
কিন্তু এই অনুসন্ধানযাত্রার মধ্যে দিয়েই বেরিয়ে আসে এসব ঘটনার রাজনৈতিক মাত্রা। আমরা জানতে পারি, ব্রোসার্ডের স্ত্রীর ভাই ছিল কমিউনিস্ট। কমিউনিস্টরা তখন ফ্রান্সে চেষ্টা করছিল নাৎসীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধ গড়ে তোলার। কিন্তু তাতে কী? তথ্যানুসন্ধান করতে আসা রক্সকে এক চার্চের ধর্মযাজক বোঝানোর চেষ্টা করেন, ‘ব্রোসার্ডের কী অপরাধ? ওইসব ইহুদিরা তো কম্যুনিস্ট ছিল! ব্রোসার্ড তাদের পার পেতে দেবে না, সেটাই তো স্বাভাবিক। কম্যুনিস্টরা তো অ্যানার্কিস্ট, কর্নেল। অন্যদিকে ব্রোসার্ড হলো নিবেদিতপ্রাণ খ্রিস্টান।’
এমনকি বিচারক অ্যানিম্যারি লেভিকে পারিবারিক সম্পর্কের সূত্রে ডেকে পাঠান দেশের এক মন্ত্রী। গাঢ় স্বরে তিনি বলতে থাকেন, বন্ধুর মেয়ের এই সাফল্যে তিনি আনন্দিত, কেননা ব্রোসার্ডের এই মামলা লেভির পেশাদারি জীবনের জন্যে একটি বড় অর্জন। মিডিয়ার চোখ এখন লেভির দিকে, ক’জন পায় এমন সাফল্য!
কিন্তু লেভি নিজে তো এ মামলাকে ব্যক্তিগত সাফল্য অর্জনের নিরিখে বিচার করেন না, সোজাসাপটা জানান তিনি, এই ধরণের কথাবার্তা তার ভালো লাগে না। কিন্তু মন্ত্রী বলতে থাকেন, ‘আমি তোমার সঙ্গে কথা বলছি একজন পুরানো পারিবারিক বন্ধু হিসাবে, সরকারের মন্ত্রী হিসেবে নয়।’ তিনি জানিয়ে দেন, ভয়ংকর এক বিপদে পড়তে যাচ্ছেন অ্যানিমেরি। বন্ধুকন্যাকে পরামর্শ দেন তিনি, ‘কেউ তোমার হাতে বিষভরা চ্যালিস (যিশুর শেষ নৈশভোজে ব্যবহৃত পানপাত্র) তুলে দিলে তোমার জন্যে সবচেয়ে ভালো প্রতিদান হবে সেই বিষভরা চ্যালিস তার হাতেই ফিরিয়ে দেয়া।’
অ্যানিমেরিকে মন্ত্রী বলেন, ‘আইন আর রাজনীতির মধ্যে যখন ধাক্কাধাক্কি লাগে, আইন তখন সবসময়েই বাজে পরিণতির দিকে এগোয়।’
অ্যানিমেরি জানতে চান, আর যখন ন্যায়বিচার ও রাজনীতির মধ্যে ধাক্কাধাক্কি লাগে?
মন্ত্রী জানান, একই ব্যাপার ঘটে। তবে আরও বাজে হয় তা।
অতএব তিনি অ্যানিমেরিকে উপদেশ দিতে থাকেন, আমার কথা শোন। তুমি খুব বাজে এক জালে আটকা পড়েছো।
শুনে অ্যানিমেরি জানতে চান, মাকড়শাটা কে? ক্ষিপ্ত মন্ত্রী বলেন, তুমি ধ্বংস হয়ে যাবে, অ্যানিম্যারি।
ধ্বংস অবশ্য হয় না অ্যানিম্যারি। কিন্তু কেউই সাহায্য করে না তাকে। না দেয় তথ্য, না দেয় কোনও সূত্র। তদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ভ্যালেনটিনের মাধ্যমে চার্চের প্রিস্টের মুখোমুখি হয়ে অ্যানিম্যারি যখন বলেন, তাঁকে নির্দেশ দিতে হবে যে কোনও প্রিস্ট, অ্যাবোট অথবা প্রায়োরই ব্রোসার্ডকে আশ্রয় দিতে পারবে না, তখন তিনি খুব শাদামাটা গলায় জানিয়ে দেন, সে আদেশ তিনি দিয়ে-দিয়েছেন। শুনে অ্যানিমেরির সঙ্গী রক্স বলেন, ওই নির্দেশ নিয়ে তাঁদের সন্দেহ রয়েছে, কেননা ব্রোসার্ডকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। হঠাৎ করেই সে যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। অ্যানিমেরি তাকে জানান, এর আগে বিভিন্ন সময় ব্রোসার্ডকে কবে, কখন এবং কোথায় কোথায় থাকতে দেয়া হয়েছে তার প্রতিটি বিবরণ তাঁকে দিতে হবে। যাজক তখন বলেন, এই ক্ষেত্রে তাঁর দুটি দায়িত্ব রয়েছে। একটি দায়িত্ব হলো, এটি সবাইকে নিশ্চিত করা যে, চার্চ মানবাধিকার ক্ষুণ্ন করার দায়ে অভিযুক্ত কাউকে রক্ষা করছে না। দ্বিতীয় দায়িত্বটি হলো, কে তাঁকে (ব্রোসার্ডকে) আশ্রয় দিয়েছে তা খুঁজে বের করা এবং সেটি (আশ্রয় দেয়া) বন্ধ করা। যখন তাঁর বিচারে মনে হবে যে সঠিক সময় এসেছে, তখন অ্যানিম্যারির কাঙ্ক্ষিত সব তথ্যই তাঁকে দেয়া হবে।
অ্যানিম্যারি তাঁকে বলেন, এইসব দায়িত্ববর্ণনার মারপ্যাঁচে তথ্য না দিয়ে বরং তা গোপন করে চেয়ারম্যান ন্যায় বিচারের পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছেন। উত্তরে যাজক জানিয়ে দেন, সে ক্ষেত্রে অ্যানিমেরি চাইলে তাকে গ্রেফতার করতে পারে। এইভাবে যাজক ‘ধর্মেও আছি, জিরাফেও আছি’ অবস্থান নেন। চার্চকে তিনি মুক্ত করতে চান ব্রোসার্ডকে পুষবার গ্লানি থেকে, আবার এটাও চান যে ব্রোসার্ড মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বিচারকারীদের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাক। যতদিন না ব্রোসার্ড চলে যেতে পারবে, ততদিন নীরব থাকার নীতি গ্রহণ করেন তিনি।
কিন্তু অ্যানিম্যারির পক্ষে কি সম্ভব তাঁর নীরবতা ভাঙার জন্যে তাঁকে গ্রেফতার করা? বিশেষ করে তিনি যখন বোঝেন এর অর্থ চার্চকে নাড়িয়ে দেয়া? তারপরও ব্রোসার্ড আছে জানতে পেরে এক মঠে অভিযান চালান তিনি। ধর্মের ঘরে এ ভাবে অভিযান চালানো যায় না, ধর্মের ঘরে কোনও মেয়ে ঢুকতে পারে না বলে তারস্বরে চিৎকার করতে থাকেন অ্যাবোটটির রক্ষক। তাঁর কাছে যখন জানতে চাওয়া হয়, ব্রোসার্ড কোথায়, তখন তিনি ভাবলেশহীন কণ্ঠে জানান, অ্যাসাইলাম সম্পর্কে ধর্মে যা বলা হয়েছে সে-অনুযায়ী তিনি এ প্রশ্নের উত্তর দিতে অক্ষম! এইভাবে চার্চ প্রকারান্তরে ক্রমাগত যুদ্ধাপরাধী ব্রোসার্ডের পক্ষে দাঁড়াতে থাকে।
এসব কথাবার্তা যখন হচ্ছে, ব্রোসার্ড তখন পালাচ্ছে পেছন দরজা দিয়ে!
অ্যানিম্যারির তদন্ত এগুতে থাকে এবং একপর্যায়ে খুব স্পষ্টভাবেই বোঝা যায়, নিজেকে রক্ষার জন্যে ব্রোসার্ডের ওপর থেকে সমর্থন তুলে নিয়েছে পর্দার অন্তরালে থাকা আরও দাগী এক যুদ্ধাপরাধী। সে এখন চায়, আইনপ্রয়োগকারীদের হাতে ধরা পড়ার আগেই ব্রোসার্ড বিদায় নিক পৃথিবী থেকে, যাতে চিরজীবনের জন্যে নিরাপদ হতে পারেন আরও কয়েকজন যুদ্ধাপরাধী। এরকম সমর্থন তুলে নেয়ার পরিণতি যা হয়,- ব্রোসার্ডকে শেষ পর্যন্ত জীবন দিতে হয় তাঁরই পরিচিত ও বিশ্বস্ত একজনের হাতে। অথচ ব্রোসার্ড মনে করেছিলেন, বিশ্বস্ত ওই মানুষটিই তাকে সীমান্ত অতিক্রম করে অন্য একটি দেশে চলে যাওয়ার ব্যাপারে সাহায্য করবে। ব্রোসার্ডকে গুলি করে হত্যার পর সে সটকে পড়ল লাশের ওপর ‘দ্য স্টেটমেন্ট’ ছাপ দেয়া কাগজ রেখে। ‘দ্য স্টেটমেন্ট’ শেষ হয় একটি পার্টির মধ্যে দিয়ে। ওই পার্টিতে আবারও মুখোমুখি হন মন্ত্রী এবং অ্যানিমেরি লেভি। ক্ষিপ্ত অ্যানিম্যারি বলেন বটে, ব্রোসার্ড মারা গেছে বলে মন্ত্রীর মনে করার কারণ নেই যে, সকলেই নিরাপদ; কিন্তু তিনিও জানেন, তাঁর হাতে এমন কোনও তুরুপ আপাতত নেই যা দিয়ে তিনি যুদ্ধাপরাধীদের কাউকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেন।
দুই.
‘দ্য স্টেটমেন্ট’-এ যেমনটি দেখছি, তার সঙ্গে তেমন বড় কোনও পার্থক্য কি রয়েছে এ-বাংলাদেশের? যারা মতিউর রহমান নিজামী, মুজাহিদ, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী, মঈনউদ্দীন, আশরাফদের মতো যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে ওকালতি করছেন, তাদেরও বলতে শোনা যাচ্ছে, ওদের কোনও অপরাধ নেই, মুক্তিযুদ্ধের সময় তারা যা করেছেন, তা তাদের রাজনৈতিক অবস্থান, তাদের মনে হয়েছিল ভারতের হাতে ‘দেশ’ চলে যাচ্ছে, তাই তারা সাহায্য করেছে পাকিস্তানি খানসেনাদের।
কী অদ্ভূত কথা,- কোটি কোটি মানুষের কাছে মনে হলো ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে, কেবল এই গোলাম আযম থেকে চৌধুরী মঈনউদ্দীন আর আশরাফরাই বুঝতে পারল যে, ভারত পাকিস্তানকে দুই ভাগ করছে! কেবল মঈনউদ্দীন আর আশরাফদেরই মনে হলো, শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীরা বাঙ্গালি, কমিউনিস্ট, ভারতের দালাল; অতএব, তাদের খুন করে রায়ের বাজারের বধ্যভূমিতে ফেলে রাখা হোক! এখন আবার শোনা যাচ্ছে গোলাম আযম নাকি স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে বিশেষ করে একাত্তরের স্মৃতিই ভুলে গেছেন! অতএব পালের গোদাকে আপনি কখনোই পারবেন না জিজ্ঞাসাবাদ করতে, কেননা স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়া রোগীকে তো জিজ্ঞাসাবাদ করা ঠিক নয়! তবে স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়ার আগেই তিনি নাকি যুদ্ধাপরাধী বিচার ইস্যুটির বিরোধিতা করে একটি বুকলেট লিখে গেছেন, যা পৌঁছে দেয়া হচ্ছে কোটি কোটি মানুষের কাছে।
এইসব যুদ্ধাপরাধীরা যুদ্ধাপরাধ করার জন্যে ধর্মজ রাজনীতির বর্ম পরেছিল, এখন ওই একই বর্মটি পরেছে নিজেদের সুরক্ষিত করতে। শুধু তাই নয়, গত তিন যুগ ধরে তারা ধর্মজ রাজনীতির বর্মটি পরিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের হাজার হাজার নতুন বালক ও তরুণের গায়ে,- যাতে কখনও বিচারের মুখোমুখি হলে এসব বালক ও তরুণরা কথিত আদর্শবোধের টানে ছুটে আসে তাদের রক্ষা করতে। প্রায়ই আমাদের বলা হয়, ‘যারা যুদ্ধের পর জামায়াতে ইসলামী কিংবা ইসলামী ছাত্র শিবির করছে, তাদের তো কোনও দোষ নেই, তারা তো এ দেশেরই সন্তান। তারা তো রাজাকার, আলবদর অথবা আলশামস নয়।’ এরা বলছেন না, জন্মসূত্রে এরা এ-দেশের সন্তান হলেও যে-রাজনৈতিক চেতনা তারা ধারণ করছে, তা যুদ্ধাপরাধীদের রাজনৈতিক চেতনা এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পাশাপাশি ওই রাজনৈতিক চেতনাধারীদের বিরুদ্ধেও। তাই যে-চেতনা রাষ্ট্রগঠনের শুরুতেই একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে নাকচ করে দেয়া হয়েছে, সেই রাজনৈতিক চেতনায় রাজনীতি করার অর্থ নতুন কোনও যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত করার প্রস্তুতি নেয়া।
এবং আমরা দেখেছি, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র শিবির ১৯৭১ সালের রাজনৈতিকবোধের জায়গায় দাঁড়িয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, মহাবিদ্যালয়ে একের পর এক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছে, হাত-পায়ের রগ কেটেছে, মাথা ও হাতের মধ্যে ড্রিলিং মেশিন দিয়ে ড্রিল করেছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লতিফ হলকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে আমাদের সামনে তাদের যুদ্ধপ্রস্তুতির উদাহরণও রেখেছে। প্রতীকীঅর্থে এসবও যুদ্ধাপরাধই বটে। তারা চাইছে ১৯৭১-এর মতোই সশস্ত্র ও রক্তাক্ত উপায়ে ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনাকে হত্যা করতে, নির্মূল করতে। স্বাধীন দেশে ড. আবু তাহেরকে হত্যাকারী ইসলামী ছাত্র শিবিরের নেতা সালেহ-কে তো নতুন এক যুদ্ধাপরাধীই বলতে হয়, কেননা সে-যে রাজনৈতিক বোধ থেকে কাজ করে চলেছে, সেই রাজনৈতিক বোধের সঙ্গে ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধী চৌধুরী মঈনউদ্দীন ও আশরাফদের রাজনৈতিক বোধের কোনও পার্থক্য নেই।
সময় এসেছে মুক্ত বাংলাদেশে গত ৩৮ বছর ধরে সংঘটিত জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র শিবিরের এই সব নতুন নতুন অপরাধগুলির তথ্যসমূহও সংগ্রহ ও সংকলিত করার, কাঠগড়ায় দাঁড় করার। নিছক রাজনৈতিক সন্ত্রাস হিসেবে এসব অপরাধগুলিকে দেখার কোনও কারণ নেই। সিনেমার অ্যানিম্যারির হাতে এমন কোনও প্রামাণিক উপাদান ছিল না, যা দিয়ে তিনি যুদ্ধাপরাধীদের মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ আইনের আওতায় আনবেন। কিন্তু আমাদের জন্যে আশাব্যঞ্জক ঘটনা হলো, তেমন অনেক প্রমাণ এমনকি সংগৃহীতই হয়ে আছে আমাদের, এমনকি বিচার করার মতো একটি যথোপযুক্ত আইনও রয়েছে এ-দেশটিতে। অবশ্য নিরাশার দিকও আছে; এখানেও মন্ত্রী থেকে শুরু করে অনেক রাজনীতিক আছেন, যারা যুদ্ধাপরাধীদের প্রশ্রয় দিচ্ছেন, যুদ্ধাপরাধীদের পাশাপাশি তারাও চাইছেন আইন ও রাজনীতির মধ্যে, ন্যায় বিচার ও রাজনীতির মধ্যে একটা ধাক্কাধাক্কি লাগুক। ওই ধাক্কাধাক্কিটি ঠিকমতো লাগাতে পারলেই মাঠে মারা যাবে যুদ্ধাপরাধ বিচারের প্রক্রিয়াটি এবং তার বদলে সম্ভব হবে নতুন রূপে এমন একটি দলকে সর্বস্তরে প্রতিস্থাপন করা, যাদের মাথার মধ্যে গিজগিজ করছে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের কথিত রাজনৈতিক মূল্যবোধ ও নীতি।
এই নিরাশার দিক রয়েছে বলেই, আমরা মনে করি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হতেই হবে। কেননা এই বিচারের মধ্যে দিয়েই কেবল সম্ভব আমাদের যুথবদ্ধ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আশাবাদী মননটিকে জাগিয়ে তোলা, সম্ভব মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধসমূহের শাস্তি দেয়া, সম্ভব পুরানো মগজ নিয়ে নতুন করে বেড়ে ওঠা যুদ্ধাপরাধ-প্রবণ রাজনৈতিক শক্তিকে দুর্বল করার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও আইনগত ভিত্তি সুদৃঢ় করা।