সিনেমার সূচনাতেই দেখা গেল বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতের সাথে জাতীয় পতাকা উড়ছে। তারপর পর্দায় ভেসে উঠলো একটি তারিখ- ২৬শে মার্চ ১৯৭১। পাকিস্তানী সৈন্যরা ঢাকায় আক্রমন শুরু করেছে, গোলাগুলির শব্দের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেক্রেটারিয়েট টেবিলে রাখা মাইক্রোফোন টেনে নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন।
Children of War নামক চলচ্চিত্রের প্রথম দৃশ্য এটি। যদিও বাস্তবে স্বাধীনতা ঘোষণার ব্যাপারটি এভাবে ঘটেনি, তবু সিনেমার খাতিরে মেনে নিলাম রূপকীয় উপস্থাপনাটি। এই অংশটি গায়ে শিহরণ জাগায় যদিও তারিখটি ২৫শে মার্চ হবার কথা। কেননা বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণাটি ২৫শে মার্চ রাত বারোটার আগেই চলে গিয়েছিল ইপিআর সদর দপ্তরসহ পূর্বনির্ধারিত বেশ কয়েকটি প্রচার কেন্দ্রে।
Children of War নামক চলচ্চিত্রটি প্রথমে The Bastard Child নামে তৈরী হলেও পরে সেন্সরবোর্ডের আপত্তিতে নাম পরিবর্তন করা হয়েছিল। সিনেমাটি তৈরীর জন্য Mrityunjay Devvrat ও Soumya Joshi Devvrat এর কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতা। ভিনদেশী নাগরিক হয়েও তাঁরা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটি চলচ্চিত্র নির্মান করেছেন। সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছিল বছর দুই আগে। আমার দেখা হলো মাত্র সেদিন। সিনেমা বানাবার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেও অসঙ্গতিগুলো আলোচনা করাও দরকার। কেননা ঐতিহাসিক সিনেমার কিছু দায়বোধ থাকে যা এড়ানো যায় না।
সিনেমাটির সবচেয়ে সুন্দর হলো সিনেমাটোগ্রাফি। চিত্রায়নের উৎকর্ষতা সিনেমাটিকে বানিজ্যিক সাফল্য পেতে সাহায্য করেছে। একজন ভারতীয় বা যে কোন অবাংলাদেশীর কাছে সিনেমাটির খুব বেশী দুর্বলতা চোখে নাও পড়তে পারে। কিন্তু একজন বাংলাদেশী হিসেবে সিনেমাটির প্রচুর দুর্বলতা আমার সাধারণ চোখে ধরা পড়েছে। বৈসাদৃশ্যগুলো খুব বেশী চোখে লাগে কেননা এই সিনেমাটি বহুল আলোচিত, প্রশংসিত এবং পুরস্কৃত। ফলে বিশাল একটা প্রত্যাশা দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। প্রত্যাশাটি প্রথম ধাক্কা খায় দ্বিতীয় দৃশ্যে। কেননা যতদূর জেনেছি ছবিটা তৈরীর আগে যথেষ্ট গবেষণা ও পড়াশোনা করেছেন পরিচালক। তবু এত বেশী অবাস্তব দৃশ্যের আমদানী কেন করতে হলো সেটা বোঝা গেল না। ১৯৭১ সালের সাধারণ বাস্তব ঘটনাবলী যথেষ্ট মর্মান্তিক, এখানে আরোপিত নাটকীয়তার কোন প্রয়োজন ছিল না।
অসঙ্গতি এক: ছবির দ্বিতীয় দৃশ্যে আমরা দেখতে পাই, মধ্যরাতে একজন সাংবাদিক তাঁর বেডরুমে বসে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষনার টেপটি শুনে শুনে একটা সংবাদ/প্রবন্ধ টাইপ করছেন কোন এক পত্রিকায় পাঠানোর জন্য। পত্রিকা থেকে লোক আসবে নিতে। খানিক পর কলিং বেল বাজলো। দরোজা খুলে দেখা গেল টুপি মাথায় ছোট্ট একটা বালক দাঁড়ানো, সে পত্রিকা থেকে এসেছে লেখাটি নেবার জন্য।
১৯৭১ সালে ২৫শে মার্চের পর বিধ্বস্ত রক্তাক্ত ঢাকা শহরে এমন কোন পত্রিকা চালু ছিল যে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা নিয়ে লেখা প্রবন্ধ ছাপাতে পারে এবং মধ্য রাতে সেই সংবাদটি সংগ্রহ করতে টুপিওয়ালা বালককে সাংবাদিকের বাড়িতে পাঠানো হয়। (বাংলাদেশী মুসলমান মানেই গলায় তাবিজ, চোখে সুরমা, মাথায় ক্যাবলামার্কা টুপি, তারা সবাই কুমিল্লার আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে এমনকি ঢাকার শীর্ষ সাংবাদিক হলেও- এটা ভারতীয় পরিচালকদের চোখে বাংলাদেশীদের ট্রেডমার্ক)। কেমন অবিশ্বাস্য বাস্তববিবর্জিত একটা ব্যাপার।
শুধু তাই না, ছেলেটির হাতে খামটি দিয়ে দরোজা বন্ধ করে রেকর্ডারে কিশোর কুমারের গান চালিয়ে সাংবাদিকের বউ মদির কামনা সম্বলিত ভঙ্গিতে নাচতে থাকে এবং তারপর দুজনে মিলিত হয় আনন্দ সঙ্গমে। ১৯৭১ সালে ঢাকা শহরের বাস্তবতা সম্পর্কে যাদের বিন্দুমাত্র ধারণা আছে তাদের কাছে ওই দৃশ্যটা কেমন লাগবে তা বলাই বাহুল্য।
এবং তার পরপরই দরোজায় করাঘাত হয়। দরোজা ভেঙ্গে পাকিস্তানী সৈন্যরা ঘরে ঢুকে পড়ে। এরকম আক্রান্ত অবস্থায় মানুষ কি ধরণের আচরণ করে সেটা বাস্তবতা থেকে এতটা দূরে থাকবে ভাবিনি। নিরস্ত্র সাংবাদিক খামাকা বীরত্ব দেখিয়ে সিনেমার নায়কসুলভ একশানধর্মী ডায়লগ দিয়ে অস্ত্রধারী অফিসারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে এরকম দৃশ্য সিনেমা হলে অর্বাচীন হাততালির সংখ্যা বাড়ালেও সেটা বিশ্বাসযোগ্যতা আনতে ব্যর্থ হয়। পাকিস্তানী সৈন্যের উপর ওরকম আক্রমনের পরও সেই সাংবাদিককে হালকা পিটুনি দিয়ে ছেড়ে দেয়। এবং তাঁর সুন্দরী স্ত্রীকে ধর্ষণ করে এবং সাথে নিয়ে যায়। এতটা ভদ্র আচরণ কোন পাকিস্তানীর কাছে ১৯৭১ সালে কেউ দেখেছে বলে আমার জানা নেই। কিন্তু সেই সাংবাদিক এই সিনেমার নায়ক। সিনেমার নায়ককে প্রথম দৃশ্যে মেরে ফেলা যায় না।
আমি বলি, যেহেতু নায়ককে জীবিত রাখতে হবে সেহেতু তাকে দিয়ে পাকিস্তানী অফিসারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার দৃশ্যটা না করানোই উচিত ছিল। একাত্তরে যে মানুষগুলো একদম নিরীহ নিষ্ক্রিয় ছিল, পাকিস্তানী সৈন্যরা তাদের কাউকে রেহাই দেয়নি, আর একজন আক্রমনকারীকে মৃদু পিটুনি দিয়ে ফিরে চলে আসবে, সেটা সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য।
অসঙ্গতি দুই: মুক্তিযোদ্ধারা তালিকা ধরে ধরে রাজাকারদের ক্যাম্পে ধরে এনে পিটুনি দিচ্ছে, তথ্য আদায় করছে, এটাও একটা বিপরীত দৃশ্য। ঘটেছে বিপরীত ঘটনা। রাজাকারেরা মুক্তিবাহিনীকে নির্যাতন করেছে তথ্য আদায়ের জন্য। এখানে আরো দেখানো হলো এক জায়গায় অ্যামবুশ করে পাকিস্তানী আর্মি অফিসারকে ধরে এনে পিটুনি দিয়ে কথা আদায় করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
অসঙ্গতি তিন: মূখ্য চরিত্রে অভিনয় করা একটা কিশোরকে দিয়ে কিছু অবিশ্বাস্য দৃশ্য করানো হয়েছে। একটি শরনার্থী দলের উপর ট্রাকে করে আসা একদল সৈন্য আক্রমন চালিয়ে সবাইকে মেরে ফেলে। কিন্তু কিশোরটি বেঁচে যায়, সে এক পাকিস্তানী সৈন্যের কোমর থেকে পিস্তল ছিনিয়ে নিয়ে তাকে গুলির পর গুলি করে মেরে ফেলে। সেই সময় বাকী সৈন্যরা নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকে এবং অদৃশ্য স্থানে চলে যায় কিশোরকে বীরত্ব দেখানোর সুযোগ দিতে। কিশোর ও তার তরুণী বোন অক্ষত থাকে এবং তাদের যাত্রা অব্যাহত রাখে।
অসঙ্গতি চার: সিনেমার শুরু থেকে কিশোরটি তার বোনকে নিয়ে ভারতের সীমান্তের উদ্দেশ্যে রওনা করেছিল। কিন্তু কয়েক মাস কেটে গেলেও তারা সীমান্তে পৌঁছাতে পারছিল না পরিচালকের নির্দেশের অভাবে। যুদ্ধের শেষ দিকে কিশোরটি ভারতের সীমান্তের কাছে পৌঁছে নাটকীয়ভাবে গুলি খায়। তার পরনে তিনটা তারকা সমৃদ্ধ একটা ইউনিফরম আর পিঠে একটা ৩০৩ রাইফেল ঝোলানো। সে এই সামরিক ইউনিফরম কোথা থেকে যোগাড় করেছিল সেটা পরিচালকই ভালো বলতে পারবেন।
অসঙ্গতি পাঁচ: আরেক দৃশ্যে কিশোর ও তার বোন খাবারের সন্ধানে ঘুরতে ঘুরতে একটা পরিত্যক্ত বাড়িতে গিয়ে ভাত ও চালের সন্ধান পায়। সেখানে ভাত রেঁধে খাবার পর রাতের বেলা একদল শরনার্থী এসে হাজির হলে কিশোর লাঠি হাতে তাদের প্রতিরোধ করে দাঁড়ায়। শরনার্থী দল এক রাতের আশ্রয় চায় কিশোরের কাছে। তারপর কিশোর এক অনাবশ্যক নাটকীয় মুর্তিতে আবির্ভূত হয়ে বলে, এটা ওর গ্রাম, ওর বাড়ি, সে কাউকে আশ্রয় দিতে রাজী না। কেন কিশোরটিকে খামাকা এমন অমানবিক একটা ভূমিকায় দেখাতে হলো সেটা বুঝিনি, যদিও পরের দৃশ্যে প্রচলিত বাংলা সিনেমার কায়দায় মিলমিশ হয়ে একই দলে পরিণত হয় তারা।
আরো অসঙ্গতির উদাহরণ আনা যায়। এরকম দৃশ্যের পর দৃশ্য এত বেশী আরোপিত নাটকীয়তা, এত বেশী অবিশ্বাস্য দৃশ্য, দেখতে দেখতে ক্লান্তি চলে আসে। সিনেমা শেষ করার পর ভালোলাগার বদলে বিরক্তিটাই জেগে থাকে।
শেষ বিরক্তিটা বলি এবার। শুরু থেকে কয়েকবার করে একটা জনসভার দৃশ্য দেখানো হয় যেটাকে সম্ভবত শাহবাগের আন্দোলনকে বোঝানো হয়েছে, যেখানে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা আছে। শুরুতেও ওই জনসভার অংশ দেখানো হয়, তখন বোঝা যায়নি ওটা কিসের জনসভা। শেষ দৃশ্যে এসে যখন ৪২ বছরের কথা বলা হয় তখন পরিষ্কার হয়। কিন্তু ওই আন্দোলনের যে নেতা চরিত্রে যাকে নির্বাচিত করা হয়েছে তার বয়স, ব্যক্তিত্ব, বক্তৃতা এই তিনটাই এত বেশী নাজুক যে দৃশ্যটা কোন আবেগ সৃষ্টি করতে পারে না। তার উপর বক্তার গলায় তাবিজ, চোখে সুরমা, পরনে পাঞ্জাবী, কন্ঠে কুমিল্লার আঞ্চলিক ভাষা – যথারীতি সেই বাংলাদেশী ট্রেডমার্ক। ভীষণ বিরক্ত হয়েছি এটাতে। ভারতীয় সিরিয়ালগুলোতেও এই ট্রেডমার্ক দেখি অহরহ। এটা কোন ধরণের সংকীর্ণতা বা সাম্প্রদায়িকতা সেটা আমার বোধগম্য না। সবচেয়ে দৃষ্টিকটু লেগেছে জয়বাংলা শ্লোগানটি। এই শ্লোগানের একটা সুর তাল আছে। এটি বহুল প্রচারিত। নেটে সার্চ দিয়েও বের করে শুদ্ধ করে দেয়া যেতো। কিন্তু কেন যেন তা করা হয়নি। সিনেমাতে যে সুরে শ্লোগানটি দেয়া হয়েছে শুনলে কানে তালা দিতে ইচ্ছে করে।
অনেক বলা হলো। এক লাইনে উপসংহার টানি এবার। আমরা ঐতিহাসিক সিনেমা দেখতে চাই সত্যি। কিন্তু অসঙ্গতিতে ভরপুর কোন জিনিস চাই না। এই সিনেমা নির্মানের উদ্দেশ্য মহৎ হলেও দুর্বল চিত্রনাট্যের কারণে সিনেমাটি আমার ভালো লাগেনি। আমার গড়পড়তা রেটিং সর্বোচ্চ ১০ এ ৪।