লাতিন ভাষার কথা : ১৯

|| জ্ঞান-বিজ্ঞান || বিদ্যালয়গুলো ভাষাগত অনুশীলনের ওপর জোর দিলেও রোমক সমাজে অন্যান্য বিষয়ের জ্ঞানেরও যথেষ্ট প্রয়োজন ছিল বৈ কি। উচ্চশিক্ষা গ্রহণের কোনো রাস্তা খোলা ছিল না, কারণ আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় বলতে যা বোঝায় তার ছায়ামাত্র ছিল না রোমক সমাজে। [. . .]

Tore Janson-এর সুইডিশ ভাষায় রচিত Latin: Kulturen, historien, språket গ্রন্থের Merethe Damsgård Sørensen ও Nigel Vincet-কৃত ইংরেজি অনুবাদ A Natural History of Latin-এর বাংলা ভাষান্তর

জ্ঞান-বিজ্ঞান

বিদ্যালয়গুলো ভাষাগত অনুশীলনের ওপর জোর দিলেও রোমক সমাজে অন্যান্য বিষয়ের জ্ঞানেরও যথেষ্ট প্রয়োজন ছিল বৈ কি। উচ্চশিক্ষা গ্রহণের কোনো রাস্তা খোলা ছিল না, কারণ আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় বলতে যা বোঝায় তার ছায়ামাত্র ছিল না রোমক সমাজে। সম্ভবত এক ধরনের শিক্ষানবিসী পদ্ধতির মাধ্যমে প্রবীণেরা তাঁদের কারিগরী জ্ঞান হস্তান্তর করতেন, যদিও সে-বিষয়ে বেশি কিছু জানা যায় না। তবে, বিচিত্র সব বিষয়ের ওপরে লেখা নির্দেশিকা পুস্তক হাতে এসেছে আমাদের। আগেই বলা হয়েছে, মূল শিল্প ছিল কৃষি, এবং এই বিষয়টির ওপর এন্তার হ্যান্ডবুক রয়েছে, জ্যেষ্ঠ ক্যাটোর একটি থেকে শুরু করে — যেটার কথা আগেই বলা হয়েছে — একেবারে প্রাচীনকালের শেষ দিক পর্যন্ত। সবচাইতে বিশদটি লিখেছিলেন Columella নামের এক ভূস্বামী, প্রথম খৃষ্ট পূর্বাব্দের।

রোমকরা সব ধরনের নির্মাণ প্রকল্পেও হাত লাগিয়েছিল। সম্রাট অগাস্টাসের সমসাময়িক ভিত্রুভিয়াস নামের এক ভদ্রলোক স্থাপত্যবিদ্যার ওপরে এক বিশাল নির্দেশনা পুস্তক রচনা করেছিলেন, যার নাম ‘De architectura’। এ-বিষয়ে রচিত প্রাচীন কালের এই একটি বই-ই হাতে এসে পৌঁছেছে আমাদের। বেশ প্রভাবসঞ্চার করেছিল বইটি, বিশেষ করে রেনাসাঁর সময়ে এবং তার পরবর্তীকালে, যখন মানুষ স্থাপত্যকলায় এবং অন্যান্য ধরনের শিল্পে প্রাচীনকালের শৈলীর আদর্শে ফিরে যেতে চেয়েছিল।

বিশেষ একটি যে বৈশিষ্ট্যের জন্য রোমকরা বিখ্যাত ছিল তা হলো দূর দূরান্তে পানি পরিবহনের উপায় তৈরি, যাকে ‘কৃত্রিম জলপ্রণালী’ (aqueduct) বলে। ফ্রন্টিনাস নামের এক সফল সরকারী চাকুরে, যিনি রোমের পানি সরবরাহের ব্যবস্থাপক ছিলেন, তিনি রোমের কৃত্রিম জলপ্রণালী বিষয়ে একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন, যা এখনো আমাদের কাছে রয়েছে। এই একই ভদ্রলোক আরো কিছু বই লিখেছিলেন রোমকদের আরেক বিশেষত্ব — যুদ্ধবিগ্রহ — নিয়ে, আর সেই বইগুলোরও একটি এখনো লভ্য।

কৃষক, নির্মাতা, এবং এমনকি সৈন্যদের জন্য বিশেষ যে একটি দক্ষতা বেশ কাজের তা হলো ভূমি জরিপ করতে পারা। গণিতের একটি অংশ হিসেবে গ্রীকরা জ্যামিতির বিকাশ সাধন করলেও, রোমকদের সেই অর্থে জ্যামিতিক তত্ত্ব নিয়ে মাথাব্যাথা ছিল না; তবে তারা বিদ্যাটার কিছু নির্বাচিত অংশ ভূমি জরিপের বাস্তবসম্মত প্রয়োগ-পদ্ধতি সৃষ্টিতে ব্যবহার করেছিল, এবং বিষয়ের ওপর তাদের যথেষ্ট গুরুপাক কিছু গবেষণাধর্মী রচনা আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছে।

এ-সমস্ত ব্যবহারিক ক্ষেত্রে রোমকরা বিদ্যমান গ্রীক নমুনাগুলোকে খানিকটা ছাপিয়ে যেতে পেরেছিল বলা যায়। আবার অন্য অনেক ক্ষেত্রে তারা কেবল গ্রীক জ্ঞানসম্ভার লাতিনে অনুবাদ করেই সন্তুষ্ট ছিল। তার একটি ভাল উদাহরণ হচ্ছে চিকিৎসাশাস্ত্র, যে-বিষয়ে সেই মহান হিপোক্রেটিস থকে শুরু করে গ্রীকরা এক শক্তিশালী ঐতিহ্যের অধিকারী। রোমে চিকিৎসাশাস্ত্রের ওপর বেশ কিছু নির্দেশিকা পুস্তক রচিত হয়েছিল, সেসবের মধ্যে একটির রচয়িতা সেলসাস, তবে সেগুলোর সবক’টিই প্রায় পুরোপুরি-ই গ্রীক নমুনাগুলোর ওপর ভিত্তি করে রচিত। একই কথা প্রযোজ্য পশু চিকিৎসাশাস্ত্রের নির্দেশিকা, ওষুধ নির্মাতাদের জন্য নির্দেশনা-পুস্তক, ইত্যাদির বেলায়।

সম্ভবত যে-মানুষটি গ্রীকদের জ্ঞান-বিজ্ঞান লাতিনে স্থানান্তরের ক্ষেত্রে সবচাইতে বেশি অবদান রেখেছেন তিনি হলেন প্লিনি নামের এক বিখ্যাত কর্মকর্তা। রোমক নৌবাহিনীতে এডমিরাল ছিলেন তিনি, যে বাহিনীর প্রধান ঘাঁটি ছিল নেপলস উপসাগরে। ভিসুভিয়াসে ৭৯ খৃষ্টপূর্বাব্দে যখন অগ্ন্যুৎপাত ঘটে তখন তিনি সে বিপর্যয়ে দুর্গত লোকজনকে সাহায্য করতে গিয়ে নিজেই নিহত হন। তাঁর ভাইয়ের ছেলে ছোট প্লিনি নিজেও সেই অগ্ন্যুতপাতের সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন; তাঁর লেখা এক চিঠিতে এই নাটকীয় কাহিনীর বর্ণনা আছে। জ্যেষ্ঠ প্লিনির যে কঠিন পরিশ্রম করার অবিশ্বাস্য ক্ষমতা ছিল তা এক রকম নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এবং তিনি তাঁর জীবনের একটা উল্লেখযোগ্য সময় কাটিয়েছেন বেশিরভাগ বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের লেখা পড়ে (কখনো কখনো সেসব লেখা পাঠ করেও শোনানো হতো তাঁকে), আর তারপর তিনি লাতিনে সেগুলোর অনুবাদ বা সংক্ষিপ্তসার বলে গেছেন, অন্যেরা তা সঙ্গে সঙ্গে লিখে গেছেন। ধীরে ধীরে তিনি এই কাজটিকে একত্র করে একটি বিপুলাকার বিশ্বকোষে রূপ দিয়েছেন, এবং সেটার নাম দিয়েছেন ‘Naturalis historia’ বা, ‘Natural History’ বা, ‘প্রাকৃতিক ইতিহাস’। শিরোনামটির গ্রীক শব্দ ‘historia’-র সাধারণ মানে ‘অনুসন্ধান’ বা ‘বিজ্ঞান’, যদিও আমরা সেটাকে অতীত বিষয়ক অনুসন্ধান হিসেবেই ব্যবহার করি। যে-বইটি আপনারা পাঠ করছেন সেটার শিরোনাম (মূল সুইডিশে, ‘Latin: Kulturen, historien, språket’, আর ইংরেজিতে ‘A Natural History of Latin’; বাংলায় আপাতত সেটা বদলে রাখা হয়েছে যদিও)। বলাই বাহুল্য, প্লিনির বিখ্যাত রচনাটি থেকে এইটি অনুপ্রাণিত, এবং সেটা এই আশায় যে এখানে কেজো কিছু তথ্য আর মজার মজার কিছু এনেকডোট থাকবে, যা কিনা তাঁর সেই মহাগ্রন্থেও ছিল।

কোনো না কোনো দিক থেকে ‘Naturalis historia’ বিষয়টি আজ আমরা যাকে ‘(প্রাকৃতিক) বিজ্ঞান’ বলি সেটা নিয়েই কাজ করে, যদিও একটা দীর্ঘ সময় সেটাকে ‘Natural History’ বা, ‘প্রাকৃতিক ইতিহাস’ নামেই ডাকা হয়েছে প্লিনির বইটির নাম অনুসারে। সত্যি বলতে কি, দীর্ঘকাল ধরে — এই ১৮শ শতকেও — উদ্ভিদবিদ্যা, প্রাণিবিদ্যা, অঙ্গব্যবচ্ছেদ-বিদ্যা, খনিজবিদ্যা, এবং আরো অনেক বিষয়ে প্লিনিকে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য বিশেষজ্ঞ বলে মানা হতো। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান ধীরে ধীরে একের পর এক জ্ঞান-রাজ্যে তাঁকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেছে, এবং এখন তাঁর কাজকে বিদ্যার্জনের ইতিহাসে একটি আজব বা দুর্লভ বস্তু হিসেবেই দেখা হয় প্রায়।

জ্ঞান-রাজ্যের অন্যান্য বিশেষায়িত এলাকাতেও অন্যান্য রোমক লেখকদের বেলাতে একই কথা প্রযোজ্য। ইউরোপের ইতিহাসের একটা বিশাল অংশের ক্ষেত্রে এসব রচনাই ছিল সেরা, কিন্তু বিগত দুই শতকে সেগুলো বড্ড সেকেলে হয়ে পড়েছে। তাঁদের লেখার কিছু কিছু জিনিস বিভিন্ন জ্ঞানকাণ্ডের গোড়ার দিকের শিক্ষার্থীদের জন্য একেবারে প্রাথমিক জ্ঞানে পর্যবসিত হয়েছে, অনেকটাই প্রমাণিত হয়েছে ভুল বলে। মোটের ওপর যা টিকে আছে তা হলো লাতিন নাম ও পরিভাষা, যেগুলো অবিকল অবস্থায় অথবা খানিকটা পরিবর্তিত রূপে আধুনিক বৈজ্ঞানিক ভাষায় আজও বহাল তবিয়তে বিদ্যমান।

বিদ্যালয়গুলো ভাষাগত অনুশীলনের ওপর জোর দিলেও রোমক সমাজে অন্যান্য বিষয়ের জ্ঞানেরও যথেষ্ট প্রয়োজন ছিল বৈ কি। উচ্চশিক্ষা গ্রহণের কোনো রাস্তা খোলা ছিল না, কারণ আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় বলতে যা বোঝায় তার ছায়ামাত্র ছিল না রোমক সমাজে। সম্ভবত এক ধরনের শিক্ষানবিসী পদ্ধতির মাধ্যমে প্রবীণেরা তাঁদের কারিগরী জ্ঞান হস্তান্তর করতেন, যদিও সে-বিষয়ে বেশি কিছু জানা যায় না। তবে, বিচিত্র সব বিষয়ের ওপরে লেখা নির্দেশিকা পুস্তক হাতে এসেছে আমাদের। আগেই বলা হয়েছে, মূল শিল্প ছিল কৃষি, এবং এই বিষয়টির ওপর এন্তার হ্যান্ডবুক রয়েছে, জ্যেষ্ঠ ক্যাটোর একটি থেকে শুরু করে — যেটার কথা আগেই বলা হয়েছে — একেবারে প্রাচীনকালের শেষ দিক পর্যন্ত। সবচাইতে বিশদটি লিখেছিলেন Columella নামের এক ভূস্বামী, প্রথম খৃষ্ট পূর্বাব্দের।

রোমকরা সব ধরনের নির্মাণ প্রকল্পেও হাত লাগিয়েছিল। সম্রাট অগাস্টাসের সমসাময়িক ভিত্রুভিয়াস নামের এক ভদ্রলোক স্থাপত্যবিদ্যার ওপরে এক বিশাল নির্দেশনা পুস্তক রচনা করেছিলেন, যার নাম ‘De architectura’। এ-বিষয়ে রচিত প্রাচীন কালের এই একটি বই-ই হাতে এসে পৌঁছেছে আমাদের। বেশ প্রভাবসঞ্চার করেছিল বইটি, বিশেষ করে রেনাসাঁর সময়ে এবং তার পরবর্তীকালে, যখন মানুষ স্থাপত্যকলায় এবং অন্যান্য ধরনের শিল্পে প্রাচীনকালের শৈলীর আদর্শে ফিরে যেতে চেয়েছিল।

বিশেষ একটি যে বৈশিষ্ট্যের জন্য রোমকরা বিখ্যাত ছিল তা হলো দূর দূরান্তে পানি পরিবহনের উপায় তৈরি, যাকে ‘কৃত্রিম জলপ্রণালী’ (aqueduct) বলে। ফ্রন্টিনাস নামের এক সফল সরকারী চাকুরে, যিনি রোমের পানি সরবরাহের ব্যবস্থাপক ছিলেন, তিনি রোমের কৃত্রিম জলপ্রণালী বিষয়ে একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন, যা এখনো আমাদের কাছে রয়েছে। এই একই ভদ্রলোক আরো কিছু বই লিখেছিলেন রোমকদের আরেক বিশেষত্ব — যুদ্ধবিগ্রহ — নিয়ে, আর সেই বইগুলোরও একটি এখনো লভ্য।

কৃষক, নির্মাতা, এবং এমনকি সৈন্যদের জন্য বিশেষ যে একটি দক্ষতা বেশ কাজের তা হলো ভূমি জরিপ করতে পারা। গণিতের একটি অংশ হিসেবে গ্রীকরা জ্যামিতির বিকাশ সাধন করলেও, রোমকদের সেই অর্থে জ্যামিতিক তত্ত্ব নিয়ে মাথাব্যাথা ছিল না; তবে তারা বিদ্যাটার কিছু নির্বাচিত অংশ ভূমি জরিপের বাস্তবসম্মত প্রয়োগ-পদ্ধতি সৃষ্টিতে ব্যবহার করেছিল, এবং বিষয়ের ওপর তাদের যথেষ্ট গুরুপাক কিছু গবেষণাধর্মী রচনা আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছে।

এ-সমস্ত ব্যবহারিক ক্ষেত্রে রোমকরা বিদ্যমান গ্রীক নমুনাগুলোকে খানিকটা ছাপিয়ে যেতে পেরেছিল বলা যায়। আবার অন্য অনেক ক্ষেত্রে তারা কেবল গ্রীক জ্ঞানসম্ভার লাতিনে অনুবাদ করেই সন্তুষ্ট ছিল। তার একটি ভাল উদাহরণ হচ্ছে চিকিৎসাশাস্ত্র, যে-বিষয়ে সেই মহান হিপোক্রেটিস থকে শুরু করে গ্রীকরা এক শক্তিশালী ঐতিহ্যের অধিকারী। রোমে চিকিৎসাশাস্ত্রের ওপর বেশ কিছু নির্দেশিকা পুস্তক রচিত হয়েছিল, সেসবের মধ্যে একটির রচয়িতা সেলসাস, তবে সেগুলোর সবক’টিই প্রায় পুরোপুরি-ই গ্রীক নমুনাগুলোর ওপর ভিত্তি করে রচিত। একই কথা প্রযোজ্য পশু চিকিৎসাশাস্ত্রের নির্দেশিকা, ওষুধ নির্মাতাদের জন্য নির্দেশনা-পুস্তক, ইত্যাদির বেলায়।

সম্ভবত যে-মানুষটি গ্রীকদের জ্ঞান-বিজ্ঞান লাতিনে স্থানান্তরের ক্ষেত্রে সবচাইতে বেশি অবদান রেখেছেন তিনি হলেন প্লিনি নামের এক বিখ্যাত কর্মকর্তা। রোমক নৌবাহিনীতে এডমিরাল ছিলেন তিনি, যে বাহিনীর প্রধান ঘাঁটি ছিল নেপলস উপসাগরে। ভিসুভিয়াসে ৭৯ খৃষ্টপূর্বাব্দে যখন অগ্ন্যুৎপাত ঘটে তখন তিনি সে বিপর্যয়ে দুর্গত লোকজনকে সাহায্য করতে গিয়ে নিজেই নিহত হন। তাঁর ভাইয়ের ছেলে ছোট প্লিনি নিজেও সেই অগ্ন্যুতপাতের সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন; তাঁর লেখা এক চিঠিতে এই নাটকীয় কাহিনীর বর্ণনা আছে। জ্যেষ্ঠ প্লিনির যে কঠিন পরিশ্রম করার অবিশ্বাস্য ক্ষমতা ছিল তা এক রকম নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এবং তিনি তাঁর জীবনের একটা উল্লেখযোগ্য সময় কাটিয়েছেন বেশিরভাগ বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের লেখা পড়ে (কখনো কখনো সেসব লেখা পাঠ করেও শোনানো হতো তাঁকে), আর তারপর তিনি লাতিনে সেগুলোর অনুবাদ বা সংক্ষিপ্তসার বলে গেছেন, অন্যেরা তা সঙ্গে সঙ্গে লিখে গেছেন। ধীরে ধীরে তিনি এই কাজটিকে একত্র করে একটি বিপুলাকার বিশ্বকোষে রূপ দিয়েছেন, এবং সেটার নাম দিয়েছেন ‘Naturalis historia’ বা, ‘Natural History’ বা, ‘প্রাকৃতিক ইতিহাস’। শিরোনামটির গ্রীক শব্দ ‘historia’-র সাধারণ মানে ‘অনুসন্ধান’ বা ‘বিজ্ঞান’, যদিও আমরা সেটাকে অতীত বিষয়ক অনুসন্ধান হিসেবেই ব্যবহার করি। যে-বইটি আপনারা পাঠ করছেন সেটার শিরোনাম (মূল সুইডিশে, ‘Latin: Kulturen, historien, språket’, আর ইংরেজিতে ‘A Natural History of Latin’; বাংলায় আপাতত সেটা বদলে রাখা হয়েছে যদিও)। বলাই বাহুল্য, প্লিনির বিখ্যাত রচনাটি থেকে এইটি অনুপ্রাণিত, এবং সেটা এই আশায় যে এখানে কেজো কিছু তথ্য আর মজার মজার কিছু এনেকডোট থাকবে, যা কিনা তাঁর সেই মহাগ্রন্থেও ছিল।

কোনো না কোনো দিক থেকে ‘Naturalis historia’ বিষয়টি আজ আমরা যাকে ‘(প্রাকৃতিক) বিজ্ঞান’ বলি সেটা নিয়েই কাজ করে, যদিও একটা দীর্ঘ সময় সেটাকে ‘Natural History’ বা, ‘প্রাকৃতিক ইতিহাস’ নামেই ডাকা হয়েছে প্লিনির বইটির নাম অনুসারে। সত্যি বলতে কি, দীর্ঘকাল ধরে — এই ১৮শ শতকেও — উদ্ভিদবিদ্যা, প্রাণিবিদ্যা, অঙ্গব্যবচ্ছেদ-বিদ্যা, খনিজবিদ্যা, এবং আরো অনেক বিষয়ে প্লিনিকে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য বিশেষজ্ঞ বলে মানা হতো। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান ধীরে ধীরে একের পর এক জ্ঞান-রাজ্যে তাঁকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেছে, এবং এখন তাঁর কাজকে বিদ্যার্জনের ইতিহাসে একটি আজব বা দুর্লভ বস্তু হিসেবেই দেখা হয় প্রায়।

জ্ঞান-রাজ্যের অন্যান্য বিশেষায়িত এলাকাতেও অন্যান্য রোমক লেখকদের বেলাতে একই কথা প্রযোজ্য। ইউরোপের ইতিহাসের একটা বিশাল অংশের ক্ষেত্রে এসব রচনাই ছিল সেরা, কিন্তু বিগত দুই শতকে সেগুলো বড্ড সেকেলে হয়ে পড়েছে। তাঁদের লেখার কিছু কিছু জিনিস বিভিন্ন জ্ঞানকাণ্ডের গোড়ার দিকের শিক্ষার্থীদের জন্য একেবারে প্রাথমিক জ্ঞানে পর্যবসিত হয়েছে, অনেকটাই প্রমাণিত হয়েছে ভুল বলে। মোটের ওপর যা টিকে আছে তা হলো লাতিন নাম ও পরিভাষা, যেগুলো অবিকল অবস্থায় অথবা খানিকটা পরিবর্তিত রূপে আধুনিক বৈজ্ঞানিক ভাষায় আজও বহাল তবিয়তে বিদ্যমান।

বিদ্যালয়গুলো ভাষাগত অনুশীলনের ওপর জোর দিলেও রোমক সমাজে অন্যান্য বিষয়ের জ্ঞানেরও যথেষ্ট প্রয়োজন ছিল বৈ কি। উচ্চশিক্ষা গ্রহণের কোনো রাস্তা খোলা ছিল না, কারণ আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় বলতে যা বোঝায় তার ছায়ামাত্র ছিল না রোমক সমাজে। সম্ভবত এক ধরনের শিক্ষানবিসী পদ্ধতির মাধ্যমে প্রবীণেরা তাঁদের কারিগরী জ্ঞান হস্তান্তর করতেন, যদিও সে-বিষয়ে বেশি কিছু জানা যায় না। তবে, বিচিত্র সব বিষয়ের ওপরে লেখা নির্দেশিকা পুস্তক হাতে এসেছে আমাদের। আগেই বলা হয়েছে, মূল শিল্প ছিল কৃষি, এবং এই বিষয়টির ওপর এন্তার হ্যান্ডবুক রয়েছে, জ্যেষ্ঠ ক্যাটোর একটি থেকে শুরু করে — যেটার কথা আগেই বলা হয়েছে — একেবারে প্রাচীনকালের শেষ দিক পর্যন্ত। সবচাইতে বিশদটি লিখেছিলেন Columella নামের এক ভূস্বামী, প্রথম খৃষ্ট পূর্বাব্দের।

রোমকরা সব ধরনের নির্মাণ প্রকল্পেও হাত লাগিয়েছিল। সম্রাট অগাস্টাসের সমসাময়িক ভিত্রুভিয়াস নামের এক ভদ্রলোক স্থাপত্যবিদ্যার ওপরে এক বিশাল নির্দেশনা পুস্তক রচনা করেছিলেন, যার নাম ‘De architectura’। এ-বিষয়ে রচিত প্রাচীন কালের এই একটি বই-ই হাতে এসে পৌঁছেছে আমাদের। বেশ প্রভাবসঞ্চার করেছিল বইটি, বিশেষ করে রেনাসাঁর সময়ে এবং তার পরবর্তীকালে, যখন মানুষ স্থাপত্যকলায় এবং অন্যান্য ধরনের শিল্পে প্রাচীনকালের শৈলীর আদর্শে ফিরে যেতে চেয়েছিল।

বিশেষ একটি যে বৈশিষ্ট্যের জন্য রোমকরা বিখ্যাত ছিল তা হলো দূর দূরান্তে পানি পরিবহনের উপায় তৈরি, যাকে ‘কৃত্রিম জলপ্রণালী’ (aqueduct) বলে। ফ্রন্টিনাস নামের এক সফল সরকারী চাকুরে, যিনি রোমের পানি সরবরাহের ব্যবস্থাপক ছিলেন, তিনি রোমের কৃত্রিম জলপ্রণালী বিষয়ে একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন, যা এখনো আমাদের কাছে রয়েছে। এই একই ভদ্রলোক আরো কিছু বই লিখেছিলেন রোমকদের আরেক বিশেষত্ব — যুদ্ধবিগ্রহ — নিয়ে, আর সেই বইগুলোরও একটি এখনো লভ্য।

কৃষক, নির্মাতা, এবং এমনকি সৈন্যদের জন্য বিশেষ যে একটি দক্ষতা বেশ কাজের তা হলো ভূমি জরিপ করতে পারা। গণিতের একটি অংশ হিসেবে গ্রীকরা জ্যামিতির বিকাশ সাধন করলেও, রোমকদের সেই অর্থে জ্যামিতিক তত্ত্ব নিয়ে মাথাব্যাথা ছিল না; তবে তারা বিদ্যাটার কিছু নির্বাচিত অংশ ভূমি জরিপের বাস্তবসম্মত প্রয়োগ-পদ্ধতি সৃষ্টিতে ব্যবহার করেছিল, এবং বিষয়ের ওপর তাদের যথেষ্ট গুরুপাক কিছু গবেষণাধর্মী রচনা আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছে।

এ-সমস্ত ব্যবহারিক ক্ষেত্রে রোমকরা বিদ্যমান গ্রীক নমুনাগুলোকে খানিকটা ছাপিয়ে যেতে পেরেছিল বলা যায়। আবার অন্য অনেক ক্ষেত্রে তারা কেবল গ্রীক জ্ঞানসম্ভার লাতিনে অনুবাদ করেই সন্তুষ্ট ছিল। তার একটি ভাল উদাহরণ হচ্ছে চিকিৎসাশাস্ত্র, যে-বিষয়ে সেই মহান হিপোক্রেটিস থকে শুরু করে গ্রীকরা এক শক্তিশালী ঐতিহ্যের অধিকারী। রোমে চিকিৎসাশাস্ত্রের ওপর বেশ কিছু নির্দেশিকা পুস্তক রচিত হয়েছিল, সেসবের মধ্যে একটির রচয়িতা সেলসাস, তবে সেগুলোর সবক’টিই প্রায় পুরোপুরি-ই গ্রীক নমুনাগুলোর ওপর ভিত্তি করে রচিত। একই কথা প্রযোজ্য পশু চিকিৎসাশাস্ত্রের নির্দেশিকা, ওষুধ নির্মাতাদের জন্য নির্দেশনা-পুস্তক, ইত্যাদির বেলায়।

সম্ভবত যে-মানুষটি গ্রীকদের জ্ঞান-বিজ্ঞান লাতিনে স্থানান্তরের ক্ষেত্রে সবচাইতে বেশি অবদান রেখেছেন তিনি হলেন প্লিনি নামের এক বিখ্যাত কর্মকর্তা। রোমক নৌবাহিনীতে এডমিরাল ছিলেন তিনি, যে বাহিনীর প্রধান ঘাঁটি ছিল নেপলস উপসাগরে। ভিসুভিয়াসে ৭৯ খৃষ্টপূর্বাব্দে যখন অগ্ন্যুৎপাত ঘটে তখন তিনি সে বিপর্যয়ে দুর্গত লোকজনকে সাহায্য করতে গিয়ে নিজেই নিহত হন। তাঁর ভাইয়ের ছেলে ছোট প্লিনি নিজেও সেই অগ্ন্যুতপাতের সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন; তাঁর লেখা এক চিঠিতে এই নাটকীয় কাহিনীর বর্ণনা আছে। জ্যেষ্ঠ প্লিনির যে কঠিন পরিশ্রম করার অবিশ্বাস্য ক্ষমতা ছিল তা এক রকম নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এবং তিনি তাঁর জীবনের একটা উল্লেখযোগ্য সময় কাটিয়েছেন বেশিরভাগ বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের লেখা পড়ে (কখনো কখনো সেসব লেখা পাঠ করেও শোনানো হতো তাঁকে), আর তারপর তিনি লাতিনে সেগুলোর অনুবাদ বা সংক্ষিপ্তসার বলে গেছেন, অন্যেরা তা সঙ্গে সঙ্গে লিখে গেছেন। ধীরে ধীরে তিনি এই কাজটিকে একত্র করে একটি বিপুলাকার বিশ্বকোষে রূপ দিয়েছেন, এবং সেটার নাম দিয়েছেন ‘Naturalis historia’ বা, ‘Natural History’ বা, ‘প্রাকৃতিক ইতিহাস’। শিরোনামটির গ্রীক শব্দ ‘historia’-র সাধারণ মানে ‘অনুসন্ধান’ বা ‘বিজ্ঞান’, যদিও আমরা সেটাকে অতীত বিষয়ক অনুসন্ধান হিসেবেই ব্যবহার করি। যে-বইটি আপনারা পাঠ করছেন সেটার শিরোনাম (মূল সুইডিশে, ‘Latin: Kulturen, historien, språket’, আর ইংরেজিতে ‘A Natural History of Latin’; বাংলায় আপাতত সেটা বদলে রাখা হয়েছে যদিও)। বলাই বাহুল্য, প্লিনির বিখ্যাত রচনাটি থেকে এইটি অনুপ্রাণিত, এবং সেটা এই আশায় যে এখানে কেজো কিছু তথ্য আর মজার মজার কিছু এনেকডোট থাকবে, যা কিনা তাঁর সেই মহাগ্রন্থেও ছিল।

কোনো না কোনো দিক থেকে ‘Naturalis historia’ বিষয়টি আজ আমরা যাকে ‘(প্রাকৃতিক) বিজ্ঞান’ বলি সেটা নিয়েই কাজ করে, যদিও একটা দীর্ঘ সময় সেটাকে ‘Natural History’ বা, ‘প্রাকৃতিক ইতিহাস’ নামেই ডাকা হয়েছে প্লিনির বইটির নাম অনুসারে। সত্যি বলতে কি, দীর্ঘকাল ধরে — এই ১৮শ শতকেও — উদ্ভিদবিদ্যা, প্রাণিবিদ্যা, অঙ্গব্যবচ্ছেদ-বিদ্যা, খনিজবিদ্যা, এবং আরো অনেক বিষয়ে প্লিনিকে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য বিশেষজ্ঞ বলে মানা হতো। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান ধীরে ধীরে একের পর এক জ্ঞান-রাজ্যে তাঁকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেছে, এবং এখন তাঁর কাজকে বিদ্যার্জনের ইতিহাসে একটি আজব বা দুর্লভ বস্তু হিসেবেই দেখা হয় প্রায়।

জ্ঞান-রাজ্যের অন্যান্য বিশেষায়িত এলাকাতেও অন্যান্য রোমক লেখকদের বেলাতে একই কথা প্রযোজ্য। ইউরোপের ইতিহাসের একটা বিশাল অংশের ক্ষেত্রে এসব রচনাই ছিল সেরা, কিন্তু বিগত দুই শতকে সেগুলো বড্ড সেকেলে হয়ে পড়েছে। তাঁদের লেখার কিছু কিছু জিনিস বিভিন্ন জ্ঞানকাণ্ডের গোড়ার দিকের শিক্ষার্থীদের জন্য একেবারে প্রাথমিক জ্ঞানে পর্যবসিত হয়েছে, অনেকটাই প্রমাণিত হয়েছে ভুল বলে। মোটের ওপর যা টিকে আছে তা হলো লাতিন নাম ও পরিভাষা, যেগুলো অবিকল অবস্থায় অথবা খানিকটা পরিবর্তিত রূপে আধুনিক বৈজ্ঞানিক ভাষায় আজও বহাল তবিয়তে বিদ্যমান।

(ক্রমশ)

জি এইচ হাবীব

জন্ম ১০ই মার্চ ১৯৬৭। পেশা: শিক্ষকতা।

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.