লাতিন ভাষার কথা : ১৫

|| বছর ও মাস || যতদূর মনে হয়, গোড়াতে ছিল কেবল দশটি মাস, যেগুলোকে আমরা মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দেখি এখন; জানুয়ারি আর ফেব্রুয়ারি যুক্ত হয়েছিল পরে। কেমন করে সেই দশ মাসের পদ্ধতি চালু হয়েছিল সেটা ঠিক করে বলা মুশকিল, কিন্তু এটা একেবারেই নিশ্চিত যে [. . .]

Tore Janson-এর সুইডিশ ভাষায় রচিত Latin: Kulturen, historien, språket গ্রন্থের Merethe Damsgård Sørensen ও Nigel Vincet-কৃত ইংরেজি অনুবাদ A Natural History of Latin-এর বাংলা ভাষান্তর

বছর ও মাস

সময় পরিমাপের এক নিজস্ব উপায় ছিল রোমকদের যা আজও কৌতূহলের উদ্রেক করে, তার কারণ আজও প্রধানত আমরা তাদের পদ্ধতিই, তাদের দেয়া মাসের নামই ব্যবহার করি। রোমে যখন রাজতন্ত্র চলছিল সেই তখনই প্রাচীনতম রোমক ক্যালেন্ডারটি প্রচলিত ছিল, এবং সম্ভবত এই ক্ষেত্রে তারা অনুপ্রেরণাটি পেয়েছিল এট্রুস্কানদের কাছ থেকে।

যতদূর মনে হয়, গোড়াতে ছিল কেবল দশটি মাস, যেগুলোকে আমরা মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দেখি এখন; জানুয়ারি আর ফেব্রুয়ারি যুক্ত হয়েছিল পরে। কেমন করে সেই দশ মাসের পদ্ধতি চালু হয়েছিল সেটা ঠিক করে বলা মুশকিল, কিন্তু এটা পুরোপুরি নিশ্চিত যে আদি রোমক বছর শুরু হতো পয়লা মার্চ থেকে; ব্যাপারটা সেই চারটে মাসের নাম থেকেই বুঝে নেয়া যায় যে-মাসগুলোকে লাতিনে বলা হতো ‘mensis September’, ‘mensis October’, ‘mensis November’, ‘mensis December’। ‘Mensis’ মানে ‘মাস’, আর নামগুলোর অন্যান্য অংশ এসেছে, স্পষ্টতই, এই সংখ্যাগুলো থেকে: ‘septem’ (সাত), ‘octo’ (আট), ‘novem’ (নয়) আর ‘decem’ (দশ)।

সংখ্যা থেকে যেসব নাম আসেনি সেগুলো এসেছে, প্রায়ই, রোমক ধর্ম থেকে। এখানে একটা অবাক করা বিষয় হলো, মাসের নামগুলো হচ্ছে বিশেষণ, আর সেগুলো জুড়ে দেয়া হয়েছে বিশেষ্য ‘mensis’-এর সঙ্গে। ‘Mensis Martius’ মানে অনেকটা ‘মার্সীয় মাস’ (Martian Month)। ‘Martius’ হলো যুদ্ধ দেবতা ‘Mars’-এর বিশেষণ। একইভাবে, ‘mensis Maius’ হলো দেবী ‘Maia’-র মাস, আর ‘mensis Ianuarius’ দেবতা ‘জানুস’ (Janus)-এর সঙ্গে সম্পৃক্ত মাস। এই দেবতাকে সাধারণত দুটি মুখবিশিষ্ট করে আঁকা বা দেখানো হয়, একটি মুখ সামনের দিকে, অন্যটি মাথার পেছনে। এই দেবতার কাজ শুরু আর শেষ নিয়ে। এবং আমরা ধরে নিতে পারি যে ‘Ianuarius’ মাস-নামটা নতুন বছরের শুরু বোঝাতেই রাখা হয়েছিল। এখানে লক্ষণীয় যে, আমরা আরো ভেবে নিতে পারি যে, জানুসের দ্বিতীয় মুখটা, যেটা মাথার পেছনে রয়েছে, সেটা তাকিয়ে আছে বিগত বছরের দিকে, অর্থাৎ যা ফেলে আসা হয়েছে, যা শেষ করে দেয়া হয়েছে তার দিকে। সেদিক থেকে, বছরের পয়লা মাসের নাম এর চাইতে ভালো আর কোনোটি হতো পারতো না।

দুটো মাসের নাম সিনেটের দেয়া। যে-মাসের আদি নাম ছিল  ‘Quintilis’ (quintus, ‘পঞ্চম’ থেকে), সেটা বদলে পরে ‘Iulius’ রাখা হয়, স্পষ্টতই, জুলিয়াস সিযারের সম্মানে, আর তার পরেরটি — গোড়ায় যা ছিল ‘Sextilis’ (sextus, ‘ষষ্ঠ’ থেকে), সেটা রাখা হয় ‘Augustus’, প্রথম রোম সম্রাটের স্মরণে। এই বশংবদ মনোবৃত্তির নিদর্শন একটা দুঃখজনক দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব রেখে গেছে বৈ কি।

অবশ্য, এই পঞ্জিকার সূত্রে সিযারকে মনে রাখার একটি উপযুক্ত কারণ আছে। তিনি-ই ব্যবস্থা নিয়েছিলেন যাতে এক পঞ্জিকাবর্ষে ততগুলো দিন থাকে যতগুলো আজও সেখানে দেখতে পাই আমরা। আমাদের জানা আছে যে, পৃথিবী মোটামুটি ৩৬৫ দিন ও ৬ ঘণ্টায় সূর্যের চারদিকে একপাক ঘুরে আসে। সেই ব্যবিলনীয়দের কাল থেকেই প্রাচীনযুগের জ্যোতির্বিদরা জেনে আসছেন এ-কথা। কিন্তু রোমে ৪৭ খৃষ্ট পূর্বাব্দ অব্দি সাধারণত একটি বছরে ৩৫৪ দিন থাকত, এবং আসল ঋতুগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের একটা গুরুতর অভাব পূরণের জন্য মাঝে মধ্যে একটা বাড়তি মাস জুড়ে দেয়া হতো। কিন্তু এই গোলমেলে পদ্ধতিটা বাস্তবসম্মত ছিল না। অসুবিধাটি দূর করে একটি নতুন পঞ্জিকা — জুলীয় পঞ্জিকা (Julian Calendar) — তৈরি করতে সিযার মিশরের জ্যোতির্বিদ্যাবিষয়ক বিশেষজ্ঞ মতামতের দ্বারস্থ হলেন। বছরের প্রতি মাসে আমরা আজও যতগুলো দিন আর প্রতি চতুর্থ বছরে ফেব্রুয়ারিতে যে মোটামুটি বাড়তি চব্বিশ ঘণ্টা দেখি তার শুরু সেই পঞ্জিকা থেকেই। আজও আমরা সেটিই ব্যবহার করি, যদিও ষোড়শ শতকে পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি বাড়তি দিন যোগ করার পদ্ধতিতে একটি সামান্য পরিবর্তন আনেন, এবং ব্রিটেনে তা ১৭৫২ খৃষ্টাব্দে কার্যকর করা হয়।

বছরের দৈর্ঘ্য আর মাসের নামগুলো আমরা রোমকদের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি। অবশ্য পঞ্জিকাটির অন্যান্য ব্যাপারে তারা ততটা সাফল্য পায়নি, বিশেষ করে একটি বছরকে কি করে আলাদভাবে শনাক্ত করা যেতে পারে এই সমস্যাটির ক্ষেত্রে।

আগেই বলা হয়েছে, গোড়াতে মার্চ-ই ছিল বছরের পয়লা মাস, এবং খৃষ্ট পূর্বাব্দ ১৫৩ সাল পর্যন্ত সে-ই ব্যবস্থাই বলবৎ ছিল, যখন সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে কনসালরা প্রতি বছর জানুয়ারির এক তারিখ থেকে তাঁদের দাপ্তরিক কাজ শুরু করবেন। এভাবে বছরের শুরুটা বদলে যায়। কনসালদের দাপ্তরিক কাজ শুরু করার দিনটি ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ, কারণ যে-বছরে যাঁরা কনসাল থাকতেন তাঁদের নাম অনুসারে রোমকরা বছরটির নামকরণ করত, আর সেই নামগুলোই সব তারিখে ব্যবহৃত হতো। যেমন, সম্রাট অগাস্টাসের জীবনীতে লেখা আছে: ‘natus est Augustus M. Tullio Cicerone C. Antonio consúlibus’ — ‘অগাস্টাসের জন্ম মারকাস তুলিয়াস সিসেরো এবং গাইয়াস এন্তনিয়াস কনসাল পদে থাকাকালীন’, যা কিনা তিনি যে ৬৩ খৃষ্ট পূর্বাব্দে জন্মগ্রহণ করেন তা বলার রোমক ধরন। সন্দেহ নেই যে এটা কোনোভাবেই একটা বাস্তবসম্মত পদ্ধতি নয়, কারণ একটি বিশেষ ঘটনা কখন ঘটেছে তা কেউ জানতে চাইলে হয় তাকে কে কবে কনসাল ছিলেন তা সময়ানুক্রমে মুখস্থ রাখতে হতো, আর নইলে দাপ্তরিক নথিপত্র ঘেঁটে দেখতে হতো। কিন্তু তারপরেও রোমকেরা গোটা প্রাচীনকাল জুড়েই একগুঁয়ের মতো এই পদ্ধতি মেনে আসে, যদিও কোনো কোনো লেখক চেষ্টা করেছিলেন সেটার বদলে আরো সহজ একটা পদ্ধতি চালু করতে, আর সে-অনুযায়ী ঘটনাবলীর কাল নির্ধারণ করা হতো রোম নগরীর পত্তনের সময়, অর্থাৎ, ৭৫৩ খৃষ্ট পূর্বাব্দ থেকে। যীশু খৃষ্টের জন্মের সময়কে মাথায় রেখে তারিখ নির্ধারণের আমাদের যে পদ্ধতি তা প্রবর্তিত হয় ৬ষ্ঠ শতক থেকে, আর তা জনপ্রিয় হতে লেগে গিয়েছিল বেশ কয়েক শতক।

আবার, মাসের দিনগুলোর নাম ঠিক করারও এক অদ্ভুতুড়ে কায়দা ছিল রোমকদের। সেগুলোর সংখ্যা নির্ধারণ করত তারা প্রতি মাসের তিনটি নির্দিষ্ট দিন থেকে, আর এই তিনটি দিনের ছিল আলাদা নাম: ‘কালেন্দে’ (Kalendae), মাসের প্রথম দিন; ‘নোনে’ (Nonae), মাসের পঞ্চম দিন; আর ‘আইডাস’ (Idus), মাসের ত্রয়োদশ দিন; তবে ব্যতিক্রম ছিল মার্চ, মে, জুলাই আর অক্টোবর; এই চারটি মাসের বেলাতে নোনে (Nonae) ছিল সপ্তম, আর আইডাস (Idus) পঞ্চদশ।

(শেক্সপীয়রের ‘জুলিয়াস সিযার’ নাটক যাঁরা পড়েছেন তাঁদের হয়ত এই প্রসঙ্গে সিযারের উদ্দেশে মার্চের ১৫ তারিখে সতর্ক থাকার ব্যাপারে এক ভবিষ্যদ্‌বক্তার উচ্চারিত বাণীটি মনে পড়ে যেতে পারে — অনুবাদক  :

Soothsayer: Beware the ides of March.

Caesar: What man is that?

Brutus: A soothsayer bids you beware the ides of March.

‘Julius Caesar’, Act 1, scene 2, 15-19 )

তো, যাই হোক, এই তিনটি তারিখ থেকে অন্য তারিখগুলো হিসেব করা হতো উল্টো দিক পরপর গুনে নিয়ে। যেমন, দোসরা ফেব্রুয়ারি বোঝাতে তাদের বলতে হতো ‘ante diem quartum Nonas Februarias’ — ফেব্রুয়ারির নোনেসের আগের চতুর্থ দিন (উল্লেখ্য, ‘ante’ মানে আগে বা পূর্বে, যেমন, ante-penultimate, মানে, শেষের আগের আগেরটি, বা শেষ থেকে ৩য়টি); বা, ২০শে ফেব্রুয়ারি বোঝাতে ‘ante diem décimum Kalendas Martius’ — মার্চের কালেন্দেসের আগের দশম দিন।

সৌভাগ্যক্রমে, মধ্যযুগে পদ্ধতিটি চিরতরে বিদায় নেয়, এবং তার বদলে যেটি আসে সেটি আমরা এখন ব্যবহার করছি, আর তা হচ্ছে মাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সাধারণভাবে দিনগুলো গুনে যাওয়া।

তারিখ নির্ধারণের প্রাচীন রোমক পদ্ধতিটির একেবারে শেষ অবশেষটুকু পাওয়া যাবে ফরাসি আর ইতালীয় ভাষায়, অধিবর্ষের (leap year) প্রতিশব্দে, যা হলো, যথাক্রমে, ‘année bissextile’ এবং ‘anno bisestile’। এই নামকরণের কারণ হচ্ছে, রোমকরা অধিবর্ষের বাড়তি দিনের সমস্যাটির সমাধান করত একটি দিনকে — নির্দিষ্ট করে বললে, মার্চের কালেন্দেসের আগের ষষ্ঠ দিন, অর্থাৎ, ২৪ শে ফেব্রুয়ারিকে — দ্বিগুণ করে দিয়ে, (মানে, ২৫শে ফেব্রুয়ারিকেও ২৪ হিসেবে গুণে), আর সেটিকে তারা বলত তখন ‘bisextus’ বা, ‘bisextilis’, যার মানে, ‘দ্বিগুণ ষষ্ঠ’।

 (ক্রমশ)

জি এইচ হাবীব

জন্ম ১০ই মার্চ ১৯৬৭। পেশা: শিক্ষকতা।

১ comment

  1. Pingback: লাতিন ভাষার কথা : ১৪ | জি এইচ হাবীব

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.