Tore Janson-এর সুইডিশ ভাষায় রচিত Latin: Kulturen, historien, språket গ্রন্থের Merethe Damsgård Sørensen ও Nigel Vincet-কৃত ইংরেজি অনুবাদ A Natural History of Latin-এর বাংলা ভাষান্তর
কাব্য এবং কবিকুল
লাতিন সাহিত্যের এক অসাধারণ বিকাশ ঘটে ১০০ খৃষ্ট পূর্বাব্দ থেকে ১০০ খৃষ্টাব্দের মধ্যে, যেটাকে সাধারণত সে-সাহিত্যের ধ্রুপদী যুগ বলা হয়। এ-হচ্ছে সেই সময় যখন রোমক সাম্রাজ্য সবচাইতে দ্রুতগতিতে সম্প্রসারিত হচ্ছে, অর্জন করছে তার সেরা সব সাফল্য।
কিন্তু কি লিখেছিল রোমকরা, জানতেই চাইতে পারেন অনেকে। তার উত্তর হলো, তারা খুব মন দিয়ে গ্রীক সাহিত্যের সেরা কীর্তিগুলো অধ্যয়ন করেছিল, আর তারপর এক-ই ধরনের গ্রন্থ রচনা করেছিল। প্রথমে তারা গ্রীক রচনাগুলোর অনুবাদ-অনুকরণ আর ছায়াবলম্বন করেছিল অনেক, কিন্তু ধীরে ধীরে তারা আরো উচ্চাভিলাষী হয়ে ওঠে, এবং নিজেদের ‘মৌলিক’ রচনায় হাত দেয়, যদিও অনেক দিক থেকেই সেগুলো গ্রীকদের প্রবর্তন করা লক্ষণগণ্ডির ভেতরেই রচিত হয়েছিল। এভাবে বললে কথাটা কেমন কেমন শোনালেও লাতিন সাহিত্য কিন্তু আসলেই যথেষ্ট সফলতার পরিচয় দিয়েছিল। রোমকরা যে গ্রীকদের উদাহরণ অনুসরণ করেছিল তাতে কোনো বিতর্ক নেই; এবং তাতে করে অসাধারণ কিছু নমুনা পেয়েছিল তারা তাদের সামনে, আর তারপরে তারা চেষ্টা করেছিল লাতিন ভাষায় একইরম, চাইকি তার চাইতে ভালো কিছু সৃষ্টি করতে। এই পদ্ধতিকে তারা বলত ‘aemulátio’, যার মানে কোনো কিছু অনুকরণ বা তার চাইতে ভালো কিছু তৈরি করা। এবং অনেক ক্ষেত্রেই লাতিন রচনাগুলো তাদের নমুনার সমকক্ষতা অর্জন করেছিল, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে ছাড়িয়েও গিয়েছিল সেগুলোকে।
গ্রীক আর রোমকরা যে সাহিত্য রচনা করেছিল সেরকমের সাহিত্য আজকালকার বইয়ের দোকানে দেখা যায় না। আজ যা লেখা হয় তার বেশিরভাগই উপন্যাস, অর্থাৎ গদ্যে রচিত আখ্যানমূলক লেখা। উপন্যাস কিছু রোমকরাও লিখেছিল, কিন্তু সেগুলো প্রাচীনকালে বা তার পরেও কখনো জনপ্রিয়তা লাভ করেনি। অষ্টাদশ শতকের আগে উপন্যাস তুমুলভাবে জনপ্রিয় হয়নি, এবং তখন ইংরেজি ও ফরাসির মতো আধুনিক ভাষায় তা লেখা হতে থাকে। অথচ প্রাচীনকালে সৃজনশীল বেশিরভাগ লেখাই রচিত হতো পদ্যে। সাদামাটা গদ্যে লিখিত হতো বক্তৃতা, ইতিহাস, আর বিভিন্ন ধরনের নন-ফিকশন; সেসবের কথা পরে আসবে। যা কিছু আখ্যান বা কাহিনীমূলক বা বিনোদনমূলক তা লেখা হতো পদ্যে বা কাব্যে, যেখানে টেক্সটকে কঠোরভাবে ছন্দোবদ্ধ হতে হতো; তার কিছু উদাহরণ নিচে দেয়া হলো। লেখকেরাও খুব সতর্ক তাঁদের শব্দের ব্যবহারে, এবং অন্যান্য ধরনের অভিব্যক্তি প্রকাশে। লাতিন কবিতা প্রায়ই খুব সতর্কভাবে, অনেক যত্ন নিয়ে রচিত এবং ভাষাগতভাবে অত্যন্ত পরিশুদ্ধ হতো। রচয়িতারা যে এদিকটায় এতো পরিশ্রমী আর যত্নবান হতেন তার একটা কারণ এই যে তখন সাহিত্য ছিল একটা মৌখিক মাধ্যম। আধুনিক পাঠক মৌনভাবে পাঠ করেন, বইয়ের পাতা উল্টে যেতে যেতে, কিন্তু প্রাচীনকালে লোকে পাঠ করতো শব্দ করে।
রোমে রচিত একেবারে গোড়ার দিককার সৃজনশীল বা কল্পনাবিহারী সাহিত্যের এখনো যা টিকে আছে তা হলো নাটক, যা নিয়ে আগে কিছু কথা বলা হয়েছে। প্লতাস ও তেরেন্স-এর আদি কমেডির পর নাটকের ক্ষেত্রে আর বেশি কিছু সৃষ্টি হয়নি রোমে, তবে অন্য ধরনের বেশ আকর্ষণীয় কিছু সাহিত্য রচিত হয়েছিল। বেশ কয়েকজন কবি মূলত প্রেম বা প্রণয় নিয়ে লিখে গেছেন, এবং তাঁদের মধ্যে যাঁরা সেরা তাঁদেরকে আজ-ও কেউ ছাপিয়ে যেতে পারেননি বললেই চলে। তো, সেই প্রথমদের একজন হলেন কাতাল্লুস। লেসবিয়া নামের এক নারীর প্রতি তাঁর প্রেম আমাদের বেশ কিছু তীব্র প্রণয়াবেগঘন কবিতা উপহার দিয়েছে। তার-ই একটি এরকম :
Dicebas quondam solum te nosse Cutullum, Lesbia, nec prae me velle tenere lovem. Dilexi tum te non tantum ut vulgus amicam sed pater ut gnatos diligit et generos. Nunc te cognovi. Quare etsi impensius uror, multo mi tamen es vilior et levior. ‘Qui potis est?’ inquis. Quod amantem iniuria talis cogit amare magis sed bene velle minus. বলেছিলে একদিন চেনো তুমি কেবল কাতাল্লুসকেই, লেসবিয়া, আর, আমাকে ছাড়া এমনকি জোভ-কেও বাঁধবে না আলিঙ্গনে। ভালোবাসতাম তোমায় তখন, কেবল তেমন-ই নয় সাধারণ মানুষ যেমন বাসে প্রেমিকাকে, বরং, তেমন-ও, পিতা যেমন বাসে তার পুত্রকে আর তার কন্যার বরকে। কিন্তু এখন চিনি আমি তোমায়। তাই, যদিও আমার প্রণয়াবেগ আজ তীব্রতর, কিন্তু আমার কাছে আজ অনেক সস্তা ও লঘুভার তুমি। ‘কি করে তা সম্ভব?’ তুমি শুধাও। কারণ, এমন চোট বাধ্য করে প্রেমিককে ভালোবাসতে আরো বেশি, কিন্তু পছন্দ করতে তার চাইতে কম।
এটি হচ্ছে ধারাবাহিক বেশ কিছু কবিতার একটি যেসব কবিতায় আমরা কাতাল্লুস আর লেসবিয়ার সম্পর্কের বিকাশ সম্পর্কে একটি ধারণা পাবো, এবং দেখবো তাঁদের প্রণয় শুরুর দিককার আনন্দ ও সাময়িক উন্মত্ততা থেকে কলহ-কাজিয়া ও প্রবঞ্চনার মধ্যে দিয়ে এসে এখানে তিক্ত স্মৃতি আর পারস্পরিক দোষারোপের অন্তিম পর্বে উপনীত।
কিন্তু কবি কাতাল্লুস কেবল তাঁর তীব্র ভালোবাসার কথাই লেখেন নি। বুদ্ধিমান, প্রতিভাবান এই যুবক ডামাডোলপূর্ণ এক সময়ে অল্প কিছুদিনের জন্য রোমের প্রভাবশালী ছোট একটি দলে নিজের ঠাঁই করে নিয়েছিলেন। মাত্র তিরিশ বছর বয়েসে মারা যান তিনি, এবং মৃত্যুর আগে মাত্র একটি কবিতা সংকলন প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর, যেখানে কেবল লেসবিয়া সংক্রান্ত কবিতাই ছিল না, ছিল বন্ধুদের জন্য লেখা কিছু হাস্যরসাত্মক কবিতা, দেব-দেবী সম্পর্কে কিছু, আর ছিল — যা মোটেই ফেলনা নয় — জুভেন্তাস নামের এক বালকের প্রতি তার ভালোবাসা ব্যক্ত করা কিছু কবিতা। কোনো পুরুষ একই সঙ্গে নারী ও পুরুষের প্রেমাসক্ত হলে মানুষের ভুরু কোঁচকাত না খুব একটা প্রাচীনকালে, এবং তাদেরকে বিশেষ কোনো অভিধাতেও অভিহিত করা হতো না। অস্বাভাবিক কোনো আচরণ হিসেবে গণ্য করা হতো না এটাকে।
কাতাল্লুসের বাহাদুরীর মেলা জায়গার একটা জায়গা হচ্ছে কুৎসামূলক কাব্যরচনা। তিনি যখন খৃষ্ট পূর্বাব্দ ৬০ ও ৫০-এর দশকে রোমে বাস করছিলেন তখন অর্থনীতির প্রসার ঘটছে, আর রাজনৈতিক পরিস্থিতি বেশ ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ। নানান দল, উপদল, আর সেনাপতিরা ক্ষমতা নিয়ে নির্দয় কামড়াকামড়িতে ব্যস্ত, আর সাধারণ মানুষ-ও তাদের কথাবার্তায়, আলাপ আলোচনায় এই নিয়ে সরব, পষ্ট কথা বলতে রেয়াত করছেন না কাউকেই। কাতাল্লুসের জন্য মোক্ষম সময় ছিল এটা। পরমোৎসাহে ক্ষমতাসীন আর তাঁর নিজের অপছন্দের লোকজনের পেছনে লেগে পড়লেন তিনি, এবং মাঝে মাঝে তাঁর কবিতাগুলো হয়ে উঠল দৃষ্টিকটুরকমের রূঢ়। সুরের দিক দিয়ে অপেক্ষাকৃত অনুগ্র একটি ছোট্ট কবিতা বেশ বিখ্যাত। তার কারণ, সেই সময় যাঁর সঙ্গে তাঁর বোঝাপড়া চলছে, তিনি রোমের ইতিহাসে সবচাইতে বিখ্যাত লোকদের একজন — ভাবী-ডিক্টেটর জুলিয়াস সিযার।
Nil nimumum studeo, Caesar, tibi velle placere nec scire utrum sis albus an ater homo তোমার তোষামোদ করতে আমার বয়েই গেছে, সিযার, এমনকি একথা জানার-ও ইচ্ছে নেই মানুষটা তুমি সাদা না কৃষ্ণবরণ।
কাতাল্লুসের পর অনেক কবি-ই এসেছিলেন যাঁরা প্রেম নিয়ে সাহিত্য রচনায় আত্মনিবেদন করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হচ্ছেন ওভিদ। কাতাল্লুসের কয়েক প্রজন্ম পরের এই কবি সম্রাট অগাস্টাসের রাজত্বকালে এবং যীশু খৃষ্টের জন্মের সময়ে সক্রিয় ছিলেন। তাঁর কবিতা একই সঙ্গে চমৎকার আর বেশ বুদ্ধিদীপ্ত, তবে কাতাল্লুসের চাইতে অনেক নম্র-সম্র তাঁর ভাষা। কারো ওপর চড়াও হন না তিনি, বা, এবং নিজে তিনি কোনো তীব্র আবেগ-অনুভূতির শিকার হন না। বরং, তাঁর নিজের এবং অন্যদের সব রকমের মনোরম প্রণয়ঘটিত ব্যাপারের গল্প খুব চমৎকারভাবে বলে যান তিনি। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত কাজ হলো প্রেমিক-প্রেমিকাদের জন্য, পদ্যে রচিত, এক ধরনের নির্দেশিকা পুস্তিকা। আর সেটার নাম : ‘Ars amatoria’ প্রণয়শিল্প বা ‘প্রণয়বিদ্যা’; নারীদের সঙ্গে মেশার জন্য পুরুষ, আর পুরুষের সঙ্গে মেশার জন্য নারী রোমের যথাযথ সামাজিক পরিমণ্ডলে কেমন আচার-আচরণ করবে সেসব কথা বলা আছে সেখানে। সঙ্গে একথাও বলা আছে পরিচিত হওয়ার পর তারা কি করবে, আর যৌন মিলনের বিভিন্ন আসন ও প্রাসঙ্গিক বিষয়ে সেখানে যেসব সুপরামর্শ দেয়া আছে তা বইটিকে বেশ কুখ্যাতি এনে দেয়। যদিও, এ-বিষয়ক হাল আমলের নির্দেশিকা পুস্তকে যে রকম বিশদ বিবরণ থাকে — আধুনিক যৌনসাহিত্যের (pornography) কথা বাদ-ই দেয়া গেল — সে-তুলনায় অনেক মার্জিতভাবে বলা আছে সেসব কথা সেখানে।
বেশ পরিশ্রমী কবি ছিলেন ওভিদ, এবং অন্যান্য কবিতাও লিখেছেন ঢের। তাঁর যে গ্রন্থটি সবচেয়ে বেশি পঠিত তা হলো ‘Metamorphoses’ বা ‘রূপান্তর’। শব্দটা গ্রীক থেকে ধার করে আনা, ঠিক যেমন বহু শতাব্দী পর সেটা ইংরেজি এবং অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষায় ধার নেয়া হয়। তো, এখানে সেসব রূপান্তরই আলোচিত হয়েছে যেসব আমরা রূপকথার জগতে দেখে থাকি; এই যেমন একটি কাহিনীতে বনদেবী বা পরী ‘দ্যাফনি’ (Daphne) দেবতা এপোলোর হাত থেকে বাঁচতে লরেল ঝোপে বদলে যায়। গল্পগুলো খুব সুন্দরভাবে বলেছেন ওভিদ, আর প্রাচীন পুরাণের ছড়াছড়ি সেসবের মধ্যে, কাজেই এটা আশ্চর্যের বিষয় নয় যে বহু শতাব্দী ধরে লাতিন শেখানোর জন্য বিদ্যালয়ে ব্যবহার করা হয়েছে সেসব।
সবচাইতে বিখ্যাত রূপান্তরের কাহিনীগুলোর একটি সম্ভবত পিরামিউস আর থিসবি-র করুণ কাহিনী। প্রাচীন ব্যাবিলনে পাশাপাশি বাড়িতে বেড়ে উঠেছিল তারা, কিন্তু এক সময় দুজনে পরস্পরের প্রেমে পড়লে তাদের যার যার বাবা-মা তাদের মেলামেশা বন্ধের চেষ্টা করেন। তখন তাদের দুই বাড়ীর মাঝের এক দেয়ালের ফাটলের মধ্যে দিয়ে কথা বলত তারা; এবং একদিন দুজনে ঠিক করে যে বাড়ি থেকে পালিয়ে শহরের বাইরে একটা জায়গায় পরস্পরের সঙ্গে দেখা করবে তারা। এক মারাত্মক ভুল বোঝাবুঝির কারণে পিরামিউস মনে করে থিসবিকে একটি সিংহ খেয়ে ফেলেছে, এবং চরম অনুশোচনায় সে আত্মহত্যা করে। থিসবি আসলে নিরাপদেই ছিল, কিন্তু সে এসে পিরামিউসকে মৃত অবস্থায় আবিষ্কার করার পর নিজেও আত্মঘাতী হয়।
অন্যান্য অনেক গল্পের মতো, এরপর যে রূপান্তর ঘটে তা খানিকটা আরোপিত বলে মনে হয়, স্বতঃস্ফূর্ত নয়। একটি মালবেরি গাছের নিচে আত্মহত্যা করে পিরামিউস, এবং সে-গাছের ফলগুলো তার রক্তের কারণে কালো হয়ে যায়। সেজন্যেই কাঁচা অবস্থায় মালবেরি ফল সাদা থাকলেও পাকলে সেগুলো কালো হয়ে যায়। ওভিদের পর পিরামিউস আর থিসবির কাহিনী বহুবার বহুজনের মুখে বহুস্থানে বর্ণিত হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে সেরা হচ্ছে শেক্সপীয়রের ‘A Midsummer Night’s Dream’-এ একটি প্রহসন বা বিদ্রূপাত্মক প্যাসেজ, যেখানে একদল দোকানী এই গল্পের তাদের এক অপেশাদার পার্ফর্মেন্স-এর মহড়া দেয় আর তখন সেটা হয়ে ওঠে মূল নাটকের ভেতরে এক প্যারোডি।
প্রেমের কবিতা বেশ গুরুত্বপূর্ণ আর লোকজনের পছন্দের হলেও রোমক লেখকরা সেটাকে সর্বোচ্চ আসনে বসাননি, যা আসলে নির্দিষ্ট ছিল মহাকাব্যের জন্য। এবং সম্রাট অগাস্টাসের আমলেই রচিত হয়েছিল সবচেয়ে বিখ্যাত লাতিন কাব্য। দীর্ঘ, মনকাড়া কোনো কাহিনী লিখতে হলে গ্রীক ও রোমকরা সাধারণত হেক্সামিটার ব্যবহার করত। আর সেটা সাবার আগে যে মহান কবি করেছিলেন তিনি হোমার, ‘ইলিয়াড’-ও ‘ওডেসি’-র রচয়িতা। পরে অনেকেই চেষ্টা করেছেন তাঁর মতো দীর্ঘ কাব্য রচনা করার, গ্রীক, লাতিন দু’ভাষাতেই, কিন্তু তাঁদের মধ্যে বেশীরভাগই সঙ্গত কারণেই বিস্মৃত হয়েছেন।
কিন্তু একজন রোমক — নাম তাঁর ভার্জিল (৭০-১৯ খৃষ্ট পূর্বাব্দ) — ঠিকই সফল হয়েছিলেন। তিনি প্রথম তাঁর অসাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন রাখালিয়া জীবন নিয়ে রচিত ধারাবাহিক কিছু কবিতা ‘Bucolica’ বা, ‘Eclogae’-এ। চমৎকার এই কবিতাগুলোয় রয়েছে গ্রামীণ পরিবেশে সহজ-সরল কিছু মেষপালকের কথা যারা রহস্যজনকভাবে মাঝে মাঝে কবিদের মতো, এমনকি কখনো কখনো দ্রষ্টা বা পয়গম্বরদের মতো কথা বলে ওঠেন। বিখ্যাত চতুর্থ ‘Eclogue’-এ এক শিশুর জন্ম সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে বড় হয়ে যে কিনা জগতের ত্রাতা রূপে আবির্ভূত হবে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে খৃষ্টানরা এটাকে যীশু খৃষ্টের আগমনের একটি ভবিষ্যদ্বাণী হিসেবে দেখেছে, বা ব্যাখ্যা করেছে। এবং তার ফলে এই কাব্যের রচয়িতা মধ্যযুগে লাভ করেন পেগান বা বহুদেবত্ববাদী লেখকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ জনের সম্মান।
পরে ভার্জিল খোদ হোমারের সঙ্গে পাল্লা দেয়ার প্রয়াস পান একটি দীর্ঘ কবিতা বা ‘epos’ লিখে, যার বিষয়বস্তু ‘ইলিয়াড’ আর ‘ওডেসি’-র মতোই, যদিও তা লাতিন ভাষায় ও রোমক রুচি অনুযায়ী রচিত। দুর্দান্তভাবে সফল হয়েছিলেন তিনি তাঁর প্রয়াসে, এবং তাঁর সেই প্রচেষ্টার ফসল ‘Aeneid’-কে কোনো সমালোচক সাহিত্যের সামগ্রিক ইতিহাসে সেরা রচনা বলেও অভিহিত করেছেন। নিচে সেটির প্রথম কয়েক চরণ মূল লাতিন ভাষায় দেয়া হলো, পরে দেয়া হবে তার গদ্য বাংলা অনুবাদ আর সবশেষে জন ড্রাইডেন-এর বিখ্যাত ইংরেজি তর্জমা।
Arma virumque cano, Troiae qui primus ab oris Italiam, fato profugus, Laviniaque venit litora, multum ille et terris iactatus et alto vi superum saevae memorem Iunonis ob iram; multa quoque et bello passus, dum conderet urbem, inferretque deos Latio, genus unde Latinum, Albanique partes, atque altae moenia Romae. শোনাচ্ছি আয়ুধ আর এক মানুষের কথা, নিয়তির ফেরে পলাতক হয়ে প্রথমে যে ইতালী আর লাভিনীয় তীরে এসেছিল ট্রয়ের উপকূল থেকে; হিংস্র ও ভয়ানক জুনোর ক্ষমাহীন রুদ্র রোষের কারণে আকাশের দেবকুলের শক্তির তোড়ে জলস্থলে কোণঠাসা হয়ে যুদ্ধে অনেক যন্ত্রণা সয়েছে যে নগরটি পত্তন করার এবং ল্যাটিয়ামে দেবতাদের অধিষ্ঠিত করার আগ পর্যন্ত, যেখানে এলো লাতিন মানুষেরা, আলবীয় পিতাগণ, আর গৌরবময় রোমের সুউচ্চ দেয়াল।
ড্রাইডেন-এর অনুবাদ :
Arms, and the man I sing, who, forc’d by fate, And haughty Juno’s unrelenting hate, Expell’d and exil’d, left the Trojan shore. Long labours, both by sea and land, he bore, And in the doubtful war, before he won The Latian realm, and built the destin’d town; His banished gods restor’d to rites divine, And settled sure succession in line, From whence the race of Alban fathers come, And the long glories of majestic Rome.
এ-ধরনের ছন্দ বা লয় অন্তহীনভাবে ধরে রাখা যায়, আর সত্যি বলতে কি “ঈনীড”-এ চরণের সংখ্যা প্রায় ১০,০০০। যে-চরণগুলো এখানে উদ্ধৃত হলো সেখান থেকেই সেটার প্লট সহজেই অনুমান করে নেয়া যায়। গ্রীক আর ট্রোজানদের মধ্যে যুদ্ধে বিজিত ট্রোজানদের পক্ষে ছিলেন ঈনিয়াস, এই আখ্যানের নায়ক, এবং যুদ্ধটা হয়েছিল এখন যে-দেশটি তুরস্ক নামে পরিচিত সেটির পশ্চিম উপকূলে। কিছু সঙ্গী-সাথীসহ সাগর পথে পালিয়ে যান ঈনিয়াস, এবং বহু ঘটনা-দুর্ঘটনার পর লাতিয়াম-এর উপকূলে এসে নামেন রোমকদের উত্তরপুরুষ হিসেবে। বলা হয়ে থাকে খোদ ঈনিয়াস জুলীয় গোত্রের পূর্ব-পুরুষ, যে-গোত্রের অন্যতম সদস্য ছিলেন সম্রাট অগাস্টাস।
কাব্যটি বীর, বীরাঙ্গনা আর দেব-দেবীদের এক সুদীর্ঘ কাহিনী। ঈনিয়াসের মা দেবী ভিনাস; আর পুরো বিষয়টিই এমনভাবে পরিকল্পনা করা হয়েছে যাতে রোমকদেরকে, বিশেষ করে সম্রাট মহাশয়কে, একটি উপযুক্ত, গৌরবময় বংশপরিচয় প্রদান করা যায়। আর এই চাহিদা পূরণে আমাদের ঈনিয়াস বড়োই মানানসই। তিনি সুদর্শন, শক্তিমান, ধার্মিক, সাহসী, নিবেদিতপ্রাণ এবং জ্ঞানী; সত্যি বলতে কি, কারো কারো চোখে একটু বেশি-ই নিখুঁত। তবে রোম ও রোমকদের মহিমান্বিতকরণের চাইতে, যে শক্তিশালী আবেগ এই কাব্যের মধ্যে দিয়ে সঞ্চারিত করা হয়েছে সেটার জন্যই বরং এই মহৎ কাব্যপাঠ আমাদের জন্য জরুরি। এই কাব্যে ভার্জিলের অন্তঃশীল সুরটি বড়ই অপূর্ব ও করুণ, যা সহজেই পাঠকের মন কেড়ে নেয়।
রচনাটি মূলত ‘míseri mortales’ বা “হতভাগ্য মানুষদের” নিয়ে; অন্য কথায়, আপনাকে আমাকে নিয়ে। এই পরিস্থিতিটি সবচেয়ে স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে সেই বিখ্যাত পর্বে যখন ঈনিয়াস ঘুরতে ঘুরতে এক সময় রানী দিদোর রাজ্য কার্থেজ এসে পৌঁছান। শিগগিরই, এক তীব্র আবেগপূর্ণ প্রণয় গড়ে ওঠে দুজনের মধ্যে, এবং দিদো মনে করেন ঈনিয়াস বুঝি তাঁকে বিয়ে করে কার্থেজের সিংহাসনে বসবেন। কিন্তু দেবতাদের সংবাদবাহক হার্মেস এসে ঈনিয়াসকে জানায়, তা হবার নয়। ঈনিয়াসের জীবনের দৈবনির্দিষ্ট কাজ হচ্ছে ইতালিতে গিয়ে রোম নগরী পত্তন করা। একান্ত বাধ্যগত ঈনিয়াস তাঁর লোকজনকে হুকুম করেন জাহাজে উঠে আবার সমুদ্রে পাড়ি জমাতে। এদিকে তাঁর এই সিদ্ধান্তে হতাশায় ভেঙে পড়েন দিদো, তারপর কাপুরুষ ঈনিয়াসকে অভিশাপ দিতে দিতে আগুনে পুড়ে আত্মাহুতি দেন একটি চিতায়।
‘ঈনিড’-এর প্লটটি টিভি সোপ অপেরার মতোই প্যাঁচানো। তবে একটা পার্থক্য হচ্ছে ভার্জিলের সহানুভূতি রয়েছে দুদিকেই : দিদো, যাঁর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে, তার দিকে যেমন, তেমনি ঈনিয়াসের প্রতি-ও, যিনি কর্তব্যের প্রতি দায়বোধ থেকে দিদোর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন। ভার্জিলের জগতে প্রত্যেককেই কোনো না কোনো গুরুভার বহন করতে হয়।
তো, ভার্জিলের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন আরেক খ্যাতনামা কবি হোরেস। জীবনকে তিনি দেখেন ভার্জিলের চাইতে আরেকটু লঘু দৃষ্টিতে, যদিও সে দেখাও একই রকম গুরুত্বপূর্ণ। তাঁরও অনেক কবিতা হেক্সামিটারে লেখা, যদিও সেসবের সুর বিষাদাত্মক, বীররস পূর্ণ নয়, বরং তাতে একটা আলাপচারিতার, এমনকি খোশগল্পমূলক ভাব আছে। দ্রুতগতি বিশিষ্ট, সুচিন্তিত যুক্তি-তর্কমণ্ডিত সেসব লেখা, কিন্তু তারপরেও তাদের ভাবানুষঙ্গগুলো মাঝে মাঝেই এমন দিকে মোড় নেয় যা আগে থেকে অনুমান করা সম্ভব নয় পাঠকের পক্ষে।
হোরেস বিখ্যাত হয়ে আছেন তাঁর আকারে তুলনামূলকভাবে ছোট কবিতার সংগ্রহের জন্য, যে কবিতাগুলোকে ওউড (Ode) বলা হয়ে থাকে। সাধারণত চার পংক্তির একেকটি স্তবক বিশিষ্ট, বিচিত্র মাত্রায় লেখা এই কবিতাগলোর বিষয়বস্তুও বিচিত্র : যেমন রাজনীতি, বন্ধুত্ব, এবং প্রেম, তবে অনেকগুলোই আবার আমাদের বলে কি করে জীবন যাপন করা উচিত, অর্থাৎ কিনা সেগুলো হচ্ছে পদ্যে-বর্ণিত জ্ঞানকথা। একটি কবিতার শুরু এভাবে:
Otium divos rogat in patenti prensus Aegaeo, simul atra nubes condidit lunam neque certa fulgent sidera nautis; otium bello furiosa Trace, otium Medi pharetra decori, Grosphe, non gemmis neque purpura venale nec auro. Non enim gazae neque consularis summovet lictor miseros tumultus mentis et curas laqueata circum tecta volantis. Vivtur parvo bene, cui paternum splendet in mensa tenui salinum nec levis somnos timor aut cupido sordidus aufert. Quid brevi fortes iaculamur aevo multa? Quid terras alio calentis sole mutamu? Patriae quis exsul se quoque fugit?
আক্ষরিক অনুবাদে কথাগুলোর মানে হলো :
উন্মুক্ত ঈজিয়ান সাগরবক্ষে ঝড়ের কবলে পতিত নাবিক প্রার্থনা করে বিরামের, যখন এক কালো মেঘ গ্রাস করেছে চাঁদ, যখন স্থির নক্ষত্রেরা আর আলো দেয় না নাবিকদের। হিংস্র যুদ্ধক্ষেত্রে থ্রেস প্রার্থনা করে বিরামের, বিরাম প্রার্থনা করে মীড তার সুসজ্জিত তূণ নিয়ে। মণি-মাণিক্য বা স্বর্ণ বা রাজকীয় নীলাভ-লাল পোশাক দিয়ে শান্তি কেনা যায় না, গ্রসফাস। ধন-সম্পদ বা কনসালের লিক্তর (lictor) মনের করুণ, বিক্ষিপ্ত দশা বা ঘরের প্যানেলশোভিত ছাদের দিকে ধেয়ে আসা দুশ্চিন্তা দূর করতে পারে না। স্বল্পে যার তুষ্টি, যার বাবার লবণদানী ঝকমক করে তার নিরাভরণ টেবিলে, হীন ঘৃণা আর ভীতি যার প্রশান্ত নিদ্রা হরণ করতে পারে না তার জীবন-ই সুন্দর। ক্ষুদ্র এই জীবনে এতো কিছুর পিছে প্রাণান্ত করে ছুটি কেন আমরা? এক ভিন্ন সূর্যের আলোয় আলোকিত দেশের জন্য কেন বদল করি আপন দেশ? কোন নির্বাসিত মানুষটি পেরেছে নিজের কাছ থেকে আলাদা হতে?
আর, নীচে দেয়া হলো অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের লাতিন ভাষার প্রাক্তন অধ্যাপক জন কনিংটন-এর করা পদ্যানুবাদ :
For ease, in wide Aegean caught, The sailor prays, when clouds are hiding The moon, nor shines of starlight aught For seaman’s guiding : For ease the Mede, with quiver gay: For ease rude Thrace, in battle cruel: Can purple buy it, Grosphus? Nay, Nor gold, nor jewel. No pomp, no lictor clears the way ‘Mid rabble-routs of troublous feelings, Nor quells the cares that sport and play Round gilded ceilings. More happy he whose modest board His father’s well-worn silver brightens; No fear, nor lust for sordid hoard, His light sleep frightens. Why bend our bows of little span? Why change our homes for regions under Another sun? What exiled man From self can sunder?
প্রাচীন কবিতার ক্ষেত্রে যা হয়, সেখানে অনেক পরোক্ষ উল্লেখ (allusions) থাকে যা ব্যাখ্যার প্রয়োজন রাখে। থ্রেস হচ্ছে থ্রেসীয়দের মাতৃভূমি, যারা মিডদের সঙ্গে মিলে রোমকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। লিক্তর হলো রাষ্ট্রের নেতৃস্থানীয়দের দেহরক্ষী হিসেবে দায়িত্বপালনকারী এক ধরনের পুলিশ; কাজেই, লিক্তর পরিবেষ্টিত হয়ে থাকার মানে সমাজের সর্বোচ্চ চূড়ায় ওঠা। গ্রফাস হচ্ছেন তিনি যাঁর উদ্দেশে কথাগুলো বলা হচ্ছে কবিতায়। মিতাচার ও প্রশান্তি, আজীবন জীবনকে উপভোগ করার সামর্থ্য, এসব বিষয় নিয়েই কথা বলা পছন্দ হোরেসের। কবিতার বার্তাটি স্বরগ্রামের দিক থেকে নীচু এবং অ-চমকপ্রদ হলেও শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তা বহু মানুষকে আকৃষ্ট করেছে।
হোরেশীয় ওউড-এর কাঠামো আর শৈলী ইংরেজভাষী যেসব কবি অনুসরণ বা অনুকরণ করেছেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন মার্ভেল, গ্রে ও কিটস। নিচে এন্ড্রু মার্ভেল রচিত একটি বিখ্যাত কবিতা ‘An Hoartian Ode upon Cromwell’s Return from Ireland’-এর সূচনাংশ উদ্ধৃত হলো :
The forward youth that would appear Must now forsake his Muses dear, Nor in the shadows song His numbers languishing. ‘Tis time to leave the books in dust, And oil th’ unused armour’s rust, Removing from the wall The corslet of the hall. So restless Cromwell could not cease In the inglorious arts of peace, But thorough advent’rous war Urged his active star.
ভার্জিল আর হোরেস — তাঁদের কম বয়েসী সমসাময়িক কবি ওভিদের মতোই — তাঁদের নিজেদের সময় থেকে আজ অব্দি স্কুলে পাঠ্য। প্রায় দু’হাজার বছর ধরে লাতিন-ই ছিল বিদ্যালয়ের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ পাঠ্য বিষয়; এ নিয়ে আমরা পরে আলোচনা করবো। স্কুল কারিকুলাম (curriculum) বা পাঠ্যসূচীতে কাব্যপাঠ সবসময়-ই একটি বিশেষ অংশ হিসেবে ছিল, আর তাই ইউরোপের পুরো ইতিহাসে এই কবিতাগুলো অন্য যে কোনো কবিতার চাইতে অনেক বেশি পরিচিত। ভালো কথা, ইংরেজি ‘curriculum’ শব্দটি এসেছে লাতিন ‘currículum’, মানে, ‘দৌড় প্রতিযোগিতা’ (a race) থেকে, যা আবার তৈরি হয়েছে ক্রিয়াপদ ‘cúrrere’, মানে, ‘দৌড়ানো’ (to run) থেকে।
বলাই বাহুল্য, লাতিন সাহিত্যের ইতিহাসে সবচাইতে খ্যাতিমান কবিদের যুগ অর্থাৎ সম্রাট অগাস্টাসের কালের পর রোমকরা কাব্য রচনায় ক্ষান্ত দেয়নি একেবারেই। কিন্তু সত্যি বলতে কি, সেই বিখ্যাত কবিদের কোনো উত্তরসূরীই পূর্বসূরীদের কীর্তি বা খ্যাতি কোনটারই সমকক্ষতা অর্জন করতে পারেননি। প্রাচীন কালের দ্বিতীয়াংশের বেশ কিছু কবিতা আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছে, আর সেসবের অনেকগুলোই বেশ সুপাঠ্য, যেমন জুভেনালের ব্যাঙ্গাত্মক কবিতা। কিন্তু বিশেষজ্ঞ ছাড়া তেমন কেউ আর সেগুলো পাঠ করেন না এখন।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
২ comments
Pingback: লাতিন ভাষার কথা : ১৬ | জি এইচ হাবীব
Pingback: লাতিন ভাষার কথা : ১৭ » বাংলাদেশী শীর্ষ কমিউনিটি নিউজ পোর্টাল