১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগ থেকে চট্টগ্রামে বেশ কিছু ঘটনার সুত্রপাত হয়েছিল যার ব্যাখ্যা বিভিন্ন লেখকের কাছ থেকে ভিন্ন ভিন্ন রূপে এসেছে। সবাই সত্য বলেননি এটা নিশ্চিত। আবার কে মিথ্যা বলেছেন সেটা বের করাও দুষ্কর। আমি বেশ কিছুদিন যাবত এটা নিয়ে খুব দ্বন্দ্বে আছি। দ্বন্দ্ব নিরসনের জন্য যে পরিমান পড়াশোনা করা দরকার সেই পরিমান বইপত্র পাচ্ছি না। ইতিহাস পাঠে সাধারণত রাজনীতিবিদগণের বই এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করি। কেননা বাংলাদেশের রাজনীতিবিদগনের মধ্যে কৃতিত্ব ছিনতাই এবং অহেতুক বাহাদুরি ফলানোর ঐতিহ্য খুব জোরদার। আমার খুব ঘনিষ্ট রাজনীতিবিদ আত্মীয় যিনি মুক্তিযুদ্ধের বড় রকমের সুফল ভোগ করেছেন, কিন্তু কোন যুদ্ধের কাছ দিয়েও যাননি, অথচ সার্টিফিকেটে তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। এই ব্যাপারটা বাইরের কেউ জানে না, আমরা পরিবারের লোকজনই জানি। সেরকম লোক আরো দেখেছি বেশ কাছ থেকেই। তাদের অনেক কথাকে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি।
তাই মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক নির্ভরযোগ্য তথ্যের জন্য অরাজনৈতিক ব্যক্তিকেই খুঁজি প্রথমে। যেমন একদম সাদামাটা বই লিখেছেন মাহবুবুল আলম। তাঁর বইয়ের সবগুলো তথ্য সঠিক না, কিন্তু প্রচুর তথ্যে ঠাসা। ক্রস রেফারেন্স দিয়ে সেই তথ্যগুলো যাচাই করে কিছু না কিছু সারবস্তু বের করা যায়। তাঁর বইটা আসলে ব্যক্তিগত ডায়েরীর একটা বৃহৎ সংকলন বলা যায়। বইটার নাম – ‘রক্ত আগুন অশ্রুজল: স্বাধীনতা’। এরপর পাই বেগম মুশতারী শফির ডায়েরী স্বাধীনতা আমার রক্ত ঝরা দিন। জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলোর মতোই তথ্যসমৃদ্ধ একটা বই। এই বইতে অনেক গুরুত্বপূর্ন এবং গুরুতর তথ্য আছে যা আমাদের অনেক পূর্বধারণা ভেঙ্গে দেয়। বেলাল মোহাম্মদের ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ বইটিও ইতিহাসের আরেক দলিল। জিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণার বিশদ তথ্য এই বইটিতে আছে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ছাড়াও আরো কিছু ভিন্ন রকম তথ্য আছে বইটিতে। আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয় ‘মাহমুদ হোসেন’ নামের এক রহস্যময় ব্যক্তির সাথে। এই মাহমুদ হোসেনের কথা উল্লেখ করেছেন মেজর রফিকুল ইসলামও। একাত্তরের ২৬শে মার্চ রাতে এই লোক চট্টগ্রাম বেতারে ঢুকে অনুষ্ঠান বা ঘোষণা প্রচার করেছিল। এই মাহমুদ হোসেনের গাড়ি নিয়ে বেলাল মোহাম্মদ মেজর জিয়াকে খুঁজে বের করেন। লোকটা কক্সবাজার যাবার পথে জনতার হাতে পড়ে মারা যাওয়ায় রহস্যের কোন কূল কিনারা হয়নি।
আরো কিছু বই আছে চট্টগ্রামের মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলী নিয়ে কিন্তু সবগুলো বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। যেমন সিরু বাঙালীর ‘সেনাপতির মুক্তিযুদ্ধ ছিনতাই’। এই বইতে কিছু তথ্য থাকলেও অনেক ঘটনার বর্ননাকে বাড়াবাড়ি মনে হয়েছে। সস্তা স্টান্টবাজি ধরণের বর্ণনা। তাছাড়া ঘটনার পুনারাবৃত্তির দোষে দুষ্ট বইটি। তবে মেজর(অব) রফিকুল ইসলামের লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে বিশ্বাসযোগ্য একটা বই বলে আমার ব্যক্তিগত ধারণা। কিন্তু সেই বইতেও দুজনের লোকের অবস্থান সম্পর্কে স্পষ্ট কোন ধারণা পাইনি। লে.কর্নেল এম আর চৌধুরী এবং ব্রিগেডিয়ার মজুমদার। একজন যুদ্ধের শুরুতে মারা যান, আরেকজনকে যুদ্ধের ঠিক আগে সরিয়ে দেয়া হয় চট্টগ্রাম থেকে।
সম্প্রতি আরেকটি বই পড়লাম। ভদ্রলোক সম্পর্কে আমার কোনরকম জানাশোনা নেই, অথচ তাঁর বইতে চমকে ওঠার মতো অনেক তথ্য পেয়েছি। তথ্যগুলো বিশ্বাস করা যায় কিনা, কতটা বিশ্বাস করা উচিত বুঝতে পারছি না। ভদ্রলোকের নাম এনায়েত মওলা, বইটির নাম “মুক্তিযুদ্ধের ভিন্নছবি- চট্টগ্রামের কাকলী”। বইটি পড়ে আমি বেশ কিছু সময় মানসিক অস্থিরতায় কাটিয়েছি। ভদ্রলোক মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করলেও মুক্তিযোদ্ধা শব্দটিতে অ্যালার্জি আছে। কারণটা বলেননি। কিন্তু তিনি মুক্তিযোদ্ধা না বলে ‘ছেলেরা’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন সমস্ত বই জুড়ে। বইটাকে বিশ্বাস করলে অনেক কিছুর উপর অবিশ্বাস আসে, আবার বইটা নিয়ে বিভিন্ন রেফারেন্স পড়ে অবিশ্বাসও করতে পারছি না। কে কতটা সত্যি বলছে সেটা নির্ভর করে ব্যক্তির রাজনৈতিক অবস্থানের উপর। যদিও ভদ্রলোক বলেছেন তিনি রাজনৈতিক নিরপেক্ষ লোক, কিন্তু আসলে সেটা কি সম্ভব? বইটার মধ্যে মাথাব্যথা হবার মতো বেশ কিছু উপাদান আছে যার সত্যতা যাচাই করার জন্য আমার অনেক বই পড়া দরকার। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চট্টগ্রামের এত বই পড়েও এনায়েত মওলার কোন হদিস পাইনি কেন বুঝলাম না। তার বাড়ি কাকলীর কথা উঠে এসেছে নানান জায়গায় কিন্তু তাঁকে আড়াল করে রাখা হয়েছে কেন বুঝলাম না। কোথাও কি সমস্যা ছিল? নাসিরাবাদ এলাকায় বর্তমানে ওয়াইএমসিএ বাড়িটাই সেই কাকলী। এই বাড়ি যে চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় ছিল সেটা বলেছে অনেকে। অপারেশান জ্যাকপটে নৌকমাণ্ডোরা ওই বাড়িতে উঠেছিল। ওই বাড়ির মালিক ছিলেন এনায়েত মওলা। ভদ্রলোক পাকিস্তানীদের ফাঁকি দিয়ে পুরো সময়টা কিভাবে কাটিয়ে দিলেন সে এক রহস্য। বইতে যদিও লিখেছেন কিভাবে কি করেছেন, তবু প্রশ্ন থেকে যায়। একাত্তরের ভয়ংকর সময়ে তিনি অনেকটা অলস অবসরে কাটিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করে গেছেন, ব্যাপারটা প্রায় অবিশ্বাস্য।
যদি তাঁর দাবী মতে একাত্তরের ওই ভূমিকা সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে তাকে অরাজনৈতিক মহত্বে ভূষিত করতে হয় একাত্তরের অবদানের জন্য। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে তখন দুটো দল। ফ্রিডম ফাইটার বা এফ এফ, বাংলাদেশ লিবারেশান ফোর্স বা বিএলফ। শেষোক্তটি চার খলিফার তত্ত্বাবধানে চলতো, আর প্রথমোক্ত চলতো সেক্টর কমাণ্ডারদের নির্দেশনা অনুযায়ী। এই দুই দলে আবার বিবাদও ছিল, পরস্পর খুনোখুনির ঘটনাও ঘটেছে। এনায়েত মওলা সেই বিভেদগুলোর কথা বলেছেন স্পষ্টভাবে। এমনকি নিজেদের মধ্যে গোলাগুলি করে বেশ কিছু হতাহত হয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক নেতারা যেসব বই লিখেছেন তাতে এই দ্বন্দ্বের উল্লেখ থাকতে দেখি না। আবার এনায়েত মওলাও এক পাকিস্তানী নৌ কমাণ্ডার আনোয়ারের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়, যিনি একাত্তরে বাঙালীদের পক্ষে কাজ করেছেন। অপারেশান জ্যাকপটে তার সাহায্য করার ইঙ্গিতও দেয়া হয়েছে বইটিতে। আর কোথাও এই রহস্যময় আনোয়ার সাহেবের কথা শুনিনি। এসব ব্যাপার পড়ে এনায়েত মওলার রাজনৈতিক অবস্থান জানার জন্য কৌতুহলী হয়ে উঠেছি। কিন্তু ভদ্রলোক এখন বেঁচে আছেন কিনা জানি না। কোথায় থাকতেন তাও জানি না। তাঁর বইটা প্রকাশিত হয় ১৯৯৩ সালে আজ থেকে ২১ বছর আগে। আমি অন্ততঃ চাই তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে চেনে তেমন কারো সাথে কথা বলতে। তিনি তাঁর বন্ধু হিসেবে রেডিওর একজন নাজমুল আলমের কথা উল্লেখ করেছেন, তিনিও বেঁচে আছেন কিনা জানি না। আমাকে তথ্য যাচাইয়ে পথে নামতে হবে মনে হচ্ছে।
নীচে বইটির শেষার্ধের একটা অংশ কপি করে দিচ্ছি। এই অংশটা পড়ে আমি চমকে উঠেছি রীতিমত।
চট্টগ্রামের মিরেরসরাই থেকে শুরু করে ফেনী নদী পার হয়ে মোট প্রায় ২০ মাইল জায়গা চলাফেরার জন্য ছিল খুবই বিপদজনক। অথচ এপার থেকে ওপারে যাওয়া আসার জন্য এ জায়গাটা পার হওয়ার বিকল্প ছিল না। অবশ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম পার হয়েও আসা যেতো কিন্তু তাতে সময় লাগতো অনেক বেশি। সমূদ্রের কিনারা থেকে পাহাড়ের নিকটবর্তী সীমান্তের দূরত্ব এখানে খুবই কম। ফলে এ জায়গায় পাহারা জোরদার করলে পাকিস্তানিরা চট্টগ্রামের সঙ্গে দেশের বাকি অংশের বা ওপারের যোগাযোগ বন্ধ করে দিতে পারতো। চেষ্টার অবশ্য ত্রুটি তারা করেনি। আর এ অবস্থার মধ্যেই চলাফেরা করতে হয়েছে আমাদের ছেলেদের। ধরাও পড়েছে কেউ কেউ। ছেলেরা সাধারণতঃ মিরেরসরাই এলাকায় পৌঁছবার পর হাঁটাপথে গ্রামে ঢুকতো। তারপর ভুরভুরি ঘাট, না হয় মিয়াজান ঘাট দিয়ে নদী পার হয়ে গ্রামের পথে ৩/৪ মাইল যাওয়ার পর রাতের অন্ধকারে চলে যেতো ওপারে। খান সেনাদের শক্ত ঘাঁটি ছিল এখানে কিন্তু বেশি বিপজ্জনক ছিল রাজাকার বাহিনী। কারণ তারা দেশের লোক। মানুষ আর পথঘাট তাদের চেনা। তাদের চোখে ধুলো দিয়ে যাওয়া আসা ছিল সত্যিই কঠিন।
একদিন ক’জন ছেলে আমার বাসায় বসে আলাপ করছিল। প্রত্যেকেরই এক কথা, মিরেরসরাই এলাকা দিয়ে চলাফেরা করা দিন দিন বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। আলোচনার এক পর্যায়ে একজন হাসতে হাসতেই বললো, “আমাকে তোরা রাজাকার বানিয়ে দে, তাহলে আর কোন ভয় থাকবে না। তোদের দেখলে এ্যারেষ্ট করে সোজা ওপারে পৌঁছে দিয়ে আসবো।” সবাই হেসে উঠলো ছেলেটির কথা শুনে কিন্তু আমি হাসিনি। আমি দেখলাম, হাসি-তামাশার ভেতর দিয়ে কঠিন একটা সমস্যার সমাধান হয়ে গেল অথচ ছেলেরা বুঝলো না।
কথাটা আমার মনে খুব লেগেছিল আর সেজন্যে এ ব্যাপারে অনেকক্ষণ ধরে তাদের সাথে কথা বলেছিলাম। বলেছিলাম, “কঠিন একটা সমস্যা যদি এতো সহজে সমাধান করা যায়, তাহলে তোমাদের ভেতর থেকে কিছু ছেলে রাজাকার হয়ে যাওনা কেন? ছেলেদের আসা যাওয়ার সময়ে তারা কেবল সঙ্গে থাকবে। মিলিটারির হাতে যদি ধরা পড়ে কেউ, তখন কড়া স্যালুট দিয়ে নকল রাজাকাররা বলবে যে, বন্দীদের তারা ক্যাম্পে নিয়ে যাচ্ছে। তারপর ক্যাম্পের বদলে চলে যাবে তারা ওপারে।”
…. অবশেষে এ ধরণের একটা ব্যবস্থা চালু হয়েছিল। কিছুসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধাকে রাজাকার বানিয়ে দেয়াতে মিরেরসরাই এলাকায় ছেলেদের চলাফেরায় পরে বেশ সুবিধা হয়ে যায়…
কিন্তু তার পরেই আমাদের চমকে দিয়ে এনায়েত মওলা লিখেছেন দেশ স্বাধীন হবার পর এই ছেলেগুলোকে রাজাকার হিসেবে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই ঘটনার আর কোন সাক্ষী আছে? ঘটনাটা কিভাবে ঘটলো? এই ভুলটা কি করে হলো? এনায়েত মওলা কি আওয়ামী বিদ্বেষী লোক ছিলেন বলে এভাবে লিখেছেন? প্রশ্নগুলো মাথায় প্যাচ খেলছে।
সেই প্যাচ খোলার জন্য ব্লগটা লিখে ফেললাম। প্যাচ খোলার জন্য কারো সাথে আলোচনায় বসা দরকার। কিন্তু কোথায় বসলে, কার সাথে আলাপ করলে এই জট খুলবে বুঝতে পারছি না। একা একা কাজ করার জন্য আরো কিছু বইপত্রের যোগাড়যন্ত্র করতে পারলেও একাত্তরে সমগ্র চট্টগ্রামের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের আসল অবস্থান নিয়ে একটা লেখা তৈরী করা যেতো। এবং এই তথ্যগুলো আমাদের জ্ঞানের অসম্পূর্ণতাকে দূর করতে পারতো, সুবিধাবাদী মুখগুলোও চিহ্নিত করা যেতো। তবে আপাততঃ আমি এনায়েত মওলা সম্পর্কে আরো তথ্য সংগ্রহে আগ্রহী।
