খুব বেশিদিন আগের কথা নয়।
আমাদের সরকারের পুরানো এক উপদেষ্টা গীতিআরা সাফিয়া চৌধুরী পাটশিল্প নিয়ে “জেহাদ” করেছিলেন। হ্যাঁ, ঠিক এই কথাগুলিই বলেছিলেন তিনি। বলেছিলেন, জুট নিয়ে তিনি জেহাদ শুরু করেছেন। জুলাই ২০০৭-এর মাঝামাঝি, বাংলাদেশের শ্রমিকরা যখন প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ ও দিশাহারা একের পর এক জুটমিলগুলিতে লে-অফ ও শ্রমিকছাটাইয়ের দৌরাত্মে, তখন তিনি একদিন বস্ত্র ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের এক সাংবাদিক সম্মেলনে সুশীল ভদ্রতাসমেত জানিয়েছিলেন, পাট খাতকে বাঁচানোর জন্যে তারা নাকি তিন বছর মেয়াদী এক কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন। তা বাঁচানোর কায়দাটা কি? না, খুবই সোজা। শ্রমিকদের পেটে লাথি দিয়ে বলা, যা, ভাগ এবার, তোদের ভাত তোরা জোটা।
শ্রমিকদের ভাত অবশ্য শ্রমিকরাই জোটায়। এমন নয়, তারা বসে থাকে, আর সরকার তাদের বেতন গোণে। কিন্তু সেই কাজের পথও বন্ধ করে দেয়ার পথ বানাচ্ছিলেন তারা। কেননা তা না হলে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ-এর কাছে তাদের মুখ রক্ষা হয় না, দু চারটে পাটকল পানির দামে কিনে নিজের সম্পত্তি বানানো যায় না। আর সেজন্যেই সেদিনের ওই সম্মেলনে ঘোষণা করা হয়েছিল, পর্যায়ক্রমে ২২টি পাটকল বন্ধ করে দেয়া হবে। পাটশিল্প বাঁচানোর এই মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে আরও প্রায় আট হাজার শ্রমিককে ছাটাই করা হবে। গীতিআরা সাফি সেদিন বলেছিলেন, ‘আমি জুটের জন্যে জ্বেহাদ ঘোষণা করেছিলাম। এই জ্বেহাদে মনে হচ্ছে আমরা কিছুটা হলেও সফল হয়েছি। বাকিটুকু মনে হয় আল্লাহর রহমত থাকলে এবং আমাদের সবার প্রচেষ্টা থাকলে আমরা নিশ্চয়ই পারব।‘
গীতিআরা সাফিয়া চৌধুরী নিমিত্তমাত্র। তবে যাদের হয়ে তিনি সেই জেহাদ শুরু করেছিলেন, তাদের স্বপ্ন পুরো হয়েছে।
আর এর মধ্যে দিয়ে রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্র যাদের স্বার্থ দেখে থাকেন, তারা অনেক কিছুই অর্জন করেছেন, সন্দেহ নেই।
কিন্তু শ্রমিকরা – তারা কী অর্জন করেছে?
তারা অর্জন করেছে বেকারত্ব, তারা অর্জন করেছে আরও ক্ষুধা, তারা অর্জন করেছে আশাহীন, অনিশ্চিত এবং মৃত্যুর মতো কষ্টকর প্রতিটি মুহূর্ত।
সব সময় তাদের ওপরেই দায় চাপানোর অপচেষ্টা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, শ্রমিক আন্দোলনের কারণেই নাকি শিল্পগুলোর এই বিপর্যয়। কিন্তু এই পাটশিল্পগুলির কথাই ধরা যাক; গীতি আরা সাফিয়া নিজেই ওই সম্মেলনে বলেছিলেন, “২০০৬ সালের জুন পর্যন্ত সরকারি পাটকলগুলিতে লোকসানের পরিমাণ চার হাজার ৭৭০ কোটি টাকা। প্রতি বছর ২২টি পাটকল ৪২১ কোটি টাকা লোকসান দেয়। এর মধ্যে ১৪০ কোটি টাকা লোকসান হয় যথাসময়ে পাট কিনতে না পারার কারণে। আর শ্রমিক অসন্তোষের কারণে লোকসান হয় ৩০ কোটি টাকা।“
আমাদের সরকারি নীতিনির্ধারকদের বোঝা উচিত, যে–সব পাটকলগুলোর উচ্চ পর্যায়ের বিজ্ঞ, জ্ঞানী ও নীতিনির্ধারক লোকজনের কারণে প্রায় চারশ কোটি টাকার লোকসান হয়, সেসব পাটকলে শ্রমিক অসন্তোষ থাকাটাই স্বাভাবিক এবং সেকারণে মাত্র ৩০ কোটি টাকার লোকসান হওয়াটা খুব ন্যায়সঙ্গত। মূলত এই ৩০ কোটি টাকা লোকসানের জন্যে শ্রমিক অসন্তোষও দায়ী নয়, এ ৩০ কোটি টাকা হলো নীতিনির্ধারকদের ওই প্রায় চারশ কোটি টাকা লোকসানের জের।
মিলগুলি বন্ধ করে দেয়ায় শ্রমিকরা পথে বসেছিলেন, তাদের জন্যে লঙ্গরখানা খোলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন সুশীল সমাজের একাংশ। সরকার এতে বাধা দেয়, কেননা এর মধ্যে দিয়ে তাদের সেই চিরাচরিত ভাবমূর্তি নষ্ট হওয়ার সমূহ কারণ ছিল। তবে সুশীল সমাজের এই একাংশ তাদের সাময়িক উত্তেজনার বশে যাই করুক না কেন, অচিরেই বুঝতে পারেন ঐতিহাসিক কারণেই তাদের পক্ষে এরকম কর্মসূচি এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় এবং এ উদ্যোগ থেকে তারা সরিয়ে নেন নিজেদের।
কাজ হারানো যেসব শ্রমিকরা যে আন্দোলন করছে, তার সঙ্গে কোনও না কোনওভাবে নিশ্চয়ই রাজনৈতিক দলগুলোর সংযোগ রয়েছে। কিন্তু তারপরও বোঝা যায়, তারা আসলে সর্বাত্মক কিছু করার চেষ্টা চালাননি। দায়সারাভাবে বিবৃতি দিয়েছেন, কথা বলেছেন, শ্রমিকদের সমাবেশে গেছেন। একটি দেশে সামরিক শাসন চলাকালীন অবস্থায় এরকম কিছু হলে ওই ঘটনাকে অবলম্বন করে সেদেশে বড় ধরনের রাজনৈতিক মোর্চা গড়ে ওঠে। কিন্তু এবার বাংলাদেশে সেরকম কোনও কিছুও হয়নি। কেননা রাজনৈতিক দলগুলি, তা আওয়ামী লীগ বা বিএনপি কিংবা মুখচেনা বামসংগঠন যেটাই হোক না কেন, ভানুর কৌতুকের গৃহকর্তার মতো অপেক্ষা করছিলেন আর ভাবছিলেন, দেখি কী করে!
অতএব যা হওয়ার তাই হলো। গরু মেরে জুতো দানের মতো করে মিলগুলি বন্ধ করে শ্রমিকদের ভবিষ্যতে বকেয়া বেতন দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হলো। এর মধ্যে আগস্ট ২০০৭-এর দ্বিতীয় সপ্তাহে চট্টগ্রাম আমিন জুটমিলের শ্রমিকরা বকেয়া বেতনের দাবিতে রাস্তায় নামলো। পুলিশ গুলি চালালো, বকেয়া বেতন পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দিয়ে অসহায় শ্রমিকদের বাধ্য করল কাজে ফিরতে এবং ১০ আগস্ট পরম করুণাময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নামে বিক্ষোভের সময় একজনকে হত্যার অভিযোগ এনে ৬০০ জন শ্রমিকের নামে মামলা ঠুকে দিল।
আমাদের পরম করুণাময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আরও সামান্য করুণা বর্ষিত হলো কয়েকদিন পর আগস্ট বিক্ষোভের সময় ঢাকা শহরে। সরকারের কর্পোরেট মিডিয়াগুলি লিখতে লাগল, জনমনে কোনও বিক্ষোভ নেই, কোথাও কোনও বিক্ষোভ নেই, সামান্য একটু খেদ আছে দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধি নিয়ে!
কিন্তু মানুষের মনে যে কী প্রচণ্ড ক্ষোভ জমেছিল, এখনও জমে আছে, তা কৃষক আর শ্রমিকরা এই দু’বছরে যেসব বিক্ষোভ মিছিল করেছে সেগুলির দিকে চোখ বুলালেই বোঝা যায়। কৃষকরা বিক্ষোভ করেছে সার নিয়ে, ক্ষুব্ধ হয়েছে সরকার হাটবাজার ভেঙে দেয়াতে, শ্রমিকরা ক্ষুব্ধ হয়েছে ও বিক্ষোভ করেছে জীবনধারণের ন্যুনতম মজুরিও তাদের দেয়া হয় না বলে। নির্মম সত্য হলো, আমাদের শহুরে মধ্যবিত্ত নাগরিকরা যদি এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রেমে না পড়তেন, তা হলে তারা নিজেরাই অনেক আগে এসব ক্ষোভ-বিক্ষোভকে বড় করে প্রচার করে বেড়াতেন।
যেসব শ্রমিকদের পরম করুণাময় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বকেয়া বেতন দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে কর্মহীন করেছিলেন, মিলকারখানা বন্ধ করে দিয়েছিলেন সেই শ্রমিকদের বকেয়া বেতন এখনও মিটিয়ে দেয়া হয়নি। তাঁরা তাই আত্মাহুতি দেয়ার চেষ্টা চালিয়েছিলেন কয়েকদিন আগে। কিন্তু পুলিশ পাঠিয়ে তাদের আত্মাহুতিদানে বাধা দেয়া হয়েছে। কেননা রাষ্ট্র এদের বাঁচিয়ে রাখতে চায়, এদের মৃত্যুকে উপভোগ করতে চায় রসিয়ে রসিয়ে।
চীন থেকে আমাদের বন্ধু শিল্পী রশিদ আমিন ত্বড়িৎ–ডাক পাঠিয়েছেন : নেট খুলে পত্রিকায় ওই ছবি দেখে আমার কেবলই কান্না পাচ্ছে। আপনারা এটা নিয়ে কিছু একটা লিখুন।
তিনি লিখতে পারতেন, আপনারা একটা কিছু করুন। কিন্তু তিনি তা লেখেননি। আমাদের সীমিত সামর্থ্য ও শক্তি তাঁর জানা আছে, যেমন নিজের সামর্থ্যটুকুও।
সত্য কথা হলো, এই নিয়ে দিনের পর দিন লেখা হয়েছে। সামরিক জান্তা এরশাদের বিরুদ্ধে যখন আন্দোলন শুরু হয়, আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ গড়ে ওঠে, তখন বাংলাদেশের সব মানুষের একটি অন্যতম দাবি ছিল বিরাষ্ট্রীয়করণ বন্ধ করতে হবে। কেবল শিল্পকারখানার নয়, ব্যাংকেরও বটে।
তারপর আমরা গণতন্ত্র পেলাম। গণতন্ত্র তো নয়, পেলাম গণতান্ত্রিক বিরাষ্ট্রীয়করণের জোয়ার। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগ আর বিএনপি বিরাষ্ট্রীয়করণের বিরুদ্ধে ছিল, তারাই পালাক্রমে হয়ে উঠল এই বিরাষ্ট্রীয়করণের ঘোড়সওয়ার। তবুও দেশের সামরিকতন্ত্র আর সুশীলতন্ত্র তাদের ওপর খুব ক্ষেপে উঠল, কেননা ওই ঘোড়াটিকে তারা ঠিকমতো চালাতে পারছিলেন না। তারা মুহাম্মদ ইউনূসকে কাণ্ডারি করতে চাইলেন, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে শুরু করে খনিজ ও গ্যাসসম্পদ সবকিছু বিকিয়ে দিতে চাইলেন, নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের আওয়াজ তুললেন, সেই আওয়াজে তেমন সাড়া মিলছে না দেখে রাজনৈতিক দল সংস্কারের বাহানা তুললেন। কিন্তু সেটিও বেশ ঝুঁকিপূর্ণ বলে এখন তারা বেছে নিয়েছেন দুই নেত্রীকে এক আলোচনায় বসাতে।
কী চান তারা দুই নেত্রীকে এক করে?
বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ আর বিএনপি, এই দুটি রাজনৈতিক দলের শ্রেণীচরিত্রই এক, অর্থনৈতিক কর্মসূচিও এক, রাজনৈতিক লক্ষ্যও এক। কিন্তু তারপরও তাদের মধ্যেকার দূরত্বটি কোথায় যে বার বার দু নেত্রীকে একসঙ্গে করার জন্যে কেউ কেউ ছুটোছুটি করতে থাকেন?
দূরত্ব কিছু অবশ্যই আছে এ দুই রাজনৈতিক দলের। মার্কসের একটি মন্তব্য পড়েছিলাম, কোনও কোনও সময় মুখ্য রোগের চেয়ে গৌণ রোগই অনেক বেশি মুখ্য হয়ে উঠতে পারে। এ দুটি দলের পরস্পরবিরোধীতার মধ্যে দিয়ে তার সেই মন্তব্যের রূপটিই প্রকাশিত হয়েছে। আমাদের বামদের একটি অন্যতম দুর্বলতা হলো, একই শ্রেণীগোষ্ঠীর স্বার্থসংরক্ষণকারী এ দুটি দলের এই বিরোধাত্মক, দূরত্বময় রোগক্ষিপ্ত দিকটিকে তারা কখনোই কাজে লাগাতে পারেননি; বরং জনগণের কাছে “এ দুটি দলের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই“,- এই কথাটি বার বার বলতে বলতে যে পরিমাণ ফেনা জমা করেছেন, সেই ফেনার তরঙ্গে নিজেরাই হাবুডুবু খাচ্ছেন।
কিন্তু রাষ্ট্রসংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকরা দীর্ঘ এক পথপরিক্রমার মধ্যে দিয়ে এই সিদ্ধান্তে এসেছেন, এদের যে দূরত্ব রয়েছে তাতে অবশ্যই প্রলেপ দিতে হবে। প্রলেপ দিতে না পারলে, আর যাই হোক না কেন, নির্ধারিত নীতিগুলি ও দায়িত্বগুলি বাস্তবায়ন করা যাবে না।
কী হবে দুই নেত্রী একসঙ্গে বসলে?
কী আর হবে! তারা একটি জাতীয় সনদ প্রণয়ন করবেন, যা দেশের সম্পদ বিকিয়ে দেয়ার সহায়ক হবে, যা বিরাষ্ট্রীয়করণের সহায়ক হবে, যা সেনাবাহিনীর ভূমিকার স্বীকৃতি দেবে।
ওনারা যতই বুর্জোয়া দল হোক না কেন, নিজের নাক কেটে অপরের যাত্রা ভঙ্গ করতে পারেন। অতএব কেউ যাতে কারও যাত্রা ভঙ্গ করতে না পারে, সেজন্যেই প্রয়োজন ওনাদের একসঙ্গে করা। মানে সোজা কথা হলো, পরম করুণাময় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বলতে চাইছেন, যে-ই ক্ষমতায় আসতে চান না কেন, তাদের এইসব রোডম্যাপের দায়ভার নিতে হবে এবং আরেকজনকে তার বিরোধিতা করা চলবে না কিছুতেই।
ওদিকে সুশীলদের পার্লামেন্ট মিডিয়াগুলিকে দেখুন – যে কলামিস্ট আর সাংবাদিকরা কয়েক মাস আগে এই দু’নেত্রীকে মাইনাস করার জন্যে গলা জলে নেমেছিল, তারা এখন লাফ দিয়ে ডাঙায় উঠে কর্পোরেট চাদর দিয়ে হাতপা মুছে আবার দু’নেত্রীকে আলোচনার টেবিলে আনার জন্যে হাঁটু মাজতে শুরু করেছে। একটি দৈনিক সংবাদপত্রে পড়লাম, বাহাত্তরে পাওয়া এক বুদ্ধিজীবী লিখেছেন, “বাহাত্তুরে পাওয়া লোকজনকে দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না, বড়জোর সামন্ততান্ত্রিক গণতন্ত্র নামক এক স্তাবকতামূলক নতুন শাসনব্যবস্থা পাওয়া যায়।“ কী চমৎকার ব্যাপার, বাহাত্তুরে পাওয়া একজন গালাগালি করছে বাহাত্তুরে পাওয়া আর সবাইকে!
আর তরুণ নাগরিক বুদ্ধিজীবীরাও কম যাচ্ছেন না এইসব ব্যাপারে। পঞ্চাশের দশক থেকে শুরু করে আশির দশক এমনকি নব্বইয়ের দশকেও প্রতিবাদী তরুণদের আমরা দেখেছি রাজনীতিমুখী হতে। কিন্তু এই সুশীল নাগরিক তরুণ গোষ্ঠী রাজনীতিমুখী নন, তারা নিরপেক্ষ। তারা নিরপেক্ষতার অমীয় বাণীর নামে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, বামদল সবাইকে দায়দায়িত্বহীনভাবে সমালোচনা করতে পারেন। জরুরি অবস্থা জারি হওয়ার আগে এরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে নম্র স্বরে রাজনৈতিক দলগুলোকে সংযমী করে তোলার মহান আহ্বান জানিয়েছিলেন। জরুরি অবস্থা জারি হওয়ার পর এদের কেউ কেউ লিখেছিলেন, দু’নেত্রীকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে ভাসিয়ে দিলেও নাকি এ দেশের লোকজন কোনও কিছু মনে করতো না। আবার এতদিনে এদের গোত্রীয়ই কাউকে কাউকে লিখতে দেখা যাচ্ছে, “এই নেত্রী দুজন জনগণের নেত্রী। এবং সেজন্যে জনমতকে অবশ্যই সম্মান দেখাতে হবে। আর বাংলাদেশের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তাদের ত্যাগ আর অবদানকেও শ্রদ্ধার সঙ্গে সম্মান করতে হবে।“
এই জন্যেই আহমদ ছফা লিখেছিলেন, বুদ্ধিজীবীরা যা বলতেন, তা শুনলে দেশ স্বাধীন হতো না আর যা বলছেন তা শুনলে এখন দেশ গড়ে তোলা যাবে না।
পাটকলের এই শ্রমিকরা মরতে চায়, কেননা তাদের কাজ নেই, আর তাদের বকেয়া ২৫ কোটি টাকা দেব দেব করেও না দেয়ার ধান্ধা করা হচ্ছে।
আদমজীর মতো বিশাল একটি পাটকল আমাদের চোখের সামনে দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আমরা কতটুকু প্রতিবাদ করতে পেরেছি বলুন। আর এতো মাত্র ২৫ কোটি টাকা! এ টাকা মেরে দেয়া কোনও ব্যাপার হলো নাকি?
পাটকলের কর্মহীন শ্রমিকরা তাদের কর্মসূচি আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বন্ধ রেখেছেন। আবারও তারা আশায় বুক বেধেছেন।
কিন্তু কতক্ষণ আশায় বুক বেধে থাকবেন?
সরকারের পাট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা আনোয়ারুল ইকবাল বলেছেন, ২৭ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সব বকেয়া শোধ করে দেবেন; অথচ বিজেএমসি খুলনা এলাকার সমন্বয়কারী আর সি পাল সাংবাদিকদের কাছে বলছেন, এমন কোনও সিদ্ধান্তের কথা তার জানা নেই।
এই হলো তাদের বকেয়াপ্রাপ্তির ভবিষ্যত।
আমি জানি, কোনও সুশীল কিংবা তরুণ সুশীল বলতে পারেন, চলেন, আমরা একটি তহবিল করি; যাতে ওদের মুখে সামনের ঈদের সময় হাসি ফোটে, ওরা ওদের সন্তানদের কিছু কিনে দিতে পারে!
ভারী উত্তম প্রস্তাব, চলুন আমরা তাই করি। আর এই তহবিল সংগ্রহের জন্যে চলুন কোনও আলোকিত মানুষকে দিয়ে জাতির প্রতি আহ্বান জানিয়ে একটি কলাম লেখাই। চলুন, মুষ্ঠি মুষ্ঠি ভিক্ষা দিয়ে দারিদ্র দূর করি। আর যদি হুড়োহুড়ি শুরু করে, অসুবিধা কী? আমাদের র-একশন ব্যাটিলিয়নের ভাইরা আছেন, তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসবেন।
হ্যাঁ, এসবই জরুরি, জরুরি তাদের খাদ্যের ব্যবস্থা করা, বকেয়া আদায় করা,- কিন্তু পুরো প্রক্রিয়াটিই যে শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক, পুরো কাজটিই যে শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক, এই কথাটি বার বার কেন আমরা ভুলে যাচ্ছি? বিভিন্নজন বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে কাজ করছেন, তার জন্যে আমাদের কোনও আক্ষেপ নেই। কিন্তু কেন আমরা ভাবছি না তরুণ প্রজন্ম থেকে শুরু করে সবাইকে আসলে রাজনৈতিকভাবেই সংগঠিত হতে হবে? অমুক সভা, তমুক সভা, অমুক সমাজ, তমুক সমাজ, অমুক ফোরাম, তমুক ফোরামের মধ্যে দিয়ে এ নিয়ে আমরা অনেক কথাই বলতে পারি, কিছুদূর এগুতে পারি, কিন্তু কাজটি শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক বলেই সেসব উদ্যোগ এক সময় মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য।
আমরা কি সত্যিই শক্তিহীন হয়ে গেছি? আমরা কি পারি না রাজনৈতিকভাবে এইসব রাজনৈতিক অপতৎপরতার বিরুদ্ধে সংগঠিত হতে?
আমরা কি পারি না আরও একবার একসঙ্গে জ্বলে উঠতে?
