Tore Janson-এর সুইডিশ ভাষায় রচিত Latin: Kulturen, historien, språket গ্রন্থের Merethe Damsgård Sørensen ও Nigel Vincet-কৃত ইংরেজি অনুবাদ A Natural History of Latin-এর বাংলা ভাষান্তর
লাতিন হয়ে উঠলো ইউরোপের ভাষা
অগাস্টাসের শাসনামলে রোমক সাম্রাজ্যের আয়তন যা দাঁড়ায় তা চারশ বছর ধরে টিকে ছিল। রাইন নদীর পুবের আর দানিউব নদীর দক্ষিণের সমস্ত ভূভাগ, এবং ভূমধ্যসাগরের পুব ও দক্ষিণ উপকূলের সব দেশ এই সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সেকারণে ভূমধ্যসাগরকে কখনো কখনো ‘mare nostrum’ বা ‘আমাদের সাগর’ বলা হতো, এবং রোমকদের হাতেই ছিল সেটার সমস্ত উপকূলের নিয়ন্ত্রণ। সাম্রাজ্যের দাপ্তরিক ভাষা ছিল লাতিন আর, পুব দিকে, গ্রীক, যে-কথা আগেই বলা হয়েছে। তারপরেও, অগাস্টাসের সময় জনসংখ্যার বেশিরভাগ-ই নিশ্চয়ই এই দুই ভাষার বাইরে অন্যান্য আরো অনেক ভাষায় কথা বলত। পুবদিকটাতে লাতিন কখনোই জেঁকে বসতে পারেনি, তবে পশ্চিমের জনগণ ধীরে ধীরে লাতিনকেই তাদের ভাষা হিসেবে গ্রহণ করে নেয়।
আগেই বলা হয়েছে ইতালি ছিল বহুভাষিক। এখন যা ফ্রান্স তা তখন মাত্র বিজিত হয়েছে, আর সেখনাকার বেশিরভাগ লোক কথা বলত কেল্টিক ভাষায়। স্পেন আর পর্তুগালেও ছিল কেল্টিক নানান ভাষাভাষী অনেক মানুষ, তবে সেই সঙ্গে ছিল বহু লিগুয়ারীয় (Liguarians) আর ভাস্কোন-ও (Vascones) — যারা আজকের বাস্কদের পূর্বসূরী — তাদের নিজস্ব ভাষা নিয়ে। উত্তর আফ্রিকায় — অধুনা মরক্কো আর আলজেরিয়ায় — সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সম্ভবত ‘বারবার’ (Berber) ভাষায় কথা বলত; সেই ভাষাগোষ্ঠীর নানান ভাষায় আজও সেসব দেশের এন্তার মানুষ কথা বলে। আজ যেখানে তিউনিসিয়া তার মাঝবরাবর ছিল কার্থেজ, যে-নগরীর পত্তন করেছিল সিরিয়া থেকে আসা ফিনিশীয়রা; ফলে সেখানকার অগুনতি মানুষ ফিনিশীয় ভাষায় কথা বলত। প্রাচীন হিব্রু-র সঙ্গে সম্পর্কিত এই ভাষাটি নগর পত্তনকারীরা তাদের সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল।
এই সমস্ত এলাকাই রোমের শাসনাধীনে চলে আসে পরে। ইতালির অবশ্যই একটা আলাদা অবস্থান ছিল, কিন্তু বাকি সব এলাকা পেল প্রাদেশিক মর্যাদা, যার মানে, রোম থেকে নিযুক্ত এক একজন প্রশাসক সেসব প্রদেশ শাসন করতেন। স্বভাবতই, সেই প্রশাসকদের কিছু রোমক কর্মকর্তা-কর্মচারী থাকত, এবং সেই সঙ্গে যা সবসময়-ই থাকত তা হলো এক বা একাধিক সেনা ছাউনি। অবশ্য নতুন কোনো প্রদেশে সব সময়ই যে লাতিনভাষী লোকজন খুব বেশি থাকত তা নয়, যদিও সাম্রাজ্যের অগ্রযাত্রা কয়েকশ শতাব্দী ধরে অব্যাহত থাকায় একটা স্থিতাবস্থা নেমে এলে এই পরিস্থিতিটা পাল্টাতে থাকে ধীরে ধীরে, কারণ ক্রমেই আরো বেশি সংখ্যক মানুষ লাতিন ভাষা শিখতে থাকে তাদের মাতৃভাষা বর্জন ক’রে। এক্ষেত্রে সৈন্যরা আর সহকারী সামরিক প্রতিষ্ঠানগুলো একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। সেনাবাহিনী তার সমস্ত কর্মকাণ্ডে লাতিন ব্যবহার করতে থাকে, যার মানে দাঁড়ায় এই যে, বিভিন্ন প্রদেশের যেসব তরুণ-যুবক সেনাবাহিনীতে যোগ দিত তাদের সবাইকে লাতিন শিখতে হতো। মাঝে মাঝে প্রবীণ সৈন্যদের নিয়ে কিছু কলোনিও স্থাপন করা হতো যা থেকে মাঝে মাঝে বড় বড় শহর জন্ম নিত। আর সেখানকার ভাষা হতো অবশ্যই লাতিন।
যদিও, সম্ভবত আরো বড় একটা কারণ ছিল এই যে, স্থিতাবস্থায় অধিকাংশ প্রদেশেরই স্থানীয় অর্থনীতির উন্নতি ঘটেছিল বেশ; ব্যবসা-বাণিজ্য বেড়েছিল, বিদ্যমান নগরীগুলো সম্প্রসারিত হচ্ছিল, গড়ে উঠছিল নিত্য-নতুন অনেকগুলো। নিজেদের কথ্য লাতিন জ্ঞানের উপযোগিতাটা হাতে হাতেই টের পাচ্ছিল ব্যবসায়ীরা, আর, ভাষাটি লিখতে ও পড়তে বাধ্য হচ্ছিল তারা প্রায়ই। শহরে-নগরে লাতিনের প্রধান ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে খুব একটা সময় লাগেনি সম্ভবত। বহু স্থানেই চালু হয়েছিল স্কুল, আর সেসব স্কুলের ভাষা ছিল লাতিন, কখনো গ্রীক, কিন্তু স্থানীয় ভাষা? নৈব নৈব চ।
বিশদভাবে এই বিকাশটি চিহ্নিত করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়, কিন্তু খুব শিগগিরই স্পেন, ফ্রান্স এবং উত্তর আফ্রিকার মানুষ লাতিনে লিখতে শুরু করে, এবং তাদের জন্য লাতিন যেন এক রকম মাতৃভাষাই ছিল। তো, এদের মধ্যে একেবারে প্রথমদিকের একজন হলেন বাগ্মিতায় পটু সেনেকা, সম্রাট অগাস্টাসের সময় যিনি বেশ সক্রিয় ছিলেন। কয়েক শতকের মধ্যেই গোটা পশ্চিম ইউরোপের দক্ষিণাংশ আর উত্তর আফ্রিকার সমস্ত শহর জুড়ে মানুষজন সম্ভবত লাতিনভাষী হয়ে পড়ে। গ্রামে-গঞ্জে, যেখানে বেশিরভাগ মানুষ বাস করত, সেখানে চিত্রটি কেমন ছিল তা বলা খুব সহজ নয়, যেহেতু এসব বিষয়ে আমাদের খবরদাতারা সাধারণত নগরবাসীই ছিলেন। তবে পঞ্চম শতকে রোমক সাম্রাজ্যের পতনের সময় লাতিন ছাড়াও কিছু ভাষা যে অনেক গ্রামাঞ্চলে টিকে ছিল, এমন প্রমাণাদি পাওয়া গেছে; কাজেই সেসব ভাষা থেকে লাতিন ভাষায় পালাবদল হতে নিশ্চয়ই একটা দীর্ঘ সময় লেগেছিল।
কিন্তু তারপরেও এই পালাবদলটা যে ওই ভূখণ্ডের বিপুল অংশে বেশ গভীর আর স্থায়ী ছাপ রেখে গিয়েছিল সেটা আমরা ঠিকই উপলব্ধি করতে পারি এ-কথাটি বিবেচনা করলে যে, ইতালি, ফ্রান্স আর পর্তুগালের মানুষ আজ যে-সব ভাষায় কথা বলে তা সরাসরি ওই লাতিন থেকেই এসেছে। বেলজিয়াম ও সুইটযারল্যান্ডের মতো দেশের কিছু কিছু অংশের ক্ষেত্রেও কথাটি প্রযোজ্য। তাছাড়া, পুব দিকের এক দূরবর্তী দেশ, আধুনিক রুমানিয়াতেও, বেশ শক্ত ঘাঁটি গেড়েছিল লাতিন ভাষাটি। মোটামুটিভাবে, এই অঞ্চলটি ছিল রোমক প্রদেশ দাসিয়া (Dacia); অনেক দেরিতে — ১০০ খৃষ্টাব্দের ঠিক পর পরই হবে, তার আগে নয় — এই অঞ্চলটি জয় করে রোমকরা। এদিকে আবার, প্রায় ১৫০ বছর পর সেটার দখল ছেড়ে দেয় তারা; কাজেই এটা খুব অদ্ভুত যে সেখানকার ভাষা, অর্থাৎ, রুমানীয়, লাতিন থেকে উদ্ভূত হয়েছে। কি করে তা হলো তা নিয়ে অনেক তত্ত্বই প্রচলিত, আর সেগুলোর একটি এই যে, দক্ষিণাঞ্চলের প্রদেশগুলো — এককালে যেখানে লাতিন ভাষা প্রচলিত ছিল — সেখানকার লোকজন উত্তরে এই অঞ্চলে সরে আসে, কিন্তু ব্যাপারটি আসলেই তা কি না সেকথা কেউ নিশ্চিতভাবে জানে না।
সে যা-ই হোক, পশ্চিম ইউরোপের একটি বিরাট অংশ আর কৃষ্ণ সাগরের কাছের একটি এলাকায় কথ্য ভাষা হিসেবে টিকে ছিল লাতিন। কিভাবে সেটি পরে অন্যান্য ভাষার জন্ম দিয়েছিল সে-প্রসঙ্গে পরে আসা যাবে, তবে একথা সত্য যে, কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশ থেকে লাতিন অপসৃত হয়ে যায়, এবং এ-কথাটি উত্তর আফ্রিকার মতো আর কোথাও এতো সত্য নয়। সেখানকার মানুষ-জন শত শত বছর ধরে লাতিনভাষী ছিল, অন্তত শহরে-নগরে। পঞ্চম শতকে, ভ্যান্ডাল নামে একটা জার্মানিক উপজাতি এ-অঞ্চলের অধিকাংশ এলাকা দখল করে নেয়, এবং তাদের পর এটা কন্সটান্টিনোপল-এর পুবদেশীয় সম্রাটের অধীনে থাকে কিছুদিন। কিন্তু লাতিন ঠিক-ই টিকে যায়, পুরোপুরি না হলেও বেশ খানিকটা। তবে, সপ্তম শতকে আরবদের উত্তর আফ্রিকা বিজয়ের ফলে ভাষাটির সব চিহ্ন ধুয়ে মুছে যায় সেখান থেকে।
আরেকটি পশ্চিম প্রদেশে লাতিন কোনোদিনই সেভাবে স্থায়ী আসন নিতে পারেনি। অগাস্টাসের শাসনামলের খানিক পর, প্রথম শতকেই, ইংল্যান্ড ও ওয়েলস জয় করেছিল রোমকরা (যদিও স্কটল্যান্ড নয়), এবং প্রায় তিনশ বছর ধরে রোমক প্রদেশ ব্রিটানিয়া হিসেবে পরিচিত ছিল এলাকা দুটো। কিন্তু থাকলে কি হবে, রোমক জীবনধারা যেন কখনোই সম্পূর্ণভাবে গৃহীত হয়নি সেখানে, এবং পঞ্চম শতকের জার্মানিক আগ্রাসনের পূর্ব পর্যন্ত সেখানকার অধিবাসীরা তাদের কেল্টিক ভাষাই বজায় রেখেছিল।
এসব ব্যতিক্রমের কথা ছেড়ে দিলে, সুদীর্ঘ রোমক শাসনের একটি ফল হচ্ছে এই যে, ইউরোপের বেশ বড়সড় অংশ বিভিন্ন ভাষাভাষী থেকে বদলে একটি ভাষা ব্যবহারকারী, অর্থাৎ, লাতিনভাষীতে পরিণত হয়। পশ্চিম অঞ্চলের প্রায় সবাই যে একটি ভাষায় কথা বলছে সেটা রোমক সাম্রাজ্যের ঐক্যের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল, এবং ইউরোপে আধুনিক কাল পর্যন্ত ভাষার বিকাশের ক্ষেত্রেও একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা এটি।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
২ comments
Pingback: লাতিন ভাষার কথা : ১৫ | জি এইচ হাবীব
Pingback: লাতিন ভাষার কথা : ১৬ » বাংলাদেশী শীর্ষ কমিউনিটি নিউজ পোর্টাল