-ভাই ইলিশ মাছের কেজি কতো?
-সাতশো টাকা
-এত দাম!!!??? (আঁতকে উঠে ক্রেতা)
-(দোকানী নিরুত্তর)
-চারশো হয় না?
-না (দোকানী ঈষৎ বিরক্ত)
-সাড়ে চারশো? (নার্ভাস প্রশ্ন, ক্রেতার বুকটা ধক ধক করছে)
-আরে না!! (বিক্রেতা বিরক্ত)
-আচ্ছা পাঁচশো দেবো (খুব সাহস করে বাজেট অতিক্রম করলো ক্রেতা)
-ধুরো মিয়া আপনি ব্যাটারি গলি যান গিয়া, এইখানে আপনার ইলিশ নাই (বিক্রেতার প্রচন্ড বিরক্তি নগ্নভাবে বেরিয়ে পড়ে)

ব্যাটারি গলি থেকেই নুরুল কবির নিয়মিত বাজার করেন। কাজির দেউড়ির অদূরেই নিন্মবিত্তদের বাজার এটি। দোকানীর কথাটা সত্য বলেই ভেতরে খচ করে বিঁধলো অপমান কাঁটাটা। কানটা গরম হয়ে টকটকে লাল হয়ে যায় তাঁর। ওখানে সস্তায় মাছ পাওয়া যায় সত্যি, কিন্তু এই জাতের ইলিশ নেই। এই বাজার চট্টগ্রামের সবচেয়ে খান্দানী বাজার, কোটিপতিরাই বাজার করে এখানে। এখানে আসতে হয়েছে তাকে অনেক দুঃসাহস নিয়ে।

নুরুল কবির গত দেড় দশক কোনদিন ইলিশের দিকে ফিরেও তাকাননি সামর্থ্য ছিল না বলে। তাই জানতেন না ইলিশের দর কতো উঠেছে। শেষবার ইলিশ কিনেছিলেন ৮০ টাকা কেজি। তখনো সামর্থ্যের শেষ সীমা ছুঁই ছুঁই করছিল। অন্য মাছের দাম তখন পঞ্চাশের মধ্যে ছিল। সেবার ৮০ টাকার ইলিশ কিনে ঘরে ফিরে বউকে বলছিলেন, “আমাদের ইলিশ খাওয়ার দিন শেষ। মাত্র কবছর আগে বিশ টাকা দিয়ে ইলিশ কিনতাম। এখন নাকি ৮০ টাকা। লইট্যা আর পোয়া মাছ বাদে আর কিছু খাওয়া যাবে না।”

আজকে সদ্য বিবাহিতা কন্যা বর নিয়ে বেড়াতে আসবে। বউ খুব জোর করছে নতুন জামাইয়ের জন্য জীবনে আরেকটা বার ইলিশ মাছ কিনতে। তাই দুঃসাহস করেছিলেন কাজীর দেউড়ি বাজারে এসে। বুকের ভেতর দলা পাকানো কষ্টটা কেমন করতে থাকে। পকেটে পাঁচশো টাকার দুটো নোট নিয়ে মাথার ভেতরে মুরগী গরু ইলিশের সব হিসেব উলটপালট হয়ে যায়। বাজারের গলিতে এলোমেলো হাঁটতে হাঁটতে মনে মনে ছেলেবেলার কবিতাটা আওড়াতে থাকেন তিনি, “দাদখানি ডাল মসুরের চাল, চিনিপাতা কই……..” তার জীবনের সব হিসেব এই কবিতাটির মতো।

মুরগীর দোকানের খাঁচার সামনে বোঁটকা গন্ধের মাঝে যেন একটু স্বস্তিবোধ করেন। পকেটের টাকাগুলো এই ফার্মের মুরগী কেনার জন্যই উপযুক্ত। এমনকি শাকসবজিও তার আওতার বাইরে চলে গেছে। ১৪০ টাকায় একটা মুরগী কিনলে চার বেলা খেতে পারে তারা চারজন। কিন্তু বছরের পর বছর ফার্মের মুরগী খেয়ে খেয়ে জিবটা অতিষ্ঠ হয়ে গেছে। তবু বেঁচে থাকার জন্য চলছে। অতিথিদের জন্য রুই কাতলা গরু খাসী পর্যন্ত যাবার ইতিহাস আছে তার। ইলিশে কোনদিন সাহস করেননি। আজকে ইলিশের দিকে তাকাতে হয়েছে মেয়ের সম্মানের দিকে চেয়েই। এই মেয়েটি তার বড়ই লক্ষী, বড়ই আদরের। ওকে বিয়ে দেবার পর থেকে তাঁর বুকটা নীরব কান্নায় ফেটে গিয়েছিল। ওর জন্য সবকিছু করতে পারেন তিনি।

মুরগীর খাঁচা থেকে সরে ইলিশ মাছের দিকে গেলেন তিনি আরেকবার। মেয়ের জন্য দোকানীর অপমানও গায়ে মাখলেন না। এবার দেখতে পেলেন সেই দোকান আড়াল করে দাড়িয়ে আছে দীর্ঘদেহী এক ভদ্রলোক। কাছে যেতেই শুনতে পেলেন-

-ওই বেডা…..এক হালি ইলিশ মাপ
-আইচ্ছা স্যার
-সুন্দর গরি খাডি সাফ গরি দে
-জী সার
-বড় বড় চাই বাছি দিবি
-জী সার
-দাম হত আইসসে আঁর?
-সাড়ে চাইর কেজি…….এই ধরেন তিন হাজার একশো পঞ্চাইশ টেকা
-এই ধর, এন্ডে ২২০০ টেঁয়া আছে
-সার গো এত কম দিলে তো অয় না, আমগো কিনা তো বেশী
-যা ব্যাটা আঁরে কিনা শিখাঅর না? কিননোস চাইশশো টেঁয়া দি, একশ টেঁয়া লাভ দি, ফিরিঙ্গী বাজারুত্তুন কিনিলি আরো হম ফাইতাম, কিন্তু টাইম নাই।
-তাইলে সার পরের বার পুষাই দিয়েন
-ঠিকাছে ফরর বার ফোসায় লইস, যা এখন খাডিকুডি গাড়িত তুলি দে। আঁই কেচাবাজার গরি লই

নুরুল কবির এবার সাহস করে গেলেন ইলিশের দোকানে। আগের জনের কাছে ৫০০ করে বিক্রি করেছে যখন, তাকেও দিতে পারে।

-ভাই, আমারেও একটা ইলিশ দেন পাঁচশো টাকায়।
-মুশকিলের কতা, আফনারে আগেই কইছি, কেজি সাতশো টাকা
-একটু আগেই যে…….
-ওই হিসাব আমনে বুইঝবেন না,
-একটু ছোট সাইজ হলেও চলবে আমার
-ধুরো মিয়া অন্যদিকে যান, দিগদারী কইরেন না।

নুরুল কবির ফিরে আসে এক গাদা অপমান হতাশা নিয়ে। পকেটে যে টাকা আছে তা দিয়ে ইলিশ কেনা অসম্ভব। ভীষণ কান্না পায় তার। দীর্ঘ চাকরি জীবনে তিনি শুধু সম্মানই অর্জন করেছিলেন। অপমান অবহেলাগুলো সব বাকী রয়ে গিয়েছিল। অবসরের পর পাওনা অবহেলা অপমানগুলো ঘরে বাইরে হজম করে নিতে হচ্ছে। তবে আজকে একটা গুরুতর অর্থনীতি শিক্ষা হলো। একমাত্র স্বচ্ছল মানুষেরাই সস্তায় কেনাকাটাকা করতে পারে। কারণ বাজারে দর কষাকষির ক্ষমতা আছে স্বচ্ছল মানুষেরই।
==================================================================================

নুরুল কবিরের মধ্যে কি বাংলাদেশকে খুঁজে পাওয়া যায়? পররাষ্ট্রনীতি কিংবা আন্তর্জাতিক দর কষাকষিতে বাংলাদেশের অবস্থা কি একজন নুরুল কবিরের চেয়ে খুব বেশী উন্নত?

নীড় সন্ধানী

অদেখা স্বপ্নের ব্যাপ্তিটা প্রতিদিন বিস্তৃত হতে থাকে.........

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.