Tore Janson-এর, সুইডিশ ভাষায় রচিত Latin: Kulturen, historien, språket গ্রন্থের Merethe Damsgård Sørensen ও Nigel Vincet-কৃত ইংরেজি অনুবাদ A Natural History of Latin-এর বাংলা অনুবাদ
ছোট্ট এক নগর থেকে এক বিশাল ক্ষমতার দিকে
নিজস্ব এক ছোট্ট ভাষার অধিকারী ছোট্ট রাষ্ট্র রোমের বেশ কিছু প্রতিবেশী ছিল, আর, খৃষ্টের জন্মের পাঁচশত বছর আগে ইতালীয় উপদ্বীপে ছিল ছোট ছোট অনেক রাষ্ট্র। রোমের উত্তরে ছিল এট্রুস্কানেরা, যাদের কথা আগেই বলা হয়েছে; তবে তারা কিন্তু একটি রাষ্ট্রে ছিল না, ছিল বেশ কিছু আলাদা নগর রাষ্ট্রে। তাদের ছিল নিজস্ব ভাষা, তবে সেটা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত নয়, এমনকি সংরক্ষিত হয়েছে এমন কোনো ভাষার সঙ্গেই সম্পর্কিত নয় সেটি। নিজস্ব বর্ণমালা ছিল তাদের; এট্রুস্কান ভাষায় লেখা প্রচুর উতকীর্ণ লিপি পাওয়া গেছে। বেশ কয়েক শতাব্দী এট্রুস্কানদের ওপর নির্ভরশীল ছিল রোমকরা, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুভাবেই, এবং অনেক কিছুই তারা গ্রহণ করেছিল এট্রুস্কানদের কাছ থেকে, এমনকি তাদের বর্ণমালা পর্যন্ত।
রোমক বর্ণমালার হরফগুলো এট্রুস্কানদের ব্যবহৃত প্রতীক বা চিহ্নগূলোর সামান্য অদল-বদল মাত্র। আবার, এট্রুস্কানেরা লেখার ধারণা ও তাদের হরফগুলো নিয়েছিল গ্রীকদের কাছ থেকে। লাতিনের ব্যাপক প্রভাবের ফলে পশ্চিম ইউরোপের সব ভাষাই রোমক বর্ণমালা পেয়ে যায় উত্তরাধিকারসূত্রে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু কিছু জিনিস জুড়ে নিয়ে; যেমন ইংরেজি ও জার্মানের বেলায় ‘w’, ফরাসিদের বেলায় ‘ç’ (যেটিকে ‘ccedilla’ বলা হয়), সুইডিশ আর জার্মানের বেলায় ‘ä’ আর ‘ö’, ডেনিশের বেলায় ‘ø’, ইত্যাদি। ইউরোপীয় বর্ণমালায় যে-দুটো হরফ বহুল ব্যবহৃত — ‘v’ আর ‘j’ — তাদের রয়েছে এক ভিন্ন ইতিহাস। সে প্রসঙ্গে পরে আসা যাবে।
এসব অক্ষর ছাড়াও এট্রুস্কানদের কাছ থেকে আরো মেলা জিনিস নিয়েছিল রোমকরা, তার মধ্যে রয়েছে এমন কিছু শব্দ যেগুলো অন্য কিছু ভাষাও কর্জ করেছে; যেমন, ‘caerimónia’ (ceremony, উৎসব উপলক্ষ) আর ‘fenestra’ (window, জানালা) যেখান থেকে এসেছে ফরাসি ‘fenêtre’ আর জার্মান ‘fenester’)। উত্তরের প্রতিবেশীদের কাছ থেকে রোমানরা কি শিখেছিল তা আমরা এসব শব্দের মানে থেকে জানতে পারি। নানান ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব তাদের কাছ থেকে নিয়েছিল রোমকরা, সেই সঙ্গে নিয়েছিল এই আপাত অদ্ভুত বিশ্বাসটি যে, পাখিদের উড়ালের মধ্যে অথবা তাদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত প্রাণীদের অন্ত্রের ভেতর দেবতারা তাদের ইচ্ছা ব্যক্ত করেন এবং মানুষেরা তা পড়তে পারে। থিয়েটারের ধারণা এট্রুস্কানদের কাছ থেকে পেয়েছিল রোমকরা; আধুনিক ইংরেজি শব্দ ‘person’ এসেছে লাতিন ‘persona’ থেকে যেটা ধার নেয়া হয়েছিল এট্রুস্কানদের কাছ থেকে, আর সেটার আদি অর্থ ছিল থিয়েটারে ব্যবহৃত মুখোশ, তা থেকে নাটকের কোনো চরিত্র আর শেষ অব্দি ‘person’। জানালাবিহীন কুঁড়েঘরের বদলে কি করে বাড়ি বানাতে হয় সেটাও তাদের এট্রুস্কানদের কাছ থেকেই শেখা।
অন্যদিকে আবার, বেশ কয়েক শতাব্দীর মধ্যে আমাদের অর্থে সাংস্কৃতিক কোনো অর্জন ছিল না রোমকদের; প্রথম এবং প্রধানত কৃষক ছিল তারা। অবশ্য রোমকরা হয়ত স্বীকার করতে চাইবে না যে তাদের সংস্কৃতি ছিল না কোনো। লাতিনে কৃষিকাজ হলো ‘agricultura’ — তৈরি হয়েছে ‘ager’ (field, মাঠ, ক্ষেত) আর ‘cultura’ মিলে; ‘cultura’-র আদি অর্থ ছিল ফসল ফলানো, কিন্তু ধীরে ধীরে সেটায় আধ্যাত্মিক বিকাশ আর সংস্কৃতির বিষয়টা যুক্ত হয়েছে। লাতিন শব্দ ‘cultura’ এসেছে ক্রিয়াপদ ‘cólere’ (grow, জন্মানো, বিকশিত হওয়া) থেকে, ঠিক যেমন ইংরেজি ‘growth’ এসেছে ‘grow’ থেকে।
তাদের আরেকটি প্রধান কাজ ছিল সামরিক ক্রিয়াকর্ম, ‘milítia’। অসাধারণ যোদ্ধা ছিল রোমকরা। খৃষ্টপূর্ব পঞ্চম ও চতুর্থ শতকের পুরো সময়টা আর তৃতীয় শতকের প্রথমার্ধ একের পর এক যুদ্ধ করেছে তারা প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে। সব কিছুই যে সব সময় অনুকূলে থেকেছে তাদের তা নয়, কিন্তু ধীরে ধীরে রোমকরা গোটা ইতালীয় উপদ্বীপটিই জয় করে নিল এক সময়। আর, ধীরে ধীরে, কিন্তু বেশ নিশ্চিতভাবে তারা তাদের জয় করা সমস্ত রাজ্যে লাতিন ভাষা ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হলো। সেটা তারা যেভাবে করেছিল তার একটা পদ্ধতি ছিল যেসব সৈন্য সামরিক বাহিনীতে তাদের চাকরির মেয়াদ পূর্ণ করেছে তাদেরকে বিজিত এলাকার খানিকটা জায়গা দান করা। সৈন্যরা স্বভাবতই লাতিনভাষী ছিল, ফলে তারা এবং তাদের পরিবার তাদের সঙ্গে বিজয়ীর ভাষা নিয়ে গেল বিজিতদের ভূমিতে; সেখানে তারা তাদের মূল কাজ — কৃষি — অব্যাহত রাখল। আর এভাবেই অন্যান্য ভাষা ভাষী অঞ্চলে বিস্তার ঘটল লাতিনের। অন্যদিকে যাদের হাতে মূল ক্ষমতা তাদের ভাষা তো লাতিন ছিলই; কাজেই রোমক সাম্রাজ্যের সবাই কিছু না কিছু লাতিন শিখে ফেলল, এবং কয়েক প্রজন্ম পর দেখা গেল লাতিনই রাজত্ব করছে।
একজন সৈন্য বা ‘miles’-এর শিগগিরই ‘colónus’ বা ‘চাষী’ হতে বাধা ছিল না। এধরনের একদল ‘coloni’ (‘colónus’-এর বহুবচন) নিয়ে একটি ‘colónia’ — কোনো বিজিত দেশে একসঙ্গে বসবাস রত বেশ কিছু সংখ্যক রোমক — তৈরি হতো। ইংরেজি ‘colony’ শব্দটি কোথা থেকে এসেছে তা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছি আমরা।”
অবশ্য রোমের একেবারে আদি যুগেও যে সবাই সাদামাটা চাষী ছিল তা নয়, ধনী আর ক্ষমতাবান মানুষও ছিল, যারা সিনেটে বসতো, সামরিক বাহিনীতে কর্তৃত্ব করতো বা কনসাল হতো। অনেক আগে থেকেই নেতা আর সাধারণ লোকজনের মধ্যে একটা রাজনৈতিক ফারাক ছিল রোমে; নেতাদের বলা হতো ‘partes’, (fathers) — সিনেটরদের বোঝানর জন্য একটি সাধারণ অভিধা, কাজেই তাদেরকে বলা হতো ‘patríci’, বা ‘patricians’। আর জনসাধারণকে, ‘plebs’, ফলে তাদেরকে বলা হতো ‘plebéii’ বা, ‘plebians’। কয়েক শতাব্দির মধ্যেই রোমে এই কথা বা শব্দগুলো সেকেলে হয়ে গেলেও, লোকের সামাজিক পদমর্যাদা বোঝাতে আজো সেসব ব্যবহার করি আমরা।
২৭০ খৃষ্টপূর্বাদের মধ্যেই রোমকরা তাদের অসংখ্য যুদ্ধ-বিগ্রহ আর উপনিবেশ স্থাপনের মাধ্যমে গোটা ইতালীয় উপদ্বীপের প্রভু বনে যায়। এরপর তাদের নজর পড়তে শুরু করে সাগর পারের দেশগুলোর দিকে। আফ্রিকার উত্তর উপকূলে, আজকের তিউনিসিয়াতে, কার্থেজ নামের খুব সমৃদ্ধ এক নগর ছিল। কার্থেজীয়রা ছিল বণিক ও নাবিক। পশ্চিম ভূমধ্যসাগরের বেশিরভাগ বাণিজ্য আর উপকূল নিয়ন্ত্রণ করত তারাই; সিসিলির বেশিরভাগই তাদের কব্জায় ছিল। আর এই দ্বীপটির ওপর নজর ছিল রোমকদেরও।
তিনটি বড় বড় যুদ্ধ করেছিল রোমকরা কার্থেজীয়দের সঙ্গে যাদেরকে তারা ‘poeni’ বা ‘punic’ (জনগণ) বলতো। একশ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা এই তিনটে পিউনিক যুদ্ধের কথা ইতিহাসের বইয়ে বিস্তারিত পাওয়া যাবে। শেষ অব্দি রোমকরা জয়ী হয়, এবং ধ্বংস করে দেয় তারা কার্থেজ নগরটিকে, তবে যুদ্ধের ফলাফল কি হবে তা দীর্ঘদিন ধরে অনিশ্চিত ছিল। কার্থেজীয় সেনাপতি হানিবল যখন প্রাচীন যুগের ট্যাংক বলে অভিহিত হাতিসহ এক সেনাবাহিনী নিয়ে আল্পস পর্বতমালা ডিঙিয়ে এখনকার ফ্রান্স থেকে ইতালিতে প্রবেশ করেন সেটাই ছিল সম্ভবত এই তিন যুদ্ধের সবচাইতে অসাধারণ মুহূর্ত।
হানিবল তথা কার্থেজীয়দের পরাস্ত করার পর থেকে ভীষণ রকমের গর্বিত হয়ে পড়ে রোমকরা, আর এই বিজয়ই ভূমধ্যসাগরের পরাশক্তি হিসেবে পরিণত করে তাদের। তারপরেও লেখালেখি, শিক্ষা-দীক্ষা, নানান ধ্যান-ধারণা, বিজ্ঞান, শিল্প আর সঙ্গীতের ক্ষেত্রে প্রাচীন রোমকদের অবদান অন্যান্য অনেক জাতির তুলনায় নগণ্যই বলতে হবে। বিশেষ করে তাদের পুবের প্রতিবেশী গ্রীকদের তুলনায় ঢের পিছিয়ে ছিল তারা।
