Tore Janson-এর, সুইডিশ ভাষায় রচিত Latin: Kulturen, historien, språket গ্রন্থের Merethe Damsgård Sørensen ও Nigel Vincet-কৃত ইংরেজি অনুবাদ A Natural History of Latin-এর বাংলা অনুবাদ
লাতিন কি করে লাতিন হলো
আদি রোমকরা কি করে নিজেদের একটি ভাষার অধিকারী হলো? অন্যান্য ভাষার সঙ্গে সম্পর্কটা কেমন ছিল এই ভাষার? একুশ শতকের মানুষের কাছে এটা খুব আশ্চর্যের বিষয় বলে মনে হতে পারে যে ছোট্ট একটি স্থানের মাত্র হাজার কয়েক লোক একটি আলাদা ভাষায় কথা বলছে। বাংলা, ইংরেজি, জার্মান, ফরাসি, হিস্পানি, ইতালীয় ভাষায় কোটি কোটি মানুষ কথা বলে এবং বিশাল এলাকা জুড়ে তাদের বাস। অবশ্য সারা দুনিয়া জুড়েই যে এই চিত্র তা নয়। ইউরোপে যতোগুলো ভাষা আছে তার অন্তত দশ গুণ বেশি আছে আফ্রিকায়, যদিও দুই মহাদেশে জনসংখ্যা প্রায় সমান। ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক দিক থেকে বিচার করলে দেখা যায়, ভাষা আর রাষ্ট্র বা স্বাধীন রাজনৈতিক সত্তার সংখ্যার মধ্যে শেষমেষ একটা জোরালো সম্পর্ক থাকে। অনেক আগে — যখন কোনো বড় রাষ্ট্র ছিল না, ছিল বেশিরভাগই কেবল ছোট ছোট উপজাতি বা গোত্র — তখন বড় কোনো ভাষাও ছিল না। তার কারণ হলো, মানুষের ভাষা ক্রমাগত বদলে যেতে থাকে। যে-জনগোষ্ঠীর অন্য জনগোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে খুব একটা যোগাযোগ থাকে না, তাদের এক নিজস্ব ভাষা গড়ে ওঠে ধীরে ধীরে, যে-ভাষা অন্য সব জনগোষ্ঠীর ভাষাগুলো থেকে আলাদা, যদিও হয়ত একসময় তারা সবাই পাশপাশি বসবাসকারী লোকজনের মতোই একই ভাষায় কথা বলতো।
বলতে গেলে সেভাবেই রোম নামের ছোট্ট নগরের ভাষাও স্থানীয়ভাবে গড়ে উঠেছিল। তবে আশেপাশের ভাষা থেকে তা একেবারে ভিন্ন ছিল না। বেশ কয়েকটি ভাষার সঙ্গে মিল ছিল লাতিনের। তাদের মধ্যে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ওস্কান (Oscan) ও আম্ব্রিয়ান (Umbrian)। ইতালির যে এলাকাটি এখনো আম্ব্রিয়া নামে পরিচিত— ল্যাটিয়ামের উত্তর ও পুব দিকে — সেখানেই প্রচলিত ছিল আম্ব্রিয়ান ভাষাটি। আর ওস্কান ছিল মূলত দক্ষিণ ইতালির এক বিরাট এলাকার ভাষা। দুই ভাষারই ছিল লেখ্য রূপ আর, এই দুই ভাষায় লেখা উল্লেখযোগ্যসংখ্যক উতকীর্ণ লিপি এখনও বর্তমান, যার বেশিরভাগেরই পাঠোদ্ধার করা গেছে। দেখা গেছে ওস্কান, আম্ব্রিয়ান আর লাতিন ভাষা ব্যাকরণ ও শব্দভাণ্ডারের দিক থেকে যথেষ্ট এক, যদিও এতোটা নয় যে সেই মিলের ভিত্তিতে তাদেরকে এক-ই ভাষা বলা যায়। ফারাকটা ছিল সুইডিশ আর জার্মান, বা, ইতালীয় আর হিস্পানির মধ্যে ফারাকের মতো, কিংবা, আরো বেশি হলে ইংরেজি ও জার্মান বা ফরাসি ও ইতালীয়-র মধ্যে তফাতের মতো। ওস্কান, আম্ব্রিয়ান, লাতিন এবং কিছু ছোট ভাষা মিলে তৈরি হয়েছে ভাষাবিদেরা যাকে বলেন ইতালীয় ভাষাসমূহ, আর ধারণা করা হয় যে এই ভাষাগুলোর মধ্যে মিলের কারণ হচ্ছে, কোনো এক সময় একটি সাধারণ ইতালীয় ভাষা ছিল, যদিও সে-বিষয়ে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
তবে যে-বিষয়টি নিশ্চিত তা হলো, ইতালীয় ভাষাসমূহ আরো বড়ো একটি ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে একটি ছোট দল বা গোষ্ঠী, আর যেহেতু এই ভাষাগুলোর শব্দরাজি ও ব্যাকরণগত নানান বিষয়ে বেশ মিল রয়েছে তাই সেগুলোর নিশ্চয়ই একটি সাধারণ ঐতিহাসিক উতস ছিল। এই বৃহত্তর ভাষাগোষ্ঠীর নাম ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠী; বেশিরভাগ ইউরোপীয় ভাষাই এই ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত, সঙ্গে রয়েছে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, ইরান, আর আফগানিস্তানের অসংখ্য ভাষা। ইন্দো-ইউরোপয়ীর মধ্যে আবার ইংরেজি রয়েছে জার্মানিক ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে, যেখানে আছে জার্মান, ওলন্দাজ আর স্ক্যান্ডিনেভীয় নানান ভাষা। একথার অর্থ আবার এই যে, ইংরেজি ও লাতিন একই বিরাট ভাষা পরিবারের সদস্য, ঠিক যেমন ইংরেজি আর ফারসি, বা ইংরেজি আর হিন্দি। সাধারণত মনে করা হয় যে, এসমস্ত ভাষার মধ্যে মিলের কারণ হলো আরো অনেক আগের একটি সাধারণ ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা, যার অন্তত আংশিক পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেছেন নানান পণ্ডিত ও বিদগ্ধজন।
সে যা-ই হোক, ইংরেজি আর লাতিনে এরকম শব্দ খুব কমই আছে যেগুলো সরাসরি একই ইন্দো-ইউরোপীয় উৎস থেকে এসেছে বলে তাদের মধ্যে মিল দেখতে পাই আমরা। সেই অল্পসংখ্যক শব্দের একটি হলো লাতিন ‘mus’ (ইঁদুর), ইংরেজি ‘mouse’, যার সদৃশ রূপ রয়েছে সংস্কৃত, আবেস্তাঁ, আরমেনীয় আর গ্রীক ভাষায়। ধ্বনি পরিবর্তনের কারণে এই শব্দগুলোর ব্যঞ্জনবর্ণগুলো এক, কিন্তু স্বরবর্ণ আলাদা। (মজার বিষয় হলো, অনেক স্কটিশ উপভাষার আধুনিক উচ্চারণ লাতিনের উচ্চারণের কাছাকাছি, কারণ সীমান্তের দক্ষিণের উপভাষাগুলোর মতো সেগুলো একই ‘স্বরবর্ণ পরিবর্তনের’ (vowel change) মধ্যে দিয়ে যায়নি।
পরস্পর সম্পর্কিত আরেকটি দল হচ্ছে ‘mother’, ‘father’, ‘brother’; আর এই শব্দগুলোর লাতিন প্রতিরূপ হলো — জানেন অনেকেই — ‘mater’, ‘pater’, ‘frater’; যদিও এখানে স্বর, ব্যঞ্জন দুই ধরনের বর্ণই বদলে যাওয়াতে মিলটা চট করে ধরা যায় না। লাতিন রূপগুলোর আরো বেশি কাছের বরং ইংরেজি বিশেষণগুলো — ‘maternal’, ‘paternal’, ‘fraternal’; কিন্তু তার কারণ হচ্ছে এই ইংরেজি শব্দগুলো সরাসরি লাতিন থেকে ধার-করা, সেগুলো প্রাচীন ইন্দো-ইউরোপীয় পূর্বসূরী ভাষার একই বা অংশভাগী উত্তরাধিকারের ফল নয়।
সত্যি বলতে কি, এসব শব্দ যে ৫,০০০ বছরেরও বেশি সময়ের পৃথক ও স্বাধীন বিকাশের পরেও এমনকি আংশিক মিলসম্পন্ন সেটাই আশ্চর্যের কথা। লাতিন ও ইংরেজির একই উত্তরাধিকারের ফল হিসেবে চিহ্নিত করা যায় এমন শব্দ এক মুঠোর বেশি পাওয়া যায়নি, আর মাঝে মাঝে তো ধ্বনির মিলও খুঁজে পাওয়া যায় না। যেমন, লাতিন সর্বনাম ‘ego’ আর ইংরেজি ‘I’- এর উৎস এক হলেও শব্দ দুটো মধ্যে যে মিল রয়েছে তা সাধারণ মানুষের পক্ষে বুঝে ওঠা সম্ভব হয় না।
বোঝার কৌশলটা হলো সংশ্লিষ্ট ধ্বনির নিয়মবদ্ধ প্যাটার্ন লক্ষ করা। সেইসব প্যাটার্নের একটি হলো এই যে, ইংরেজি ‘f’ প্রায়ই লাতিন ‘p’-এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট; এই যেমন ইংরেজি ‘fater’ আর লাতিন ‘pater’; বা, ইংরেজি ‘fish’ আর লাতিন ‘pisces’।
এটা অবশ্য বেশ সোজাসাপ্টা। কিন্তু আরো অবাক-করা কিছু উদাহরণ রয়েছে যেগুলোর বেলাতেও কথাটি খাটে। যেমন, লাতিন ‘qu’ মাঝে মাঝে ইংরেজি ‘f’-এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়, কখনো বা ‘v’ এর সঙ্গে। আর তাতে করে ইংরেজি ‘five’ -এর সঙ্গে লাতিন ‘quinque’-এর সম্পর্ক প্রমাণ করা যায়।
লাতিন ও ইংরেজি শব্দের মাঝে সম্পর্ক বোঝা আরো কঠিন হয়ে পড়ে তখন যখন তাদের অর্থের পরিবর্তন ঘটে। ইংরেজি ‘qucik’ আর লাতিন ‘vivo’ (live, জ্যান্ত)-এর মধ্যে যে সম্পর্ক রয়েছে তা শব্দ দুটোর ব্যঞ্জনবর্ণে উল্লেখিত সংশ্লিষ্টতার সূত্র প্রয়োগ ক’রে নির্ণয় করা গেলেও, আদি অর্থর্ ‘live’ (জ্যান্ত) খুঁজে পাওয়া যাবে কেবল ইংরেজি এসব নির্দিষ্ট অভিব্যক্তি ‘the quick and the dead’ (জীবিত ও মৃত) বা ‘quicksilver’ (‘পারদ’; চঞ্চল এই মৌলিক পদার্থটি জ্যান্ত নিশ্চয়ই) এ-ই। তুলনামূলক ভাষাতাত্ত্বিক গবেষণা এভাবে কি করে প্রাগৈতিহাসিক সম্পর্ক খুঁজে বের করতে পারে তা এক বিস্ময়ের ব্যাপার বৈ কি।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
১ comment
Pingback: লাতিন ভাষার কথা : ১ | জি এইচ হাবীব